কবি অসীম (গিরি) বন্দ্যোপাধ্যায় -র আসল নাম অসীম কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় | জন্ম কলকাতার, চেতলার কর্পোরেশন হাসপাতালে | তাঁর ঠাকুমা কোনো একদিন তাকে ‘গিরি’ বলে ডেকেছিলেন, যা অসীম জানেনও না কবে! কিন্তু সেই থেকে পাড়ায় তাঁকে সবাই গিরি বলেই ডাকতে শুরু করে | ধীরে ধীরে তিনি অসীম গিরি নামেই পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর পিতা কানাইলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতা হেনা দেবী।
প্রথম থেকেই মায়ের অপূর্ব সুরেলা গলা এবং তাঁর পিতার এসরাজ ও তবলা বাজানো তাকে আচ্ছন্ন করে | বাড়ীতে সঙ্গীতের আবহাওয়ায় প্রভাবিত হয়ে গান শিখতে শুরু করেন | কিন্তু হারমোনিয়াম বাজানো নিষেধ, তানপুরায় শিখতে হবে! ফলে অসীম অসুবিধায় পড়েন | সে অসুবিধা আজও আছে |
ঢাকুরিয়া রামকৃষ্ণ বিদ্যাপীঠ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ ক’রে, সায়েন্স নিয়ে ভর্ত্তি হন আশুতোষ কলেজে ১৯৭৪ সালে | অত্যন্ত অল্প বয়সে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করায় সকলেই চমকিত হন | বাড়ীর তীব্র দারিদ্র তাকে আটকাতে পারেনি | সায়েন্স ছেড়ে বাংলা পড়েন | যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ ও বি.এড পাশের পর কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছেন | তারপর কলকাতার একটি নামকরা ইংরিজি মাধ্যম স্কুলে বাংলা ভাষার শিক্ষকতার চাকরি নেন |
১৯৭০--এর দশকের রাজনৈতিক আবর্ত তাকে আকৃষ্ট করলেও তখনও তিনি অত্যন্ত ছোট | তবু বামপন্থী রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে, পাড়ায় গননাট্য সংঘে নাটক, গান শুরু করেন। পরে রাজনীতির বিভাজনে (মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির থেকে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ কমিউনিস্ট পার্টির জন্মের সময়ে ) তিনি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন।
শেষে ব়্যাডিক্যাল বামপন্থী রাজনীতিতেই আকৃষ্ট হয়ে সুরেশ বিশ্বাসের কাছে গণ সঙ্গীত গাইতে শুরু করেন |
১৯৭৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর দ্বারা কায়েম করা “এমার্জেন্সী” বা জরুরী অবস্থা-র সময়ে কিছুদিনের জন্য গ্রেপ্তারও হন কিশোর বয়সেই | নানা আন্দোলনে গান গাইছেন ১৯৭৪ সাল থেকে | ক্রমশঃ চারণ হয়ে ওঠেন | নির্মলেন্দু চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, কমল সরকার, পরেশ ধর, দিলীপ বাগচী, প্রমুখদের সংস্পর্শে আসেন | এমন কি ভূপেন হাজারিকার সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ ছিল এক সময় | বাউল-ফকির, লোকগান, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গানের সঙ্গে তাঁর শরীরি ভাষাকে কাজে লাগিয়ে রীতিমত পারফরমিং আর্টিস্ট হয়ে ওঠেন |
কিন্তু তাঁর সত্তায় বিদ্রোহ থাকায়, সব রাজনৈতিক দলেরই বিরাগভাজন হন তিনি |
রাজার হাট, কানোরিয়া, বাউরিয়া সহ ব্যাপকভাবে গ্রামাঞ্চলে ঘুরে ঘুরে লোকগান সংগ্রহ করতে গিয়ে কৃষক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া তার জীবনে নতুন মোড় এনে দেয় | অবশেষে পরিচয় হয় সুমন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যিনি বর্তমানে কবীর সুমন নামে খ্যাত | সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-লালগড় আন্দোলনে তিনি সুমনের সঙ্গী থেকেছেন |
একটা সময় এমন ছিল যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনশন মঞ্চে ২৬ দিনের মধ্যে ২৪ দিন টানা গান গেয়েছেন | মমতার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ ঘুরে বেরিয়েছেন | আমরা সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়ে অসীমকে দেখেছি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কৃষিজীবী কমিটির প্রায় প্রতিটি মিটিঙে মিছিলে আন্দোলনের “স্টার-সিংগার” হিসেবে। যে কোনো সভায় প্রথমে একে একে সব বক্তারা তাঁদের বক্তব্য রাখতেন। গায়ক বা গায়ক-দল তাঁদের গান গাইতেন, কবিরা কবিতা পাঠ করতেন। সব শেষে মাইক ধরতেন আন্দোলনের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি কিছুটা বক্তব্য রাখার পরই বলতেন "...অসীম, একটা গান গাও!” তখন অসীম মঞ্চে উঠে গান গাইতে শুরু করতেন এবং সমবেত মণ্ডলীকে সেই প্রচণ্ড আন্দোলনের মেজাজে মাতিয়ে তুলতেন। আকাশ-ফাটানো করতালি দিয়ে তাঁর গান শেষ হলে আবার নেত্রী মমতা মাইক তুলে তাঁর বাকি বক্তব্য রাখতেন এবং সভার সমাপ্তি ঘোষণা করতেন। এটাই নিয়ম ছিল সেই আন্দোলনের।
কালের কি পরিহাস! আজ অসীম গিরি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সহযোগীদের কাছে ব্রাত্য ও অস্পৃশ্য | কারণটা তাঁরও অজানা। হয়তো কবীর সুমনের মতোই, ভালবাসা ও বিদ্রোহের রঙে নিজেকে রাঙ্গাতে চেয়েছেন বলে !
তখনকার বিরোধী পক্ষ এখন সরকার পক্ষ! কিন্তু এখন তাঁদের সভা সমিতিতে আর অসীমের মত সেই সব মানুষদের দেখতে পাওয়া যায় না যাঁরা কোনো কিছু পাওয়ার আশা না করেই সেই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। এমনকি তাঁদের গানও আজ সরকার পক্ষের কাছে ব্রাত্য! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই ২০১১র নির্বাচনের শেষ মুখে এসে, তাঁর দলকে বলেছিলেন শুধু রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজাতে! এটা যে কবীর সুমন, দেবাশিস রায়, অসীম গিরিদের মত মানুষের গান বন্ধ করে দেবার জন্যই তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পৃথিবীর ইতিহাসে কোত্থাও এমন খুঁজে পাওয়া যাবে না যে আন্দোলনকারীরা আন্দোলনের শেষে নিজেরাই নিজেদের আন্দোলন থেকে উঠে আসা গান, কবিতা, সাহিত্যকে মুছে দেবার চেষ্টা করেছে, যেমন সিঙ্গুর- নন্দীগ্রাম আন্দোলনকারীরা করলো!
এখন সরকার পক্ষের আসর যাঁরা মাতায় তাঁদের মধ্যে একদা বামফ্রন্টের ধামাধরা গায়ক-শিল্পীদের সংখ্যাই বেশী! যাঁরা আন্দোলনের দুর্দিনে, বামফ্রন্টের হাড়হিম করা সন্ত্রাসকে পরোয়া না করে, সেই দুর্বার আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন, তাঁরাই কেন আন্দোলন শেষ হতেই ব্রাত্য হয়ে পড়লেন ? এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে ? মা মাটি মানুষের নামে যে আন্দোলন, তার শেষে তারাই যে শুধু সেলিব্রিটিদের মাথায় করে নাচবে (তা সে যত নির্লজ্জ্বভাবে বামফ্রন্টের সমর্থন করে থাকুক না কেন) আর অপেক্ষাকৃত কম খ্যাতদের, কোন এক অজ্ঞাত কারণবশতঃ অবজ্ঞার আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবার চেষ্টা করবে, এটা কে জানতো!
কবীর সুমন তাঁর “নিশানের নাম তাপসী মালিক” বইতে লিখেছেন ... “যে অসীম গিরি সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়ে তাঁর গণগান ও ভাষণ দিয়ে জনতাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, তিন বছর ধরে চাকরি ও প্রাণের মায়া ছেড়ে যিনি ছুটে গিয়েছেন “নেতার” ডাকে, আন্দোলনের ডাকে রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে, কৃষিজমিরক্ষা কমিটির প্রতিটি সভায় যিনি থেকেছেন উপস্থিত, মেট্রো চ্যানেলের প্রতিটি সভায় যিনি সক্রিয় অংশ নিয়েছেন, তাঁকে কি সুন্দর ভুলে মেরে দেওয়া হল। নন্দীগ্রামের বার্ষিকী উদযাপনে নেতা- অনুমোদিত রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক কোনও দলই তাঁকে ডেকে নিলেন না। ডাক পড়ে নি এই বান্দারও--- এক সময়ে যাকে অসীমের চেয়েও বেশি ব্যবহার করা হয়েছিল। কোনও শিরোপা বা কোনও কমিটির অমুক-তমুক পদের আশায় এ-দেশের অসীম গিরিরা লড়াই করেন না।” - পৃষ্ঠা ৬১।
অসীম গিরি সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের এমন একটি ব্যক্তিত্ব যে সমকালীন সাহিত্যিকদের উদ্বুদ্ধ করেছে, তাঁদের রচনায় তাঁর চরিত্রকে ধরে রাখতে। কবি ও ঔপন্যাসিক মানিক মণ্ডলের সিঙ্গুর আন্দোলনের পটভূমিকায় লেখা উপন্যাস “ভালো নেই” তে আমরা অসীমের উপস্থিতি দেখতে পাই। তাঁর পরবর্তী উপন্যাস “জল জমি জঙ্গল” এ এই অসীমই একটি বড় চরিত্র!
কবীর সুমন তাঁর “নিশানের নাম তাপসী মালিক” বইটি যাঁদের উত্সর্গ করেছেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম নামটিই হল “বন্ধু, গণ-আন্দোলন কর্মী অসীম গিরি”। কবীর সুমন, অসীমের গায়কী সম্পর্কে লিখেছেন ... “সেই সভায় গান গেয়েছিলেন অসীম গিরি। আমিও ভাষণের সঙ্গে একটি গান গেছিলাম। কিন্তু অসীম তাঁর গানের একটি মোক্ষম লাইনের সুর এমন বলিষ্ঠভাবে বেশ খানিকক্ষণ এক নিঃশ্বাসে ধরে রাখলেন যে হাজার হাজার গ্রামবাসী হাততালি দিয়ে উঠলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে।” পৃষ্ঠা ১১৫। এই পাতারই আরেক জায়গায় লেখা... “যতদূর মনে পড়ছে ফেরার সময়ে অসীম মমতার গাড়ীতেই উঠেছেন।” এই বইয়েরই অন্য এক জায়গায় কবীর সুমন লিখেছেন যে অসীম গিরি মোটেও চাইছিলেন না যে তিনি ভোটে (২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচন) দাঁড়ান। - পৃষ্ঠা ২২৯। তা থেকেই বোঝা যায় যে অসীম গিরি কোনো কিছু পাবার আশায় আন্দোলনে আসেন নি এবং চাইতেন না যে অন্যরা তা করুক।
অসীম গিরির প্রথম গানের এলবাম “নন্দীগ্রাম টু মেগাসিটি” ২০০৮ সালে বার হয়। তাঁর দ্রিতীয় এলবাম “রাস্তা থেকে” প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে | অত্যন্ত জনপ্রিয় শিল্পী এই চারণ গায়ক জনগনের কাছে প্রতিষ্ঠিত হন অসীম গিরি নামেই | অসীম গিরি শুধু গায়ক কবি হয়েই থেমে যান নি। তিনি নানা সময়ে, অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিষয়ের উপর, নানা প্রবন্ধ লিখে গেছেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।
অসীম গিরির গানের কথা সহজ সরল এবং রাজনৈতিক সময়ের সত্য-প্রতিফলন। গানের সুর মাটির গন্ধে ভরপুর কিন্তু আধুনিক। তার গানে যেন রাস্তার সাধারণ মানুষের মনের ভাবনার উচ্চারণ। সেই অর্থে তাঁর দ্বিতীয় সি.ডি. "রাস্তা থেকে"-র নামকরণ সম্পূর্ণ সার্থক। তাঁর গানে ও কবিতায় তিনি বেশীরভাগই কোনো সাংকেতিক ভাষার ব্যবহার করা প্রয়োজন বোধ করেন না। যা বলার তা সোজা সাপটা বলে দেন কারও পরোয়া না করেই। তাঁর গান থেকে কখনও রাজনীতিকে আলাদা করা যাবে না। মানুযের দুর্দশা আর রাজনীতি নিয়েই তিনি কথা বলেন তাঁর গানে। অথচ তাঁর গান কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলীয় স্লোগান ধরে লেখা হয় না! তাঁর গানে তিনি নিজেই গেয়েছেন "...ভাবতে চাই না বাম অথবা ডান..." বা "আমি বিদ্রোহী পতাকার রং নেই"। এমন কি "ব়্যাডিক্যাল" বামপন্থী মনোভাবাপন্ন মানুষ হয়েও একজন তথাকথিত দক্ষিণপন্থী দল-নেত্রীর নেতৃত্বে উদ্বুদ্ধ হয়ে গেয়েছেন "মমতা আপনি লড়ুন"। এমন সহজভাবে সত্যকে মেনে নেওয়ার দৃষ্টান্ত খুব বড় একটা দেখা যায় না। আবার অন্য অনেকের মত, নিজের সত্তা, চিন্তা, ভাবনা সম্পূর্ণভাবে বিসর্জ্জন দিয়ে, জিতে আসা দলে নাম লেখানোর কাজটিও করেন নি।
তাঁর গান কোনো কফিহাউসের আড্ডা-বিলাস প্রসূত কাব্য নয়। নয় কোন বাতানুকূল ড্রইং রুমের শীতল শান্ত ছায়ায় বসে লেখা গীত। তাঁর গান উঠে এসেছে রাস্তা থেকেই। তিনিই সগর্বে গাইতে পারেন "আমি চারণ তোমার সাথে যে যেখানে লড়" | কারণ তিনি তাই-ই। মুকুন্দ দাসের পর সারা বাংলা চষে বেড়ানো এমন চারণ আর ক'জন এসেছেন সেটা বিদ্বজ্জনেরা বলুন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোথাও কোথাও তার নাম উল্লেখ করলেও কোনো স্বীকৃতি দেননি | সে কথাই “নিশানের নাম তাপসী মালিক”--গ্রন্থে তাঁকে উত্সর্গের মধ্য দিয়ে প্রমান করেছেন সুমন | বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর সম্পর্কে বহু আলোচনা বেরিয়েছে | কিন্তু বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে তিনি ব্রাত্য | “দলদাস” তিনি হবেন না কোনোদিন | গণগায়ক তথা মানবাধিকার কর্মীই রয়ে যাবেন এ প্রত্যয় তাঁর |
আমরা চাই এই কবি-শিল্পীকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হোক। যে অন্যায় তাঁর বিরুদ্ধে করা হয়েছে, যে ভাবে তাঁকে ব্যবহার করে, ক্ষমতায় এসে তাঁকে বিস্মৃতির ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, তা যেন শুধরে নেওয়া হয়। না হলে বাংলার ভবিষ্যত প্রজন্ম এই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের হোতাদের মাফ করবেন না।