কবি আশা দেবীর কবিতা ও ছড়া
*
স্বপ্ন-শেষে
কবি আশা দেবী
যামিনীমোহন কর সম্পাদিত মাসিক বসুমতী পত্রিকার ভাদ্র ১৩৫৩ (অগাস্ট ১৯৪৬)
সংখ্যায় প্রকাশিত।


আমার মনের বালুবেলা প’রে
.                        যারা বেঁধেছিল বাসা,
অকাল-বাদলে মাতাল বন্যা
.                        ভেঙ্গেছে তাদের আশা।

.        ************************     


.                                                                               
সূচিতে . . .    




মিলনসাগর
*
তিস্তার বালুচর
কবি আশা দেবী
ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত “ভারতবর্ষ” পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৫৪ (ফেব্রুয়ারী ১৯৪৮)
সংখ্যায় প্রকাশিত।


.                তিস্তার বালুচর
ওপারে স্নিগ্ধ আমের ছায়ায় চাষীদের খড়ো ঘর।
.        ঘুরে ঘুরে ফেরে আহারান্বেশী
..                কত পাখীদের ঝাঁক
.        কাদা খোঁচা আর যুগল-চক্রবাক।
ঝির ঝির জল অভ্রের ফ্রেমে কাঁচের ছবির প্রায়
.                স্বপ্নেতে মন ছায়।
হিমালয়-গলা বরফ-ধারায় তন্বী দেহটি ঘিরে
মৃত্যুর মত শীতলতা তার অণুতে অণুতে ঘিরে
.                তিস্তার বালুচর,
বরষা প্লাবনে তারে ঘিরে বাজে মেঘ-মন্দ্রিত স্বর।
.        বন্ধ্যা মাটিতে মধুভরা স্নেহধারা
হিমগিরি-ভাঙা পাগল-ঝর্ণা নিসঙ্গ পথহারা।

.                রাত্রে স্বপ্নে দেখি
নীল স্রোত বেয়ে চৌধুরাণীর ডিঙ্গা চলেছে একি?
দূর বলাকার পাখার মতন আকাশেতে পাল ওড়ে---
.                কালের চক্র ঘোরে
হাজারো মশালে রাঙা হয়ে যায়
.                নিশীথের কালো জল
কালো তরঙ্গ হেসে ওঠে খল খল।
নীল জলরাশি নাগিণীর মত দুলে দুলে করে খেলা।
বালুকার চরে জাগে স্পন্দন সৃষ্টির আহ্বানে,
.        বন্ধ্যা বালুকা উপহার বয়ে আনে
.                মুঠো মুঠো কাশফুল
শ্যামসী পাতায় শিশু তরমুজ দুলে ওঠে দুল্ দুল্।

.        তীরে বাসা বাঁধে ঘর ছাড়া পাখী
.                কাকলী মুখর তানে
.        মিশে যায় সেই আনন্দ-গীতি
.                তিস্তার কলগানে॥

.                  ************************     


.                                                                               
সূচিতে . . .    




মিলনসাগর
*
ব্যবধান
কবি আশা দেবী
যামিনীমোহন কর সম্পাদিত মাসিক বসুমতী পত্রিকার পৌষ ১৩৫৩ (ডিসেম্বর ১৯৪৬)
সংখ্যায় প্রকাশিত।


তুমি তো শিল্পী তোমার মনেতে ফুটিতেছে শতদল,
সুদূর-প্রসারী কল্পনা-রথে চলিয়াছ বিহ্বল।
মানস-বিহারে চলেছ মরাল রেখা রেবা-শিপ্রার তীরে।
নীড়ের মরালী ভাঙ্গিয়াছে ডানা তিতিছে নয়ন-নীরে।
হেথায় কঠিন বাস্তবে বাঁধা বন্য হরিণী আমি,
সোনার শিকল রুনু-ঝুনু বাজে চরণে দিবস-যামি।
ভুলে গেছি কোথা সমীর-স্বনিত ঝাউ বনানীর মায়া,
পাহাড়ী নদীর কুলু-কুলু গান শ্যাম দেবদ্রুমছায়া।
মনে পড়ে না তো গিরিদরী তীরে কারে বাসিয়াছি ভালো
ভুলে গেছি নাম কে দিল জ্বালায়ে প্রথম প্রেমের আলো
বেণু-বেতসের কুঞ্জ-কুটীরে কার ছায়া অঞ্চল,
সে দিনের স্মৃতি ফেলেছি ধূলায় মিশায়ে অশ্রুজল।
তুমি আছ বসে বাতায়ন-তলে নীল নভ পানে চাহি,
সমৃতিপটে জাগে অনামা নায়িকা প্রেম-নীরে অবগাহি।
রোগ-দাবে-দাহী কঙ্কাল তনু মৃত্যুর পল গণে,
অদেহী কাহারা দেখে ফিরে যায় নিশীথ পবন-স্বনে।
অর্দ্ধচেতনে আমি ভাবি মনে পোহাবে না অমা-রাতি!
একেলা শয়নে প্রাণ ইন্ধনে জ্বলিছে বুকের বাতি।
তোমার প্রিয়া কি তমাল কুঞ্জে আসিয়াছে অভিসারে
মুখরিছে তার মণি-মঞ্জীর ঝিল্লীর ঝঙ্কারে।
গভীর রজনী মৃত্যুর মত নিথর নীরব আজ
গড়িয়া উঠিছে ঘোর ব্যবধান তোমার আমার মাঝ
তোমার যাত্রা দূর মেঘলোকে আমি যে মর্ত্ত্যচারী,
আকাশ ধরার মাঝেতে কেবল ভরা শ্রাবণের বারি।

.                  ************************     


.                                                                               
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বিষকন্যা
কবি আশা দেবী
ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ভারতবর্ষ পত্রিকার শ্রাবণ ১৩৫৪ (অগাস্ট ১৯৪৭)
সংখ্যায় প্রকাশিত। মিলনসাগরে সংযোজন ১৫.৯.২০১৬।


হে রূপসী তব উষর বুকের মাঝে,
ফোটে নাকি সেথা কামনার শতদল---
অকারণে কভু বিমনা হো না সাঁঝে?
গোধূলি আঁধারে হো নাকি বিহ্বল?
তুলসীর মূলে জ্বালো নাকি তুমি আলো,
সন্ধ্যা-শঙ্খ বাজে না তোমার ঘরে?
নিশার আঁধারে শুধু ছায়া কালো কালো
ঘুরে মরে শুধু তব অঙ্গন পরে।
চক্ষে তোমার নীল-কাজল-রেখা,
সে যে মরীচিকা---সাহারার মায়া রাগ,
লীলালক্তকে কার শোণিতের লেখা,
আলুল-বেণীতে গর্জায় কাল-নাগ।
হে বিষকন্যা, একি খেলা অভিনব!
ছলনা তোমার নিত্য নূতনতরো।

একি অভিসারী সজ্জা রচেছ নব,
হে মৃত্যুরূপা---মানসী মূরতি ধরো।
হে ছলনাময়ী, হে অভিশপ্তা নারী!
তুমি চিরদিন জ্বালে মরুর বুকে তৃষা,
বাঁধ নাকে ঘর তুমি চিরপথচারী,
তোমার আকাশে ঘন দুর্যোগনিশা।
তব অভিমানে অশ্রু বারি যে ঝরে,
ধারা নয় সে তো তরল বহ্নি-জ্বালা,
তব নিশ্বাস ওড়ে বৈশাখী ঝড়ে,
ঝরা-উল্কায় তোমারি ছিন্নমালা।
হে স্বর্ণমৃগ, তোমার বিনাশ নাই,
তিন তিল বিষে তুমি যে তিলোত্তমা,
কত ট্রয় কত কুরুবর্ষেতে তাই,
জ্বলে তব রূপ কৃষ্ণ-বহ্নি সমা।

.               ************************     


.                                                                               
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
একা জেগে রয় পাণ্ডুর চাঁদ
কবি আশা দেবী
হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত সম্পাদিত বঙ্গশ্রী পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৫২ (মার্চ ১৯৪৬) সংখ্যায়
প্রকাশিত।
মিলনসাগরে সংযোজন ১৫.৯.২০১৬।


একা জেগে রয় পাণ্ডুর চাঁদ ম্লান আকাশের তলে
নীরব পাখায় নিশীথ মরাল উড়ে যায় দলে দলে।
অনাদিকালের বেদনা বাহিয়া একে একে দেয় দেখা
ইন্দ্রধনুর রঙ্গে যেন আঁকা স্মৃতির রক্ত-লেখা।

অখণ্ড কাল বিভাগ-বিহীন অপলক জাগরণ,
মহাকাল গলে অক্ষ-মালায় নিয়ত বিবর্ত্তন।
প্রলয় তিমিরে সহসা ফুটিল আলোকের শতদল,
রূপের মাঝারে অরূপ জাগিল মাতিল ধরণীতল।

নির্ম্মম আর কামনার বুকে অঙ্কুর হোয়ে ফুটি,
আলোর পথের যাত্রী আমরা তমোবন্ধন টুটি।
কোন সে মন্ত্রে অন্ধ ঝড়তা ভাঙ্গে বন্ধন ঘোর,
কোন সে মন্ত্রে পাইনু চেতনা ছিঁড়ি আবরণ ডোর!

হিমালয় বুকে টেরাইয়ের কোলে যেথায় ঘুমায় নদী,
সেথায় জাগিয়া শুক্লা রজনী রচে মৃত্যুর বেদী।
কল-ঝঙ্কারে পাগলা ঝোরার ধ্বনিছে রুদ্রতান,
শ্যামল শয়ানে বিহ্বলা মৃগী প্রিয়েরে শোনায় গান।

যৌবন সেথা আবরণহীন উদ্ধত উদ্দাম,
কর্ম্ম সেথায় মুখর চপল নাই সেথা বিশ্রাম।
স্নেহের বাঁধনে জড়ায়ে সেথায় আলেয়ার মোহ মায়া
নভোচারী মেঘ দূরে উড়ে যায়---নদী আঁকে বুকে ছায়া

সে পথে কি চলে একেলা পথিক ছিঁড়ে মোহ-বন্ধন,
ফিরে চল ঘরে বলে নাকি মন? বুকে জাগে ক্রন্দন?
মর্ম্মরব্যথা বাজে বনতলে---“ও-পথিক, ছাড় পথ,”
ছল ছল আঁখি জাগে বাতায়নে যাত্রী থামাও রথ॥

.               ************************     


.                                                                               
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
পরাজয়
কবি আশা দেবী
হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত সম্পাদিত বঙ্গশ্রী পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৫২ (মার্চ ১৯৪৬) সংখ্যায়
প্রকাশিত। মিলনসাগরে সংযোজন ১৫.৯.২০১৬।


জীবনের সাথে বার বার
.                        আজ বুঝি পরাজয়
চেন নাই তুমি নিজেরে আজিও
.                        শক্তি করেছ ক্ষয়।
তোমার আকাশে এলো না মাধবী
.                        ব্যর্থ বাসর নিশি,
মধু গুঞ্জনে হোল না মুখর
.                        স্তব্ধ সকল দিশি।
শ্রাবণ ধারায় হোল না সরস
.                        তোমার উষর মরু,
মুকুলিত শাখা করে হাহাকার
.                        নীরব শুষ্ক তরু।
মহাকাল আঁকে সুদূর নভেতে
.                        প্রলয় রক্তলিখা,
আলোহীন পথে জ্বালাও হে রথী
.                        আশায় প্রদীপ্শিখা।

.               ************************     


.                                                                               
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর