কবি অরবিন্দ ঘোষ - জন্ম গ্রহণ করেন কলকাতায়, ১৫ই অগাস্ট ১৯৭২ তারিখে। পিতা ডঃ কৃষ্ণধন
ঘোষ ছিলেন প্রথিতযশা চিকিত্সক এবং ডিস্ট্রিক্ট সার্জেন | মাতা
স্বর্ণলতা দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের
রাজনারায়ণ বসুর কন্যা। তিনি একজন আলোতপ্রাপ্তা মহিলা ছিলেন এবং কবিতা লিখতেন। তাঁর লেখা
কবিতা আমরা বামাবোধিনী পত্রিকার সংখ্যায় এবং অন্যান্য সংকলনে দেখতে পাই। কবির মেজদা
মনমোহন ঘোষ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজীর অধ্যাপক এবং
কবি |
মাসী লজ্জাবতী বসু ছিলেন সেকালের প্রতিষ্ঠিত কবি। ছোট ভাই ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের
"ভাঙা বাংলার রাঙা যুগের আদি পুরোহিত সাগ্নিক বীর" -
বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষ

পিতার কৃষ্ণধনের উগ্র সাহেবিয়ানার জন্য মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই অরবিন্দকে দার্জিলিং এর লরেটো
কনভেন্ট এ ভর্তি করা হয়। এরপর ১৮৭৯ সালে মাত্র সাত বছর বয়সে, তাঁর অগ্রজ দুই ভাইয়ের সঙ্গে
তাঁকেও বিলেতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ১৮৮৪ পর্যন্ত তিনি ম্যাঞ্চেস্টারের গ্রামার স্কুলে পড়েন। ১৮৯০
সাল পর্যন্ত পড়েন সাউথ কেনসিংটন সেন্ট পলস্ স্কুলে। লাতিন ও গ্রীক ভাষায় পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি ৮০
পাউণ্ডের বৃত্তি পান এবং ভর্তি হন কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংস কলেজে। কেম্ব্রিজে অরবিন্দ ফ্রেঞ্চ,
লাতিন ও গ্রীক ভাষায় ফর্স্ট ক্লাস ট্রাইপোজ বা ব্যাচেলার্স ডিগ্রি (স্নাতক হওয়া) অর্জন করেন। ইংল্যাণ্ডে
থাকাকালীনই তিনি তাঁর ভাইদের সঙ্গে এবং কিছু উত্সাহী ভারতীয় তরুণদের সাথে
“Lotus and Dagger”
নামে একটি গুপ্ত সমিতি গড়ে তোলেন। ফরাসী বিপ্লব ও আইরিশদের মুক্তি সংগ্রাম খুব সম্ভবত তাঁকে এই
রকম একটি সমিতি গড়ে তুলতে উত্সাহ দিয়েছিল। খুব অল্প বয়স থেকেই তিনি দেশমাতৃকার মুক্তির কথা
ভাবতেন। কেম্ব্রিজে পড়াকালীন তিনি সেখানকার “ভারতীয় মজলিসের” সম্পাদক ছিলেন। সেখানে তিনি এ
নিয়ে নানা বক্তৃতাও দিয়েছিলেন।

এরপর চলে আই.সি.এস পরীক্ষার প্রস্তুতি। সেই সময়ে তাঁর মনে হয়েছিল যে পৃথিবীতে তাঁর আগমন
দেশমাতৃকার মুক্তির জন্যই। তাই ঘোড়সাওয়ারীর পরীক্ষার দিন তিনি অনুপস্থিত থেকে
ICS পরীক্ষায়
অকৃতকার্য হন! ১৪ বছর ইংল্যাণ্ডে থাকার পরেও সেখানকার জীবনযাত্রার প্রতি তাঁর কোনো মোহ বা
ভালোবাসা জন্মায় নি।

সেই সময়ে লণ্ডনেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় বরোদার মহারাজা সয়াজীরাও গায়কোয়াডের, যিনি তাঁকে ২০০
টাকা মাসিক বেতনে তাঁর স্টেট সার্ভিসে চাকরি দেন। বম্বাইয়ের জাহাজঘাটায় নেমেই তাঁর মন শান্তিতে
ভরে গিয়েছিল। ১৮৯৩ থেকে ১৯০৬ সাল পর্যন্ত তিনি বরোদায় কাজ করেন। এখানেই তিনি ভারতীয়, ভাষা,
সংস্কৃতি, ধর্ম ও শাস্ত্র নিয়ে অধ্যয়ন করে নিজেকে আগামীর জন্য প্রস্তুত করে তোলেন। সংস্কত শিখে
অধ্যয়ন করেন বেদ, উপনিষদ, গীতা, কালিদাস, ভবভূতি, রামায়ণ, মহাভারত, মনুস্মৃতি ইত্যাদি। বাংলার
পাশাপাশি শেখেন গুজরাতি ও মারাঠি। তাঁর মাইনের বেশীটাই বইপত্রের পেছনে ব্যয় করতেন। তাঁর
বাংলা ভাষা শিক্ষা শুরু অবশ্য ইংল্যাণ্ডেই, মিস্টার টাওয়ার্স নামের এক ইংগ্রেজ শিক্ষকের কাছে।

১৯০১ সালে, বরোদায় থাকাকালীন, তাঁর বিয়ে হয় ভূপালচন্দ্র বসুর কন্যা মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে।
বরোদায় থাকার শেষ দিকে তিনি বিপ্লবী কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তিনি নিজে ১৯০৪ সালে বাংলার
বিভিন্ন জেলা পরিদর্শন করেন। ১৯০৪ থেকে ১৯০৯ সালের মধ্যে তিনি ভারতের জাতীয়তাবাদকে এক নতুন
আকার বা নতুন অধ্যায় দিয়েছিলেন। ১৯০৫ এ এল লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ। দেশে যে অসন্তোষ জন্মেছিল তা
প্রকাশের পথ পেল। ১৯০৬ সালে অরবিন্দ, বরোদার চাকরি থেকে বিনা বেতনে দীর্ঘ ছুটি নিয়ে নিজেকে
পূর্ণমাত্রায় আত্মনিয়োগ করলেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। বাংলার চরমপন্থী জাতীয়তাবাদীদের সংগঠিত
করলেন। বয়কট এবং স্বদেশী আন্দোলনকে তিনি এক বিশাল জাতীয় আন্দোলনে পরিণত করার চেষ্টা
করলেন। আগস্ট ১৯০৬ তে কলকাতায় “জাতীয় কলেজ” স্থাপন হওয়ার পর তিনি বারোদার চাকরি ছেড়ে
দিয়ে, স্বল্প বেতনে, চলে আসেন প্রিন্সিপাল হয়ে।  

১৮৯৮ সালে বিহারের দেওঘর থেকে, অনুজ
বারীন্দ্র, এনট্র্যান্স পরীক্ষা পাশ করে ১৯০১ সালে পাটনা কলেজে
ভর্তি হন কিন্তু তাঁর প্রথাগত শিক্ষা অসমাপ্ত থেকে যায় | এর পর কিছুকাল তিনি তাঁর মেজদা মনমোহন
ঘোষের কাছে কাটিয়ে, গুজরাতের বরোদায়, সেজদা অরবিন্দ ঘোষের কাছে চলে যান | সেখানে অরবিন্দের
বিপ্লবের ভাবনায় প্রভাবিত হয়ে, বন্দুক চালানো অভ্যাস করেন | এর পর তিনি অরবিন্দের নির্দেশে চলে
আসেন কলকাতায়, অরবিন্দের মন্ত্রশিষ্য যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘাযতীন) এর সাথে মিলে বিপ্লবী দল
গঠন ও পরিচালনার কাজে | দুজনে মিলে কলকাতায় বাংলার তরুণ বিপ্লবীদের নিয়ে গড়ে তোলেন স্বদেশী
আন্দোলনের মূল সংঘটন “অনুশীলন সমিতি” | ১৯০৬ সালে শুরু করেন “যুগান্তর” সাপ্তাহিক পত্রিকা, যা
ব্রিটিশ বিরোধী পত্রিকা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে | অরবিন্দ এই পত্রিকায় কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন,
যদিও কোথাও তাঁর নাম প্রকাশিত হয় নি। তিনি বিপিনচন্দ্র পালের অনুরোধে তাঁর ইংরেজী সাপ্তাহিক
“বন্দেমাতরম” পত্রিকাতেও লিখতে শুরু করেন, যদিও এখানেও তাঁর নাম প্রকাশিত হয় নি।
১৯০৬ সালে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে, অরবিন্দের সাফল্যের পর লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক
তাঁকে কংগ্রেসের সুরত অধিবেশনে নিমন্ত্রন জানান। সেখানে কংগ্রেসের দুই নরম ও চরম
পন্থীদের সংঘর্ষের ফলে কংগ্রেস দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। অরবিন্দের নীতিরই জয় হয়। এর ফলে ভারতীয়
রাজনীতির উগ্রপন্থীদের দমন করার নীতি নেয় ইংরেজ সরকার। তিলককে ৬ বছরের জন্য কারাগারে
নিক্ষেপ করা হয়।  ১৯০৭ সালের আগস্ট  মাসে অরবিন্দের উপর রাজদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু
প্রমাণের অভাবে তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় সরকার।

এদিকে
বারীন ঘোষের নেতৃত্বে কলকাতার মানিকতলায় তরুণ স্বদেশীদের বোমা তৈরি করার প্রশিক্ষণ
দেওয়া শুরু হয় | মানিকতলার সেই জায়গাটি এখন “বোমার মাঠ” নামে খ্যাত |

১৯০৮ সালের ৩০শে এপ্রিল ভাগলপুরে কিংসফোর্ড সাহেবকে হত্যার চেষ্টায় ধরা পড়েন ক্ষুদিরাম বোস এবং
প্রফুল্ল চাকী | এই মামলার সূত্র ধরে ২ মে ১৯০৮ তারিখে ধরা পড়েন
বারীন ঘোষ, কারণ তাঁদের ছোঁড়া
বোমা ওই বোমার মাঠেই তৈরী হয়েছিল বলে পুলিশ মনে করে |  ৫ই মে ধরা পড়েন অরবিন্দ ঘোষ। বিপ্লব
ও হত্যার ষড়যন্ত্রের দায়ে তাঁদের অভিযুক্ত করা হয়। সেই মামলায় (
আলিপুর বোমা মামলা বা Alipore
Bomb Case
), বারীন ঘোষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় যা পরে জাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বদল করা হয় |

এই মামলায় এঁদের হয়ে লড়েছিলেন বিখ্যাত ব্যারিস্টার ও
কবি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ | এই মামলা
চলাকালীন স্বীকারোক্তিতে
বারীন্দ্রকুমার ঘোষ সম্পূর্ণ দায় নিজের উপর তুলে নিয়েছিলেন | ১৯০৯ সালে
বারীন ঘোষকে “কালাপানি” --
আন্দামানের সেলুলার জেলে দ্বীপান্তরিত করা হয় | অরবিন্দ ঘোষ বেকসুর
খালাস পান | ১৯২০ সালে “জেনারেল এমনেস্টির” ফলে, ১২ বছর আন্দামানের জেলে কাটিয়ে বারীন ঘোষ
মুক্তি পান |  তা সত্ত্বেও বারীন ঘোষের নামে কুত্সা রটানো হয়, ইংরেজ ও তাদের দালাদের দ্বারা।

বিচারাধিন থাকার সময়ে মাত্র এক বছর অরবিন্দ কারাগারে ছিলেন। এই সময়ে তাঁর মধ্যে এক পরিবর্তন
আসে। তিনি সক্রিয় রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে গ্রহণ করেন আধ্যাত্ম সাধনার জীবন। ৪ঠা এপ্রিল ১৯১০ তারিখে
তিনি ফরাসী অধিকৃত পণ্ডিচেরীতে পৌঁছান। সেখানে তিনি চল্লিশ বছর ধরে সাধনায় মগ্ন থাকেন যার মধ্যে
বারো বছর নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেন। অরবিন্দ ঘোষ হয়ে ওঠেন ঋষি অরবিন্দ বা শ্রীঅরবিন্দ।

পণ্ডিচেরিতে তাঁর সাক্ষাত হয় বিখ্যাত তামিল কবি
সুব্রহ্মমন্যা ভারতীর সঙ্গে। প্রকাশিত করেন “আর্য”
পত্রিকা ১৫ আগস্ট ১৯১৪ তে। ১৯১৪ সালে ফরাসী দম্পতি মীরা ও পল রিচার্ড পণ্ডিচেরিতে এসে ঋষি
অরবিন্দকে দেখে মুগ্ধ হন। ১৯২০ সালের ২৪শে এপ্রিল
মীরা রীচার্ডস পণ্ডিচেরিতে বরাবরের মতো চলে
আসেন। তিনিই পরবর্তিতে
Mother নামে খ্যাত হন এবং ১৯২২ থেকে আশ্রমের ভার গ্রহণ করেন। ১৯২৬
সালের ২৪শে নভেম্বর শ্রী অরবিন্দের “সিদ্ধি” লাভ হয়। ১৯২৭ থেকে তিনি মাত্র ৪টি দর্শনের দিনে জনসম্মুখে
আবির্ভূত হতেন এবং বাকি সময় নির্জনে সাধনা-মগ্ন থাকতেন।

২৮ মে ১৯২৮ তারিখে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পণ্ডিচেরীতে ঋষি অরবিন্দকে দেখে লিখেছিলেন ---
"....অরবিন্দকে তাঁর যৌবনের মুখে ক্ষুব্ধ আন্দোলনের মধ্যে যে তপস্যার আসনে দেখেছিলুম সেখানে তাঁকে
জানিয়েছি
--- 'অরবিন্দ রবীন্দ্রের লহ নমস্কার।'  আজ  তাঁকে  দেখলুম তাঁর দ্বিতীয় তপস্যার আসনে,
অপ্রগল্ ভ  স্তব্ধতায় আজও তাঁকে মনে মনে বলে এলুম --- 'অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহ নমস্কার' ।"
     

শ্রীঅরবিন্দের রচনা বিশাল। তিনি লিখেছেন সাহিত্য, রাজনীতি, আধ্যাত্মিকতা, দর্শন, সংস্কৃতি, যোগ ও
সমাজদর্শন নিয়ে। “ঈশ”, “কেন” প্রভৃতি উপনিষদের তিনি অনুপম ব্যাখ্যা করে গিয়েছেন। ইংরেজীতে লেখা
তাঁর কবিতাগুলি এবং অন্যান্য রচনার গভীরতা মনকে আকৃষ্ট করে। তাঁর মহাকাব্য “সাবিত্রী” এক  
বিস্ময়কর রচনা। কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালে। শ্রীঅরবিন্দ কবিতাটিকে লেখা শুরু  
করেছিলেন ১৯১৬ নাগাদ। প্রায় ৫০ বছর ধরে লেখা এই কাব্যটি অন্তত ১৮ বার রিভাইস বা সংশোধন করা
হয়! কাব্যটিতে রয়েছে ১২টি অধ্যায়, ৪৯টি সর্গ এবং ২৪০০০ পঙ্ ক্তি।

তাঁর বাংলা কবিতার সংখ্যা তুলনায় অল্প। একটি দীর্ঘ কবিতা বা কাব্য “উষাহরণ কাব্য” (আটটি সর্গ)
অসমাপ্ত রয়ে গেছে। তাঁর কবিতার মূল ভাব আধ্যাত্মিক অথবা দেশভক্তি অথবা পৌরাণিক কাহিনী
অবলম্বনে রচিত।


আমরা
মিলনসাগরে  তাঁর কবিতা ইনটারনেটে প্রকাশিত করে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে
আমাদের এই প্রচেষ্টা সার্থক বলে মনে করবো। শ্রীঅরবিন্দের বাংলা কবিতা সম্বলিত এই পাতা তাঁর প্রতি
আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য।  



উত্স - প্রতিমা ঘোষ, অরবিন্দ ঘোষ, বাংলার মনীষা ১     

মিলনসাগরে কবি শ্রীঅরবিন্দের মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।   

www.sriaurobindoashram.org    
http://andamancellularjail.org/    


আমাদের ই-মেল
- srimilansengupta@yahoo.co.in                                         উপরে   


এই পাতার প্রথম প্রকাশ - ০৩.০৮.২০১২
...