কবি অশোকবিজয় রাহার কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
ফাল্গুন

ছিটকিনি নড়ে উপরের জানালায়,
একটু কবাট ফাঁক,
চুড়ির ঝিলিক একটু আলোর চিড়,-----
দুই খানি শাদা হাত :
দুইটি কবাট দুই দিকে স’রে যায়
গোধূলির আলো পাখা ঝাপটায় চোখে-মুখে-বুকে এসে
ধু-ধু হাওয়া খেলে এলোচুলে, পর্দায়  |


নদীর ও-পারে আকাশে আবির-ঝড়,
আলতা গলেছে জলে,
হাওয়া-জানালায় চোখে-মুখে কাঁপে ঝিকিমিকি আবছায়া,
ধু-ধু হাওয়া এলোচুলে,-----


দূরে এক কোণে পলাশের ডালে আগুন লেগেছে চাঁদে |


.                   ****************                                                            
উপরে   


মিলনসাগর
কবি অশোকবিজয় রাহার জন্ম শতবর্ষে মিলনসাগরের শ্রদ্ধাঞ্জলি
*
মায়াতরু

এক- যে ছিলো গাছ,
সন্ধে হ’লেই দু-হাত তুলে জুড়তো ভূতের নাচ |
আবার হঠাৎ কখন
বনের মাথায় ঝিলিক মেরে মেঘ উঠতো যখন
ভালুক হ’য়ে ঘাড় ফুলিয়ে করতো সে গরগর
বৃষ্টি হ’লেই আসতো আবার কম্প দিয়ে জ্বর |
এক পশলার শেষে
আবার যখন চাঁদ উঠতো হেসে
কোথায় বা সেই ভালুক গেলো, কোথায় বা সেই গাছ,
মুকুট হ’য়ে ঝাঁক বেঁধেছে লক্ষ হীরার মাছ |

ভোরবেলাকার আবছায়াতে কান্ড হ’তো কী-যে
ভেবে পাইনে নিজে,
সকাল হ’লো যেই
একটিও মাছ নেই,
কেবল দেখি প’ড়ে আছে ঝিকির-মিকির আলোর
রুপালি এক ঝালর |


.                   ****************                                                            
উপরে   


মিলনসাগর
*
ভাঙলো যখন দুপুরবেলার ঘুম

ভাঙলো যখন দুপুরবেলার ঘুম
পাহাড়-দেশের চারদিকে নিঃঝুম,
বিকেলবেলার সোনালি রোদ হাসে
গাছে পাতায় ঘাসে |
হঠাৎ শুনি ছোট্ট একটি শিস-----
কানের কাছে কে করে ফিসফিস ?
চমকে উঠে ঘাড় ফিরায়ে দেখি,
এ কী !
পাশেই আমার জানালাটাতে পরির শিশু দুটি
শিরীষ গাছের ডালের ‘পরে করছে ছুটোছুটি |


অবাক কান্ড------আরে !
চারটি চোখে ঝিলিক খেলে একটু পাতার আড়ে !
তুলতুলে গাল, টুকটুকে ঠোঁট, খুশির টুকরো দুটি
পিঠের ‘পরে পাখার লুটোপুটি,
একটু পরেই কানাকানি, একটু পরেই হাসি----
কচি পাতার বাঁশি-----
একটু পরেই পাতার ভিড়ে ধরছে মুঠোমুঠি
রাংতা-আলোর বুটি |
এমন সময় কানে এলো পিটুল পাখির ডাক,
একটু গেলো ফাঁক,----
এক ঝলকে আর-এক আকাশ চিড়খেয়ে যায় মনে
আরেক দিনের বনে,-----
তারি ফাঁকে পাৎলা রোদের পর্দাটুকু ফুঁড়ে
এরাও গেলো উড়ে,
রইলো প’ড়ে ঝরা পাতা, রইলো প’ড়ে ঢালু,
পাহাড়-ধসা লাল গুহাটার হাঁ-করা ঐ তালু  |

.                   ****************                                                            
উপরে   


মিলনসাগর
*
ডিহাং নদীর বাঁকে

একটি রাতের একটু দেয়া নেয়া
.        এই তো হল শেষ,
আজ সকালে পাহাড়-দেশের মেয়ে,
.        ছাড়ব তোমার দেশ |
মনের মাঝে ঘরছাড়া কেউ আছে
.        চিনি নে কেউ তাকে,
যাবার বেলা বিদায় ব’লে যাব
.        ডিহাং নদীর বাঁকে |



দুয়ার ঠেলে একটুখানি হেসে
.        আবার ফিরে গেলে,
হঠাৎ তুমি এ কী নূতন বেশে
.        বাহির হয়ে এলে ?
বুকে তোমার আগুন-রঙের শাড়ি
.        আগুন যে ধরালো,
উঠল জ্ব’লে পাহাড়তলীর বনে
.        বর্শা-ফলার আলো |




কোথায় ছিল সবুজ বনের তলে
.        ঐ আগুনের শিখা-----
জিহ্বা মেলে হাজার বছর ধ’রে
.        তৃষার মরীচিকা ?
ঐ  আগুনে পড়ছি তোমার মুখে
.        তারি অনল-গীতা,
জ্বলছে তোমার সর্বদেহে বুকে
.        সর্বনাশের চিতা ||

.           ****************                                                            
উপরে     


মিলনসাগর
*
রুদ্র বসন্ত

রুগ্ ণ দেহ ভগ্ন মন, বসন্তের স্তব্ধ দ্বিপ্রহর,
শুধু মাঝে মাঝে শুনি রুক্ষকন্ঠ কাকের চীৎকার,
কুক্কুটের তীক্ষ্ণ ডাক দূর হতে আসে একবার,
শুষ্কপত্রে  বার দুই শোনা যায় করুণ মর্মর |

বাহিরে তাকায়ে দেখি শিয়রের মুক্ত জানালায়,
তীব্র রৌদ্রে কাঁপে চোখে বিকারের উগ্র মরীচিকা,
চম্পকের শীর্ণ ডালে নৃত্য করে লেলিহান শিখা,
শেষ রক্তবিন্দু ঝরে রিক্তপত্র পলাশ-শাখায় |

দিগন্তের তাম্রভালে ভাসে দূরে ধূম্রের আভাস,
‘পরিত্রাহি’ ডাক ছাড়ে বনানী চাহিয়া ঊর্ধ্বমুখে,
ধরণীর রক্তনাড়ী ফেটে পড়ে প্রান্তরের বুকে,
বহ্নির স্ফুলিঙ্গ হানে বাতাসের আগ্নেয় নিঃশ্বাস |

দীপ্তশিখা দাবদাহ মেলে যায় দূর হতে দূর,
আকাশের প্রান্ত হতে ঘুরে পড়ে দগ্ধপক্ষ চিল,
আর্তকন্ঠে শেষবার ডেকে ওঠে মুমূর্ষু কোকিল,
বিকট চীৎকার করে  অর্ধদগ্ধ ভয়ার্ত কুকুর |

দারুণ অসহ্য জ্বালা, তীব্র দাহে অবসন্ন দেহ,
শুকায়েছে কন্ঠতালু, আর্ত প্রাণ উঠিছে ফুকারি,
সম্মুখে লেহিছে সৃষ্টি বিশ্বগ্রাসী বিরাট ভুখারী,
পৃথিবী না প্রেতলোক মাঝে মাঝে হতেছে সন্দেহ |

.           ****************                                                            
উপরে     


মিলনসাগর
*
গলির মোড়ে

এখানে গলির মোড়ে একদল তরল তরুণী
জল-ঢেউ ছিটাল হঠাৎ
উজ্জ্বল হাসির কাচ ভেঙে গেল সূর্যের আলোকে |

এখানে গলির মোড়ে চকিতে দেখেছি এক নদী----
দুই দিকে জলের ঝিলিক
মাঝখানে চোরাবালি হাসে |
দুই তীরে ধসে-পড়া সারি সারি পথিকের ঢিবি
সূর্যাস্তের সেনা  |

জানি আজ পৃথিবীতে দিকে দিকে যুগসন্ধ্যা নামে
ধোঁয়া ও কালির ছাপে দুর্ভাগা আকাশ,
তবু এই পড়ন্ত বেলায়
এখানে গলির মোড়ে একদল তরল তরুণী
চকিতে দেখাল সেই নদী  ||

.           ****************                                                            
উপরে     


মিলনসাগর
*
কিমাশ্চর্যম্

হু হু করে ট্রেন ছোটে----চৈত্রের দুপুর
কামরায় ভিড়
পাখা নেই----- অসহ্য গুমোট
রুমালে কপাল মুছে একটেরে ঠায় সে আছি |

চোখ ফেরে এখানে ওখানে
হঠাৎ কী যেন হয়ে যায়
যেদিকে তাকাই
সকলি অদ্ভুত ঠেকে,
চুপ করে ভাবি
আমি যে হইনি ওই অন্ধ দরবেশ
কিংবা ওই নুলো
কিংবা ওই খোঁড়া ভিখারিটা
এ বড়ো আশ্চর্য কথা,
আমি যে হয়েছি আমি, আর কিছু নয়
এ বড়ো বিস্ময় |

.           ****************                                                            
উপরে     


মিলনসাগর