কবি অতীন্দ্র মজুমদারের কবিতা
|
জাগাও আনন্দে গান
কবি অতীন্দ্র মজুমদার
জাগাও আনন্দে গান :
মূর্ছিত মৃত এ স্বদেশ
কল্লোলে আনো নব তান॥
এ মহা আঁধারে জাগো শিল্পী কর্মী
জাগো কবি---
আলোকতীর্থে নবজীবন---সূর্যকর লভি’ ,
সংগ্রামে জয়, সংগ্রামে জয়---এই
অভয়মন্ত্র করো দান॥
মৃত্যুকে কে মনে রাখে
জীবনের মহাকলরবে,
দুঃস্বপনের বিভীষিকা
আলোকে লুপ্ত হবে হবে॥
বিষণ্ণ মৃত্যুর চরণচিহ্ন মুছে নিয়ে
স্বর্গকে আনবোই জীবনের রাজপথ দিয়ে
বন্ধনভয় সংঘাতে ক্ষয় করে
স্পর্ধার দাও আহ্বান॥
. ******************
. সুচিতে . . .
মিলনসাগর
এই মৃত্যুর সমুদ্র পার হয়ে ভাই
কবি অতীন্দ্র মজুমদার
এই মৃত্যুর সমুদ্রপার হয়ে ভাই
আকাশের সীমানা যে নাই----
ভেঙে বন্ধদ্বার মুছে অন্ধকার
চলো স্বপ্নের দূর দেশে যাই॥
যত বঞ্চনা লাঞ্ছনা জিনে
সংগ্রামে জয়পথ চিনে
নবজীবনের গান, জয়ী জনতার গান চলো
স্থবিরের সমাধিতে গাই॥
এই অন্ধকার-ঘেরা দ্বারে
দৃপ্ত জীবন কড়া নাড়ে,
চিরনির্ভয় চিরদুর্জয় নিঃসংশয়----
এসো মরণে বরণ করি তারে॥
রাঙা নিশানে নিশানে পাল তুলে
সাগরের পারে নব কূলে,
গাই সাম্যের গান, গাই ঐক্যের গান,
চলো মানুষের জয়গান গাই॥
. ******************
. সুচিতে . . .
মিলনসাগর
কোন্ গর্জনে নেমে আসে ঝড়
কবি অতীন্দ্র মজুমদার
কোন্ গর্জনে নেমে আসে ঝড়
ধরণীর মুখ ম্লান :
এ তো ঝড় নয়, রিক্ত নিঃস্ব প্রাণের দীর্ঘশ্বাস------
এ ঝড় ওড়াবে ফুত্কারে যত অলস সুখবিলাস।
দেখ্ পায় প্রাণ, পায়েরে পথের ধূলি,
উধাও হাওয়ার জয়গান গায় আকাশের দু’হাত তুলি’
বিশাল ভয়াল আকাশে ছড়ায় দারুণ অট্টহাস।
ক্লান্ত পৃথিবী স্তব্ধ যে তার গান
মেঘের আড়ালে ছায়াপথ ম্রিয়মান :
এ আঁধার ছিড়ে ঊর্দ্ধে ওড়াবে কে
জীবনের রঙে রঙিন লালনিশান॥
শোন্ , ওরে মন, এই তো সময় তোর,
শাসনে শোষণে পীড়নে কঠিন নির্মম যতো ডোর,
---ভেঙে ফেল্, হোক্ ভাঙনের গানে
সৃষ্টির অধিবাস।
ওড়াও ওড়াও ফুত্কারে যতো অলস সুখবিলাস॥
. ******************
. সুচিতে . . .
মিলনসাগর
শুভদৃষ্টি
কবি অতীন্দ্র মজুমদার
ওরে মেয়ে, মুখ তোল্, আমি তোর অশ্রুর দর্পণে
দেখব নিজের ক্লান্তি, বিষণ্ণ এ জীবনের গ্লানি।
দেখব কী করে আমি প্রগলভ সে ঝঞ্ঝার অন্তিমে
এনেছি কান্নার বৃষ্টি, যন্ত্রণার নির্মম জোয়ার
কালো তোর চোখের পাতায় ; আমি অস্থির আমার
যত ক্ষোভ বেদনার অভিশাপ যা দিয়েছি শুধু
আমার ফাল্গুন শেষে প্রখর সে নির্দয় বৈশাখে॥
ওরে মেয়ে মুখ তোল্, আমি তোর কান্নার জোয়ারে
এবার নিজেকে দেব। আমি তার স্রোতে ভেসে ভেসে
পার হয়ে দূরত্বের দ্বীপ, কত বিভেদের বাঁধ
অশ্রুর নিষ্ঠুর স্রোতে চূর্ণ করে, অস্পষ্ট দৃষ্টির
কুয়াশাকে ভেদ করে, শুনব সে চেনা কণ্ঠ, সেই
চেনা চোখ ফের দেখব অন্তহীন নীলিমার নভে :
যাব সেই দ্বীপে যার অরণ্যের সুস্নিগ্ধ শরীরে
প্রেম হব, গান হব, সুশ্যামল পল্লবে পল্লবে॥
. ******************
. সুচিতে . . .
মিলনসাগর
বলিদান
কবি অতীন্দ্র মজুমদার
সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত শনিবারের চিঠি অগ্রহায়ণ ১৩৫১ (ডিসেম্বর ১৯৪৪) সংখ্যায়
প্রকাশিত।
আমি যেন ভাই হই শেষ-বলিদান,
আমারই রক্তে ব্যথিতা ধরার হউক মুক্তিস্নান।
শৃঙ্খল বাঁধা পীড়িত মানুষ ক্ষমাহীন দিনে রাতে,
নিরুপায় যারা জাগে ভাই যত অপমান নিয়ে মাথে,
দুঃখ-রাতের-বর্ষা-ধারায় যার আঁখিজল মেশে,
আমি নেব ভাই হেসে,
তাহাদের যত চিন্তার বোঝা আমার স্কন্ধে তুলি
সকল দুঃখ, সকল যাতনা ভুলি ;---
আমার আত্মদান,
পীড়িত ব্যথিত মানবাত্মার ক্ষোভের করুক ত্রাণ॥
জেনেছি, জেনেছি মৃত্যুরে ভয় নাই---
অমর অভিলাষ
এখানে কবির নাম অতীন্দ্রনাথ মজুমদার দেওয়া হয়।
নরেন্দ্র দেব সম্পাদিত "পাঠশালা" পত্রিকার আশ্বিন-ভাদ্র ১৩৪৮ (সেপ্টেম্বর ১৯৪১) সংখ্যায়
প্রকাশিত।
পৃথিবীর কবি আমি নই, হে আকাশ, অয়ি দূরস্থিতা
ছন্দে রূপে, লিখনীর মোহগ্রস্ত নির্ব্বাক আবেগে---
আমার মানসপত্রে তোমাদের করিনি অঙ্কিত,
বিভ্রান্ত চেতনা রসে মুগ্ধ আমি নহি কোনদিন।---
আমার সন্মুখে ছিল জরাগ্রস্ত বীর্যহীনা ধরা,
অচঞ্চল চক্ষু মেলি’ জ্যোতিহীন মুমূর্ষ তপন,
গতিহীন ধরিত্রীর রুদ্যমানা নির্ধরের গীতি,
ম্রিয়মান ছিল যত---চিন্তানত কুঞ্জের মল্লিকা।
আজি দেখি ফাল্গুনের রৌদ্রস্নাতা বিশীর্ণা তটিনী
অবনীর প্রণবৃন্তে আনিয়াছে উচ্ছল জোয়ার
চঞ্চল তরঙ্গাঘাতে ; মৌন গান হল ঝঙ্কারিত
আজিকার বসুধার কুঞ্জে কুঞ্জে অশোক শাখায়।
আমারে বলিষ্ঠ কর, হে আকাশ, মোরে শক্তি দাও
অমর চুম্বন দানি মৃত্যুহীন, লয়হীন কর,
---অসংখ্য বন্ধন ছেদি দাও সেই অমর্ত্য শকতি
বীর্যবতী করিবারে নব রূপে নব ধরিত্রীরে।
. *******************************
. সুচিতে . . .
মিলনসাগর
এসো : মুক্ত করো
কবি অতীন্দ্র মজুমদার
কবিতাটি প্রতিভাসের অর্জুন গোস্বামী সম্পাদিত "জেলখানার কবিতা" তে মুদ্রিত আছে।
কবিতাটি আমাদের পাঠিয়েছেন শ্রী অনির্বাণ দাস, যিনি জলপাইগুড়ির বিবেকানন্দ
হাইস্কুলের শিক্ষক। এ জন্য আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।
তাঁর ইমেল - anirbanpinku@gmail.com ।
কে কাকে করবে মুক্ত!
যদি না সে মুক্ত করে নিজেই নিজেকে
লড়াইয়ের ময়দানে
রক্ত দিয়ে, রক্ত বিনিময়ে॥
ভয়ের আঁধারে বন্দি
বন্দি কেউ প্রথার নিগড়ে,
অবিশ্বাসে বন্দি কেউ
কেউ বাঁধা মিথ্যার প্রত্যয়ে . . .
সকলেই বন্দি আজ
দৃশ্য কিংবা অদৃশ্য বলয়ে॥
আমি কোনো প্রার্থনার মন্ত্রে কোনো দিন
বিশ্বাস রাখি না :
কোনো কোনো শৌখিন সোচ্চার দাবিতেও
আমার অনীহা॥
আমার বিশ্বাস শুধু সংগ্রামে---একাগ্র সংগ্রামে।
বন্দিমুক্তি যদি চাও---তবে এসো---লড়ো
রক্তে ও ঘামে
আমার কবিতা গান নিয়ে আমি আছি
আমাদের সকলের
বন্দিমুক্তি রক্তাক্ত সংগ্রামে॥
. *******************************
. সুচিতে . . .
মিলনসাগর
মে-দিবসের কবিতা
কবি অতীন্দ্র মজুমদার
রচনা ১৯৪৪। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও কবি অতীন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত “মে-দিনের
কবিতা” কাব্যসংকলনের (১৯৮৬) কবিতা। কবিতাটি আমাদের পাঠিয়েছেন শ্রী অনির্বাণ
দাস, যিনি জলপাইগুড়ির বিবেকানন্দ হাইস্কুলের শিক্ষক। এই জন্য আমরা তাঁর কাছে
কৃতজ্ঞ। তাঁর ইমেল - anirbanpinku@gmail.com ।
“সামাহারা হুডি সামাহারা”---
টরন্টো ওহায়োর ইক্ষুর প্রান্তরে
ডেনভারে মন্ট্রিলে কারা দিল সাড়া
---“সামাহারা হুডি সামাহারা।”
উইনিপেগের হ্রদে নীল ঢেউ টলমল্
যবের শীষের ডগা কাঁচা রোদে ঝলমল্
কাটা-ফাটা পোড়ামুখে হাড়মোটা বুক ঠুকে
দু’হাত আকাশে তুলে উল্লাসে ডাকে কারা!
এভ্রের খনিখোঁড়া দুর্বার মজুরের
গোধূমের খেতে-খাটা চিকো ব্রুনো চাষিদের
হুঙ্কারে গর্জনে স্বপ্নে ও ও জাগরণে
কাজে আর অবসরে মন্ত্র সে লেনিনের
আকাশ-কাঁপানো আর বাতাসে-ছড়ানো ডাক
---চাষি মজুরের রাজ করা চাই খাড়া---
বুড়ো হাড়ে কচি মুখে, নির্ভীক বুক ঠুকে
কুইবেকে এল্ পাসে প্রাণের শিকড় ধ’রে
দুই হাতে দিল ঘনঘন কারা দিল নাড়া---
---“সামাহারা হুডি সামাহারা”---
“হেই ওক দ্রান দ্রান হেই ওক দ্রান---”
তুর্কমানিয়া আর রুক্ষ আনডিজান
বার্নলে ধূলো ওড়ে সারি সারি ক্যারাভান
---“দ্রান্ দ্রান্ হেই ওক্ দ্রান্”॥
“দ্রুকু চাকা রুকু চাকা বুকু চাকা বুম্”---
মেক্সিকো জাগে ভাঙে চেতনার ঘুম।
নীলচে বাদামী রঙে ঢাকা মাঠ বোল্ সন,
সবুজ কলার চাষে দিকে দিকে শিহরণ,
লম্বা ঘাসের ঝোপে ঘোড়া ছেড়ে ক্যাবেলেরো
দুপুরের ঘুমে নিঃঝুম।
আবার ওদিকে দেখো মাপিমির মালভূমি
হাসিমুখ মোটা নাক চটুল চতুরবাক
সারি সারি সিনোরিতা, বাজে ঝুমঝুমি।
সামনে পিছনে নাচে সোম্ ব্রেরো টুপি
ডোরাকাটা জামাপরা নারিকেল ছায়াধরা
নম্র খোঁপার সাথে কথা চুপিচুপি।
হঠাৎ আগুন লাগে খোড়োঘরে কানিয়াগে
সাদা স্প্যানিয়ার্ড চোখে অগ্নিবিলাস জাগে
---ঘরের ঘরে তৈয়ার ড্রামে গুমগুম।
অত্যাচারের আর শোষণের সাথে তারা
শেষবার করে নেবে চরম সে বোঝাপড়া
দুনিয়ার হতভাগা একসাথে হবে খাড়া
ড্রামে গুমগুম---
গ্রেট বাসিনের মাটে বোল্ সন্ মন্টেরি
গান গায় “বুকু চাকা বুম্”॥
গং গং গং বগো গং গং গং
সুমাত্রা বলীদ্বীপে জাভা আর মালয়ের
ঘরে ঘরে বাজে গ্যামলেন্
. ---গং গং গং!
ঝম্ ঝম্ বৃষ্টির মঞ্জীর ভিজে খেতে
হ্যানয় ক্যাম্বোডিয়া ব্যাংকক্ লুইচে তে
হাওয়ায় বাঁশের পাতা দোলে অনুখন।
গালফোলা উঁচু খোঁপা হাতে বালা রংঢালা
রেশমী লুঙ্গিতে অনুপমা---
বাঁশি বাজে চ্যাংমায় কালো পিঠ পৈকায়
হাঁটু জলে ধান বোনে রীতি সনাতন।
ফরাসি বোমারু আসে আকাশ আঁধার করে
দু’হাত কপালে তুলে দেখে কিছুখন ধ’রে
ঘর ছেড়ে পথে আসে মুঠো বাঁধা মন।
আশে পাশে যারা আছে হতভাগাদের কাছে
সকালে শপথ নেয় মাথা উঁচু ইউন্যাচে
---এদের হঠাবো আর বাঁচাবো জীবন।
আমরা তো একা নই ব্রহ্ম ভারত ওই
বিপদে করবে তার বাহু প্রসারণ---
ব্যাংককে বলীদ্বীপে ইন্দোচীনের মাঠে
গম্ভীর গং গং গং---
দুনিয়ার চাষিদের আর যত মজুরের
শপথ সে বাজে অনুখণ---
---“গং গং গং বগো গং গং গং”॥
. *******************************
. সুচিতে . . .
মিলনসাগর