রাজপুত্র
কবি বাণী রায়
(“জুপিটার কাব্যগ্রন্থ থেকে”)
রাজপুত্র! রাজপুত্র! পক্ষীরাজ তব
গেছে চলি বহুদিন তেপান্তর ধরি,
সুদূর আকাশ-প্রান্তে দিক্চক্রবাল,
অশ্বারোহী মিলায়েছ কৃষ্ণবিন্দু যেন।
সে তো হল বহুদিন।
বহু ঊষা এল,
কাজল-আকাশে এল কত না প্রদোষ ;
কত পুষ্প বিকশিল,
ভ্রমর গুঞ্জিল,
পক্ষীরাজ ফিরে আর এল না ধরায়।
রাজপুত্র, নিশা-অন্তে র’লে স্বপ্নপ্রায়।
নহি আমি রাজকন্যা,
তবু অনিমিখ
প্রত্যহ প্রত্যক্ষ করি দিগন্তের সীমা,
ধূলা ওঠে ঝড় হয়ে, শুষ্ক পত্র খসে,
ধূসরে মিলায়ে যায় সুদূর নীলিমা।
ওঠে না অশ্বের ধূলি শুধু চক্রবালে,
রাজপুত্র, এ নয়ন ঢাকে বাষ্পজালে॥
. ********************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
রিক্শার গান
কবি বাণী রায়
কঠিন পথেতে কোমল রিক্শা চলে।
রাত্রি অনেক।
---টুং টাং করে করুণ রিক্শা বলে।
পীচ-ঢালা পথ গলে না এখন রোদে।
এখন অনেক রাত।
পিঠের চামড়া-পোড়ানো রৌদ্র নয়---
তবু বড় অবসাদ,
এখন অনেক রাত।
টুং টাং করে ক্লান্ত রিক্শা বলে---
রাত্রি এখন ঝরে
গলানো মোমের নরম ধারানি যেন।
রাত্রির মতো পরাগে পরাগে
ঘুমের শান্তি ধরে।
---মন যে কেমন করে
তোমার বুকের গোপন বাসাটি চেয়ে ;
ঘুমোও ঘুমোও রিকশাতে চড়া মেয়ে ;
স্খলিত শিথিল পা,
আর যে চলছে না।
ধীরে ধীরে চলি
ঘুমের তোমার ঢালাও সুযোগ পেয়ে।
একটু সবুর দাও না, দাও না
. রিক্শাতে চড়া মেয়ে।
আমার মনের থেমে গেছে যত
. মোটর, ট্রাম ও প্লেন ;
গতির বাহন আর তো সে চলে না।
আমার মনেতে এখন রিক্শা চলে।
সে-ও তো অমনি বলে,
আর আমি পারি না,
আর আমি পারি না।
. আর আমি পারি না।
রাতের ছায়ার বাদুড়-পাখার তলে
একটু ঘুমোও এখন সোয়ারী তাই।
একটু জিরেন চাই
. আর আমি পারি না।
এখন মনে তে আমার রিক্শা চলে,
শেষ হয়ে গেছে মোটর-প্লেনের চাকা,
আমার মনের পাখা
গুটিয়ে লুকায় রিক্শা চাকার তলে
শুধুই ক্লান্ত, ক্লান্ত রিক্শা চলে॥
. ********************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
এলিজি
কবি বাণী রায়
মৃত্যুরে দেখেছি আমি শ্বাপদের রূপে।
মত্যু বার-বার জীবনের উপহার
. করেছে হরণ।
দেখেছি নির্লজ্জ সেই বুভুক্ষ মরণ।
বিকশিত জীবনের দল
নিষ্ঠুর নখরাঘাতে বিধ্বস্ত লুণ্ঠিত।
শিশুর শিয়রে তার ভয়াল প্রহরা ;
যৌবনের শয্যাতলে মৃত্যুর কণ্টক।
স্তব্ধ-ভীত আঁখি মেলি’ দেখেছি মরণ
আশ্বাস-বিশ্বাস নিত্য করেছে হরণ।
তোমার কুন্ত কালো,
আরো কালো চোখ,
বিনাহেতু লজ্জানত চোখের পলক।
আইভরি-ম্লান ভালে কুম্কুমের টিপ,
আরক্ত অধর দুটি প্রবালের দ্বীপ,
মানস মুকুতা ঝরে চিত্ত-ঊর্মি থেকে,
বঙ্কিম কটাক্ষ যায় বাঞ্ছিতেরে দেখে।
---মোহিনী কিশোরী তুমি।
তোমারও শিয়রে দেখিলাম কালো দুটি বাদুড়ের পাখা,
গৃধিনীর লুব্ধ নখ।
মর্মর ফলক তোমার বুকের বেদী ;
ফুটিলো গোলাপ,
মৃত্যুর রক্তিম পুষ্প, লুব্ধ নখাঘাতে।
কালো চুলে জ্বলে আলো তবু ক্ষণে-ক্ষণে।
সজাগ প্রহরী সে তো বেহুলা-বাসরে।
ক্লান্ত সুপ্ত সেবীদল ; নিতন্দ্র প্রদীপ ;
জ্বলে প্রদীপের তলে প্রবালের দ্বীপ
মধুর বঙ্কিম হাস্যে।
সে কি উপহাস ?
কালের কবলশূন্য আজো দেহতট,
পেলো না কালের ছোঁয়া
---তাই এত হাসি ?
. ********************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
জুপিটার
কবি বাণী রায়
(“জুপিটার কাব্যগ্রন্থ থেকে”)
দেবরাজ জুপিটার! বাসিয়াছি ভাল
দীর্ঘ রুক্ষ জটাজুট, প্রদীপ্ত নয়ন,
সহস্র শিখায় জ্বলে বজ্র অগ্নিদাহ,
যে অগ্নিতে সেমেলির অকালমরণ।
. আমি বাসিয়াছি ভাল, প্রেমিক দেবতা,
. ভিন্ন ভিন্ন ওই রূপ প্রেমের খেলায় ;
, রাজহংসরূপী,---লেডা, হয়ো সাবধান,
. অতর্কিতে যদি কোনো বিপদ ঘনায়।
আমার অভয় আছে, নই আমি লেডা,
অর্জুনের অন্ধকার এ নয়নে নাই,
বৈরাগ্য-বিদ্রূপ আছে, আছে কুতূহল,
তাই তো নির্ভয়ে কাছে আসিতেই চাই।
. জুপিটার। জুপিটার।
. বজ্র করে হাহাকার,
. ম’রে গেছে জুপিটার জানি বহুদিনই,
. তবু কে দেউলে তার ?
. নব পূজারিণী!
. কী সঙ্গীতে জুপিটার নিতে চাও জিনি ?
. প্রেমের সঙ্গীত শোন, হে প্রেমিক দেব
. বাসনা মিলিয়ে গেছে ইন্দ্রধনু প্রায়,
. মিলিয়েছে ধুলিলীন মনের কামনা,
. উদ্দীপিত চিত্ত আজ দীপ্ত বন্দনায়।
এস এস জুপিটার, হে আকাশচারী,
অলিম্পিয়া-দেবকুলে প্রবল ঈশ্বর,
সাইক্লোপ জন্মে যার রুদ্র প্রেমানলে,
বজ্রের হুঙ্কারে যার শৈল থরথর।
স্বর্ণসূত্রে বাঁধা পৃথ্বী আসনে যাহার,
সেই দেবতায় ডাকি, এস জুপিটার।
. টলমল প্রভঞ্জনে তাম্র জটীপাশ,
. বিজলি খেলিয়া যায় দৃষ্টির বিভঙ্গে
. দণ্ডের আঘাতে যার অশান্ত পাথার,
. সেই দেবতায় ডাকি, এস জুপিটার।
বজ্র, মেঘ, বৃষ্টি ও বিদ্যুৎ---
সকলের ঊর্ধ্বে জাগে মূর্ত্তি কি অদ্ভুত।
বিরহে নয়নে ঝরে ব্যর্থ অশ্রুধার,
তাই চো মৃতেরে ডাকি, এস জুপিটার।
. এস জুপিটার, এস, এস জুপিটার,
. তোমার বন্দনা করি প্রাচীন সত্তার।
. শূন্য দীর্ণ হর্ম্মতল, মৃত ওঠ জেগে,
. মানবীর উপাসনা দিক এনে প্রাণ।
. ********************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
Et tu-Brute
কবি বাণী রায়
নাম ধ’রে ডেকেছিলে ;
বসন্ত প্রভাতে ফুলের মালঞ্চতলে কবে অকস্মাৎ
নাম ধ’রে ডেকেছিলে আমারে তুমিও।
সাগর সিকতা বক্ষে ভাঙে কত ঢেউ,
ফেন-চিহ্ন পড়ে থাকে শুধু বালি-বুকে,
কিছুক্ষণ পড়ে থাকে।
নূতন জোয়ার ভাসায় সে চিহ্নগুলি নীরবে সহজে
জানি তুমি চিনেছিলে।
বহুকামী মন দেখেছিলে আঁখি মেলি পরম কৌতুকে।
ভেবেছিলে খেলা এই,
ভেবেছিলে তুমি, কিশোরীর লীলাখেলা ঘুচিবে একদা।
তোমরা করেছ ভুল।
তর্কশাস্ত্র প’ড়ে চেনা যায় নারী-হিয়া ? বলো দার্শনিক
বলো তুমি অকপটে-পারনি বুঝিতে,
ভেবেছিলে লৌহ-মাটি-চিত্তের স্বরূপ।
লৌহ সে কঠিন অতি,
দারুণ আঘাতে ভাঙিয়া গড়িতে হয়,
মাটি জল দিয়ে
গড়া যায় সব কিছু।
জলে কি কখনো
স্থায়ী মূর্তি গড়া চলে ? --- বলো দার্শনিক।
ফুল ফোটে চিত্ত বনে।
মুঞ্জরিয়া তনু ধরে কত ফুল-শোভা যৌবনের বরে।
পাশে থেকে আচম্বিতে চোখে লাগে ঘোর,
নেশা জাগে রক্ত-মাঝে, ডাকো নাম ধ’রে।
কতদিন কত কথা,
কত বিশ্লেষণে বুঝিয়া লয়েছ তুমি অদ্ভুত এ মন।
তবু সবি ভুলে গিয়ে---তবু অকস্মাৎ---
নাম ধরে ডেকেছিলে, হে বন্ধু। তুমিও ?
. ********************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
দূর বালুচরে চক্রবাকের পিপাসায় দহে প্রাণ
কবি বাণী রায়
শনিবারের চিঠি, ভাদ্র ১৩৫৫ (অগাস্ট ১৯৪৮) সংখ্যা থেকে নেওয়া
চক্রবাকী
চক্কবাকবহুত্র, আমন্তেদি সহঅরম্। উবষ্ঠিদা রঅণী। ---(অভিজ্ঞানশকুন্তলম্)
তুমি যদি শোনাও সঙ্গীত
কবি বাণী রায়
শনিবারের চিঠি, ভাদ্র ১৩৫৫ (অগাস্ট ১৯৪৮) সংখ্যা থেকে নেওয়া
চিরজয়া
পলায়ন
কবি বাণী রায়
সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত শনিবারের চিঠি পত্রিকার কার্তিক ১৩৫০ (নভেম্বর
১৯৪৩) সংখ্যা থেকে।
আপনার আত্মারই অন্বেষণ হতে
দ্রুতবেগে পলায়ন করি ;
জীবন-মৃত্যুরে ঘেরি নামে যে শর্ব্বরী,
তারে করি আপনার চির-আবরণ।
পলায়ন করি
দ্রুতবেগে, অপরাধী ত্রস্ত পলায়ন।
. রাত্রির সীমানা যেথা রচেছে তোরণ,
. তারি অস্তে চির-জাগরণ ;
. উষার হীরক-তারা জ্বলে অনিমিখ,
. সোনার সূর্যেযের আলো হাসে,
. তাহারে এড়ায়ে মম চির-পলায়ন।
সহসা সংসার-মাঝে বিরামের ক্ষণ,
জেগে ওঠে মন,
সহসা সত্যের দেখা পেতে চাহে মন,
তবু সে উদয় হতে ফিরাইয়া মুখ
জীবনের জটা মাঝে পরি যে বন্ধন,
নিজের নিকট হতে চির-পলায়ন।
. জনতার মাঝে আমি মাগি যে আশ্রয় ;
. উইলোর পাতা-ছাওয়া কুঞ্জবাস হতে
. যেখানে আঁধার সন্ধ্যা নামে আদরেতে
. যেখানে সহসা পাখী গেয়ে ওঠে গান,---
. আমি খুঁজি চৌরঙ্গীর সজ্জিত বিপণি,
. বিদেশী পণ্যের মাঝে নিজের বিলয়।
ভয় পায় মন---
নিঃসঙ্গ পাহাড়চূড়ে নির্ঝর-সঙ্গমে,
চক্রবাক্যে বালিশয্যা বিছানো সাগরে,
লাজুক পরীর কোণে
শঙ্খের কঙ্কণে
পল্লীবধু যেখা করে সন্ধ্যাদীপ ধরে।
রাত্রির প্রহরে
নগরীর ধূম্রজাল নিয়ে বিসরিয়া
যদি মম ভ্রান্ত আত্মা ওঠে
সে মহান সৌন্দর্য্যের কল্পনাস্বপনে,
আনি ফিরাইয়া
রাজপথে ত্রিতলের সুখশয্যা-বুকে।
ভয় পাই আমি
সে নিঃসঙ্গ সৌন্দর্যের ক্ষণপরশনে।
. তোমার প্রদীপ্ত আঁখি যদি
. আমার এ তন্দ্রাস্তব্ধ অন্তরেতে পশে,
. দেখিবে সেখানে তুমি নাহি কোন সুখ,
. প্রণয় উন্মুখ ;
. শুধু আছে ভীতি নিরবধি।
. প্রেমের সন্ধান হতে চির পলায়ন॥
. ********************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
একটি সনেট
কবি বাণী রায়
সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত শনিবারের চিঠি পত্রিকার পৌষ ১৩৫৩ (জানুয়ারী ১৯৪৭)
সংখ্যা থেকে।
উন্মীল ময়ূখমালা --- কিরণ-মুকুট
রজনীর তম ভেদি জাগিল পলকে,
উথলে রজত-সিন্ধু আলোর ঝলকে
উদিল প্রাচীর নভে তপনের মুখ।
রজনীর বক্ষে আজো পুরাতন দুখ,
তারকার মাল্য, আহা, যদিও অলকে!
তবু নিশা চাহে মুক্তি আলোর স্তবকে,
প্রভাতে ফিরিয়া পেতে হৃদয় উত্সুক।
আমার প্রভাত হাসে মানসের তলে ;
বর্তমান অন্ধকার নিশার পাথার।
তবি জ্যোতি ল’য়ে চাহে দিবাকর মম,
আলোক পরশ তার সঙ্গোপনে জ্বলে ;
এক সনে সম্মিলিত আলোক-আঁধার ;
আমার তপন হয়ে জাগো প্রিয়তম।
. ********************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
একলা দিনে
কবি বাণী রায়
আবু সয়ীদ আইউব সম্পাদিত “পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা”, বৈশাখ ১৩৫৩ (এপ্রিল
১৯৪৬), কাব্যসংকলন থেকে নেওয়া।
হয়তো এমনি দিন কাটিবে কতই
তোমার প্রতীক্ষা-ম্লান বসি বাতায়নে
মিলিবে নিঃশ্বাস মম দক্ষিণার সনে।
. তোমারে পাব না শুধু পাশে।
বর্ষা যবে আমার এ জগতের পরে
টেনে দিবে যবনিকা বৃষ্টির অক্ষরে ;
রাত্রি জাগে মোহময় চাঁদের আভায়,
তারায় তারায় যবে স্বপন ঘুমায় ;
সঙ্গীহীন দিবারাত্রি ঝরাবে নয়ন।
. তোমারে পাব না শুধু পাশে।
অনাগত যত দিন আছে
তাহারা কখনো কেউ পাবে কি তোমায়?
শরতের আগমনী, বসন্তের হোলি,
হৈম কোজাগরী আর প্রথম বৈশাখ ;
সব দিন ছন্দহীন আসিবে বৃথায়।
. তোমারে পাব না কভু পাশে।
. ********************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর