কবি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা
*
কৃষ্ণকথা
কবি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

আমার মন্দ ভালো মিলেমিশে
আলো অন্তহীন, অন্ধকারে দেখব
এবার চোখের রঙিন যা কিছু সব
অঘটনের ঘটতে থাকা ভুল
সত্যপীরের জয়ধ্বনি, অজানে নির্ভুল
কেঁপে ওঠে মৃত্যুপাখি যখন আকাশময়
উড়তে থাকে---- ডানার খাঁজে লুকিয়ে রাখে
ভয়, দাঁড়ে বসে আদর মেখে
দানা-পানি জল, কৃষ্ণকথা, রাধে রাধে
শোনায় অর্নগল, শান্ত থাকি-----
ঘুমের ভিতর স্বপ্নে ভেজাচোখ
মিথ্যে বোনা ঘাসের মাদুর
গড়িয়ে যখন রোদ, আঁধার পেরোয়
আঁধার পেরোয় আলোতে উন্মুখ---

.       *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কল্প-প্রলয়
কবি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

ছিটকে উঠছে জল
নীহার বিন্দু কণা কণা
ভেঙে প্রলয়ের খেলাঘর
ভেসে যাচ্ছে ভূমন্ডল-উত্তর দক্ষিণ অধঃঊর্ধ্ব অতীত
অস্থির ব্রহ্মান্ডে শুধু চোখবুজে শুয়ে জাগতিক
.                           শ্রয়েডিংগারের বিড়াল

সৌর জগত থেকে বিপ্ বিপ্ ভেসে আসে
সংকেতে খেলে যায় ঈশ্বরের পাশা
তৃষিত আলো গানে মুগ্ধ ভুবনে
ঝড়ে ওঠে আলোঝড়
সিলিকন ভ্যালি জুড়ে ত্রাস
দুর্বার গতিময় আলোর নিমেষ
ভেঙে পড়ে অনিবার্য ঈশ্বর-কণা
আঁধারের কিস্তিমাতে |

ভৌতিক অন্ধকারে নিউট্রিনো
হাজার হাজার ভুতুরে-কণা
ছুটে চলে অশরীরী ভয়
নিসর্গ নগরগ্রাম জলাজঙ্গল-নক্ষত্রমন্ডলী সৌর শহর
বুকের ভিতর শুধু স্থায়ী অভিমান
চোখ বেয়ে ঝরে অবিরল

.       *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
দৃশ্যকাল
কবি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

ক্রমশ আলগা হচ্ছে টান
ক্রমশ প্রতিসরনের গল্প
গাছপালার ভিতর দিয়ে দেখা যায়
ধুলোর উড়ন্ত বালুকণা রশ্মিরেখার নির্মাণে
ফুটিফাটা রেখাচিত্রে ভুবনের গান
রুদালী সংগীত হয়ে বেজে ওঠে কলার টিউনে

স্মৃতি বলে কিছু নেই
ঝাপসা শহর বাড়ি ঘর
অতীতের পিছুটানে এখনও নাছোড়
লতাতন্তু বুনে যায় স্বর্ণাভ জাল
ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী কথা সোনার ভ্রমর
ফেসবুকে ভেসে আসে মায়া-মারীচের আখ্যান

পিলসুজ পুড়ে তেল
কটুগন্ধে ভারী হয়ে উঠেছে বাতাস
সন্ধ্যার আকাশে ডানা গুটিয়ে শুকসারী
রূপকথা বলে যায় জৈব আলো-আঁধারির
তেপান্তরের মাঠ রাক্ষস জিন পরি
প্রযুক্তি প্রমাণে কী ভাবে ঘনায় প্রমাদ |

.       *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
মুদ্রিত স্বাক্ষর
কবি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

অন্ধকারের মাঝে আমায় ধরেছ দুইহাতে
আর সাড়া দেব বলে আমি পেরিয়ে যাচ্ছি
ঈশ্বরীয় উপকথাগুলো, সমান্তরাল আকাশ
বিশ্বমান গবেষণালিপি শূন্যতার পরিভাষা,
এত যে আঁধার খেলা, আলোর অতীত নিরাকার
রূপ তার শ্যামসব নৈশবাহার, যেন রচিত
শ্রাবণমেঘ কপট বিরহ ঘনিয়ে আন্ধার
জন্মান্ধের রিপুসন্ধানে আঁধারের পদাবলি
রাধিকার পথ-অভিসার, ঝড়বাদলের রাতে
বিপদের প্রান্তসীমায় অবাক লন্ঠন হাতে
তুমি মুদ্রিত স্বাক্ষর, রোশনাই-এ ভরে দাও ঘর
অন্তরে বাহিরে, ভয়তরাসের বাঁকে অতলান্ত খাদে  |

.            *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
অপেরাগৃহ
কবি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

অপেরা শূন্যগৃহ দৃশ্যের মাঝে বসে একা পিয়ানো
চারপাশে উড়ন্ত বেলুন কাগজ কুচির রঙ
নিপুণ আলোর কারুকাজ, তন্ময় মুখের ভাঁজে
দক্ষ বিষাদ-বিলাপ-আনন্দ-অশ্রু-ক্রোধ-ক্ষমা প্রসন্নতা |
মঞ্চজুড়ে ছায়ামহড়া আঁধার ঘনিয়ে দৃশ্যপট,
কারা আসে কারা যায় বদলের ঘন্টাপ্রহরও
আসক্তি উদাস অভিমান, জমাট প্রেমের রসায়ন
সমাজ জটিল কুটিল গ্রন্থি থেকে খুলে যায়
অনন্তজীবন, দুলে ওঠে পর্দার ভাঁজ, দৃশ্যবদল
সাজঘরে মঞ্চসফল পালা স্নায়ু সংলাপে----
ধাতব কঠিন স্বরগ্রাম ওঠে নামে, বরফশীতল হিম
রোমকূপে শিহরণ, দিশেহারা শিরাউপশিরা
বুকের ভিতর জলাধারে প্রপাতের জলোচ্ছ্বাস
আবহে থেমেছে কলরব, শূন্য অপেরা গৃহ
ঢেকে শ্যাওলা ছত্রাক, অদৃশ্য নাট্যকুশীলব |

.            *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
বাঁশি
কবি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

হেঁয়ালিতে মেতে আছে বিলুপ্ত নগর
প্রান্তিক জনপদে কানাবাঁশি যত বাজে
উড়ে আসে আনচান মুগ্ধ বেপুথ ভ্রমর,
বিলাবল মধুরাগে রাত্রি ঘনিয়ে অনুপম
প্রসারিত অন্ধকারে ডুবে যায় স্মৃতিঘন
দীর্ঘ অতীত কথা ভুলে যাওয়া স্বরলিপি ধুন---
‘বনে যদি ফুটল কুসুম---নেই কেন সেই পাখি’----
বিলাপ করুণ, বাগানে বাগানে গৃঢ় পাতামর্মর
অনুরাগে ধুলো মাখে সহজিয়া গান উত্সব,
পটছবি এঁকে চলে নুন হাওয়া তেল ঘাম রঙ
দুঃখের বারোমাস্যা সুখের শিথিল আলাপ
সন্ধ্যার রূপোজীবা রাত্রির মধু সহবাস
নকশার কারুকথা স্তব্ধ শুনেছে পাথর
এলোচুল মেলে দেয় ফুলের বাতাস মরমীয়া
কানাবাঁশি বেজে চলে অন্ধ কামুক ডাকাতিয়া |

.            *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
অবাঙ
কবি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

তোমাকে অস্বীকার করব বলেই পেরিয়ে যাচ্ছি
ঝুলন্ত সাঁকো ফুলভারনত মায়া অর্কিড
ঈশ্বরীয় উপকথা ভর করে স্নায়ু-সংহত
রাত্রির এলোচুলে নরক অতীত

তোমাকে অস্বীকার করব বলেই জ্বলে ওঠা
জাদুলন্ঠন--কাচে চৈনিক পরিভাষা
দ্বন্দ্ব মধুর আঁখিপাতে কনফুসিয়াস
নিরাকার মোহ থেকে উথ্বানরহিত

তোমাকে অস্বীকার করব বলেই খুঁজে ফিরি
দোজখ থেকে জন্নত, চাঁদ তারা আসমান
মিনার গম্বুজ হাঙর সমুদ্র যদি পাই
অলীক ফেরেশতা ঈশ্বীয়দূত

তোমাকে অস্বীকার করব বলে দেশান্তর
ফেরারি সন্ন্যাস ত্রিসন্ধ্যা যাপন
বেআব্রু রাত খুলে পরকীয়া আচমন
কমন্ডুল ভরে ওঠে শঙ্খ শামুক  |

.            *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
ছবি-কথা
কবি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

