আধুনিকতার বার্তা বয়ে নিয়ে আসে যবে পশ্চিমা বাতাস দেখা দেয় ভারতের তিন সিন্ধু উপকূলে তিনটি নগর মাদ্রাজ বোম্বাই আর কলকাতা প্রতীচীর নব কন্ঠস্বর তিনটিতে মিশে আছে দূর আতলান্তিকের নিঃশ্বাস প্রশ্বাস |
কলকাতা আরো বড়ো | এখানেই সাগরের জোয়ারের সাথে গঙ্গা মিলিয়েছে তার হিমাচল শিখরের চিরন্তনী বাণী | গঙ্গা আর সাগরের মিলে যাওয়া ধ্বনি হেথা করে কানাকানি দুই যুগ দুই দেশ সভ্যতার বিনিময় করে দুই হাতে |
তুমি নও অতীতের তুমি নও কুলীনের উত্তরাধিকারী তুমি কুলপ্রবর্তক আধুনিক সংস্কৃতির তুমিই অগ্রণী রেনেসাঁসে তুমি শীর্ষে, সংস্কারে ও বিপ্লবেও তুমি শিরোমণি সাম্য আর স্বাধীনতা দুই ধ্বজা দুই ভূজে তুমি ধ্বজাধারী |
হিংসাতেও তুমি সেরা | গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং তোমারি কলঙ্ক তারই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া দেশভাগ লোকভাগ মানুষ বিপন্ন | তোমারি রাক্ষসী ক্ষুধা গ্রাম থেকে টেনে আনে নিরন্নের অন্ন তোমার সর্বাঙ্গে মাখা গঙ্গামৃত্তিকার সাথে দুর্নীতির পঙ্ক |
সাহেবরা চলে গেছে, সাহেবিয়ানা তো আরো বেড়ে গেছে বেশী মাতঙ্গীর পূজা করে মণ্ডপে মণ্ডপে আজ অ্যান্টনী ফিরিঙ্গী টুইস্ট নাচন নাচে বিসর্জনে ঘুরে ঘুরে নন্দী আর ভৃঙ্গী ওদিকে বাজায় খোল হরিবোল হরিবোল মার্কিন বিদেশী |
বাবুস্থানে বাবুধানী বাঙালীজাতির তুমি মহাতীর্থ মক্কা এখনো তোমার প্রিয় যাত্রা আর সঙ আর পাঁচালী ও টপ্পা | গঙ্গা ভ্যালী সভ্যতার তুমিই মোহেঞ্জোদারো, তুমিই হরপ্পা তুমি যদি লুপ্ত হও সাথে সাথে আমরাও পাব জানি অক্কা . হাঁকি তাই, ফরক্কা ! ফরক্কা ! . বিশ্ব ব্যাঙ্ক, করো এসে রক্ষা |
মন্টু ‘আজি কী মুরতি হেরিনু তোমার----” মশার জ্বালায় হই জেরবার | হাত চুলকায় পা চুলকায় চুপ ক’রে বসা হলো দেখি দায় | তাই বলে কত পায়চারি করি বাইরে আঁধার পা বাড়াতে ডরি | ঘন জঙ্গল ঘেরা চারি ধার অদ্ ভুত তার পাতার বাহার কিন্তু যাদের লোকে ‘লতা’ বলে তাদের বিহার বারান্দাতলে | মশার কামড় বিরক্তিকর তা বলে কি খাব ‘লতা’-র কামড় ! জঙ্গীপুরের ডাকবাংলায় সঙ্গীবিহীন প্রাণ যদি যায় তবেই হয়েছে ! তার চেয়ে ভালো হ্যাজাগ্ বাতিটা আরো জোরে জ্বালো | বেয়ারা ! বেয়ারা !---- কোথায় বেয়ারা ! চাপরাশিটারও দেখিনে চেহারা | খাইয়ে আমাকে ওরা গেছে খেতে কেউ কোথা নেই এ রাতে-বিরেতে | ঘুম আসে নাকো রাত দশটায় মশারি খাটিয়ে গরম বেজায় | ফাইল ! ফাইল ! চারি দিকে স্তূপ দেখলেই চোখ ব্যথা করে খুব | তার চেয়ে ভালো গুন গুন করা যত রাজ্যের কবিতা ও ছড়া | “হে মাতঃ বঙ্গ শ্যামল অঙ্গ----”
[ অতিথির প্রবেশ ]
কে ? কে ? কে আসছে ওই পা টিপে পা টিপে ? টর্চের বাতি জ্বলে আর নিবে | . কে ? কে ?
শৈলেশ আমি শৈলেশ | চিনতে পারলে ? পারলে না ? কবে কলেজ ছাড়লে মনে পড়ে? প্রায় একুশ বছর পাইনিকো ভাই তোমার খবর |
মন্টু শৈলেশ ? ওহো ! শৈলেশ পাল তুমি এইখানে !আহা ! কত কাল পরে দেখা হলো তোমার সঙ্গে ! আরে বোসো বোসো | হঠাৎ বঙ্গে এরূপ স্থানে যে আশাই করিনি | তাই তো ভাবছি চিনি কি না চিনি |
শৈলেশ বেহারেই থাকি | তবে মাঝে মাঝে এদিকেও আসি জমিদারি কাজে | শুনলুম তুমি এসেছ বেড়াতে ভাবলুম যাই দেখা করি সাথে | সময়ও বুঝি হয়েছে বেয়াড়া বদলেও গেছে আমার চেহারা | তবু যে চিনেছ এই যথেষ্ট, না যদি চিনতে সেও অদেষ্ট | তুমি বড়লোক-----
মন্টু আমি বড়লোক ! আর হাসিয়ো না | ওসব ঠাট্টা ঢের আছে শোনা |
শৈলেশ কেন ভাই ! কেন ! কত বড় পদ ! পদের সঙ্গে নেই সম্পদ ?
মন্টু পদমর্যাদা রাখতে রাখতে কোথা চলে যায় রূপোর চাকতি ! মাসের অন্তে সব বাড়ন্ত তবু লোকে বলে ভাগ্যবন্ত !
শৈলেশ তুমি ওকথা বলো যদি ভাই আমরা সকলে কোতা তবে যাই ! জমিদারি উঠে যাবার দাখিল ম্যানেজারি গেলে আঁধার নিখিল ! লক্ষ্মী ছাড়ে তো ষষ্ঠী ছাড়ে না বয়স বাড়ে তো শক্তি বাড়ে না | থাক গে ওসব বলতে আসিনি রসনাটা নয় মধুরভাষিণী | অনেক দিন তো যাোনি ওদিকে বন্ধুরা সাড়া পায় নাকো লিখে | এসে একবার ছুটিতে ছাটাতে বেহারে দু’দিন সময় কাটাতে |
মন্টু ইচ্ছে তো আছে | ছুটি মিলবে কি ? বন্ধুরা আছে কে কোথায় দেখি | কে কী হয়েছে ? কে কী করছে ? সুখে সাফল্যে জীবন ভরছে ? কোথায় প্রভাত ? মুকুন্দ সেন ? নওলকিশোর ? নাজিম হুসেন ? কামতা বঙ্কু কোথা এরা সব ? খোঁড়া হেমন্ত ? পাগলা কেশব?
শৈলেশ এই তো স্মরণ রেখেছ, মন্টু | বাদ পড়ে কেন বুড়ো ও ঝন্টু ? বেঁচে আছে ওরা সব ক’জনেই রণজিৎ লালা সেই শুধু নেই |
মন্টু পড়েছি, পড়েছি শোকসংবাদ চিকিত্সকের বিষম প্রমাদ | সেই শুধু নেই | সেই শুধু নেই ! কোথায় গেল সে জিজ্ঞাসা এই |
শৈলেশ থাক গে ওসব বৃথা জিজ্ঞাসা বাড়ীখানা লালা হাঁকিয়েছে খাসা | ব্যাঙ্কে নগদ রেখে গেছে ঢের ভাবনা কেবল গৃহবিবাদের | মুকুন্দ, জানো, ডেপুটি হয়েছে ‘সাব’ খসে গেল অনেক বয়েসে | প্রভাত এখন মস্ত হাকিম মস্তকে তার কত শত স্কীম | নাজিম হুসেন পাকিস্তাঁ গিয়ে ভুল করেছিল, এসেছে পালিয়ে | খান থেকে নোকরিটা নেই | লোকে ভালবাসে, মূলধন এই | নওলকিশোর ভূমিহার নয় মনের দুঃখ মনে চেপে রয় | চাকা ঘুরে গেলে উঠবে উপরে দল নিয়ে আছে, প্র্যাকটিস করে | খোঁড়া হেমন্ত খোঁড়ায় না আর সারা বেলা করে মোটর বিহার মোটরগাড়ীর এজেন্সী নিয়ে কী ফোলা ফুলেছে মুটিয়ে মুটিয়ে ! ঐ যে তোমার পাগলা কেশব আশা করি ভুলে যাওনি সে-সব | সে-সব ব্যাপার ধুয়ে মুছে গেছে কেশব এখন সিনেমা খুলেছে | পুরুষ না হয়ে নারী হলে আজ বেচারির হতো পতিতা সমাজ |
মন্টু মোটের উপর জীবন আহবে ভালোই করেছে বন্ধুরা সবে |
মন্টু আমাদের গেছে সে একদিন তখন ছিলাম কেমন স্বাধীন ! কত যে স্বপন কত কল্পনা আকাশেতে আঁকা কত আল্ পনা ! সেদিনের চোখে দুনিয়াকে আর যায় না দেখা | এ দোষটা কার !
শৈলেশ কী দেখতে চাও ? কী দেখবে বলো ?
মন্টু সেও ভুলে গেছি কত কাল হলো | কী যে আজ চাই ! কী পাওয়া বাকী | বুঝিনে, বুঝতে পারিনে সেটা কী | আরো ধন নয়, আরো মান নয়, আরো আয়ু নয়, আরো প্রাণ নয় ! তবে কী ! তবে কী ! কী আমার চাই ! সব আছে, তবু কী আমার নাই !
শৈলেশ গুরু করেছ কি ? দীক্ষা নিয়েছ ? দেবতাকে তাঁর প্রাপ্য দিয়েছ ?
মন্টু ধর্মে আমার হলো নাকো মতি ভাবিনে কী হবে পরকালে গতি | ইহকালে যদি না জানি বাঁচতে পরকালে কেন চাইব নাচতে ?
শৈলেশ আমি বলি তুমি নাম জপ করো ক্রতু আর কৃত আজ হতে স্মরো জীবনের আর ক’টা দিন বাকী ! দিতে যদি চাও শমনকে ফাঁকি তবে জপ করো ঠাকুরের নাম তা হলেই যাবে কৈবল্যধাম |
মন্টু ইহকালে যদি না জানি বাঁচতে কেন যাব কৈবল্য যাচতে !
শৈলেশ কী যে বলো আর হয় না অর্থ | ধর্মই সার | অসার মর্ত্য |
মন্টু ধর্ম না যদি বাঁচতে শেখায় তারে নিয়ে আমি করব কী, হায় ! জানি নাকো আমি কত দিন আছি বাঁচতে শিখব যত দিন বাঁচি | ধর্ম যদি-না বাঁচতে শেখায় শিল্পের কাছে যাব পুনরায় | দিবসরাত্রি সৃষ্টি যে করে রসমাধুর্য বৃষ্টি যে করে জীবন কি তার কখনো ফুরায় ! পেয়ালা যে তার বরে পুনরায় |
শৈলেশ আমি তো দিয়েছি ধর্মেই মন নয়তো পাগল হতে কতক্ষণ ! চারিদিকে দেখি ভূতের নৃত্য শত অবিচার নিত্য নিত্য | চৌর্যের জয়, কে কাকে ধরবে ! ছোট আর বড় অসাধু সর্বে | প্রতিকার নেই, জ্বলছে মর্ম তাই তো শরণ করেছি ধর্ম |
মন্টু ধর্ম না-যদি জানে প্রতিকার তবে কেন যাও ধর্মের দ্বার ?
শৈলেশ তবে তাই হোক, আমার ধর্ম সব ছেড়ে দিয়ে শিল্পকর্ম | আসবে না ফিরে তরুণ সময় অন্তর হবে তারুণ্যময় | প্রথম যৌবনের হলো ইতি দ্বিতীয় যৌবনের হবে স্থিতি |
শৈলেশ একদিন হবে তারও অন্ত শমনের দূত অতি দূরন্ত | পরলোকে যেতে নেবে কী পাথেয় ? শিল্প কি যাবে তোমার সাথেও ! ওপারের কথা কখন ভাববে মন যদি যায় গল্পে কাব্যে ! নাম যশ নিয়ে করবে কী, ভাই ! নাম জপ করো, সাথী হবে তাই |
মন্টু এপারেই যারা জীবন্মুক্ত সত্যের সাথে নিত্য যুক্ত সমান তাদের ইহপরকাল যেমন সকাল তেমনি বিকাল ! আমার মুক্তি নীরবে নিজনে অপ্রতিমের প্রতিমা সৃজনে |
শৈলেশ পাগল ! পাগল ! অসার যুক্তি নামজপ বিনা কোথায় মুক্তি ! কঠিন বাঁচন কঠিন মরণ তাই ধরি কষে গুরুর চরণ | পাপ যদি করি তিনিই ভরসা নইলে যে পরকালটি ফরসা |
মন্টু আমি ধ্যান করি পরম রূপের বীভত্সতাও তাঁরই হেরফের | তাঁকেই দেখেছি চোখ খোলা রেখে তাঁকেই এঁকেছি হাতে কালি মেখে | এ জীবনে তাঁরে দেখা আর আঁকা এই তো মুক্তি | আর সব ফাঁকা |