. ওগো সুন্দরী, ওগো সুন্দরী রাধা, শীতল জানিয়া তোমার ও দুটি চরণে পড়িনু বাঁধা | কত জনে কত দেবতা মিলয় যেমন যাহার রুচি কেহ গড়ে লয় কেহ খুঁজে পায় পন্ডিতজনে পুছি’ | কত না আয়াসে ওরা তো করিল রহস্য পরিমাণ আপনা হইতে মোরে মিলি’ গেল সুন্দরী ভগবান | সুন্দরী ভগবান গো আমার সুন্দরী মোর নারী সাগর হইতে উঠিয়া আসিলে হাতে লয়ে সুধা ঝারি | দেবতার পদ প্রক্ষালি’ কেহ সে জলে মিটায় ক্ষুধা আমার তিয়াসা ধন্য করিল নারীকন্ঠের সুধা | নারীকন্ঠের সুধা গো আমার নারীকুন্তল বাস এত সুখ মোর সহিবে কি যদি মেলি’ দাও কেশপাশ ! ঘেরি‘ দাও যদি কেশ দিয়া মোরে ঢাকি’ দাও যদি দেহ সংজ্ঞা হারাব ও-সুরা চুমুকি’ সুরভি করিয়া লেহ | সৃষ্টির সার ধরণী গো আর ধরণীর সার নারী নারীর মাধুরী দশ ইন্দ্রিয়ে আহরিতে যদি পারি ! ধরণীর সার রমণী গো আর রমণীর সেরা সে জনমে জনমে আমার লাগিয়া জনম মাগিল যে | পরশি তাহার প্রতিটি অঙ্গ প্রতিটি অঙ্গ দিয়া এ যে বিশ্বের আদি বহ্নি গো এসেছে কী রূপ নিয়া ! রূপের বহ্নি কেমন করিয়া এমন তন্বী হলো এমন শীতল এমন কোমল এত লাবণ্যী হলো ! সারা সৃষ্টি সে গৌরীর মতো তপ করেছিল একা তাই তার তনুরেখায় রেখায় লাবণ্য দিল দেখা | তারায় তারায় যুগযুগান্ত অনঙ্গ পুড়ে মরে শীতলিয়া ধরা তবে না এমন ফুলে ফলে ওঠে ভরে | ধূলির আগুন ফুল হয়ে ফোটে ফুলের আগুন ফল তারায় আগুন তরুণীর আঁখিতারা হয়ে ঝলমল | সৃষ্টি সে আসি’ শেষ হয়ে গেছে তোমার দু’গাছি কেশে অনন্ত কাল বিকশি’ উঠেছে তোমার অধর হেসে | কোথা হতে তুমি আসিবে কেন গো তুমি তো আদির আদি আপন আগুনে ফাগুন করেছ সৃষ্টির মায়া ফাঁদি’ | . ওগো মায়াবিনী, ওগো মায়াবিনী রাধা, গোরোচনা গোরা অঙ্গে তোমার সৃষ্টির মায়া ফাঁদা |
. ওগো সুন্দরী, ওগো সুন্দরী রাধা, বলো, কবে মোর হবে, সমাপন বাঁশরীর সুর সাধা | বাঁশরির সুরে কাঁদা গো আমার কারে পাইবার আশা কারে পাইবার কাহারে দিবার কার হইবার আশা ! সুবর্ণ করে নাও গো আমায় সুকন্ঠ করে নাও ধ্বনিতে আমার প্রেমের পরশমণি পরশিয়া যাও | সহজ সুরের গানটি গাহিব, গাহিব সহজ সুরে বনের পাখির কন্ঠ আমার কন্ঠে দাও তো পুরে | সহজ হবার সাধন সে যদি কঠিন সবার চেয়ে করুণা কোরো না, ভিক্ষা দিয়ো না, অল্প কী হবে পেয়ে ! সরস মাটিতে হরষে ফুটিব শুচি সৌরভ লয়ে যেখানে পড়িব বাস বিতরিব জিনিব সহজ জয়ে | জিনিব সহজ জয়ে গো, বন্ধু, জিনিব তোমারে শেষে ধূলায় চাইতে রিক্ত হইয়া বাহিরিব বরবেশে | . ওগো একাকিনী, ওগো একাকিনী রাধা, কেহ নাহি জানে তুমি আর আমি কোন অবাঁধনে বাঁধা |
না-ই যদি হয় নাই হলো আহা ভারতের স্বাধীনতা হুঙ্কার ছাড়ি’ তর্জনী নাড়ি’ নাই মুছালেম ব্যথা ! . নাই মুছালেম ভিজে আঁখিপাতা . হাহুতাশভরা রচি’ বীর গাথা ইনায়ে বিনায়ে কবে মান্ধাতা কারে জিনেছিল কোথা বৃথা মোরে ডাকো আমি পারি নাকো হেন ঘোর রসিকতা ! . আমি ক্ষণজীবী কবি আয়ু কই, সখি, মহারথীদের মহাযশ যাব লভি !
ভীরু বলে তুমি ফিরাবে নয়ন মূঢ় বলে দিবে গালি বাঁকা হাসি হেসে তালে তালে তালে বাজাইবে করতালি | . সেও সই, তবু পারি না কিছুতে . সাধ্য যা নয় তাহারি পিছুতে ছুটিয়া ছুটিয়া মরীচিকা ছুঁতে শ্বাসটুকু দিতে ঢালি’ বৃথা দাও লাজ আছে আরো কাজ তারি লাগি প্রাণ জ্বালি | . আমি ক্ষণজীবী কবি যুগ যুগ ধরে যে পাবক জ্বলে কেন হব তার হবি ?
যে রূপবহ্নি নয়নে জ্বলিছে যে রসবিন্দু বুকে যে মায়াবহ্নি কল্পনা মোর রাঙাইছে কৌতুকে . সেই অনলের কয়েকটি কণা . লয়ে বিরচিব নব আল্ পনা বসে বসে তাই চলে জল্পনা বিরহবিরস মুখে বহে যায় বেলা নীরবে একেলা নিষ্ফলতার দুখে | . আমি দিনেকের কবি নভ অঙ্গনে আল্ পনা আঁকি’ নিভে যাবে মোর রবি |
আপনারে লয়ে ফিরি অহরহ নামাতে না পারি ব্যথা ভ্রূণ লয়ে কাঁদে গরভিণী নারী কুঁড়ি লয়ে কাঁদে লতা | . সৃজনবেদনা জাগে অনিবার . কত কী যে মোর রয়েছে দিবার ফাগুন থাকিতে তাই তো আমার ফুটিবার ব্যাকুলতা বলিবার যত কবে তা বলিব মনে থেকে যায় কথা | . আমি অস্ফুট কবি ফুটিলেই মোর ব্যথা যাবে, সখি, না ফুটিলে যাবে সবি |
আমারে পাবে না জগতের কাজে আমি চির পলাতকা বচন বিনাতে নাহি জানে যারা আমিই তাদের সখা | . প্রণয়ীরা মোরে ডাকি’ লয়ে যায় . বাসরঘরের চোরা ঝরোকায় আমি লিখে লই আপন ভাষায় ওদের প্রলাপ বকা আমি দিই ছেপে যত চাপা হাসি যতেক মিছে চমকা | . আমি বাণীচোরা কবি বাচাল জনার যত কথাভার উতারিয়া লই সবি |
তরুণ ছেড়েছে তরুণীর মায়া দীক্ষা লয়েছে একা জনমের মতো করেছে বরণ জাগিয়া স্বপন দেখা . শ্রবণে বেজেছে মা’র হাহাকার . উতলা হয়েছে খাপে তরবার তবু ভাঙিবে না ধৈর্য তাহার আগে চাই রণশেখা কথাটি বলে না নিজেরে ছলে না ললটে নিষ্ঠা লেখা | . আমি বিমুগ্ধ কবি মরণে কী শোক তার জয় হোক, আঁকি’ লব তার ছবি |
হেম শৃঙ্খল কাটি’ কোন জন কোথায় নিরুদ্দেশ কেহ নাহি জানে বাজে তার প্রাণে সকলের সব ক্লেশ | . সৃষ্টির আদি অন্ত বুঝিতে . জরা মরণের ওষধি খুঁজিতে মারের সঙ্গে নিত্য যুঝিতে আয়ু তার নিঃশেষ সাধনা না সাধি’ সাধক মরিল কেহ না জানিল লেশ | . আমি বিনম্র কবি সেই অজানার তর্পণ করি’ পরম পূণ্য লভি |
ঘরে ঘরে পাই গৌরীর দেখা তপোনির্মল রূপ সে বর অঙ্গ রঙ্গে বিলোকি’ অনঙ্গ মানে চুপ | . কল্যাণী যায় গৃহ কাজ করি’ . পূর্ণা চলিছে অন্ন বিতরি’ সম্মুখে তার হাত পাতে ডরি’ আপনি ভুবন ভূপ কোলে দোলে শিশু ভয় পরিহরি’ এ যে অতি অপরূপ | . আমি কুতূহলী কবি রহস্য এর নাহি পেয়ে টের রসনা রয় নীরবি’ | তাই বলি মোর কোথা অবসর যোগ দেব কোনো কাজে দৃশ্য নেহারি’ ঠাঁই ঠাঁই ফিরি মিলি সকলের মাঝে | . দেখি আর লিখি যখন যা আসে . কখন কে কাঁদে কখন কে হাসে খেয়ালীর মতো ঘুরি আশে পাশে ভাববিলাসীর সাজে রণভেরী শুনে সরে না চরণ মনে মনে মরি লাজে | . আমি দর্শক কবি নাটবেদী পরে যেতে ভয় বাসি, দূর হতে অনুভবি |
আমার এ কাজে কে করিবে আজ আমি যদি যাই রণে কবে জানিবে কে যাহা গেল থেকে শুধু আমারি এ মনে ? . কোটি কোটি পথ একটি জীবন . তাও দুটি দিনে হবে সমাপন আপনারি পথে চলি সে কারণ নিজেরি অনুসরণে কভু চলে নাই কভু চলিবে না এ পথে অপর জনে | . আমি যে তোমারি কবি তোমারি আলোকে আলোকিত আমি, তব তরে এ পদবী |
এ ধরণী কত সুন্দরী ! কত সুন্দরী ! . মানুষ সেও কী সুন্দর ! সে কী সুন্দর ! রূপসুধা পিই প্রাণ ভরি দু’-নয়ান ভরি’ . আনন্দরসে উতলায় মম অন্তর | দেশে দেশে সেই শ্যামল কোমল ঘাসগুলি লতাদের কোলে ফুলেদের কচি হাসগুলি পাখি উড়ে যায় তরুদের বাহুপাশ খুলি’ . ছায়ায় শিহরে তটিনীর তটপ্রান্তর | সেই যে ধরণী সুন্দরী সেই সুন্দরী . পর দেশে এত সুন্দর ! এত সুন্দর !
মানুষ সেও কী সুন্দর ! সে কী সুন্দর ! . ভালোবাসা তার ভালো, আহা, কত ভালো ! মমতার রঙে রাঙা যে তাহার অন্তর . বাহির তাহার যত হোক শাদা কালো ! দেশে দেশে নারী তেমনি দোলায় চিত্ত শিশুর মেলায় অকারণে পায় নৃত্য জীবন ছাপায়ে মাধুরী ঝরিছে নিত্য . প্রেমের দেয়ালি মর্ত্য করেছে আলো | মানুষ সে যে কী সুন্দর ! সে কী সুন্দর ! . ভালোবাসা তার ভালো, আহা, কত ভালো ! এ জীবন কী যে নন্দিত ! কী যে নন্দিত ! . বেঁচে আছি বলে ধন্য রে আমি ধন্য ! মানুষ আমারে ভালোবেসে দেয় কী অমৃত . ধরণী আমারে ভালোবেসে দেয় অন্ন | দেশে দেশে মোর তেমনি মধুর বন্ধন আরেকের তরে একেরে ছাড়িতে ক্রন্দন যেথা যাই সেথা পাই প্রীতি অভিনন্দন . মরণেও কিছু এ ছাড়া হবে না অন্য | এ জীবন কত নন্দিত ! কত নন্দিত ! . জন্মেছি বলে ধন্য রে আমি ধন্য |
যখন আমি সৃষ্টি করি আপন রবি আপন তারা আমার প্রাণের আগুন হতে বৃষ্টি করি উল্কা ধারা . যখন আমার বক্ষতটে . পুলক-ভূমিকম্প ঘটে দীর্ঘশ্বাসের ঝড় ডেকে যায় আঁখির অথির সাগর ধারা তখন ওগো স্রষ্টা তোমার দুঃখসুখের পাই কিনারা |
তখন তোমার সঙ্গ লভি, বিশ্ব হিয়ার হে একাকী তোমার চরণপাতের সাথে চরণপাতে ছন্দ রাখি | . তোমার হাতে হাতটি ভরে . তখন চলি কালের পরে শিশুর মতো খেলার সুখে থামতে থাকি চলতে থাকি | সৃষ্টি আমার ছায়ার মতো পিছনে রয় ধূলায় ঢাকি ||
মাঝে মাঝে যদি আমি আর কারো পানে আন মনে চেয়ে রই তিয়াসী নয়নে জেনো, প্রিয়ে, সে আমার নয় ভালোবাসা প্রেমের তিয়াসা নয়, রূপের তিয়াসা | এমন সুন্দরী ধরা শ্যাম জ্যোত্স্নাবতী নারী সে সুন্দরতর সুধা-স্রোতস্বতী | আমারে লোভায় ওরা এমন শোভায় প্রেমের পালঙ্ক হতে মন উড়ে য়ায় | তবু, প্রিয়ে, সে আমার নয় চপলতা প্রেমের অন্যতা নয়, তৃষ্ণার অন্যতা | হৃদয় রয়েছে বাঁধা অচল নোঙরে চাহনি ভাসিয়া ফিরে লহরে লহরে | তারায় তারায় খুঁজি রহস্যের আলো তুমি মোর ধ্রুবতারা, তোরে বাসি ভালো |
সৌন্দর্য রচনা করি, একমনে থাকি গৃহকোণে আমার কিসের দায় ? কেন যাই কুরুক্ষেত্র মাঝে অর্জুনসারথি হতে ? সে ভূমিকা আমায় না সাজে | জয় সেও পরাজয়, মন বলে, মতি নাহি শোনে |
বাইরে সঙ্কট, বুঝি | তার চেয়ে অন্তরে সঙ্কট | মন চায় স্থির হয়ে সুষমার দীপখানি জ্বালা যাতে কিছু লজ্জা পায় কুশ্রীতার অন্ধ মাতোয়ালা | মতি চায় ছুটে যেতে জোয়ানে জোয়ানে যেথা জট | এ সঙ্কটে আয়ু যায় | কোথায় হয়েছি উপনীত ? প্রশ্ন করি আপনারে | চেয়ে দেখি রচনার পানে | কল্পনায় যা রয়েছে আজো ভূমি পায়নি সেখানে অন্তঃসত্ত্ব বসে আছি দশ মাস কবে যে অতীত | বাইরে সঙ্কট বাড়ে | শুনি কালচক্রের ঘর্ষণ আমি আছি, তবু নেই ! এই আজ জীবনদর্শন |