গাঢ় এক লালের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি এখন----
রক্তের লাল, সূর্যাস্তের লাল, রক্তিম আগুনের কাছে
ফিকে সব রঙ, ছুঁতে পারছে না চোখ, কিছুতেই না
মস-অলিভ-জলপাই অরণ্য মুহুর্মুহু পালটে ফেলছে
ছায়ার ঘনত্ব, পাতার মুখোশ, ঘাস-ফড়িংয়ের রঙ
পতঙ্গ সবুজ, রঙদার ময়ূর-টিয়া----হরিয়ালি ক্রমশ ধূসর
হেঁয়ালি হয়ে উঠছে, আকাশ নীলাভ, গাঢ় ছাই আর অঙ্গার-কালোর
গহনে বিদ্যুৎ-লাল আন্ধার, কৃষ্ণপথে যক্ষের মেঘ-নির্নয়---
গুহামুখে খুলে দিচ্ছে অভীসারী পথ------- প্রামণ্য আর্কাইভ
চর্বি -প্রদীপে পিচ্ছিল-শ্বেত-লোহিত ছায়াতপ,
যেন কুহুকের জন্ম দেবে হারানো শতকের আতপ রোমান্স
আসমানি চাহিদাগুলো পুড়তে পুড়তে ক্রুর লাল
আদিম ক্যানভাসে আনকোরা শস্যের চারা পিঙ্গলকপিশহরিৎ

আর আমার ব্রহ্মান্ড-আঁকি বিস্ফোরিত ক্রোধ, হলুদ তীব্র মেধা
সমাহিত করে রাখি বিমুগ্ধ দর্শক |

.            *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
সংকেত
কবি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

মুঠোর ভিতরে রোদ পুড়িয়ে দিচ্ছে আঙুল
কী দিয়ে যে লিখি তাপ কী দিয়ে গহন----
অভিমানী ছায়ার বিকেল, নকশার ম্লান কারুকাজ
উষ্ণতার খড়কুটো দিয়ে যেটুকু জ্বেলেছি আগুন
দাবানল শিকা লেলিহান বনের অরণ্যক্ষুধা
জপস্নিগ্ধ শ্লোক প্রবচন, পুড়ে যাচ্ছে নৈর্ঋত দিন
রাত্রির অজপা আশ্লেষ, সিলিকন ভ্যালি জুড়ে
নিরাপদ জাগছে প্রহর, নক্ষত্র শিহর মায়াভূমি
অনুগামী সন্ধ্যা আঁচে আরোরার আলো উত্সব,
যেন ফেনাময় কফিতে চুমুক, যেন মৃত নগরীর
বুকে পম্পেই নগর, ঘাসের ঘাগরা নাচে সমুদ্রে ফেনিল
জলস্তম্ভ ছুঁয়েছে আকাশ, খাড়ি রাত্রি-শহর
প্রান্ত ভূমিতে চুপ রূপকথা মুগ্ধ শুনছে রাক্ষস
রাতচরা পাখিদের সাংকেতিক মিথ মনোলোগ
কৌটোর ভিতরে ভ্রমর ঘুমোয় দেহনশ্বর
অক্ষর গোপন প্রাণ ---- ন হন্যমান জাদুচাবি জানে
আগুন ছোঁবে না তাকে ছোঁবে না দহন
আঙুলের দগ্ধ অভিমানে

.            *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
পারমার্থিক
কবি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

ছিঁড়ে যাচ্ছে দিন, অন্ধর মতো আলো ঢাকা
আয়ানোস্কিয়ারে ঝিল্লিরব পতঙ্গ পাখার
ঘসটানি, অশরীরী ছায়াপথে কখন নেমেছে সন্ধ্যা
কুষ্ণপথে উড়ে যাচ্ছে আশ্চর্য গোলক, নামহীন
যতি চিহ্নহীন এক একটি উড়ান, অভিযানে
নীলগ্রহ নক্ষত্রশহর, ধাবমান তারা পুঞ্জে
লেগে আছে ক্লান্তি ঘুমের অবসাদ, গোধূলির
আজান-শঙ্খরব, হার্ডডিস্কে রাখা আছে
প্রলয়রাতের আখ্যান, যখন সৌরঝড় যখন
উল্কাশিহর, প্রতিটি গ্রহের মাঝে অচেনা সমুদ্র
ঢুকে যায়, ঢেউশীর্ষে ভেসে উঠে অক্ষদ্বীপ
অপেক্ষা মুদ্রায় জ্বলে ওঠে আলো সারিসারি
মনিটারে অদৃশ্য পালক মুছে দেয় ধুলোস্তর,
আয়ুর অতীত প্রত্নমুখের ছবি যদি বলে দেয়
রিপু সন্ধানে ---- শোক মায়া দেহ পরিণাম |

.            *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর