কবি আসরফী খাতুন-এর কবিতা
*
একটা রোজগার
"আকাশ হতে চেয়েছিলাম" কাব্যগ্রন্থ থেকে
কবি আসরফী খাতুন

একটা রোজগার চিবিয়ে খায় তোমাকে
রক্তমাংস অস্থিমজ্জা সব
যতই তুমি বটবৃক্ষ হও
পোকামাকড়ে চিবোয় তোমার দেহ
আকাশ ভেঙে যখন বৃষ্টি হয়
তুমি তখন বাতাস হয়ে উড়ে যাও
দূরগগনের দিকচক্রবাল ছুঁয়ে লটকে থাকে তোমার সিক্ত শরীর
টপ টপ করে ঝরে পড়ে লাল বৃষ্টি
ওষুধে সচল করে তোমার দেহ
ঈর্ষার মেঘেরা প্রতিনিয়ত জাপটে ধরে
তোমার পেঁজা তুলোর মতো সফেন মন
তোমার ইমিটেশন গয়নাগুলি
সোনা হয়ে ঝকমক করে
বৃষ্টি ভেজা দিনে স্বপ্নের পাখি বাসা খোঁজে
সারাটা জীবন নীলকন্ঠ পাখিটা তোমায় অস্থির করে
তাকে ধরার জন্য আজও ছুটছো তুমি
আপাদমস্তক তুমুল বন্যাভেজা শরীরে
আঁকড়ে ধরো একটা আস্ত মানুষ |

.    
      ****************  
.                        
                                                     সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
রবিঠাকুর তোমাকে
"আকাশ হতে চেয়েছিলাম" কাব্যগ্রন্থ থেকে
কবি আসরফী খাতুন

রবিঠাকুর তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য
সকাল থেকে সাঁঝ-সাঁঝ থেকে ভোর
ছুটে বেড়িয়েছি---পাইনি দেখা আজো
হঠাৎ দেখি আম্রকুঞ্জে প্রসন্ন বদনে তুমি
কচিকাঁচাদের নরম মাটিতে আঁচড় কাটছো
গড়ে তুলছো পশু, পাখি, ফুল, ফল
এবং আস্ত একটা মানুষ---
হে কবিগুরু আমার মাটি কি খুব শক্ত ?
সারাজীবন হা পিত্যেশ করে বসে রইলাম
একটাও আঁচড় দিলে না তো ?
সারাক্ষণ শুধু তোমার মধুর স্বরের জন্য উত্কর্ণ হলাম
একবার তো সাড়া দিলে না তুমি
তোমায় দেখব বলে শুধুই ছুটলাম
একবার তো তুমি চাইলে না ফিরে

হন্যে হয়ে খুঁজে খুঁজে আঁধার হোল কালো
সেই অভিমান নিয়ে বলি থেকো তুমি ভালো
আমায় তুমি নাই বা দিলে একটুখানি পরশ
নাইবা দিলে খুশির মেলা নাই বা দিলে হরষ
ভালো থেকো রবিঠাকুর সারাজীবন ধরে
কি পেলে গো ঠাকুর তুমি আমায় নিঃস্ব করে?
অবশেষে একদিনকে উঠল তুমুল ঝড়
সেই ঝড়েতে ভেসে গেল মিথ্যে বাড়ি ঘর
রইলো পড়ে শুধুই তোমার কলস ভরা পানি
সারাজীবন ওই ধনেতেই হয়েছি রাজরাণী
আজ পেয়েছি দেখা তোমার পেয়েছি আজ দেখা
রিক্ত নই,  নিঃস্ব নই,  নই গো আজ একা
হেসে উঠে বলেন তিনি শোনরে তুই শোন
দেড়শো বছর পরে আবার উঠল জেগে মন
হৃদয় দিয়ে পড়িস না তো ভাবিস না তো তোরা
মানবতার বাণী আজ তাই তো ছন্নছাড়া
মুখে বড়ো বুলি বলিস মনটা শুধু ফাঁকা
মনের মাঝে পরান সাজে রয়েছে কি আঁকা
আমার ছবি চারিদিকে জ্বলছে অনেক আলো
ভালোবাসিস সব মানুষকে হবে তবেই ভালো |

.               ****************
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
অষ্টাদশী মেয়েকে
"আকাশ হতে চেয়েছিলাম" কাব্যগ্রন্থ থেকে
কবি আসরফী খাতুন

আমার অষ্টাদশী মেয়েকে দেখে মনে পড়ে
ছেলেবেলার কথা যখন মা বলত
কি হবে বেশি পড়াশুনা করে? ঘরের কাজ কর
কাজে লাগবে একদিন—ভালো করে
রান্না করে স্বামী, শ্বশুর শাশুড়িকে খাওয়াবি
দেখবি ওরা তোকে কত ভালোবাসবে
শ্বশুর ঘরে তোর মান বাড়বে
সেদিন মায়ের কথা বিশ্বাস হত না
উল্টো কথাই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেত
বয়সের ভারে নুজ্বদেহ আজ বলে দেয়
‘জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা’
তবে সে ধন রান্নাবান্না নয় অন্য কিছু—
নদীর চড়ায় আজ ধূ ধূ বালিরাশি
নোনা পানির স্বাদ পাই অবিরত
সবাই বলে লড়তে নেমে মেয়েটা ভুল করল
আজও তাকে লড়তে হয়---

মেয়েটা গল্প ভালোবাসে, খেতে-বেড়াতে
সবকিছু ভালোবাসে শুধু ওর ভাল্লাগে না পড়তে
সারাদিন রাত শুধু চিন্তার পাহাড় জমে
আমি তো আমার মায়ের মতো
পারি না বলতে --- কি হবে পড়াশুনা করে ?
বলি ইকরা পড়ো---- আল্লাহ জ্ঞানী মানুষকে
বেহস্তের পথ দেখান --- সেই বেহস্ত কোথায়
জানবে না মেয়েটা ?
জানবে না নোবেলজয়ী মেয়েটার কথা
জানবে না আকাশচারী মেয়েটার কথা
জানবে না সীতা, সাবিত্রী, দ্রৌপদীর লজ্জার কথা—
জানবে না খাদিজা-রোকেয়া-গুলনাহারের কথা
এই ধরার বুক থেকে যখন ঝরঝর ঝরবে পানি
তখন মেয়েটা কি নিয়ে থাকবে
ও কি কোনদিন খুঁজে পাবে
মায়ের বেদনার অতলান্ত পাহাড় আর
সেই পাহাড়কে জয় করার সেই অজানা চাবিটা |

.               ****************
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
বাঁচা
"আকাশ হতে চেয়েছিলাম" কাব্যগ্রন্থ থেকে
কবি আসরফী খাতুন

এখন আর আয়ু চেয়ে লাভ নেই
গাছের মতো বাঁচা আশা করা বৃথা
পাহাড়ের মতো থাকা, আকাশ কুসুম কল্পনা
সোঁ-সোঁ শব্দ করতে করতে মশাগুলো আসে
ওরা জানেই না তারা কখন মৃত্যুর দরজায় ঢুকে গেছে
এরপর শুরু হবে খেলা
এত বৃষ্টি, নদী ভরপুর--- সব বাধা পার করে
রোদ আসবেই---- কে ভেবেছিল
সৃষ্টির প্রথম ধাপে --- এক --- দুই--- থেকে
একশো কোটিও ছাপিয়ে যাবে মানুষ
সোঁদা মাটির গন্ধে নিজের অস্তিত্ব---
খুঁজতে খুঁজতে হারিয়ে যায় জীবন |

.          ****************
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
পয়লা বোশেখ
"আকাশ হতে চেয়েছিলাম" কাব্যগ্রন্থ থেকে
কবি আসরফী খাতুন

আজ আবার পয়লা বোশেখ ফিরে এলো
জীবন প্রভাতে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে নয়
এলো কঠিন বাস্তবের হাত ধরে
কঙ্কালসার আব্বার দেহ ঘিরে
ছানিপড়া চোখের অঝোরে ঝরে পড়া
পানি হয়ে—ঘোলাটে চোখের
আঁধার কালো রূপ নিয়ে----
তালাক চাওয়া নাতবৌয়ের আগুন হয়ে
বিগড়ে যাওয়া বউ পালানো ছোটো ছেলের বিলাপ হয়ে
রোগে জীর্ণ থির চোখের ক্ষোভ নিয়ে
এলোমেলো ভাবনার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে
প্যামড়ার পীরবাবার দোয়া হয়ে
রাখালের পীরতলার মীথ হয়ে
মাঝিপাড়া, বাউরিপাড়ার হাড় জিরজিরে
ন্যাংটো ছেলেগুলোর চাউনি হয়ে
যে বুড়িটা ঘোলাটে ছানিপড়া চোখ নিয়ে
পীরবাবার কাছে এসেছিল সালাম করতে
তার ফিরে যাওয়ার শেষ ভিক্ষা হয়ে
তেত্রিশ বছরের আইবুড়ো মেয়েটার স্বপ্ন হয়ে

তবে আর যাইহোক তুমি যে
বেলাশেষে আবার ফিরেএলে
তাতেই আমি খুশি—
চিরদিন তুমি লেপ্টে থেকো জীবনের আষ্টে পৃষ্টে
এলোমেলো পথের বাঁকে দেখা যেন হয়
প্রতিবছর ফিরে ফিরে আর---

.          ****************
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
তিন তালাক
"আকাশ হতে চেয়েছিলাম" কাব্যগ্রন্থ থেকে
কবি আসরফী খাতুন

তালাক তালাক তালাক --- তিন তালাকে
খোদার আরশ পর্যন্ত কেঁপে ওঠে
অথচ আজও মানুষ ভাত দিতে দেরী হলে
তালাক দেয়—বলে তালাক তালাক—
এমনকী ঘুমের ঘোরেও নাকি তালাক দেয় কেউ কেউ
আর সে সব কথা -- ফলাও করে প্রচার হয়
সংবাদ পত্রের পাতায়
স্কুল-কলেজ-অফিস আদালত রাস্তাঘাটে
নাক সিটকায় শিক্ষিত মানুষেরা
বলে—ধর্ম কি রে বাবা, নারীদের জীবন নিয়ে
ছিনিমিনি খেলে এরা
মুখের তিনটি শব্দই চল্লিশবছরের সম্পর্ক
ভেঙে খান খান করে দিল
একবারও ভাবল না --- শব্দ তিনটের গুরুত্ব কত গভীর
নিজের একান্ত আপনজনকে তিনটে শব্দ
কী করে আলাদা করে দিত পারে !
আর ধর্ম কি সত্যই তাই বলে ?

দাম্পত্য প্রেমকে দৃঢ়বন্ধনে বাঁধতে
মানুষ ভয় পায়--- তাই জীবন সমুদ্রে
বৈচিত্রের জন্য আগুন জ্বালায় নিজের হাতে
দোহাই দেয় ধর্মের, আসলে কোনো ধর্মই
মানবতা বিরোধী ছিল না কোনোদিন,
আজও নয়, শুধু মানুষ তাকে খড়্গ হিসাবে
ব্যবহার করে, সর্বনাশ করে মানুষের
মানবতার, নারীত্বের ----

.          ****************
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
মুক্তি তুমি কোথায়
"আকাশ হতে চেয়েছিলাম" কাব্যগ্রন্থ থেকে
কবি আসরফী খাতুন

রজনীগন্ধার সুগন্ধটা বিস্বাদ, দুর্গন্ধময়
হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে
হারিয়ে যাচ্ছে বিবাহবার্ষিকীর তেসরা জুন
জেগে উঠছে সাংসারিক বোঝা
চাকরির জন্য লাখটাকা ডোনেশন
বাঁচার জন্য লাখ দেড়েক
গয়না বাঁধা --- ব্যবসা লাটে
ছাড়াবার টাকা নেই বেড়ে চলে সুদের পাহাড়
ট্যাক্সের জন্য রেকারিং
চিলড্রেন পলিসির কথা মাথায় ঘুরপাক খায়
ছেলের পড়াশুনা ভবিষ্যৎ কাজের মেয়ের মাইনে
দুধের টাকার জন্য কচকচানি
কর্মস্থলে ব্যক্তিত্ববোধের লড়াই

ভাইবোন-আত্মীয়স্বজনদের প্রতারণা-প্রবঞ্চনা
ব্যঙ্গ বিদ্রূপবাণ
মায়ের অবহেলা করার কথা
মান অভিমান—মৃত্যুকালীন ক্যান্সার রোগীর
অসহ্য কষ্ট—বাবার কঙ্কালসার দেহ
ছেলেকে দেখত না পারার বেদনা
সবমিলিয়ে দিশেহারা

ক্ষণে ক্ষণে জেগে ওঠে পাগলামির নেশা---
মুক্তি তুমি কোথায় ?
তোমাকে আজ আমার খুব দরকার
তোমার সাথে আজ আমি গাঁটছড়া বাঁধব
তুমি ফিরে এসো
শুধু একটিবার ফিরে এসো---

.          ****************
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
আকাশ হতে চেয়েছিলাম
"আকাশ হতে চেয়েছিলাম" কাব্যগ্রন্থ থেকে
কবি আসরফী খাতুন

আমি আকাশ হতে চেয়েছিলাম
এখনও পাহাড় ছুঁতে পারিনি
আমি সমুদ্রে সাঁতার কাটতে চেয়েছিলাম
এখনও জলে নামতে পারিনি
এতদিন কাজ করলাম, তিন যুগ পার করলাম
এখনও কাজের মতো কাজ খুঁজে পাইনি
কত দিন কত রাত শুধু স্বপ্ন দেখেছি
আজো স্বপ্ন পূরণ হয়নি
আমি তো হিমালয়ের স্বপ্ন দেখেছিলাম
এখনও মনুমেন্ট দেখতে পারিনি
আমি তো লোকের দুঃখ শুনে কত কেঁদেছি
নিজের দুঃখ বলতে পারিনি
সারাজীবন শুধু লড়াই করেছি
সেই লড়াইয়ে জিততে পারিনি

আমি আকাশ হতে চেয়েছিলাম
এখনও পাহাড় ছুঁতে পারিনি—
দিনকে দিন আকাশটা হারিয়ে যাচ্ছে
বাতাসটা যাচ্ছে পচে
সবুজরা হলুদ হয়ে যাচ্ছে
পাহাড় ধসে পড়ছে
সমুদ্র যাচ্ছে শুকিয়ে
আর স্বপ্ন ভেঙে খান খান হচ্ছে
মন মারা যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে
পাখিরাও আজ আর নেই
আকাশে আজ শুধু আগুন
আর---

.          ****************
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
ভালো লাগে
"আকাশ হতে চেয়েছিলাম" কাব্যগ্রন্থ থেকে
কবি আসরফী খাতুন

ভাবতে বেশ ভালো লাগে
যদি এমন হয়
সারা আকাশ আগুন জ্বেলে
ছড়ায় দেশময় |

দেখতে বেশ ভালো লাগে
যদি এমন হয়
গাছে গাছে লেজওয়ালা সব
বুদ্ধিজীবী হয় |

শুনতে বেশ ভালো লাগে
যদি এমন হয়
বড়ো বড়ো নেকড়েরা সব
মধুর কথা কয় |
আর কত কি ভাল লাগে
যায় না বলা মুখে
বন্ধু তুমি শুনবে কি গো
কি জ্বালা এই বুকে |

.      ****************
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
আমার প্রিয় বাংলাদেশ
"আকাশ হতে চেয়েছিলাম" কাব্যগ্রন্থ থেকে
কবি আসরফী খাতুন

আমার প্রিয় বাংলাদেশ তোমাকে আমি কি দেব ?
আমার কাঁচা মন নাও তুমি--- যা ইচ্ছা গড়ো
আমার শরীর-মাটিতে --- ফলাও নানা ফসল
আমার চোখ নিয়ে ---- গড়ে তোল নীল সমুদ্র
আমার দাঁত নিয়ে ---- গড়ো তুমি পাহাড়ের চৃড়া
আমার ঠোঁট দিয়ে ---গড়ে উঠুক গোলাপের বাগান
আমার কান যেন ---- শুনতে পায় তোমার সবকথা
আমার হাত যেন কাজে লাগে --- তোমার শিল্পকলায়
আমার পা যেন আসমুদ্রে পাড়ি দিতে পারে
আমার প্রতিটি পাঁজর দিয়ে ---গড়ো তুমি তোমার ইমারত
আমার প্রতিটি নিঃশ্বাস প্রশ্বাস যেন---তোমার কাজে লাগে
আর কি আছে বল তোমাকে দেবার ?
আরো যদি কিছু থাকে নিয়ে নিও সব
আমি যেন সারাজীবন হয়ে থাকি লীন
তোমারই বুকের মাঝে --- তোমারই দেহের সনে
হয়ে দীন হীন |

.                 ****************
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর