কবি আশা দেবীর কবিতা ও ছড়া
|
বিশ্বাস করো দাদা
কবি আশা দেবী
(শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও এখলাসউদ্দীন আহমদ সম্পাদিত “দুই বাংলার ছড়া” থেকে নেওয়া)
বিশ্বাস করো দাদা---
মনে কত আশা হরেকরকম,
বরাতে দোষে সকলই জখম
ডাল রুটি সাথে খেয়ে চম্ চম্
. সুর সাধি মা-মা-গা-ধা!
মনে হয় দাদা যাই চলে চাঁদে,
মোট ঘাট নিয়ে ঝঞ্ঝাট বাধে
. কপাল এমনি তরো ;
তার চেয়ে দাদা, এস যাওয়া যাক---
ত্রিকোণ পার্কে ঘুরি তিন পাক,
ঝঞ্ঝাট ল্যাঠা সব চুকে যাক
. ফুচকায় পেট ভরো।
. ************************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
মকরমুখো সাতটি ডিঙায়
কবি আশা দেবী
মকরমুখো সাতটি ডিঙায়
. পালটি দিয়ে তুলে
অরূপকুমার নীল সায়রে
. চলছে দুলে দুলে।
দেশ বিদেশের বেসাত করে
আনবে রতন ভরে,
ভানুমতীর দেশে গিয়ে
. ভিড়ল অচিন কূলে।
হালুম বাগা আছে বসে
. পিয়াল গাছের তলে,
কটমটিয়ে তাকিয়ে আছে
. ভাসছে নোলার জলে।
‘মানুষ এল আজকে খাসা
করব ফলার পেটটি ঠাসা’
হুম্ হুম্ হুম উঠল ডেকে
. ধরবে তারে ব’লে
বাগিয়ে অসি অরূপকুমার
. দারুণ লড়াই করে
তরোয়ালের খোঁচা খেয়ে
. বাগা গেল মরে।
রাজার মেয়ে হেসে হেসে
মালা দিলে গলায় এসে,
বললে. ‘আনো মটর গাড়ী
. তাতেই যাব চড়ে।’
. **********************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
ফড়িংয়ের বিয়ে
কবি আশা দেবী
ব্যাঙেদের সাত ভাই
. চলে ঠেলা-গাড়িতে
চলেছিল বিয়ে খেতে
. ফড়িঙের বাড়িতে।
বুড়ো ব্যাঙ ঠেলে গাড়ি
. থপ্ থপ্ পায়েতে
মোটা মোটা বুট পড়া
. লাল কোট গায়েতে।
বিয়েবাড়ি গিয়ে দেখে
. ভারি মজা ভাইরে,
সবাই বসেছে খেতে
. কারো পাতা নাইরে!
বর-বউ পালিয়েছে
. কাঁচকলা দেখিয়ে---
একপাল হাঁস শুধু
. হাসে প্যাঁক পেঁকিয়ে।
. **********************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
সত্যি বলছি
কবি আশা দেবী
সত্যি বলছি---আমিও ছিলাম রাজা,
গল্প এ নয়, নয়কো বানানো,
. নয় ভাং খেয়ে মগজ শানানো
কালীর দিব্যি---বলিস্ নি তুই :
. “বকিসনে বাজে, যা---যা!”
সত্যি বলছি কান পেতে শোন্---
. আমিও ছিলাম রাজা!
বুঝতিস্---যদি দেখতিস একবার!
সঙ্গে ঘুতো হুঁকোবর্দার,
মন্ত্রী, সেপাই আর চোপদার,
হাঁক দিলে ছুটে আসে সেনাপতি,
হাতে নিয়ে তলোয়ার,
রাজাসনে বসে তা দিতাম গোঁফে---
. দেখলি না একবার!
কী হল সেবার, শোন্ তার বিবরণ :
কোথা থেকে এল দস্যু দাকণ
নিরীহ প্রজাকে করে ফেলে খুন
লুটপাট করে---কেড়ে নেয় সব
. দেশ হল জ্বালাতন---
কেমনে সেটাকে করিনু ঠাণ্ডা
. শোন তার বিবরণ।
বলব কী তোকে---ব্যাটা যেন ভীমসেন!
ইয়া বড় গোঁফ---পায়েতে নাগরা
পেল্লায় ছাতি, বেজায় তাগড়া---
সোজা বলে এসে, “করব লড়াই---
. রাজা কোথা পালালেন ?”
সেনাপতি মোর টেনে দিলে ছুট---
. দেখে সেই ভীমসেন।
বেরিয়া এলাম হাঁকাহাঁকি শুনে তার---
ফস্ করে তাকে দিতে এক ল্যাং
পড়ে গেল সেটা---ভেঙ্গে গেল ঠ্যাং
যত প্রজা মোর নাছে ড্যাং ড্যাং
. ওঠে জয়-জয়কার---
আরে কোথা যাস্ ? মিথ্যে এ নয়
. বলছি তো বারবার---
রাজা সেজে আমি সে বছর গাঁয়ে
. করেছিনু থিয়েটার।
. **********************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
কবির অশ্বলাভ
কবি আশা দেবী
কাব্য শুনে বেজায় খুশী হলেন যখন সুলতান,
বলেন, “কবি, ছন্দে তোমার ধন্য হলো মূলতান।
কী চাও বলো---এক্ষুনি কি দেব হাজার তঙ্কা ?”
বলেন কবি. “টাকার নামেই জাগছে বেজায় শঙ্কা।
বাড়বে যে লোভ,---কলম দিয়ে বের হবে না কাব্য,
রাত্তির দিন কেবল আমি টাকার কথাই ভাববো।
মেহেরবাণি করেন যদি---একটি দেবেন অশ্ব,
চড়ব তাতে---হাটের থেকে অনেক কিনে শস্য।”
“একটি ঘোড়া দাও কবিকে”---হুকুম দুলেন সুলতান,
উজীর ছিলেন বেজায় ঘুঘু জ্বালিয়ে খেতেন মুলতান।
ভাবেন তিনি, “পদ্য লিখেই ঘোটক নেবে বত্স ?
দাঁড়াও কবি---আমি অনেক গভীর জলের মত্স্য।”
মরকুটে এক বুড়ো ঘোড়া মিলল কবির ভাগ্যে,
কবি ভাবেন---কী আর করা---যা জুটেছে যাকগে।
রাজসভাতে করবো নালিশ ? শেষকালে কি মরবো ?
উজীরটা যে ধূর্ত---মিছে শূলেই কেন চড়বো!
নওরোজেতে ঘোড়ায় চড়ে ঘোরেন পথে সুলতান,
খুশী মেজাজ---উত্সবেতে জমাট শহর মুলতান।
হঠাৎ দেখেন হাঁটেন কবি পাধুটো তার ক্লান্ত,
ডাকান তাঁকে---বলেন রেগে : “কেমন তুমি ভ্রান্ত!
ঘোড়া দিলাম তবুও কেন
. পাচ্চ হেঁটে কষ্ট ?”
বলেন কবি “কারণটা তার
. শুনুন হুজুর স্পষ্ট!
ঘোড়াটাকে শুইয়ে খাটে
. টিপছি কেবল তার পা,
ভালো খাবার দিচ্ছি এনে
. পছন্দসই তার যা।”
“পাগল নাকি ? তোমার মত
. এমন খাজা নেই তো---
ঘোড়ার কিনা জামাই আদর!”
. “ব্যাপার হুজুর সেই তো!
ঘোড়া ভালোই, একটু কেবল ল্যাংচা এবং বৃদ্ধ
গুরুজনের পৃষ্ঠে চড়া শাস্ত্রে যে নিষিদ্ধ।
বয়েসে সে অনের বড়ো, মানবো না কি ধর্ম ?
জ্যাঠা- খুড়োর চড়বো কাঁধে ? এটা কেমন কর্ম ?”
ঘাড়টি ধরে উজীরটিকে তাড়িয়ে দিলেন সুলতান,
কবির তেজী আরবী ঘোড়া কাঁপিয়ে ছোটে মূলতান।
. **********************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
আষাঢ়ে
কবি আশা দেবী
বঙ্কিমচন্দ্র সেন সম্পাদিত দেশ পত্রিকার শ্রাবণ ১৩৫০ (জুলাই ১৯৪৩) সংখ্যায় প্রকাশিত।
আশাঢ়ে অঝোর ঝরে আঁখি বিরহীর,---
স্বপনে জাগিয়া রহে গোপন প্রেয়সী ;
পুঞ্জব্যথা উচ্ছ্বসিত-হয়ে অশ্রুনীর---
খুঁজি’ ফিরে, কোথা আজি রহিলে উর্বশী!
বিরহের দাবানলে দগ্ধ হিয়া তার ;
প্রতীক্ষায় ব্যাকুলিত শত বিভাবরী
কেটে যায় নিরাশার তলে বারেবার,
আশার দেউটি জ্বলে-শূন্যতারে ভরি।
মায়ার মূরতি প্রায়, দূরে থেকে হায়---
কল্পনার উপবনে ভোর গোধূলিতে
শুধু কি সঞ্চরি’ যাবে? মিলন আশায়
জ্বলিবে অনল তব প্রেমিকের চিতে?
চঞ্চলা প্রেয়সী, জাগো স্মরণে-নয়নে,
বিরহীর অস্রুজলে বিনিদ্র শয়নে।
. **********************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
মুক্তি
কবি আশা দেবী
যামিনীমোহন কর সম্পাদিত মাসিক বসুমতী পত্রিকার পৌষ ১৩৫২ (ডিসেম্বর ১৯৪৫)
সংখ্যায় প্রকাশিত।
গান কি হোয়েছে গাওয়া?
দেখ না কি চেয়ে শ্যাম বন-পথ
. ঝরা ফুলদলে ছাওয়া।
বসন্ত চলে গিয়েছে অনেকক্ষণ
ভারি আবাহনে ঊষর ধরণী রহস্যে নিমগন।
. খাঁচায় রুদ্ধ কুহু
. ডাকিছে মুহুর্ম্মুহু
দলা-তৃণ-পথে পদরেখা কার
পথিক-বধুরে ডাকে বার বার,
না-বলা ব্যথায় গুমরি যেন রে
. উঠিতেছে ঝোড়ো হাওয়া
. গান কি হোয়েছে গাওয়া?
. আজ শুধায়ো না বাণী
না-করা যে কাজ না-বলা যে ব্যথা
. পড়ে থাক পীছে রাণী।
তোমার মাঝারে নিজেরে হারায়ে
. খুঁজে মরি আমি মিছে
আমার ছায়ারে আমি চিনি নাই
. খুঁজিয়া মরিনু পিছে।
তুমি মোর কেহ নহ?
এ কি ব্যথা দুঃসহ
পাষাণ স্তব্ধ মোর ব্যথা-ভার বহি,
জলহারা মেঘ বিদ্যুত্হীন
. জেগে রয় সে বিরহী।
ঝরেছে শেফালী শিশির-নয়না
. ধূলিলীনা অভিমানী---
. আজ শুধয়ো না বাণী।
মুক্ত তুমি যে আজ
বাঁধি নাই তোমা কোন বন্ধনে
. পরি নাই কোন সাজ,
সবার মাঝারে তোমারে করিব নত?
নিঠুর বেদনা আসিবে অযুত
. আঘাত আসিবে শত।
মিলন-মধুর গান
হোক তবে অবসান,
ফিরে চ’লে যাও বিজয়ী পথিক
. সমাপ্ত তব কাজ---
মুক্তি দিয়েছি হে চির-যাত্রী
. মুক্ত তুমি যে আজ॥
. **********************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
হে সূর্য্যরথী
কবি আশা দেবী
যামিনীমোহন কর সম্পাদিত মাসিক বসুমতী পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৫২ (ফেব্রুয়ারী ১৯৪৬)
সংখ্যায় প্রকাশিত।
মহাকাল রথঘর্ঘর ধ্বনি বাতাসে উঠিছে বাজি,
গণজনতার বুকের রক্তে সরণি রয়েছে সাজি।
হে সূর্য্যরথী তুমি এসো নামি রাঙা আল্পনা পরে,
তোমার আমার আগমনী গান মন্দ্রিছে ঘরে ঘরে॥
এসো গো হে তুমি দীপ্ত দীপ্তি অন্ধ জড়তা নাশি,
অমৃত কিরণে মৃত্যু-মলিন তমিস্রা উদ্ভাসি,
নিয়ে এস সাথে নূতন মন্দ্র চির নবীনের গান,
করোটি বক্ষে জাগুক আবার নবীন আশার বান।
জ্যোতি-হারা মহাব্যোম শূন্যেতে তুমি জ্বেলে দাও শিখা
ধরিত্রী-বুকে এঁকে দাও নিতি সোনার পত্রলিখা।
রথচক্রের ঘূর্ণনে তব ঘোরে জরা-যৌবন,
তব ভ্রুকুটিতে অনাহত-কাল করিছে চংক্রমণ।
শিশু অতীতের মধুর কণ্ঠে শুনেছিলে সাম গান,
যুগ-সমুদ্র-মন্থনে আজ সে প্রভাতী অবসান।
তব অশ্বের হ্রেষাধ্বনি শুনি, স্তব্ধ কাকলী রব,
জরার্ত্ত ধরা কেঁপে ওঠে ত্রাসে শ্মশানে কাঁপিছে শব।
হে সূর্য্যরথী তুমি কি দেখেছ অস্থিচূর্ণ ধূলি?
ঘূর্ণি হাওয়ার হাহাকার ওড়ে দিগন্ত সমাকুলি,
তপ্ত অশ্রু করিছে পূর্ণ শূন্য নদীর জল,
তুমি কি শুনেছ জীব-দানবের উন্মাদ কোলাহল।
লক্ষ বুকের লাক্ষা রঙিল কঙ্কাল স্তূপ পরে,
সূর্য্যমুখীরা নয়ন মেলিছে নব-প্রভাতের তরে।
যুগবিপ্লবী অভিজিৎ জাগে ভাঙি বাধা-বন্ধন,
সূর্য্য-সারথি তুমি এসো নামি গাহি তব আবাহন।
. **********************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
আকাশ-প্রদীপ
কবি আশা দেবী
যামিনীমোহন কর সম্পাদিত মাসিক বসুমতী পত্রিকার চৈত্র ১৩৫২ (মার্চ ১৯৪৬) সংখ্যায়
প্রকাশিত।
কভু নিশীথ চাঁদের দেশে সন্ধ্যাতারা
ছিস একলা জেগে সে কি তন্দ্রাহারা
. ম্লান শিশির শাখে
. একা পাখী সে ডাকে
“ফিরে এসো প্রিয় ঘরে দাও গো সাড়া॥”
তবু পাইনের শিরে আসে স্বপ্ন ঘিরে
বন মরালের দল আসিছে ফিরে
. মোর দেউল-তলে
. স্মৃতি-প্রদীপ জ্বলে
একা পাষাণ-দেবতা সেথা জাগিছে কি রে?
কেন আমার জীবন ঘিরে নামিছে ছায়া,
. যদি বা বাসর নিশি রচে না মায়া।
. আজ আমার নীড়ে
. শুধু মরণ ফিরে
. পরিহাস আনে বহি জীর্ণ কায়া।
যেন সে ছিল আমার প্রিয় কল্প লোকে,
তারি বেদনা স্মরি ধারা নামলো চোখে।
. আজ গোধূলি-বেলায়
. মোর মরণ-খেলায়
কোন স্তব্ধ চরণ বাণী হারালো মুখে॥
আজ আমার কুহেলি-ঘেরা গগন-তলে,
মোর ব্যথার আকাশ-দীপ একেলা জ্বলে।
. আজ আমার মনে
. কোন নিভৃত কোণে
কবে হারানো স্মৃতির মণি আঁধারে ঝলে॥
প্রিয় জানি তুমি গেছ চ’লে নিশীথ-প্রাতে,
. আজিকার মধুরাতি গিয়াছে সাথে।
. শুধু আমার ঘরে
. ব্যথা গুমরি মরে
শুধু আকাশ-প্রদীপ নেবে ঝঞ্ঝা-রাতে॥
. **********************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
রাতের গান
কবি আশা দেবী
যামিনীমোহন কর সম্পাদিত মাসিক বসুমতী পত্রিকার বৈশাখ ১৩৫৩ (এপ্রিল ১৯৪৬)
সংখ্যায় প্রকাশিত।
যবে তুমি চলে গেলে দূর বিদেশে,
মরা চাঁদ ডুবে গেল ক্লান্ত হেসে।
পথে চলা পদধ্বনি শুনিয়া কানে,
রাতের চাঁদোয়া সরে কোথা কে জানে।
নিথর পাহাড় ঘেরা গ্রামখানিরে,