হা দেশাচার!
বারাসতস্থ কোন ভদ্র কুলবালা

জগদীশ করেছেন জগৎ সৃজন,
যত কিছু বস্তু সব সুখের কারণ।
সুখময় যিনি তাঁর কার্য সুখময়,
সুখের বিষয় কভু দুঃখ নাহি রয়।
তবে যে পাইছে কষ্ট নরগণ এত,
আপনার ক্রিয়া দেষ নহে অবগত।
তাঁহার প্রদত্ত যাহা সুখের কারণ,
একটি ইহার নহে অসার সৃজন।
কাম আদি যত বৃত্তি নিকৃষ্ট গণিত,
সকলি শিবের হেতু হয়েছে সৃজিত।
ছয় রিপু রিপু বলি অনেকেই বলে ;
রিপু নয় রিপুগণ হিতকারী ফলে।
অরাতি শাসন হেতু দ্বেষের সৃজন,
ক্রোধের উদ্ভব দুষ্ট করিতে দমন।
প্রজার উত্পত্তি হেতু কামের উত্পত্তি,
পালিতে শৈশব কাল মোহের আরতি।
এইরূপে রিপুগণ সবে হিতে রত,
ঐশিক আদেশে কার্য্য করে স্বভাবতঃ।
প্রকৃতিরে রোধিবারে সাধ্য আছে কার,
বিপরীত ফললাভ বিপরীতে তার।
স্বভাবের কর্ত্তা যিনি জগত ঈশ্বর,
তাঁহার আদেশ এই মানব উপর।
“স্বভাবের ভাব বুঝে কর ব্যবহার,
উপরে উঠনা হও অনুগামী তার।”
শ্বাপদাদি করি দেখ যত পশুগণ,
সবে স্বভাবের পথে করে বিচরণ।
বিভুদত্ত সংস্কারে করিছে ভ্রমণ।
সাধ্য কি উপরে উঠে করিয়া লঙ্ঘন।
নাহি বটে নরকুলে সেরূপ সংস্কার,
কিন্তু বোধ দিয়াছেন বিনিময়ে তার।
বোধবলে দেখ দেখি করি বতর্কন,
লঙ্ঘিলে স্বভাবে হয় কাহাকে লঙ্ঘন?
স্বভাবতঃ রিপুগণ বপুবাসে স্থিত।
যার যে স্ববৃত্তি তাহা পালিতে উদ্যত।
যেরূপ শরীর ক্ষয়ে ক্ষুধার উদয়,
ঈঙ্গিতে করিয়া জ্ঞাত অভাব নাশয়।
ক্ষুধারে দমন করি রাখ কিছু দিন,
নাশিবে জীবন ক্রমে তনু হয়ে ক্ষীণ।
সেইরূপ রিপুগণ যার যে সময়,
যথাযোগ্য কাল পেয়ে হইবে উদয়।
কি সাধ্য তোমার তারে রোধ করিবারে।
বিপরীত ফল পাবে রোধিলে তাহারে।
প্রদীপের পশ্চাতে যেরূপ অন্ধকার,
কার্য্যকারণেতে আছে যোগ সে প্রকার।
প্রতি কার্য্য তত্ত্ব কর পাইবে কারণ,
কাহারো উদ্ভব নহে বিনা প্রয়োজন।
তবে কেন কার্য্য কর বিপরীত তার,
না হয় চেতন কিহে দেখি বার বার?
ব্যভিচার ভ্রুণহত্যা যুগল প্রভাবে,
প্লাবিত হয়েছে দেশ আর নাহি রহে।
দারুণ বৈধব্য দশা অসীম যাতন,
সহিতে নারিয়া দেখ কত নারীগণ।
অনায়াসে অপথে করিছে পদার্পণ।
ধর্ম্মে দিয়া জলাঞ্জলি অধর্ম্ম অর্চ্চন।
বিধবাবিবাহ কিহে এ হতে দূষণ,
যুক্তি ও স্বভাবসহ নহে কি মিলন,
শাস্ত্র কি নিষেধ করি করিছে শাসন,
বল হে বল হে সিধী নিষেধ কারণ?
ধন্য ধন্য কুসংস্কার তরেরে বাখানি,
স্বর্গীয় আদেশ লঙ্ঘে তোরে শ্রেষ্ঠ মানি।
দুরাচার দেশাচার কি তোর শাসন,
কেমন কঠিন প্রাণ দয়াহীন মন।
অবলার প্রতি কেন এত নিদারুণ,
চির ব্রহ্মচর্য্য বিধি করেছ অর্পণ!
বিধবার দেহ কি হে পাষাণে নির্ম্মিত,
জড় পিণ্ডবৎ সুধু চেতনা রহিত।
নাহি কি মনোজ বৃত্তি নাহি রিপুগণ,
রস রক্তে দেহ কিহে হয় নি সৃজন?
বহু পাপ করিয়া অবলা জন্মিয়াছে,
ভারত মাঝারে হিন্দু রমণী হয়েছে।
একেত অভাবে শিক্ষা বিদ্যালোকহীনা,
সদা অন্তঋপুররুদ্ধা বন্দিনী সমানা।
হিতাহিতজ্ঞানহীন পশুর সমান,
তদুপরি এই দশা করেছ বিধান।
করেছ দেশীয় গণ তাহে ক্ষতি নাই,
তোমাদের কি হইবে ভাবি সদা তাই।
ইহারা করেছে পাপ ভোগে হবে ক্ষয়।
কিন্তু তোমাদের পাপ হতেছে সঞ্চয়।
রাশি রাশি পুঞ্জ পুঞ্জ হয়েছে সঞ্চিত,
পরিণাম বলে বোধ নাহি কি কিঞ্চিত?
জগত পিতার কাছে কি কথা কহিবে,
অন্তর্যামী তিনি তাঁরে কিসে প্রতারিবে?
অপার করুণা তাঁর হেরেও নয়নে,
নহে কি সদয় ভাব আবির্ভাব মনে।
মহারাণী বিক্টোরিয়া ইংলণ্ডবাসিনী,
তাঁর প্রতি কত ভক্তি প্রভু বলে গণি।
গবর্ণর জেনেরল অধীন তাঁহার,
তাঁরে দেখি নত আঁখি নম্র ব্যবহার।
ভয় কি ভক্তির বলে কর এ প্রকার,
যা হোক করিতে হয় নীতি ব্যবহার।
বলহে সুসভ্যদল জিজ্ঞাসি এখন,
জগদীশ প্রতি ভাব আছে কি তেমন?
আছে কি শাসন ভয় আছে ভালবাসা।
অপ্রত্যক্ষ বলে কিহে অস্তিত্বে নিরাশা?
ব্যাভারে নাস্তিকবৎ অস্তি বল মুখে,
নতুবা কি বঙ্গমাতা মরে এত দুখে!
ভ্রুণরক্তে ভারতের কেন হে দূষণ,
কে দিবে অসৎ কাজে উত্সাহ এমন?
প্রতি গ্রাম প্রতি পল্লি পুরেছে বেশ্যায়।
নাশিছে অগণ্য শিশু হায় হায় হায়!!
অবলার আচরিত পাপ দাবানলে,
দিতেছ আহুতি সবে উত্সাহ অনিলে।
কোথা বিভু কৃপাময় করি নমস্কার,
কাতরা কিঙ্করীগণে হের একবার।

