কবি অনিতা অগ্নিহোত্রীর কবিতা
*
আগুন লাগা শরীর নিয়ে যদি
কবি অনিতা অগ্নিহোত্রী

আগুন-লাগা শরীর নিয়ে যদি
জ্বলতে জ্বলতে তোমার বাড়ি আসি
ভেজা বাতাস জড়িয়ে দিও গায়ে
ভয় পাবে না, ঘরপোড়া সন্ন্যাসী

সরিয়ে নিও পুড়তে পারে যা যা
আসবাব আর জীবন-জোড়া ফাঁকা
তুষের কাঁথা খড়ের কঙ্কালে,
ঝাঁপির বেত, ঘাসের আংরাখা।

জ্বলছে জ্বলছে সলতে-পোড়া প্রাণ
পুড়ছে হাড় পুড়ছে শিরদাঁড়া
চোখের কোটর আলজিভ আর নাভি
হতভম্ব দাঁড়িয়ে আছে পাড়া।

এক ফোটা জল, এক ছিঁটে জল কেউ
দেয় না, কত তেষ্টা জীবন জুড়ে
একটু নরম ছায়ার অন্য পাখি
উড়ছে ধু-ধু আগুন-পাঁচিল ঘুরে।

তোমার কাছে নয়নভরা জল
তোমার কাছে পদ্মজাগা বিলও
ভেজা-বাতাস, বৃষ্টি-নেভা রাত,
তোমার কোলেই মরণ লেখা ছিল।

আগুন-লাগা শরীর নিয়ে যদি
জ্বলতে জ্বলতে তোমার কাছে যাই,
পাগল নদী জড়িয়ে দেবে গায়ে ?
তারায় তারায় ছড়িয়ে দেবে ছাই ?

.       *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
মুখ
কবি অনিতা অগ্নিহোত্রী

শালবনে বৃষ্টির শব্দে
যে মুখখানি ধুয়ে যায়
.                যার ছবি
.                প্রতিমার মতো স্পষ্ট পড়ে আছে
.                সময়ের জলতলে

যে কালও রেখেছে পা
স্বপ্নের গলুইয়ে
আলতার রাঙা জলে
গলে গেছে ঘুম
.                যার জন্যে
.                এক আকাশ অভিমান নিয়ে
.                দিগন্তে চলে গেছিলাম

.                সে-ই
.                আজ
.                চলে যাচ্ছে
.                কখনো ভাবিনি

এমন নৈকট্যে গাঢ় হয়ে
নিঃশর্ত আগুনে সে আমার মুখচুম্বন করবে।

.      
    *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
তুমি কেমন আছ
কবি অনিতা অগ্নিহোত্রী

তুমি আমাকে যেমন রেখেছ আমি তেমন আছি
শিকড়ে কোল ঘেঁষে রাঙা বটফলের মতন।
রোদে, বৃষ্টিতে ভিজে আনন্দে, কান্নায় ঘামে
গোরুর গাড়ির চাকায় পিষ্ট মাটিতে মুখ ঘ’ষে
আবার একদিন ধুলোর সঙ্গে উড়ে যাই চৈত্র বিকেলে
তুমি আমাকে এমনই রেখেছ।
শিরায় শিরায়               
  একদিন জ্বর আসে,
আবার একদিন                ধমনী বেয়ে ফিরে যায় হাহাকার।

.         
       *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
স্বগতোক্তি
কবি অনিতা অগ্নিহোত্রী

আদরি নারকেল গাছ                আর দেখবো না
তোমার কেশরে
কেমন চিকন রোদ ঠোঁট ঘষে
দেখব না উজ্জ্বল ফুলেরা কেমন
আলো দিয়ে
ক্রমাগত অন্ধকারে হেঁটে চলে যায় . . .
ছ’টার ঘন্টার শব্দ আকাশে টাঙিয়ে দেবে
বিষণ্ণ ঘড়িটি . . .
অনেক আগের তার বন্ধ করে দিয়ে যাব
দৃষ্টির জানালা
শাশ্বতী পাখিটি এসে নিয়ে যাবে কাঠ, কুটো, কাঠি
রোজকার :
শ্মশানবন্ধুর মতো কাতর গাছেরা,
লাল সূর্যে হাত রেখে আগুন পোহাবে,
ঝিরিঝিরি হাওয়া শেষে বৃষ্টি দিয়ে চলে যাবে
সন্ধের বাগানে :
তাদের কী এসে যায়, আঁধার বাড়িটি,
বন্ধ করে বসে আছে দৃষ্টির জানালা!

.          *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
পট
কবি অনিতা অগ্নিহোত্রী

জলের অনেক নিচে পড়ে আছে
.                        নিশ্বাসের শব্দ
জলজ দামের মত ভ্রাম্যমাণ, অথচ কী বায়বীয় অছিলায়
.                        সমুদ্র খাতে তার মূল
ছুটন্ত নৌকোর আলো ডাকে
জল যেই ন’ড়ে ওঠে নিশ্বাসের ধবনি নিভে যায়
কাছাকাছি অন্ধকারে, ঢেউ ও বাতাসে লগ্ন
.                        তুমি কি কোথাও
রয়ে গেছ? মারভের তল খোঁজা গানে
তোমার গোটানো পট : খুলে যায় জলের ভিতর
বিচিত্র দ্বিধায় লেখা, ছবি ও অক্ষরে তোমার কাহিনি
যৌনিহীন মৎস্যকন্যা, অবাঞ্ছিতা, সে জানে সে  সমস্ত
.                         পড়েছে।

.      
        *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
এসেছি তোমার বাড়ি
কবি অনিতা অগ্নিহোত্রী

এসেছি তোমার বাড়ি। কী দিবা, চিন্তামণি, খেতে
পেরিয়ে ধূসর পথ, উইঢিপি, ফণিমনসার
তর্কাতীত, গাঢ় সম্বন্ধতার সূচিমুখ, খুব খিদে
তোমার পুকুরে চাঁদ মরে ভেসে আছে দুঃখী
আতারা ঝুঁকে প’ড়ে দেখে আর মৃত্যুভয় পায়
ধানখেতে খুড়ে কারা রেখে গেছে শিশুর
কঙ্কাল : কপালে এখনো তার ধ্যাবড়ানো
কাজলের দাগ, মার অক্ষমতা ভালোবাসা হয়ে
ফুটে ওঠে মর্গের হাতায় : এসেছি তোমার
বাড়ি : কী দেবে, চিন্তামণি, পেতে
কাঁতা পাতো, পাহাড়, নদীর বুক, শালবন ঢাকা
একখানি, ছেঁড়া কাঁথি, তাতে কলকা পাকা আম
সফেদার কচি মুখ দিও, যাতে ওই দিনমজুরের
হাড় জাগায় বুক আর বেঁধে না মাজায়
রমণীর ছেঁড়া চটি সেফটিপিন অসাড় কনুই
ঘুমের নীচের স্তরে এই সব ভালো নয় থাকা

এসেছি তোমার বাড়ি : বহু সন্ধ্যা সকালের গন্ধ মাখা
অনেক ধূলির চেয়ে ধূলিসর : কী দিবে চিন্তামণি
কী আছে তোমার : ভাক নেই, কাঁথা নেই, একাকীর
বিফল সংসার। এসেছি তোমার কাছে, স্বর্গের পথে
ভাঙা ঘর। কপালে তিলক দাও, মৃত্তিকাধূসর
অন্নের চিন্তাকে দিও অঙ্কুরের সদ্যোজাত পাখা।

.              *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কাগজকুড়ানিদের জন্য গাথা
কবি অনিতা অগ্নিহোত্রী

আমার মতো তুমিও যদি চুমুক দিতে
আয়না-ভাঙা পারার মতো বিষের কাপে
তুমিও দেখতে কুঁচকে যাচ্ছে রোদের কাঁথা
ছিটকে উঠছে রক্তমাখা ছিন্ন হাওয়াই
তুমিও দেখতে জীবন ঠোঁটে রুচছে না আর
হাড়ে মধ্যে শীতের ছুরি, পায়ের নীচে
কনকনে রাত, দিনের বেলা জুড়িয়ে বরফ
রোদ ও আকাশ সঙ্গে তাদের অট্টহাসি

সবচে বড় শ্রেণীশত্রু কারা : কাগজকুড়ানিরাই
বলেন নাগর : গুলিবারুদ বরাত দেওয়া হয়নি বলে
লাঠি এবং রক্ষিদলেই চালাতে হয়। রাত্রে তারা
স্তব্ধ শহর শাসন করে : উড়ালপুলের বিষ-কোটরে।

যদিও মানা উড়ালপুলে পদারোহণ
কুড়ানিরাই ছড়িয়ে পড়ে সদলবলে : এবং করে সমাজদূষণ
ফেলে দেওয়া আবর্জনা বাছতে বসে, চাঁদের আলোয়
শুকায় তাদের, খাদ্যবস্তু থাকলে সেঁটে কামড়িয়ে খায়
এখন তারা শক্ত। শীতল। মৃতদেহে। শহর আকাশ
দিন পনোরে বর্ষেছে শীত, রৌদ্রবিহীন
স্বাভাবিকের অনেক নীচে দুমড়ানো শীত, এসব
কাগজকুড়ানিদের ধ্বংস হেতু : সমাজদূষণ

বন্ধ করো, শীতের চেয়ে ক্ষিপ্র কে আর ? সমাজবন্ধু!
মাথার উপর ছাত না থাকা ভবঘুরে!

.              *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
সূর্য-ডোবা দেখতে গিয়ে
কবি অনিতা অগ্নিহোত্রী

সেই মেয়েটি হারিয়ে গেছে সিঁথির মোড়ে
সূর্যডোবা দেখতে গিয়ে। সেই মেয়েটি
ক্রন্দসী-তীর ছাড়িয়ে গেছে মেঘান্তরে।
ঘাসের ঘুঙুর লোটায় পায়ের। রূপোর কাঠি

শিয়র বাগে। কে আর তাকে মধ্যরাতে
জাগায়, সে তো ছাপিয়ে গেছে এই সময়ের
দ্বন্দ্ব-দোলন। বনের দু’হাত জ্যোত্স্না-পাতে
পিছল, তাকে ডাকতে পিছু শঙ্কা পথের।

মা লেধেছে, পা ধুবি আয়, বাবা সাঁকোর
কাছেই ছিল, হাত ধরবে। ভাই জানালায়
দাঁড়িয়ে ভাবে গল্প বাকি। বোনটি তো ওর
এলই না আর : শিহর ওঠে রাত ইঁদারায়।

নৈর্ঋতে চুল শুকোচ্ছিলো লাল-রঙা রোদ,
ঝাপটেছিল পাখা কিছু উদ্বাহু গাছ :
দিক্ হারানোর ঝঞ্ঝাবায়ে ও কোন অবোধ
ছাড়িয়ে গেল আকাশ রোদের আনাচ-কানাচ,

সূর্য-ডোবা দেখতে গিয়ে রাতের তোড়ে
সেই মেয়েটি তলিয়ে গেছে সিঁথির মোড়ে॥

.            *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর