কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতা
যে কোন গানের উপর ক্লিক করলেই সেই গানটি আপনার সামনে চলে আসবে।
কৃষ্ণ
কবি অন্নদাশঙ্কর রায়
রচনা – ১৯২৫

সুন্দর তুমি খুঁজিয়া ফিরিছ কারে ?
নাই সে খোঁজার আদি আর অবসান |
সুরের দূতীরে পাঠাও কাহার দ্বারে ?
নাই সে জনের কোথা কোনো সন্ধান |
তুমি শুধু সুর, তুমি পথে চলা সুর,
তুমি চলি’ যাও বাঁশিতে বাঁশিতে বেজে |
দূর হতে আসি’ নিকট, পালাও দূর
এক যুগ হতে আর যুগে চলা এ যে |
তোমার খোঁজার সমারোহ দেখে মরি
ওগো সুন্দর, এত জানো ছলাকলা !
কত রূপ কত বর্ণ বিকাশ করি’
গন্ধে ছন্দে অবিরাম তব চলা |
প্রাতে খুলে ফেলি’ যামিনীর যবনিকা
চিনিবার তরে কার মুখ তুলে ধরো !
ঊষার অলকে আঁকি সিন্দুর লিখা
মেঘে চুম দিয়া সরমে অরুণ করো |
সারা দিন ছোটো হেথায় হোথায় মিছে
আলোয় উজলি’ মুগ্ধ ধরণী সারা
দিনশেষে তবু বারুণীর পিছে পিছে
মশাল ধরিয়া তিমিরে হও যে হারা |
লক্ষ নয়ন ফুটে ওঠে দিকে দিকে
নিশিভোর চলে শুধু খোঁজা, শুধু খোঁজা
ছায়াপথ বেয়ে চরণচিহ্ন লিখে
অসীমের মাঝে ছুটে বাহিরাও সোজা |
যৌবন, তব পথপাশে জাগে হাসি
কুসুমে কুসুমে মাতামাতি কানাকানি
কেলিকদম্ব ঝরায় মুকুলরাশি
কুঞ্জে কুঞ্জে ফুলবাণ হানাহানি |
রঙে রঙে তুমি রাঙাইলে দিশি দিশি
রঙের নেশায় সৃজিয়া চলিলে কী যে
কালো হয়ে গেল সব কটি রঙ্ মিশি’
তুমি যে কালিমা অঙ্গে মাখিলে নিজে |

ওগো যৌবন, ওগো চির যৌবন,
নিতি নিতি তুমি জাগাও নবীন প্রাণ
জরারে জোগাও সবুজের রসায়ন
কচি ও কাঁচায় শক্তির অভিমান |
এত করি’ তবু হয় নাকো মনোমতো
প্রিয়ার লাগিয়া আরো কিছু বুঝি চাই
মরণ সাজিয়া ভাঙোসবি অবিরত
কচি ও কাঁচা ও জরতীর ভেদ নাই |
ওগো নিষ্ঠুর সুন্দর, ওগো কালো,
কোথা পেলে ঐ সাপ খেলানোর বাঁশি !
দিকে দিকে কী যে সুরের আগুন জ্বালো
যারা শোনে তারা ঝাঁপ দিয়ে পড়ে হাসি’
এক দিক হতে আর দিকে পড়ে সাড়া
নৃত্যের তালে চরণে শিহরে সুখ
উদ্দাম বেগে ঘুরে মরে রবিতারা
বিপুল ব্যথায় দোলে সিন্ধুর বুক |
কুহকী !  এত যে কুহক লাগাও প্রাণে
বিশ্বের প্রতি কণায় স্বপন সৃজে
আমরা বৃথাই খুঁজে মরি ওর মানে
তুমি শুধু হাসো, হয়তো জানো না নিজে |
বিশ্বের তুমি শোভারূপ, তুমি কান্ত
ফোটা সুষমার নির্যাসে তুমি গড়া
মনোহর তুমি হয়ে ওঠ অবিশ্রান্ত
তোমার মাধুরী তোমারি সৃজন করা |
এত সুন্দর তবু তুমি চাও কারে ?
খুঁজিয়া বেড়াও কী বিপুল পূর্ণতা ?
কত কী গড়িলে নিজ হাতে বারে বারে
মন ভরিল না, করি’ করি’ দিলে চূর্ণ তা’ |

