কবি অমিতাভ গুপ্তর কবিতা
*
কবি অমিতাভ গুপ্তর পরিচিতির পাতায় . . .
কলকাতায়
কবি অমিতাভ গুপ্ত
বিন্দু বিন্দু ধরিত্রী (আগষ্ট ২০১০) কাব্যগ্রন্থ থেকে।

অক্টোরলনি মনুমেন্টের মতো মহাউঁচু শহীদমিনার
পেরিয়েই লক্ষ করছি চপল বেলুনঅলা জর্ডন নদীর মতো ওই
যুবতীকে পয়সা দিচ্ছে। যেসব পয়সাগুলি স্বভাবত ধাতব বা ভারি
তাদেরও যোগ্যতা আছে। তবু মেমসাহেবের ক্রেডিটকার্ডটিকে
জাতিস্মরের মতো উগরে ফেলছে সাবেকি শপিংমল। খানিকটা দূরে
ছাতুবাবু লাটুবাবু। বাঈজির নুপূরের সোনালিরূপোলি ধ্বনি। কপিশরঙের
জিভ থেকে জন্ম নেওয়া আরও ভালো আমেরিকা। তবু, আলিপুরে
পশুশালা। আপাতত সেখানেই যেতে হবে। ব্রিটিশ সিংহের
বর্তমান ঠিকানাটা জানি কিন্তু বলব না

        এইসব সনতারিখের মতো
ধুলো ও বালিকে ছেড়ে যদি কালীঘাটে যাই। নকুলেশ্বর
শিবের মন্দির আর সন্ধ্যারতির মতো একটি আদিম
গর্ভগৃহ। চারিদিকে এত মন্ত্র। এত বেদনার মতো দান
এমন প্রার্থনা দিয়ে ভালোবাসা সাজানো সম্ভব হয়েছিল
                    ফিরে
তো যেতেই হবে। তার আগে আরেকটু উঁকি মেরে দেখে নেব নাকি বেঁটেখাটো
হাইরাইজের পেটে ডালপালা মেলে--দেওয়া ভিখারির ক্ষুদ্র হাত অ্যাসেম্বলিহাউস








*
বর্ণসংকর
কবি অমিতাভ গুপ্ত
বিন্দু বিন্দু ধরিত্রী (আগষ্ট ২০১০) কাব্যগ্রন্থ থেকে।

হাসপাতালের মধ্যে শুয়ে আছে কানায় কানায় ভরা হাসপাতালের
পোড়াঘর | ভস্মস্তবকের মতো একগুচ্ছ জননীর
জন্ম হয়েছিল হয়ত সেইসব গতরাতে নক্ষত্রখচিত যারা সম্পূর্ণ রজনী
    সহস্র ছুরির মতো মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ওঠানামা করে
ক্লোরোফর্মের মতো শপিং শপিং মল ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে | তবু আজও হাসপাতালের
দিকে ছুটে যাচ্ছে পুষ্ট নার্স

    আকাশপাতাল ছিঁড়ে নিয়ে আসা অ্যান্টিবায়োটিক
স্টেরয়েড তুলো গজ এক্সরে প্লেটের বাঁক শালুকফুলের মতো
ফুটন্ত ডিমসেদ্ধ উত্সাহব্যঞ্জক
হরলিকসের কাপটিকে কিংবা আবেগপ্রবণ নিন্দা পরচর্চাটিকে
    সাক্ষী রেখে যে--মানুষ মিথ্যে কথা বলে
সে আজও স্ট্রেচার হয়ে চারিদিকে বাহিত হয়েছে
শুধু এ’দেশের
শুধু এ’দেশের পোড়া ঘরে ঘরে জননীজন্মের শেষ নেই








*
নীলদর্পনের অনুবাদ : ১৩ অক্টোবর ২০০৬
কবি অমিতাভ গুপ্ত
বিন্দু বিন্দু ধরিত্রী (আগষ্ট ২০১০) কাব্যগ্রন্থ থেকে।

বুড়োবয়েসের আগে আমিও অস্পষ্টভাবে ভাবতাম কয়েকটি চিঠি লিখে যাব
বুড়োবয়েসের আগে আমিও ভেবেছি হয়তো অদৃশ্য বাড়ির মতো কোনো কোনো
ঠিকানা রয়েছে কোনো না--দেখা রাস্তায়
সেসব ইচ্ছেরা আজ মরেছে নিপুনভাবে ফিঙে বা শালিকপাখি যেমন নিপুন মরে যায়
এতদিন পরে আজ চারিদিকে মোবাইল এতদিন পরে আজ চারিদিকে এস এম এস
এতদিন পরে আজ আরো মোবাইল
হে আমি হে ক্ষয়াটে খর্বুটে আমি আপাতত তোমারই উদ্দেশে
কুষ্ঠিঠিকুজির শেষপাতাটির মতো এই ভাঙাচোরা কাগজের দিকে ঝঁকে প’ড়ে
কয়েকটি বিশ্রামরত শব্দাক্ষর আধোঘুমে আবছা হওয়া কিছু বাক্যদের ডাক দেব
এচিঠি পড়ার আগে ক্ষমা কোরো এ চিঠির পাঠ তবু অসমাপ্ত চোখ মেলে
ক্ষমা করে দিয়ো তবু তোমার বিপন্ন ভাষাব্যঞ্জনার কাছে
মন্ত্রের মতন একটি ভবিষ্যৎ অথবা উদ্দেশ্যহীন ভবিষ্যতাতীত
কী দেব উজার করে শালিকপাখির মতো ছোট ছোট মরে যাওয়া নিয়ে
তোমারও উদ্বিগ্ন হাসি দিয়ে বোনা শস্যফসলের মাঠ তোমারও যৌবনে আঁকা রাঙা
                        ডাকঘর
চুরি হয়ে যায় তবু সেদিনের গল্পটিকে লিখে ফেলছি মনে পড়ে এই -তো সেদিন
মধুর সন্দেহ নিয়ে গৌতম বসু ও আমি কালীকৃষ্ণ গুহ আর গৌতম চৌধুরী
লালগোলা প্যাসেঞ্জারে উঠলাম স্টেশনের চারিদিকে হোর্ডিং--এর ধোঁয়া
দারুণ সস্তাদামে মোটরগাড়িরা ওই এসে গেল বুঝি
তার আগে কিছুক্ষণ ট্রেনে চড়ে নেওয়া ভালো প্লাস্টিকের কফিটিও ভালো
মাটির ভাঁড়ের মতো কেউ কেউ খুরি বলে সম্ভবত বাঙালেরা বলে
আমিও বাঙাল নাকি বাঙালি না আদিশূরবাহিত বদ্যি কায়েত বামুন
হাজার বারোশ’ খুব বেশি হলে বছর আগেই বুঝি বাংলায় প্রথম এসেছি
যাকগে সেসব কথা এখন ট্রেনের মধ্যে মাটির ভাঁড়ের মত নেমন্তন্নবাড়ি ছুঁড়ে ফেলে
অরিন্দম নিযোগীর বিয়ের নেমন্তন্ন ছিল ভালোই খেয়েছি
বেশ চেটেপুটে মাংসের কালিয়া মাছ মিস্টি কুচোপান
মূলত যা নেমন্তন্নবাড়ি তার অভিজ্ঞ ও আধুনিক গুরুজন ঠিকমত খেয়েছেন
তাহলে ফিরতেই হবে ওরে তোরা দেখ দেখি ট্রেনের টাইম
ট্রেনের কামরার মতো এই যে আমার চিঠি সিটের কিনারে এই
নিজেকে আকুল গুঁজে রাখা
এই যে গম্ভীর ট্রেন এই মাত্র প্ল্যাটফর্ম থেকে ঝরে গেল
এই যে কয়েকটি তর্ক হালকা জানালার মতো দুলে উঠছে কথা
বলছেন গৌতম চৌধুরী আর ফল্গু বেশ মনোযোগ দিয়েই শুনছেন
হে আমি হে বিপুল বিচূর্ণ আমি মনে রেখো সেদিন তোমার সঙ্গে প্রায়
একযুগ পরে ফল্গুর দেখা
হয়েছিল আর ফল্গু বসুর সঙ্গে দেবজ্যোতি রায়ও ছিলেন
দেবজ্যোতির সঙ্গে শমিত মন্ডল আর শমিতের সঙ্গে বাসুদেব
আচার্য বা বাসুদেব আচার্যের সঙ্গে অমিতাভ গৌতম গৌতম আর কালীকৃষ্ণ আর
এই যে জটিল পথ রেললাইনের পথ রক্তমাখা আনন্দের মতো ঘন অন্ধকার চিরে
বহুদূরে ভেসে যাচ্ছে বড়ো বেশি বহুদূরে যাওয়ার আগেই যাকে ম্লান ঠাট্টা ক’রে
বঙ্কিমচন্দ্র বলে উঠলেন রেলপথ নির্মাণ করিয়া তোমরা রামাশ্যামারহিম চাষার
কোন্ উপকার বলো সাধন করিতে পার কিন্তু কতদূর ট্রেন ছুটে যাচ্ছে
বিদ্রোহী সিপাহীদের ঠ্যাঙাবার জন্যে কোম্পানির
বরকন্দাজের দল মীরাটে চলেছে কেউ লক্ষও করেনি নীলদর্পণের শেষ
সংলাপ লিখতে লিখতে দীনবন্ধু মিত্র দ্রুত চোখ তুলে দেখলেন দোয়াতে
ডোবালেন এবং এই নীল কালি অপরাজিতার আর নয়নতারার পাপড়ি থ্যাঁতলানো
রসে তৈরি দিব্যি ভালো
এবং শিগগিরই তাঁকে পৌঁছে দিতে হবে তাঁর পান্ডুলিপি বন্ধু মাইকেলের কাছে
                        যদি অনুবাদ হয় যদি
ছদ্মনামেও যদি কোনোদিন মাইকেল বইটা ছাপায় যদি জরিমানা হয় যদি
কালীপ্রসন্নের মত কেউ সেই জরিমানা যেচেই মেটায়
ছিন্ন পংক্তির মত কোনো কোনো পলিটব্যুরোর তেরোই অক্টোবর দু’হাজার ছয়
                        অনুমতিপত্র কোনো মুখ্যমন্ত্রীকে
অতএব ধানজমি নিয়ে যাক বড়লোক কিনে বা না--কিনে আরও
বড়লোক হোক বড়লোক আরও
ছিন্নভিন্ন পংক্তির মতন
ছড়িয়ে পড়ছে ময়লা গুমটিঘর ইস্টিশনমাস্টারের তাঁবু ক্ষুণ্ণ পোর্টারের মুখ
ছিটকে যাচ্ছে রেলপুলিশের হালকা হাই যেন রাত বাড়ছে আরো রাত বেশি রাত
আরো বেশি গরম ফুটন্ত ভাঁড় ভাঁড় নয় প্লাস্টিকের কাপ আরো এইদিকে চাই
ওই যে ঝলসে উঠল আরেকটি প্ল্যাটফর্ম বিজ্ঞাপন বহুকামিতার জন্যে
উত্সাহব্যঞ্জক ওই বুলাদির গোল গোল চোখ
আবার ট্রেনের দোলা পুনর্বার তর্কনির্ভর ঝাঁকুনিরা
আবার দুর্গম প্রশ্ন দুদিকে ত্বরিতগতি কলাগাছমজাপুকুরের রাশি ডাইনিচরার মাঠ
সুপার মার্কেটের ফণা তুকতাক হাঁচি টিকটিকি কারলোন
আবার জানালা কাঁপছে দেখা যাচ্ছে আধফোটা অন্ধকারে বন্ধুদের বিতর্কিত মুখ
মনে পড়ছে কলেজ স্ট্রিটের পথে গর্বিত দুঃখের দিন কফিহাউসের মতো বিড়ির তামাশা
মনে পড়ল একফর্মার বই যা তখনো লাইনো টাইপে ছাপা হত
তবু মনে পড়ে যায়তবু মনে পড়ে
পুরোনো বাঘের মতো শতাব্দী নিঃশ্বাস ফেলে গিয়েছিল আমাদেরও ঘাড়ে
বাঘের ওঝারা এসে গলা টিপে ধরেছিল বাঘের নাগাল পায়নি ধরেছিল আমাদেরই টুঁটি
দাঙ্গা যুদ্ধ মাল্টিন্যাশানাল আর পরমানুচুল্লিবোধ আর আরও বেশি মডার্নিজম্
রোমশ জঙ্গলে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছিল সেই বাঘ সত্তরদশক আশি নব্বই একুশ
যেন সেই বাঘটিকে খাঁচা থেকে বের করে আনা যায় এখনো হঠাৎ
তাকে বলা যায় যাও সব বুনো অন্ধকার
ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলো
কাঞ্চন কাঞ্চন সেই বাঘটিকে আদর করার মতো ভঙ্গিতেই কালীকৃষ্ণ হাত নাড়লেন
দক্ষিণবাহুর দীর্ঘ তর্জনীটি ছিটকে উঠল হয়তো বা আমারই উদ্দেশে
‘পূর্ণ থেকে পূর্ণ নিলে যদি
পূর্ণ অবশিষ্ট থাকে থাক কিন্তু শান্তিপাঠশ্লোকটির সঙ্গে পরবর্তী টেক্সট
কিছুতেই মেলানো যাবে না’
‘ আমাদের অদ্ভুত জীবনে কিন্তু জন্মান্তরবাদ ছাড়া অন্য কোনো সান্ত্বনা নেই’
গৌতম সিগ্রেট ধরাতে উদ্যত কে যেন
সাবধান করে দিল ‘শঙ্করাচার্যের কথা বহুমুখী ব্যাখ্যার ভারে
যথেষ্ট বিচিত্র তবু মায়াবোধ আপেক্ষিক জগতের প্রপঞ্চকে কিছুটা তো বিনির্মাণ করে
‘আমাকে ঠ্যাঙালে যদি আপনারও ব্যাথা লাগে আহা সব আঘাত তো ফিজিকাল নয়
যেহেতু পূর্ণের ব্যাপ্তি নিরপেক্ষ আমরা সবাই সমঅনুভূতিটির
সাধ্যেই পরিব্যপ্ত’ ‘তবু
মায়ার তৃতীয় স্তরে পৌঁছলেই বোঝা যাবে পূর্ববর্তী দুটি স্তর ও প্রপঞ্চতুল্য’
গৌতম চৌধুরীর চশমারা হেসে উঠল হয়তো--বা আমার উদ্দেশে
‘আপনাকে ঠ্যাঙালে আমি ব্যাথা পাব এমন অবোধ্য কোনো সম্ভাবনা’ ‘ রামকৃষ্ণের গল্প
                                মনে
পড়ছে কিন্তু থাক রামকৃষ্ণের চেয়ে একটু বেশি সহজমান্য হয়তো শেকস্ পীয়রের
কথা মনে পড়ছে টেমপেস্ট
মিরান্দার সেই উক্তি আই হ্যাভ সাফারড
উইথ দোজ দ্যাট আই স সাফার
অর্থাৎ উল্টোভাবে বলা যায় নিজের প্রাণের কাছে সমস্ত অপ্রাণ নিয়ে
পূর্ণ প্রাণবিশ্ব যদি ধরা দেয় তাহলে ত্যাগের
অহংকার লোপ পাবে কে কাকে কীভাবে কোন্ ক্ষেত্রকালে ত্যাগ করবে
যেহেতু পূর্ণের এই চিরায়তনের মধ্যে
ত্যাগের তিলেকমাত্র অবকাশ নেই শুধু সুযোগ রযেছে সমঅনুভবে মিলিত হওয়ার’
রেললাইনের পাশে পড়ে থাকা মুন্ডুকাটা মৃতদেহনিচয়ের মত
আমাদের সতর্ক বিষয়গুলির ‘পরে কেউ বুঝি টর্চ ফেলেছে খুঁজছে আইডেন্টিফিকেশন
মার্ক আহা যদিও চেকার বুঝতে পারছেন ভদ্রলোক তবুও টিকিট দেখা দরকার
এই যে টিকিট এই টাটকা তাজা টিকিট দেখুন
স্বভাবদাক্ষিণ্য থেকে ক্ষয়ক্ষতি দান করে এতক্ষণে ফসলক্ষেতের
ধাবমান গহ্বরেরা ‘শান্তিপাঠের দুটি চরণও ঈশোপনিষদের মূল টেক্সটের অন্তর্গত
                                বলে
মনে করা ভুল নয় যেহেতু পরবর্তী শ্লোকে ব্যবহৃত ঈস
শব্দটির শ্রেষ্ঠ অর্থ শান্তিপাঠেই বিধৃত’ ওগো তোরা দেখ দেখি দুধারে ফসলক্ষেতে
মর্মভেদী মায়াবী আঁধার
ধীরেধীরে নতুন নতুনতর হয়ে উঠছে ‘ত্যাগ
করা প্রয়োজন আর ত্যাগেই আনন্দ’ ‘কাকে ত্যাগ
কে করবে যখন সকলই পূর্ণ পূর্ণের সংসারে’
‘শান্তিপাঠ অংশটির সঙ্গে কেন মূল টেকস্ ট জড়িয়ে ফেলছেন শান্তিপাঠে
পূর্ণের উল্লেখ আছে কিন্তু ঈশোপনিষদের বাকি অংশে তো পূর্ণের প্রসঙ্গ নেই’ ‘ঈশ
শব্দটির অর্থ তবু শান্তিপাঠেই বিধৃত
অর্থাৎ পূর্ণই ঈশ অর্থাৎ ত্যাগবোধ শুধু অহংকার
ব্যক্তির আমির কোনো ত্যাগের ক্ষমতা নেই অধিকার নেই কোনো ত্যাগের বা ত্যাগ না
                                করার’
কোনো এক আকস্মিক প্রেমের মতন ভেসে আসে কোনো কোনো অরিন্দম নিযোগীর বউ
ছেলেপুলে হয় যারা অজস্র রঙিন মাঠ জুড়ে
খেলা করে
এই তো নদীয়া সেই কৃষ্ণনগরের কাছে কাঠগড়া কনসার্ন আঠোরোশ’ ষাটের
মার্চমাস এই তো হুগলীজেলা সিঙ্গুরের
দু’হাজার ছয় সন শীতের আঁধাররাতে বেড়াবেড়ি গ্রাম
তোবা তোবা লাট
সাহেব কি নীলির ভাগ নিতে পারে তিনি নাম কিন্ তি এয়েলেন
ট্রেনের ঝুঁটির গিঁটে বাঁধা পড়ে দ্রুত ও মন্থর কিছু স্টেশনেরা ‘শুধু
পূর্ণতা বিষয় নয় অংশও আলোচ্য আপনি মনে রাখবেন’
হাসিতামাশার মতো ঝগড়ার রুজুরুজু ফাঁকে ফাঁকে ভাবছিলাম বলব কি বলব না
আমার অফিসভরা লকার এবং
চাবির কয়েকটি গল্প ছোট ছোট লকারের জন্য ছোট ছোট
চাবি আর চাবি রাখবার জন্যে আরেকটা লকার
এবং দ্বিতীয় সেই লকারের চাবিটিও যথাযথভাবে রাখা প্রয়োজন বলে
তৃতীয় লকার হল চতুর্থলকার হল পঞ্চম হাজার লক্ষ কোটি কোটি কোটি
চারিদিকে জ্বলন্ত রাত্রির শিখা এতবেশি রাত যেন মনে হয় চাবির পেটের মধ্যে ঢুকে গেছে
সমস্ত লকার
এতবেশি রাত যেন মনে হয় সেইসব ছায়াদের প্রদিক্ষণ করি
যাদের দেবতা মুগ্ধ তাই মোহহীন
অনুভব করি যেন ছিন্ন সেইসব ঘ্রাণ টের পাই জ্ঞাত ও অজ্ঞাত
বিদ্রোহী গ্রামের পটে পূর্ণ ও শূন্যতার তুলির আঁচড়
কেঠেছে অথবা শুধু আমাদের উত্ক্ষিপ্ত ট্রেনগুলি কোনোদিকে না থেমেই ছুটে গেছে
বিবাহবাসর থেকে বিবাহবাসরে
সপ্রতিভ হাসির মতন খুলে গেছে লেভেল ক্রসিংগুলি
আমরা নামিনি বলে ক্ষতি নেই পূর্ণ বা শূন্যের কোনো অবিদ্রোহ নেই
নীলের দাদন নিয়ে বাড়াভাতে ছাই ওগো বাড়াভাতে ছাই ওগো বাড়াভাতে ছাই
ওগো ধরেছে নীলের যমে আর রক্ষা নাই
স্টেশন বা হয়তো নয় ভাগনাডিহির মাঠ জুন মাস আঠারোশ পঞ্চাশ সন তিরিশ
তারিখ সিধু কানু ডেকেছিল আমরা নামিনি ট্রেন থেকে
আঠারোশ পঞ্চাশ সন জুলাই আহস্ট মাস সাঁওতাল পরগনা থেকে বীরভূম বীরভূম থেকে
ভাগলপুর ডাক দিয়েছিল কিন্তু ট্রেন থেকে আমরা নামিনি
আঠারোশ সাতান্ন সন মার্চ মাস উনতিরিশ তারিখের বিকেল পাঁচটার ব্যারাকপুর








*
দোষ
কবি অমিতাভ গুপ্ত
বিন্দু বিন্দু ধরিত্রী (আগষ্ট ২০১০) কাব্যগ্রন্থ থেকে।

অনাদরের বয়েস ঊনষাট
পেরিয়ে গেল। চিনতে পেরেছ ?
একটু আগের আগস্ট মাসের মত
পতাকাছায়া, সন্ধ্যাবেলার মেঘ
অনাদরের পুচ্ছ পরেছে

বারণ কর। পতাকাছায়া যেন
জড়িয়ে থাকে তোমারও যৌবনে
আগস্ট মাসে পনেরো তারিখের
ভ্রূণের ভানে উনিশে ভাদ্র

মায়ের পাঁজর টুকরো হওয়ার পরে
অনাদরের জন্ম হয়েছিল
সিংহ--মুখ ফিরিয়ে হেসে ওঠে
গজিয়ে ওঠে চিতাবঘের থাবা

সিঙ্গুরের শীতের ডিসেম্বরে
শিস্ দিচ্ছে সশস্ত্র অস্ত্রেরা
অনাদরের স্বভাবদোষ। কেন
মানবে না সে নতুন পলাশীকে ?







*
অব্যক্ত
কবি অমিতাভ গুপ্ত
বিন্দু বিন্দু ধরিত্রী (আগষ্ট ২০১০) কাব্যগ্রন্থ থেকে।

কয়েকটি সোনার কাঁটা ধীরে ধীরে তোমার মেধায়
নিবে গেল। সূর্যাস্তে, বিশ্বাস করো, উচ্ছন্ন চাষার জমিটিও
        হোমাগ্নিশিখার মতো মনে হয়
কিছুক্ষণ আগে এই রাত অন্তর্গূঢ় হবে আর তুমিও বিচিত্র কিছু লবনখন্ডের মতো
সমুদ্রের চারিদিকে ফেঁসে যাবে। কিছুক্ষণ আগে
হরিনাথ কাঙালের পত্রিকাটি পুনর্মুদ্রণের হয়তো প্রয়োজন হবে

শোনো শোনো আমার বার্ধক্য এত শৌর্যময়, আজো ধনুকে টংকার
দিতেপারি। গভীর মসৃণ কালোপদ্মের পাপড়ির
দোলায় মথিত হ্রদ চিরে চিরে ফেলে
    প্রশ্নের স্তব্ধতাটিকে ক্ষরিত করেছি
শিখেছি লাঙ্গল , হাল। মনে পড়েছে এইসব পৃথিবীতে তবু একদিন
উদ্যত বিশ্বাস ছিল ছোট ছোট ভাঙ্গাগড়া ছিল,
মনে পড়েছে আজ শুধু ইনড্রাস্ট্রিয়াল স্ট্রাইক ও শিল্পায়ন। পুলিশশিল্পের ছুটি নেই

বহুমুখী প্রতিভার মতন মিছিলে ওই কেউ কেউ যারা ফুল্লরার
বারমাস্যা স্কুলপাঠ্য ব্যাখ্যা লিখতেন
    গুটিপোকা ত্যাগ করে প্রজাপতি হয়ে যায় সমস্ত পতাকা
আকাশের পরাগে রেণুর কাছে ছড়িয়ে ছড়িযে পড়ছে গর্জিত ইশারা
নানাসাহেবের মতো আমিও কি মরে যাব, নেপালের তরাই--এ পালাব
তোমার মেধার কাছে সুশ্রুষার
ভান করে অতলস্পর্শী কোনো কুয়াশাগুচ্ছকে রেখে যাব
শোনো শোনো, এইসব মাঠে আর একদিনও নবান্ন হবে না ?








*
সমুদ্যত
কবি অমিতাভ গুপ্ত
বিন্দু বিন্দু ধরিত্রী (আগষ্ট ২০১০) কাব্যগ্রন্থ থেকে।

কয়েকটি প্রশ্নের শক্তি মনে রাখা দরকার। বলিষ্ঠ প্রশ্নের
আঘাতে বিদীর্ণ জমি, কারখানার গহন ফ্লুইড
কেঁপে উঠল। মনে রাখতে হবে এই, এবার পাথরজন্মে যা দেখেছি, এই
কেঁপে--ওঠাটির ধরণেও
মীমাংসার বীজধান বড়ো হয়, প্রসারিত হয়ে যেতে শুরু করে
             মেশিনের ভ্রূণজাতকেরা

মরিচদাগের মতো মেঘের আকাশ। ট্রলারের ডেরেকের গর্জনের মতো
যেসব বৃষ্টির শব্দ ছুটে আসছে , যেসব সবুজ কাস্তে ধীরে ধীরে কেটে দিচ্ছে
ফ্লেকার পেরেকগুচ্ছ ইস্ক্রুপ, যেসব লাঙল ওই ডিস্টিলেশন
কলামের বাক্প্রতিমায়
চোখ উল্টে পড়ে গেল--- সেইসব অজস্র নিসর্গ বুকে নিয়ে
             ছুটে যাচ্ছে কোনো--এক ছুটির হুইস্ ল

প্রশ্নের নির্মাণ যেন কখনো না--থামে তবু। মনে রাখতে হবে, আজও
বিপুল উদ্দেশ্য থেকে বিপুল ও অজ্ঞাত সন্ধিমুহূর্তের
রহস্য বা জটিলতা শুরু হয়েছিল

             সবকিছু পুনর্বার শুরু হবে। গূঢ়
অথচ নিজস্ব ত্রাসে স্রস্ত যারা, যারা আততায়ী, যারা অন্ধকার ফুঁড়ে
কারখানা চুরি করে জমিকে মুছিয়ে দেয়, তারা টের পাওয়ার আগেই
আমারো পাথরজন্ম জ্যোত্স্নায় ভেসে গেল








*
পাঠক্রম : ফাল্গুন ১৪১৫
কবি অমিতাভ গুপ্ত
বিন্দু বিন্দু ধরিত্রী (আগষ্ট ২০১০) কাব্যগ্রন্থ থেকে।

পাঠ থেকে বিচ্ছুরিত হয়েছিল দ্যোতনা। অর্থ
বুঝিনি
    অজ্ঞাত ছন্দের মতো বিন্যস্ত পংক্তিযূথের
পাশে আরও কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকি। বিশাল রাত্রির ছায়া
দিগন্তে দিগন্তে। যেন অনুচ্চার্য
নয় তবু সবকথা মুখে বলা কীভাবে মানায়
চুর্ণে বিচূর্ণিতে ছড়িয়ে ছড়িয়ে থাকা মূর্খের ব্যাকরণবোধ
যা প্রতিফলিত নয়, অনুমানকরি, অনন্তের
        সহস্র উদ্ভিদ তাকে ভূর্জপত্র
দান করে যাবে


যেন স্থপতির দেশে বেড়াতে এসেছি তাই চারিদিকে এত মূর্তি
এত বেশি প্রকট প্রতিমা
হাতুড়ির নিপুনতা নিয়ে বেঁচে আছে যশ খ্যাতি ভালোবাসা
    এই দেশে স্বভাবত গম্বুজের চাষ হয় স্পেলিং মিসটেক
আমিও খাঁচার মতো দৃঢ় হতে চেয়েছি ও নিখুঁত তর্কের মতো
বয়স্ক বা প্রণম্য হয়েছি
মরা পাথরের স্তুপে খুনিরা ধ্যানস্থ আর ধ্যানমন্ত্রে
ছন্দ বা চিত্রকল্প গণতন্ত্রসন্মতভাবেই নির্বাচিত

কতদিন হয়ে গেল তোমার দুচোখে আর পলক পড়ে না
দু’বছর হয়ে গেল ? মার্চ, ২০০৭ ? অথবা আরেকটু আগে
১৯৬৭ সন ? সেও বুঝি মার্চ মাস, পাথরের সমতলে কয়েকটি চাষার বউ
বুকে পিঠে বন্দুকের ফুটো নিয়ে ঝরে পড়েছিল








*
গ্রিন হান্ট
কবি অমিতাভ গুপ্ত
বিন্দু বিন্দু ধরিত্রী (আগষ্ট ২০১০) কাব্যগ্রন্থ থেকে।

ক্রমশ যেখানে আজও বাস করি লেটারবক্সের মতো যে অপেক্ষা যার কোনও
                অন্তর্গত তালাচাবি নেই
বিদেশি শস্যের পাশে উত্ফুল্ল ভারতীয় ফসল যেভাবে
শুয়ে থাকে আধোলিপ্ত | মরে ঝরে যাক যারা বুকচিরে
ধ্যান
রোপণ করেছে তবু শিঙার মতন যেন অতর্কিত ফুঁসে
উঠেছে জঙ্গল আর কে কাকে কীভাবে যেন ক্রমাগত খুন করে যায়
    ক্রমশ লেটারবক্সে উড়ে আসে এস এম এস উড়ে আসে ব্রেকিং নিউজ
এসব শহরে তাই আরও বেশি রাজনীতি আরও বেশি বেঁড়ে গরু পুচ্ছ দোলায়
ফেঁসে--যাওয়া রাস্তা আর ল্যান্ডমাইনের ফাঁদে আদিম ও নুয়ে পড়া মাঠ
ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের
রিমোট একটু মুচরে দৃশ্যত দেখেছি তাই ঈষৎ লাজুক
লক্ষ করি ঘাতকের জিভ থেকে চুঁইয়ে--পড়া রক্তও নিহতের সর্বশেষ উচ্চারিত
                বাক্যের মতোই পাঁশুটে
লক্ষ করি মোটা মোটা ফাইলের বাকল জড়িয়ে ওই মন্ত্রপাঠ করে পার্লামেন্ট
লক্ষ করি অন্ধের নড়ির মতো বাঁকা সেমিনার
ভূতগ্রস্ত ওই ওই বাঁশবন ওই উই মুষিকের ক্ষিপ্র গর্ত ওই
চিকণ মসৃণ
    স্পেশাল ইকনমিক জোন পালাচ্ছে বুটের ভারি গম্ভীর ও অজ্ঞাতপূর্ব আওয়াজে
এতদিন পরে শুধু মনে হয় মনে হতে পারে
ভাবকল্প শেষ হলে বেদান্তেও অকথিত নিয়তি ফুরাবে


ময়ূরীনদীর ক্লান্ত কেকাধ্বনি যেভাবে যেমন করে জলমর্মরের
দিকে, ওই মিশে গেল | নতুন অতীত নিয়ে দিগন্তের ভাঙা আর গড়া
ধীরে ধীরে আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে | আটবিক শবর নিষাদ
চরিত্র গঠন করছে
    হয়তো এখানে এসে একদিন ধ্বংসাবশেষের মতো
            মিলিয়ে গিয়েছে
এইপটে, হয়তো--বা, ধূসরের ধুলো দিয়ে ধূসরের ধূসরতা দিয়ে
কোনো--এক পুনর্বার শশাঙ্কের উত্ক্ষিপ্ত সন্তান








*
থমকে যাওয়া
কবি অমিতাভ গুপ্ত
বিন্দু বিন্দু ধরিত্রী (আগষ্ট ২০১০) কাব্যগ্রন্থ থেকে।

অন্তর্বয়নের সব ধ্বনিকেই ভেঙে দিয়ে দুহাজার তিনশ বাইশ
বত্সরাধিক আগে কোনো--এক মহীন্দর কোনো--এক ক্ষুদ্র সমুদ্রের
মাঝমধ্যিখানে
দাঁড়িয়ে, কী অজ্ঞাতকুলশীল ভাষায় যা বলেছিল তার অর্থ
খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছি
    তখন তো কাশীপুর বরাহনগর থেকে মরিচঝাঁপির
রাস্তা পাকা হয়নি তেমন কিংবা খুচরো মার্কেটিং-এর জন্য ছোটছোট মোটরগাড়ির
প্রয়োজন বোঝেনি হাবারা
    সূতোর গুটির মতো জড়ানো শব্দের ঘোরে
মুর্ছিত অথবা তরঙ্গোদ্যত নীল নীল বিষ ছুঁয়ে চকিত বুঝেছি
এ জীবন শুধুমাত্র পূর্ণ নয় এ জীবন শুধু মাত্র অর্ধবৃত্তাকার
যেরকম লালগড়ে পড়ে আছে ধনুকের মতো বাঁকা শিশুর কঙ্কাল
দুহাজার তিনশ বাইশ হয়তো অল্পই সময়
তখনো তো বারাসাত বানতলা নন্দীগ্রাম ছিল কিনা সঠিক জানিনা শুধু
লোহিত পীতাভ শত স্বর্ণমুদ্রা ছিল
স্বাভাবিক নরবলি দিয়ে রঘুডাকাতেরা বেলপাতার উপর রক্তচন্দনেই নাম
লিখতে অভ্যস্ত ছিল
    বোতামের বুক টিপে টাকা
বের করা তখনো শিখিনি শুধু দিগন্তটি ততটাই কাছে ছিল যতটা সুদূর
হতে পারে টেথিসের জল ফুঁড়ে জন্ম নেওয়া তিমির পেটের মত
        উদারপিচ্ছিল থমকে যাওয়া
ষোড়শ বা সপ্তদশ মহাজনপদ








*
দু’এক রতি ধ্বংস
কবি অমিতাভ গুপ্ত
বিন্দু বিন্দু ধরিত্রী (আগষ্ট ২০১০) কাব্যগ্রন্থ থেকে।

রাসপুটিনের বিশাল ছায়াকে অনুসরণ করছে বালকেরা
        আর তাদের জননী
ভারতীয় স্বাধীনতার মতো মধ্যরাতের পোশাকটিকে কোনোরকমে গায়ে
জড়িয়ে, ধেয়ে আসছে পিছুপিছু। এই দৃশ্যকে লক্ষ করছে
        অপলক কয়েকজন
ক্যাকটাস

এই দৃশ্যে একাকার হয়ে যায় ওই রাসপুটিন ওই বালক ওই বালকজননী
এমন কী যারা দ্রষ্টা যারা মূলত ক্যাকটাস
এই একাকার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা এখনো রয়ে গিয়েছে
রাশিয়া থেকে ভারতবর্ষের প্রতিটি মরুভূমির প্রারব্ধে প্রতিটি
        জলাধারের আগ্রাসী বাঁকে বাঁকে


রাজা কী জানে রাজা সুখে নেই
রাজার কোষাগার শান্তভাবে দেখে
এসেছি। যেন কোষবদ্ধ তরবারি

রাজার আদেশেই বালি ও কাঁটা দিয়ে
তৈরি প্রাসাদের মধ্যে ছোট বড়ো
কল বা খামারের পাঁজর দিয়ে গড়া
উটের মূর্তি ও ফোয়ারা বসিয়েছি

সবার শস্যে কী রাজার খিদে মেটে
ঝলসে ওঠে কোষবদ্ধ কোষাগার
আমার মুজুরিও পোষায় না