.        *************************  

.                                                                                 
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
বামাবোধিনী পত্রিকার অনামা নারী কবিদের কবিতা
*
বিদ্যা যে অমূল্য ধন অনেকে না জানে
বর্দ্ধমানস্থ কোন ভদ্র কুলবালা

বিদ্যা যে অমূল্য ধন অনেকে না জানে।
ক্ষয় নাহি হয় দেখ বিদ্যা ধন দানে॥
বিদ্যার যে গুণ আমি কি বর্ণিব ভাই।
বিদ্যার সমান বন্ধু ত্রিজগতে নাই॥
কবে বা মহিলাগণ বিদ্যাবতী হবে?
হিংসা দ্বেষ পরনিন্দা আর নাহি রবে॥
এমন যে বিদ্যাধন কোথা গেলে পাই।
ইচ্ছা হয় যথা বিদ্যা তথা আমি যাই॥

ঈশ্বরের নিকটেতে করি এ মিনতি।
অবলা সরলা বালা হক্ বিদ্যাবতী॥
যতনেতে বিদ্যা-হার পর সবে গলে।
বিদ্যাভ্যাস কর সবে রমণীমণ্ডলে॥
একান্ত অন্তরে রাখ বিদ্যা প্রতি মন।
বিদ্যার সমান আর নাহি কিছু ধন॥
এমন যে বিদ্যাধন কোথা গেলে পাই।
ইচ্ছা হয় যথা বিদ্যা তথা আমি যাই॥

অবলার হয় যদি বিদ্যার অভ্যাস।
আলোকিত হবে তার হৃদয় আকাশ॥
পাপে নাহি থাকিবে কামিনীর মন।
বিদ্যামৃত রস পান করিবে যখন॥
বিদ্যায় বঞ্চিত হয়ে আছে যেই জন।
অসার জীবনে তার কিবা প্রয়োজন॥
এমন যে বিদ্যাধন কোথা গেলে পাই।
ইচ্ছা হয় যথা বিদ্যা তথা আমি যাই॥

.        *************************  

.                                                                                 
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
স্ত্রীশিক্ষা হিতৈষিগণের প্রতি
দত্তপুকুরস্থ কোন ভদ্র কুলবালা

একি সুমঙ্গদল শুনি মহোদয়গণ,
হর্ষে লোমাঞ্চিত তনু পুলকিত মন।
প্রমোদ লহরী হৃদে বহে অনিবার,
ভাবি অবলার দুঃখ না রহিবে আর।
তৃষিতা চাতকী দেখে দয়া উপজিল,
স্ত্রীশিক্ষা বারিদ তাই প্রকাশ পাইল।
সেই ঘন বরষিলে বঙ্গনারীকুল,
নিবারিবে জ্ঞানজলে মন তৃষাকুল।
উন্মুখ হইবে তবে বুদ্ধি কল্পতরু,
সুন্দর সুকৃতি ফুলে সাজিবে সুচারু।
থাকিতে নয়ন পুন আন্ধ না রহিব,
বিদ্যানিধি উপার্জ্জিয়ে অন্তর জুড়াব।
অর্দ্ধাঙ্গ দ্বিপদ পশু পড়েছে কি মনে,
নয়নবিহীনে দয়া হলো এতদিনে?
তবু ভাল এত দিনে কর্ণ জুড়াইল,
শ্রবণ মঙ্গল ধ্বনি শ্রবণ করিল।
চিন্তাকাশ হতে মোহ হইবে সুদূর,
বচনে জ্ঞানের স্রোত বহিবে প্রচুর।
পশু মধ্যে গণ্য পুন কেহ না করিবে,
হৃদয়েতে সুখচন্দ্র সদা প্রকাশিবে।
জ্ঞান সূর্য্য প্রকাশিবে কর পসারিয়া,
হৃদয়ের অজ্ঞানতা যাবে পলাইয়া।
এমন মনের আশ আছিল কাহার,
জ্ঞানদীপে নাশিবেক মনের আঁধার?
অবলার দুখে দুখী সুধীবরগণে,
সতত আছেন রত উপায় চিন্তনে।
কি করিলে নারীকুলে হইবে মঙ্গল,
অবিরত এই বাবি মানস চঞ্চল।
কায়মনে প্রাণপণে করেন যতন,
কিরূপে রমণীগণ পাইবে রতন।
রতন রতন সে যে জ্ঞান রত্নহার,
কেমনে অবলা তার পাবে অধিকার।
অবিরত এই ভাবে ব্যাকুলিত মন,
কিরূপে শিখিবে জ্ঞান হিন্দুনারীগণ।
আপনারা হলে হেন উদার স্বভাব,
না থাকিবে নারীকুলে সুখের অভাব।
অতেব দাসীদের পুরাইয়া আশ,
জ্ঞান অস্ত্রে কাটি দেন মোহ জালপাশ।
কাটিতে এ জাল নাহি অবলার বল,
নিরস্ত্র হইয়া তাই ফেলি অশ্রুজল।

.        *************************  

.                                                                                 
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বিদ্যাশাক্ষার্থ ভগ্নীগণের প্রতি উপদেশ
শ্রীমতী *** চট্টোপাধ্যায়

নাম মম
*** আছি বর্দ্ধমানে,
লেখাপড়া শিখিয়াছি পতি সন্নিধানে।
ঈশ্বর করুণা করে অবলার প্রতি,
মনোমত বিদ্যাবান দিয়াছেন পতি।
বাল্যকালে যবে আমি ছিনু বাপঘরে,
আছিল বড়ই ইচ্ছা পড়িবার তরে।
বাঙ্গাল দেশেতে বাড়ী পিতাঠাকুরের,
কি সম্ভব শিখিবার ছিল আমাদের।
ভাগ্যক্রমে যাই আমি এদেশে পড়েছি,
ভাগ্যক্রমে যাই পতি এমন পেয়েছি।
তাই ত মনের ইচ্ছা হইয়ে সফল,
লেখা পড়া কিছু কিছু শিখিনু সকল।
একদিন পতি যবে প্রসন্ন হইয়া,
বামাবোধিনী পত্রিকা দিলেন আনিয়া,
কয় খণ্ড সমুদয় করে অধ্যয়ন,
কতই সন্তুষ্ট হলো অবলার মন।
এতদিনে শুভাদৃষ্ট বুঝি বাঙ্গালার,
অবলার তরে হলো রীতি শিখিবার।
আহা কি সুখের দিন হবে সেই দিন,
অবলা সকল যবে হবে দুঃখহীন!
শুন শুন ভারতের ভগিনী সকল,
করহ মনেতে সবে প্রতিজ্ঞা সবল।
মন দিয়া পড়াশুনা কর বোন সবে,
অশেষ আনন্দ মনে হবে হবে হবে।
পতির নিকটে যদি পাইবে আদর,
যদি সন্তোষেতে রবে সংসার ভিতর।
মনের আনন্দে কাল করিবে যাপন,
কর কর কর তবে কর অধ্যয়ন।
ঈশ্বরেতে ভক্তি সবে কর দিয়া মন,
কর ভক্তিভাবে পূজা পতির চরণ।
ঈশ্বর কেমন বস্তু, পতি বা কেমন,
সকলি বুঝিবে আগে কর অধ্যয়ন।
রন্ধন বণ্টন আদি আহার করিয়া,
সংসারে যত কিছু সর্ম্ম সমাপিয়া।
যদ্যপি ক্ষণেককাল সুখী হোতে চাও,
অধ্যয়নে বোন তবে সময় কাটাও।
আজ বোন এইখানে হইনু বিদায়,
বেঁচে থাকি যদি দেখা দিব পুনরায়।
প্রথম আমার লেখা করিতে প্রকাশ,
প্রথম আমার এই উন্নতির আশ।
আশ্বাস যদ্যপি পাই অবলা বলিয়া,
পুনরায় দিব দেখা, আদর পাইয়া।

.        *************************  

.                                                                                 
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
একাকী শয়ন করে ভাবিলাম মনে
দত্তপুকুরস্থ কোন ভদ্র কুলবালা

একাকী শয়ন করে ভাবিলাম মনে।
ভুলিয়ে আছি কি আমি নিত্য তত্ত্ব ধনে॥
যাঁর গুণে পাইলাম যত পরিজন।
তাঁহার ভজনে সবে দেহ দেহ মন॥
অকুল ভবজলধি করিবারে পার।
জগদীশ ভিন্ন দেখ কেবা আছে আর॥
যাঁহার কৃপায় থাকে জীবের জীবন।
তিনি ভিন্ন আমাদের নাহি অন্য জন॥
মায়াময় এসংসার কিছু নহে সার।
নয়ন মুদিয়ে দেখ সব অন্ধকার॥
অতএব তুচ্ছ সুখ নাহি চাহি আমি।
পাপ হতে মুক্ত কর জগতের স্বামী॥

.        *************************  

.                                                                                 
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ঈশ্বর সাধন
অজ্ঞাত কবি।
বইয়ের একটি পৃষ্ঠা পাওয়া যায়নি বলে এই কবির নাম পাওয়া যায়নি। কবিতাটির
শেষটাও আমরা পাইনি সেই কারণেই।

শুন শুন ভ্রান্ত মন বলিছে তোমায়।
ঈশ্বরের পদ ভুলে আছ কি আশায়?
বারে বারে বলি মন না শোন বারণ।
ভ্রমণ করিছে যেন প্রমত্ত বারণ॥
মদে মত্ত হয়ে ভ্রম, করে অহঙ্কার।
জাননা যে কিছু দিনে হবে ছারখার॥
অতএব বলি মন করিয়া মিনতি।
ভক্তিভাবে কর সদা ঈশ্বরের স্তুতি॥
ঈশ্বরের পদে যদি হয়ে থাক নত।
অনায়াসে ফল তুমি পাবে মনোমত॥
দয়াময় নাম তুমি ভুলে আছ কিসে?
বোধ হয় মজে আছ বিষয়ের বিষে॥
ওরে মন এই বেলা হও সাবধান।
সেই নাম বিনা দেখি নাহি পরিত্রাণ॥
কেম মন অকারণ করে অন্বেষণ।
কত কাল ভ্রমপথে করিবে ভ্রমেণ?
জেনেো জাননা তুমি কর হাহাকার।
দেখিতেছ এসংসাক সকলি অসার॥
ঘুমে অচেতন আর রবে কতকাল।
ক্রমে ক্রমে ছেদ কর ভব মায়া জাল॥
দুদিনের খেলা মাত্র এ ভব সংসার।
কেহই তোমার নয় তুমি নও কার॥
মরণ নিকটে যবে হবে আগুসার।
ভাব রে ভাব রে দশা কি হবে তোমার॥
তখন কোথায় যাবে, রবে কোন খানে।
কি ভাবে কাটিবে কাল থাকি কোন স্থানে॥
কোথায় রহিবে তব প্রিয় অহংকার।
লোভ মোহ দ্বেষ ক্রোধ হিংসা কদাচার॥
অতএব বলি মন হও সাবধান।
ঈশ্বরের প্রতি তুমি রাখ ধ্যান জ্ঞান॥
নহিলে নিস্তার কিসে পাইবে রে মন।
যখন দংশন তোমা করিবেক হরি@॥
কে হইবে সখা তব বিনা সেই হরি#॥
হায় মন একি ভাব দেখি রে তোমার।
অকারণে ভ্রম কেন অখিল সংসার॥
রয়েছে অমূল্য ধন তোমার দেহ পুরে।
তবে কেন মর তুমি ত্রিভুবন ঘুরে॥
জানিতেছ সদা যাঁরে দেহ রূপ পুরে।
কেন মন তবে তুমি বাব তাঁরে দূরে॥
হৃদয় মন্দিরে দেখ মুদিয়ে নয়ন।
ধ্যানেতে তাহার সঙ্গে করহ মিলন॥
তাঁর প্রেমে মত্ত হও হৃদয়ে পশিয়ে।
কাজ নাই আর মন দূর দেশে গিয়ে॥
ভক্তাধীন ভগবান ভক্তের সহায়।
ভক্তিভাবে প্রেম পূজা দেহ তাঁর পায়॥
কোথায় কি কর তত্ত্ব পূজার কারণ।
শরীর নৈবেদ্য তব কর নিবেদন॥
ভক্তির অধীন নাথ সকলেতে কয়।
ভক্তিভাবে যেই ডাকে তাহারে সদয়॥