জানি জানি, তুমি কী ধন খুঁজিয়া ফির
কার তরে তব অবিরাম অভিসার
পাইলে না, তাই বিরহী সেজেছ চির
যত বার গেলে ফিরে এলে তত বার |
নিখিলের রূপ কেঁদে মরে যার তরে
সে যে নিখিলের বক্ষে লুকানো প্রীতি
তারে তুমি যত চাহিলে বাহিরে ঘরে
পাইলে না, তুমি নাহি জানো তার রীতি |
সে আছে তোমার অন্তর আলো করি’
সে আছে তোমার বাঁশরির সুরে বাঁধা
তুমি ঘুরে মরো সারাটি গোকুল ভরি’
তোমারি বক্ষে লতাইয়া আছে রাধা |
পথ খোঁজা রীতি ঘুচিবে তোমার কবে ?
চলিতে চলিতে কবে দাঁড়াইবে থেমে ?
সুন্দর, তুমি প্রেমিক যেদিন হবে
সুষমা সেদিন সার্থক হবে প্রেমে |
জানি জানি কভু আসিবে না হেন দিন
তুমি নিষ্ঠুর, প্রেমপাশ যাও টুটি’
তুমি তো পালালে মথুরায় উদাসীন
বিরহিণী রাধা ভূতলে পড়িল লুটি’ |
সেই তুমি কভু প্রেমে কি পড়িবে ধরা ?
সুচির বিরহ, বিলাস তোমার সে যে !
তুমি শুধু সুর, শুধু পথ খুঁজে মরা,
তুমি চলি’ যাও বাঁশিতে বাঁশিতে বেজে |

.               **********       
.                                                                                  
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর  
*
রাধা
কবি অন্নদাশঙ্কর রায়
রচনা – ১৯২৭

.          ওগো সুন্দরী, ওগো সুন্দরী রাধা,
শীতল জানিয়া তোমার ও দুটি চরণে পড়িনু বাঁধা |
কত জনে কত দেবতা মিলয় যেমন যাহার রুচি
কেহ গড়ে লয় কেহ খুঁজে পায় পন্ডিতজনে পুছি’ |
কত না আয়াসে ওরা তো করিল রহস্য পরিমাণ
আপনা হইতে মোরে মিলি’ গেল সুন্দরী ভগবান |
সুন্দরী ভগবান গো আমার সুন্দরী মোর নারী
সাগর হইতে উঠিয়া আসিলে হাতে লয়ে সুধা ঝারি |
দেবতার পদ প্রক্ষালি’ কেহ সে জলে মিটায় ক্ষুধা
আমার তিয়াসা ধন্য করিল নারীকন্ঠের সুধা |
নারীকন্ঠের সুধা গো আমার নারীকুন্তল বাস
এত সুখ মোর সহিবে কি যদি মেলি’ দাও কেশপাশ !
ঘেরি‘ দাও যদি কেশ দিয়া মোরে ঢাকি’ দাও যদি দেহ
সংজ্ঞা হারাব ও-সুরা চুমুকি’ সুরভি করিয়া লেহ |
সৃষ্টির সার ধরণী গো আর ধরণীর সার নারী
নারীর মাধুরী দশ ইন্দ্রিয়ে আহরিতে যদি পারি !
ধরণীর সার রমণী গো আর রমণীর সেরা সে
জনমে জনমে আমার লাগিয়া জনম মাগিল যে |
পরশি তাহার প্রতিটি অঙ্গ প্রতিটি অঙ্গ দিয়া
এ যে বিশ্বের আদি বহ্নি গো এসেছে কী রূপ নিয়া !
রূপের বহ্নি কেমন করিয়া এমন তন্বী হলো
এমন শীতল এমন কোমল এত লাবণ্যী হলো !
সারা সৃষ্টি সে গৌরীর মতো তপ করেছিল একা
তাই তার তনুরেখায় রেখায় লাবণ্য দিল দেখা |
তারায় তারায় যুগযুগান্ত অনঙ্গ পুড়ে মরে
শীতলিয়া ধরা তবে না এমন ফুলে ফলে ওঠে ভরে |
ধূলির আগুন ফুল হয়ে ফোটে ফুলের আগুন ফল
তারায় আগুন তরুণীর আঁখিতারা হয়ে ঝলমল |
সৃষ্টি সে আসি’ শেষ হয়ে গেছে তোমার দু’গাছি কেশে
অনন্ত কাল বিকশি’ উঠেছে তোমার অধর হেসে |
কোথা হতে তুমি আসিবে কেন গো তুমি তো আদির আদি
আপন আগুনে ফাগুন করেছ সৃষ্টির মায়া ফাঁদি’ |
.       ওগো মায়াবিনী,  ওগো মায়াবিনী রাধা,
গোরোচনা গোরা অঙ্গে তোমার সৃষ্টির মায়া ফাঁদা |

.       ওগো সুন্দরী, ওগো সুন্দরী রাধা,
বলো, কবে মোর হবে, সমাপন বাঁশরীর সুর সাধা |
বাঁশরির সুরে কাঁদা গো আমার কারে পাইবার আশা
কারে পাইবার কাহারে দিবার কার হইবার আশা !
সুবর্ণ করে নাও গো আমায় সুকন্ঠ করে নাও
ধ্বনিতে আমার প্রেমের পরশমণি পরশিয়া যাও |
সহজ সুরের গানটি গাহিব, গাহিব সহজ সুরে
বনের পাখির কন্ঠ আমার কন্ঠে দাও তো পুরে |
সহজ হবার সাধন সে যদি কঠিন সবার চেয়ে
করুণা কোরো না, ভিক্ষা দিয়ো না, অল্প কী হবে পেয়ে !
সরস মাটিতে হরষে ফুটিব শুচি সৌরভ লয়ে
যেখানে পড়িব বাস বিতরিব জিনিব সহজ জয়ে |
জিনিব সহজ জয়ে গো, বন্ধু, জিনিব তোমারে শেষে
ধূলায় চাইতে রিক্ত হইয়া বাহিরিব বরবেশে |
.      ওগো একাকিনী, ওগো একাকিনী রাধা,
কেহ নাহি জানে তুমি আর আমি কোন অবাঁধনে বাঁধা |

.                       **********       
.                                                                                  
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর  
*
কৈফিয়ৎ
কবি অন্নদাশঙ্কর রায়
রচনা – ১৯২৭

না-ই যদি হয় নাই হলো আহা ভারতের স্বাধীনতা
হুঙ্কার ছাড়ি’ তর্জনী নাড়ি’ নাই মুছালেম ব্যথা !
.             নাই মুছালেম ভিজে আঁখিপাতা
.             হাহুতাশভরা রচি’ বীর গাথা
ইনায়ে বিনায়ে কবে মান্ধাতা কারে জিনেছিল কোথা
বৃথা মোরে ডাকো আমি পারি নাকো হেন ঘোর রসিকতা !
.                      আমি ক্ষণজীবী কবি
আয়ু কই, সখি, মহারথীদের মহাযশ যাব লভি !

ভীরু বলে তুমি ফিরাবে নয়ন মূঢ় বলে দিবে গালি
বাঁকা হাসি হেসে তালে তালে তালে বাজাইবে করতালি |
.             সেও সই, তবু পারি না কিছুতে
.             সাধ্য যা নয় তাহারি পিছুতে
ছুটিয়া ছুটিয়া মরীচিকা ছুঁতে শ্বাসটুকু দিতে ঢালি’
বৃথা দাও লাজ আছে আরো কাজ তারি লাগি প্রাণ জ্বালি |
.                       আমি ক্ষণজীবী কবি
যুগ যুগ ধরে যে পাবক জ্বলে কেন হব তার হবি ?

যে রূপবহ্নি নয়নে জ্বলিছে যে রসবিন্দু বুকে
যে মায়াবহ্নি কল্পনা মোর রাঙাইছে কৌতুকে
.              সেই অনলের কয়েকটি কণা
.              লয়ে বিরচিব নব আল্ পনা
বসে বসে তাই চলে জল্পনা বিরহবিরস মুখে
বহে যায় বেলা নীরবে একেলা নিষ্ফলতার দুখে |
.                     আমি দিনেকের কবি
নভ অঙ্গনে আল্ পনা আঁকি’ নিভে যাবে মোর রবি |

আপনারে লয়ে ফিরি অহরহ নামাতে না পারি ব্যথা
ভ্রূণ লয়ে কাঁদে গরভিণী নারী কুঁড়ি লয়ে কাঁদে লতা |
.               সৃজনবেদনা জাগে অনিবার
.               কত কী যে মোর রয়েছে দিবার
ফাগুন থাকিতে তাই তো আমার ফুটিবার ব্যাকুলতা
বলিবার যত কবে তা বলিব মনে থেকে যায় কথা |
.                       আমি অস্ফুট কবি
ফুটিলেই মোর ব্যথা যাবে, সখি, না ফুটিলে যাবে সবি |

আমারে পাবে না জগতের কাজে আমি চির পলাতকা
বচন বিনাতে নাহি জানে যারা আমিই তাদের সখা |
.            প্রণয়ীরা মোরে ডাকি’ লয়ে যায়
.             বাসরঘরের চোরা ঝরোকায়
আমি লিখে লই আপন ভাষায় ওদের প্রলাপ বকা
আমি দিই ছেপে যত চাপা হাসি যতেক মিছে চমকা |
.                       আমি বাণীচোরা কবি
বাচাল জনার যত কথাভার উতারিয়া লই সবি |

তরুণ ছেড়েছে তরুণীর মায়া দীক্ষা লয়েছে একা
জনমের মতো করেছে বরণ জাগিয়া স্বপন দেখা
.              শ্রবণে বেজেছে মা’র হাহাকার
.              উতলা হয়েছে খাপে তরবার
তবু ভাঙিবে না ধৈর্য তাহার আগে চাই রণশেখা
কথাটি বলে না নিজেরে ছলে না ললটে নিষ্ঠা লেখা |
.                      আমি বিমুগ্ধ কবি
মরণে কী শোক তার জয় হোক, আঁকি’ লব তার ছবি |

হেম শৃঙ্খল কাটি’ কোন জন কোথায় নিরুদ্দেশ
কেহ নাহি জানে বাজে তার প্রাণে সকলের সব ক্লেশ |
.              সৃষ্টির আদি অন্ত বুঝিতে
.              জরা মরণের ওষধি খুঁজিতে
মারের সঙ্গে নিত্য যুঝিতে আয়ু তার নিঃশেষ
সাধনা না সাধি’ সাধক মরিল কেহ না জানিল লেশ |
.                     আমি বিনম্র কবি
সেই অজানার তর্পণ করি’ পরম পূণ্য লভি |

ঘরে ঘরে পাই গৌরীর দেখা তপোনির্মল রূপ
সে বর অঙ্গ রঙ্গে বিলোকি’ অনঙ্গ মানে চুপ |
.              কল্যাণী যায় গৃহ কাজ করি’
.              পূর্ণা চলিছে অন্ন বিতরি’
সম্মুখে তার হাত পাতে ডরি’ আপনি ভুবন ভূপ
কোলে দোলে শিশু ভয় পরিহরি’ এ যে অতি অপরূপ |
.                      আমি কুতূহলী কবি
রহস্য এর নাহি পেয়ে টের রসনা রয় নীরবি’ |
তাই বলি মোর কোথা অবসর যোগ দেব কোনো কাজে
দৃশ্য নেহারি’ ঠাঁই ঠাঁই ফিরি মিলি সকলের মাঝে |
.              দেখি আর লিখি যখন যা আসে
.              কখন কে কাঁদে কখন কে হাসে
খেয়ালীর মতো ঘুরি আশে পাশে ভাববিলাসীর সাজে
রণভেরী শুনে সরে না চরণ মনে মনে মরি লাজে |
.                       আমি দর্শক কবি
নাটবেদী পরে যেতে ভয় বাসি, দূর হতে অনুভবি |

আমার এ কাজে কে করিবে আজ আমি যদি যাই রণে
কবে জানিবে কে যাহা গেল থেকে শুধু আমারি এ মনে ?
.              কোটি কোটি পথ একটি জীবন
.              তাও দুটি দিনে হবে সমাপন
আপনারি পথে চলি সে কারণ নিজেরি অনুসরণে
কভু চলে নাই কভু চলিবে না এ পথে অপর জনে |
.                       আমি যে তোমারি কবি
তোমারি আলোকে আলোকিত আমি, তব তরে এ পদবী |

.                       **********       
.                                                                                  
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর  
*
মিলনের গান
কবি অন্নদাশঙ্কর রায়
রচনা, জাহাজ-- ১৯২৭

তোমাদের তরে মিলনের গান গাই
.           ওগো জগতের তরুণ তরুণী যত |
তোমাদের সুখে সুখ মেলাবারে চাই
.           ওগো জগতের তরুণ তরুণী যত |
প্রিয়বাহুলীনা অয়ি তনু তনুলতা
কানে কানে মৃদু সোহাগ কুজনরতা
তোমারে নেহারি’ কী যে আনন্দ পাই
.           ওগো নববধূ কেমনে বোঝাব কত !
তোমাদের সুখে সুখ মিলাবারে চাই
.           ওগো জগতের তরুণ তরুণী যত |

চির মন্দার ফোটে তোমাদের বুকে
.           ওগো জগতের তরুণ তরুণী যত |
শরৎ শেফালী ঝরে হাসিঝরা মুখে
.           ওগো জগতের তরুণ তরুণী যত |
আঁখিতে আঁখিতে চপলা পড়েছে ধরা
চরণধূলায় মরণে মিলায় জরা
রজনীতে রাস নব নব কৌতুকে
.            দিবসে বিবশ নিলাজ নর্ম শত |
মলয়গন্ধি সুরা তোমাদের মুখে
.             ওগো জগতের তরুণ তরুণী যত |

তোমাদের কেহ লক্ষ্মী লভিলে রণে
.              ওগো জগতের তরুণ তরুণী যত |
তোমাদের কেহ তরণী ভরিলে ধনে
.              ওগো জগতের তরুণ তরুণী যত |
তোমাদের কেহ বাণীরে মানায়ে বশ
শ্বেত চন্দনে ললাটে আঁকিলে যশ
তোমাদের কেহ ঘরে ডাকি’ জনে জনে
.              আপনা বিলায়ে দিলে দধীচির মতো
কোনো তথাগত একাকী চলিলে বনে
.              ওগো জগতের তরুণ তরুণী যত |

তোমরা ধন্য তোমরা সফল,  ভাই
.              ওগো জগতের তরুণ তরুণী যত |
সবার গর্বে সকলের জয় গাই
.              ওগো জগতের তরুণ তরুণী যত |
জীবনের ছকে নিয়তি চালায় পাশা
পণে হারিলাম রাজকন্যার আশা
হে বন্ধু মোর কেহ নাই কিছু নাই
.              হে বন্ধু আমি পরাভব লাজে নত |
তোমাদের সুখে সুখী হয়ে উঠি তাই
.              ওগো জগতের তরুণ তরুণী যত |

.                     **********       
.                                                                                  
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর  
*
বিমুগ্ধ
কবি অন্নদাশঙ্কর রায়
রচনা, ইংলন্ড – ১৯২৭

এ ধরণী কত সুন্দরী !  কত সুন্দরী !
.           মানুষ সেও কী সুন্দর ! সে কী সুন্দর !
রূপসুধা পিই প্রাণ ভরি দু’-নয়ান ভরি’
.           আনন্দরসে উতলায় মম অন্তর |
দেশে দেশে সেই শ্যামল কোমল ঘাসগুলি
লতাদের কোলে ফুলেদের কচি হাসগুলি
পাখি উড়ে যায় তরুদের বাহুপাশ খুলি’
.           ছায়ায় শিহরে তটিনীর তটপ্রান্তর |
সেই যে ধরণী সুন্দরী সেই সুন্দরী
.           পর দেশে এত সুন্দর ! এত সুন্দর !

মানুষ  সেও কী সুন্দর ! সে কী সুন্দর !
.           ভালোবাসা তার ভালো, আহা, কত ভালো !
মমতার রঙে রাঙা যে তাহার অন্তর
.           বাহির তাহার যত হোক শাদা কালো !
দেশে দেশে নারী তেমনি দোলায় চিত্ত
শিশুর মেলায় অকারণে পায় নৃত্য
জীবন ছাপায়ে মাধুরী ঝরিছে নিত্য
.           প্রেমের দেয়ালি মর্ত্য করেছে আলো |
মানুষ সে যে কী সুন্দর ! সে কী সুন্দর !
.           ভালোবাসা তার ভালো, আহা, কত ভালো !
এ জীবন কী যে নন্দিত ! কী যে নন্দিত !
.           বেঁচে আছি বলে ধন্য রে আমি ধন্য !
মানুষ আমারে ভালোবেসে দেয় কী অমৃত
.           ধরণী আমারে ভালোবেসে দেয় অন্ন |
দেশে দেশে মোর তেমনি মধুর বন্ধন
আরেকের তরে একেরে ছাড়িতে ক্রন্দন
যেথা যাই সেথা পাই প্রীতি অভিনন্দন
.           মরণেও কিছু এ ছাড়া হবে না অন্য |
এ জীবন কত নন্দিত !  কত নন্দিত !
.           জন্মেছি বলে ধন্য রে আমি ধন্য |

.                     **********       
.                                                                                  
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর  
*
সৃষ্টি
কবি অন্নদাশঙ্কর রায়
রচনা – ১৯২৮

যখন আমি সৃষ্টি করি আপন রবি আপন তারা
আমার প্রাণের আগুন হতে বৃষ্টি করি উল্কা ধারা
.               যখন আমার বক্ষতটে
.               পুলক-ভূমিকম্প ঘটে
দীর্ঘশ্বাসের ঝড় ডেকে যায় আঁখির অথির সাগর ধারা
তখন ওগো স্রষ্টা তোমার দুঃখসুখের পাই কিনারা |

তখন তোমার সঙ্গ লভি, বিশ্ব হিয়ার হে একাকী
তোমার চরণপাতের সাথে চরণপাতে ছন্দ রাখি |
.               তোমার হাতে হাতটি ভরে
.               তখন চলি কালের পরে
শিশুর মতো খেলার সুখে থামতে থাকি চলতে থাকি |
সৃষ্টি আমার ছায়ার মতো পিছনে রয় ধূলায় ঢাকি ||

.                     **********       
.                                                                                  
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর  
*
প্রণাম
কবি অন্নদাশঙ্কর রায়
রচনা, ইংলন্ড – ১৯২৯

যে নারী পূরায় বাঞ্ছা অন্তরযামিনী
.              তাহারে প্রণাম |
সে নয় বিভবলুব্ধা সামান্য কামিনী
.              তাহারে প্রণাম |
ঊর্ধ্ব হতে বর্ষে সুখ কল্পতরু প্রায়
স্বর্গ হতে পারিজাত শিয়রে ঝরায়
আপনি লুকায়ে থাকে সলজ্জ দামিনী
.              তাহারে প্রণাম |

সহস্র বর্ষের তপে সে ক্ষণিকপ্রভা
.              ক্ষণকাল ঊরে
চঞ্চলা লক্ষ্মী সে আনে বৈকুন্ঠের শোভা
.              প্রেমিকের পুরে |
দিয়ে যায় যুগান্তের প্রার্থিত দর্শন
নিঃস্বের করামলকে দুর্বহ কাঞ্চন
আপনারে দিয়ে যায় সুচির দুর্লভা
.              ক্ষণযুগ জুড়ে |
অসহ্য সৌভাগ্য দিলে অমর্ত্য বল্লভা
.              মনোবাঞ্ছা পূরে |

যে লক্ষ্মী কামনাযজ্ঞে সহিতগামিনী
.              তাহারে প্রণাম |
নূতন তপস্যা দানি’ সহস্র বর্ষের
সমাপন করি’ যায় ক্ষণিক হর্ষের
গুন্ঠন টানিয়া নেয় নিষ্ঠুরা স্বামিনী
.               তাহারে প্রণাম |
কোথা সে লুকায়ে যায় ক্ষণসৌদামিনী
.               তাহারে প্রণাম |

.                 **********       
.                                                                                  
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর  
*
মাঝে মাঝে
কবি অন্নদাশঙ্কর রায়
রচনা, ইংলন্ড – ১৯২৯

মাঝে মাঝে যদি আমি আর কারো পানে
আন মনে চেয়ে রই তিয়াসী নয়নে
জেনো, প্রিয়ে, সে আমার নয় ভালোবাসা
প্রেমের তিয়াসা নয়, রূপের তিয়াসা |
এমন সুন্দরী ধরা শ্যাম জ্যোত্স্নাবতী
নারী সে সুন্দরতর সুধা-স্রোতস্বতী |
আমারে লোভায় ওরা এমন শোভায়
প্রেমের পালঙ্ক হতে মন উড়ে য়ায় |
তবু, প্রিয়ে, সে আমার নয় চপলতা
প্রেমের অন্যতা নয়, তৃষ্ণার অন্যতা |
হৃদয় রয়েছে বাঁধা অচল নোঙরে
চাহনি ভাসিয়া ফিরে লহরে লহরে |
তারায় তারায় খুঁজি রহস্যের আলো
তুমি মোর ধ্রুবতারা, তোরে বাসি ভালো |

.                 **********       
.                                                                                  
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর  
*
ভারতের পথে
কবি অন্নদাশঙ্কর রায়
রচনা, জাহাজ – ১৯২৯

এবার চলেছি নিজ দেশে
.           ভারতের ছায়াতরুতলে
ধ্যানী যেথা মীলিত লোচন
.           প্রকৃতিরে মানা দেয় হেসে
স্বামী যেন কামিনীরে বলে
“ওগো তুমি থাম কিছুখন |”

হে আমার নব আবিষ্কার
.            হে মহান হে চির স্বাধীন
হে প্রেমিক মহা কারুণিক
.            খোলো খোলো তব সিংহদ্বার
তুমি নহ কারো হতে দীন
.            তুমি নহ ভিখারী ধনিক  |

তোমার উদার তরুতল
.           তোমার সুঅনুগতা সতী
পতি সে মুক্তির তপে রত
.           বনিতা ভাবিছে কত ছল
সে তব মানিনী প্রেমবতী |
.           হে ভারত, কোথা তব ক্ষত ?

সুখে তুমি পরিয়াছ চীর
.           মন তবু কটীবাসে নাই
তন্ময় রয়েছ শরবৎ
.           কুশাসনে বসিয়াছ স্থির
কত না শতাব্দী ধরে তাই
.           তব দ্বারে অতিথি জগৎ |

অতিথি দস্যুর ছদ্মবেশে
.           আসে যায় শত শত বার
মুঠাভরে যত সোনা লয়
.           তত সত্য লয় অবশেষে |
অফুরান তোমার ভান্ডার
.           যত ধন যায় তত রয়

আমরা ভাবিয়া হই সারা
.           সে মোদের ভাবনা বিলাস
তুমি দেব অজর অমর
.           তোমারে রুধিতে নারে কারা
তোমারে টলাতে নারে ত্রাস
.           অপমানে তুমি অকাতর |
হে ভারত, তোমার ধ্যানের
.           তোমার তনয়ে করো ভাগী
মোরে দাও বীজমন্ত্র তব |
.            অর্থহীন ধনের মানের
হব না হব না অনুরাগী
.             জনকের যোগ্য সুত হব |

.                 **********       
.                                                                                  
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর  
*
জীবনদর্শন
কবি অন্নদাশঙ্কর রায়
রচনা,  ১৯৫৪

সৌন্দর্য রচনা করি, একমনে থাকি গৃহকোণে
আমার কিসের দায় ? কেন যাই কুরুক্ষেত্র মাঝে
অর্জুনসারথি হতে ? সে ভূমিকা আমায় না সাজে |
জয় সেও পরাজয়,  মন বলে,  মতি নাহি শোনে |

বাইরে সঙ্কট, বুঝি | তার চেয়ে অন্তরে সঙ্কট |
মন চায় স্থির হয়ে সুষমার দীপখানি জ্বালা
যাতে কিছু লজ্জা পায় কুশ্রীতার অন্ধ মাতোয়ালা |
মতি চায় ছুটে যেতে জোয়ানে জোয়ানে যেথা জট |
এ সঙ্কটে আয়ু যায় | কোথায় হয়েছি উপনীত ?
প্রশ্ন করি আপনারে | চেয়ে দেখি রচনার পানে |
কল্পনায় যা রয়েছে আজো ভূমি পায়নি সেখানে
অন্তঃসত্ত্ব বসে আছি দশ মাস কবে যে অতীত |
বাইরে সঙ্কট বাড়ে | শুনি কালচক্রের ঘর্ষণ
আমি আছি, তবু নেই ! এই আজ জীবনদর্শন |

.                 **********       
.                                                                                  
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর  
*