হায় রে! অবোধ মন নাহি তব জ্ঞান।
নিত্য সত্য নিরঞ্জনে নাহি কর ধ্যান॥
কি হবে অন্তিমে গতি নাহি ভাব মনে।
কে তোমারে উদ্ধারিবে শমন ভবনে?
তাঁহার প্রেমেতে যদি নাহি হও লীন,
কে তোমারে উদ্ধারিবে দেখে দীন হীন॥
অতএব বলি শুন ওরে মূঢ় মন।
এখন ঈশ্বর নাম কররে স্মরণ॥
যাহাতে হইবে তব জ্ঞানের উদয়,
সর্ব্বদা থাকিবে যাহে প্রফুল্ল হৃদয়।
না থাকিবে রোগ শোক অন্য যত ভয়।
এমনি নামের গুণ জানিহ নিশ্চয়॥
মায়া জালে বদ্ধ হয়ে রবে আর কত।
ঈশ্বরের প্রিয় কার্য্যে না হইয়া রত॥
সকল ত্যজিয়া স্মর নিত্য নিরঞ্জন।
যাহাতে হইবে তব বিপদ ভঞ্জন॥
শমন আসিয়া যবে করিবে তাড়না।
কি কলে উত্তর দিবে বল না বল না?
কত দিন রবে আর এ দেহ ভবনে।
অবশ্য যাইতে হবে শমন সদনে॥
অতএব মন তুমি দেখনা চাহিয়া।
সাধনের দিন তব যেতেছে বহিয়া॥
আর মন সাধনা করিবে তুমি কবে।
বুঝি কাল চক্রে নিপাতিত হবে যবে?
যাঁহার কৃপাতে কর এ দেহ ধারণ।
ইচ্ছামত করিতেছ গমনাগমন॥
যাঁহার কৃপাতে পেয়ে কোমল রসনা॥
নানামৃত রসাস্বাদে পূরাও বাসনা॥
যাঁহার কৃপাতে পেয়ে যুগল নয়ন।
নানামত শোভা তাহে কর দরশন॥

কবিতার শেষটা পাওয়া যায়নি . . .    


@ – যম
# - পরমেশ্বর

.        *************************  

.                                                                                 
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
১২৭৪ সালের ১৬ই কার্ত্তিকের ঝড়বর্ণন
(আনুমানিক ৩১ অক্টোবর ১৮৬৭)
দোরার উত্তর পল্লী নিবাসিনী কোন মহিলা

যে কাল প্রদোষ আসি করিল প্রবেশ।
ভাবিলে থাকে না মনে জীবনাশা লেশ॥
ধরিয়া পবন দেব সংহার মূরতি।
বহিল প্রবল বেগে ভয়ানক অতি॥
ক্রমেতে বিক্রম তার হইল প্রবল।
তুলনা ধরেনা ধরা অতুল সে বল॥
উপজিল প্রাণে ভয় কাঁপিল হৃদয়।
বুঝি রসাতলে সব গেল বোধ হয়॥
গিরি গুহা মাঝে যতা কেশরী নিস্বন।
ঘন ঘোর ঘোষ আর পবন গর্জ্জন॥
মিলিয়া করিল দোঁহে শ্রবণ বধির।
ভয়ে চিত জড় সড় বিকল শরীর॥
কিছু নাহি দেখা যায় চৌদিকে আঁধার।
ধরণী ধরিল ঠিক্ প্রলয় আকার॥
জগত জীবন যেন জগত জীবন
হরিবারে আজি বুঝি করেছেন পণ॥
দেখিতে দেখিতে চাল উড়ায়ে ফেলিল।
কদলী সমান গৃহ কাঁপিতে লাগিল॥
অর্গল না মানে আর, ভাঙ্গিল কপাট।
শীতে ভয়ে লেগে গেল দশনে কপাট॥
দেখে শুনে ক্ষণে ক্ষণে হই অচেতন।
অনুমানি এইবারে গেল রে জীবন॥
নানামত ভেবে তবে ঘর চাপা ভয়ে।
ত্বরা ধরি হাত কোলে লইয়া তনয়ে॥
স্মরিয়া বিভুর পদ আশ্রয় আশয়ে।
চলিলাম সন্নিহিত ইষ্টক আলয়ে॥
কি কব দুঃখের কথা লেখনী না সরে।
দেখিলে পাষাণ হিয়া অবশ্য বিদরে॥
মহাঘো অন্ধকার যেন যমালয়।
কোন পথে যাব তাহা লক্ষ্য নাহি হয়॥
হইতেছে অবিরল ধারার পতন।
করিছে আঘাত দেহে অশনি যেমন॥
ক্ষণে ক্ষণে ক্ষণ-প্রভা প্রভা বিকশিয়া।
গমনে আটক দেয় চোখে ধাঁধাঁ দিয়া॥
কভু উঠা কভু বসা কভু বা পতন।
ভূমিতলে ছিন্নমূলা লতিকা যেমন॥
অঙ্গ কাঁপে থর থর অবশ শরীর।
কি হবে ভাবিয়া তাহা নাহি হয় স্থির॥
ক্ষণে ক্ষণে মূর্চ্ছা হয় হারাই চেতন।
শিশুর রোদনে পুনঃ হই সচেতন॥
এইরূপে উতরিনু নির্দ্দিষ্ট ভবনে।
এবার ভুলিল যম করিলাম মনে॥
করিল যে অপমান পথেতে পবন।
সহজে সহিতে নারে সতীর জীবন॥
সে দুখের কথা আমি কি বলিব আর।
কহিলে লিখিলে বহে নেত্রে জলধার॥
ক্রমিক ঝড়ের শান্তি সহ জীবনাশা
হইল উদিত মনে হইল ভরসা॥
হায়রে দুখের নিশি পোহাতে না চায়।
দুখের নয়নে হয় বোধ কল্প প্রায়॥
করুণা করিয়া যেন পোহাল যামিনী।
লোহিত আকারে দেখা দিল দিনমণি॥
যাহাকে দেখিয়া আগে প্রকৃতি সুন্দরী।
হাসিত আমোদে দেহে নানা ভূষা পরি॥
এবে দেখি শোকে ভরা বিষণ্ণ বদন।
মনোদুখে মনে মনে ঝুরিল নয়ন॥
পাদপাদি সমুদায় হয়েছে পতিত।
ভবনাদি ভূমিসহ হয়েছে মিলিত॥
অমূল রতন ধান্য জীবের জীবন।
ছিঁড়েছে কঠোর হাতে নিদয় পবন॥
সহাস অধর নাহি নিরখি কাহার।
ফুটেছে শোকের কাঁটা হৃদে সবাকার॥
সকলে উন্নত রবে করিছে রোদন।
কোথা প্রিয় নাথ ওরে কোথা বাছাধন॥
কোথা সহোদর ওরে প্রিয় সহোদর।
দেখা দেও কাছে এসে জুড়াই অন্তর॥
এইরূপে হাহারব চৌদিকে শুনিয়া।
শোকের সায়কে হৃদি যায় বিদরিয়া॥
কোথাহে জগতপতি করুণানিধান।
কর কর এ দুঃখের প্রশান্তি বিধান॥

.        *************************  

.                                                                                 
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
পালিত কপোতিনীর প্রতি
ঢাকাস্থ কোন রমণী
(বঙ্গবন্ধু হইতে উদ্ধৃত।)

বল ওগো কপোতিনী,                কেন এত বিষাদিনী,
হেরিতেছি বলগো তোমায়।
প্রকাশিয়া বল না আমায়॥

এত দুঃখী কোন দুখে,                আহা সদা অধোমুখে,
নেত্রনীর কর সম্বরণ।
সুধাও আমায় বিবরণ॥

সুবর্ণ শিকল পদে,                    সদা আছ উচ্চপদে,
সুবর্ণ পিঞ্জরে অবস্থান।
ইথেও কি ভোলে না গো প্রাণ?

তোমার সন্তোষ তরে,                অপূর্ব্ব কোটরাপুরে,
রহিয়াছে খাবার সকল।
তবু তুমি কেন গো চঞ্চল?

বল করি বিচরণ                       করি আহারাহরণ,
তাতেই বা কত সুখোদয়।
বল মোরে হইবে সদয়॥

শুন ওগো কপোতপ্রিয়ে,             বলিতে বিদরে হিয়ে,
আমিও গো পিঞ্জরবাসিনী।
কিবা সুখে বঞ্চে স্বেচ্ছাধীনী॥

আছ তুমি যে সুখেতে,                স্বর্ণময় পিঞ্জরেতে,
আমাদের নাহি এত সুখ।
তুমি কেন হও গো বিমুখ?

না দেয় গঞ্জনা কেহ,                দাসীত্ব ভার না বহ,
অন্নজলে নাহিক অভাব।
তবে কেন ভাব নানা ভাব?

ছিলে যবে স্বচ্ছাধীনী,                ভ্রমি বনে একাকিনী,
কত সুখ লভিছিলে তায়!
কি দুঃখে বা আছো গো হেথায়

বেড়াইতে নানা বন,                শাখা করি আরোহণ,
কত কষ্টে যাপিছ যামিনী!
এত সুখে আছ বিষাদিনী।

বুঝুলাম এতক্ষণে,                      তব ভাব দরশনে,
তোমরাই বুঝিয়াছ সার।
নাহি বহ অধীনতা ভার!

শুন ওগো বিহগিনী,                মোরা অতি অভাগিনী,
অন্তঃপুর পিঞ্জর নিবাসী।
আছি সদা অধীনের দাসী।

চিরদিন একমত,                      হিতাহিত জ্ঞানহত,
জ্ঞান ধর্ম্মে দিয়ে বিসর্জ্জন।
একবাবে করিছি যাপন।

তুমি নও চিরদাসী,                  কিছুদিন তরে আসি,
হেরিতেছ দুঃখের বয়ান।
হবে পুনঃ দুঃখ অবসান।

হায়রে মোদের দুঃখ,                বলিলে বিদরে বুক,
এর চেয়ে পাখী যদি হই।
তবু বুঝি মনসুখে রই।

ধন্য ওগো কপোতিনী,                  মানবিনী হতমানী,
হয়ে আছে দেখে তব সুখ।
তাই ঢাকে ঘোমটাতে মুখ।

কি বলিব বিধাতারে,                বলিতে প্রাণ বিদরে,
মোরা বুঝি তব কন্যা নই,
তাই সদা এত দুঃখ সই।

না হইয়ে ধর্ম্মাধীনী,                  আছি সদা পরাধীনী,
সদা থাকি ক্রীত দাসী প্রায়।
এই কি তব অভিপ্রায়?

পাই কত মর্ম্মব্যথা,                তথাপি না বলি কথা,
সদা মুখ ঢাকি ঘোমটায়।
এই কিহে তব অভিপ্রায়?

হয়ে দেশাচার দাসী,                অজ্ঞান সলিলে ভাসি,
কাটিলাম এ দুর্লভ কায়।
এই কি তব অভিপ্রায়?

.        *************************       

.                                                                                            
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*