কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা |
অধঃপতন সঙ্গীত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী” ২য় খন্ড, ১৯৫৫ থেকে নেওয়া | ১ বাগানে যাবি রে ভাই ? চল সবে মিলে যাই, যথা হর্ম্ম্য সুশোভন, সরোবরতীরে | যথা ফুটে পাঁতি পাঁতি, গোলাব মল্লিকা জাতি, বিগ্নোমিয়া লতা দোলে মৃদুল সমীরে || নারিকেল বৃক্ষরাজি, চাঁদের কিরণে সাজি, নাচিছে দোলায়ে মাথা ঠমকে ঠমকে | চন্দ্রকরলেখা তাহে, বিজলি চমকে || ২ চল যথা কুঞ্জবনে, নাচিবে নাগরী গণে, রাঙ্গা সাজ পেসোয়াজ, পরশিবে অঙ্গে | তম্বুরা তবলা চাটি, আবেশে কাঁপিবে মাটি, সারঙ্গ তরঙ্গ তুলি, সুর দিবে সঙ্গে || খিনি খিনি খিনি খিনি, ঝিনিকি ঝিনিকি ঝিনি তাধ্রিম্ তাধ্রিম্ তেরে গাও না বাজনা ! চমকে চাহনি চারু, ঝলকে গহনা || ৩ ঘরে আছে পদ্মমুখী কভু না করিল সুখী, শুধু ভাল বাসা নিয়ে, কি হবে সংসারে | নাহি জানে নৃত্যগীত, ইয়ার্ কিতে নাহি চিত, একা বসি ভাল বাসা ভাল লাগে কারে ? গৃহধর্ম্মে রাখে মন, হিত ভাবে অনুক্ষণ, সে বিনা দুঃখের দিনে অন্য গতি নাই ! এ হেন সুখের দিনে, তারে নাহি চাই || ৪ আছে ধন গৃহপূর্ণ, যৌবন যাইবে তূর্ণ যদি না ভুঞ্জিনু সুখ, কি কাজ জীবনে ? ঠুসে মদ্য লও সাতে, যেন না ফুরায় রাতে, সুখের নিশান গাঢ় প্রমোদভবনে | খাদ্য লও বাছা বাছা, দাড়ি দেখে লও চাচা, চপ্ সুপ কারি কোর্ম্মা, করিবে বিচিত্র | বাঙ্গালির দেহ রত্ন, ইহাতে করিও যত্ন, সহস্র পাদুকা স্পর্শে, হয়েছে পবিত্র | পেটে খায়, পিঠে সয়, আমার চরিত্র || ৫ বন্দে মাতা সুরধুনি, কাগজে মহিমা শুনি, বোতলবাহিনি পুণ্যে একশ নন্দিনি ! করি ঢক ঢক নাদ, পুরাও ভকতসাধ, লোহিত বরণি বামা, তারেতে বন্দিনি ! প্রণমামি মহানীরে, ছিপির কিরীটি শিরে, উঠ শিরে ধীরে ধীরে যকৃত্জননী ! তোমার কৃপার জন্য, যেই পড়ে সেই ধন্য শয্যায় পতিত রাখ, পতিতপাবনি ! বাক্ স বাহনে চল, ডজন ডজনি || ৬ কি ছার সংসারে আছি, বিষয় অরণ্যে মাছি, মিছা করি ভন্ ভন্ চাকরি কাঁটালে | মারে জুতা সই সুখে, লম্বা কথা বলি মুখে, উচ্চ করি ঘুষ তুলি দেখিলে কাঙ্গালে || শিখিয়াছি লেখা পড়া, ঠান্ডা দেখে হই কড়া, কথা কই চড়া চড়া, ভিখারি ফকিরে | দেখ ভাই রোখ কত, বাঙ্গালি শরীরে ! ৭ পূর পাত্র মদ্য ঢালি, দাও সবে করতালি, কেন তুমি দাও গালি, কি দোষ আমার ? দেশের মঙ্গল চাও ? কিসে তার ত্রুটি পাও ? লেক্ চরে কাগজে বলি, কর দেশোদ্ধার || ইংরেজের নিন্দা করি, আইনের দোষ ধরি, সম্বাদ পত্রিকা পড়ি, লিখি কভু তায় | আর কি করিব বল স্বদেশের দায় ? ৮ করেছি ডিউটির কাজ, বাজা ভাই পাখোয়াজ, কামিনী, গোলাপি সাজ, ভাসি আজ রঙ্গে | গেলাস পূরে দে মদে, দে দে দে আরো আরো দে, দে দে এরে দে ওরে দে, ছড়ি দে সারঙ্গে | কোথায় ফুলের মালা, আইস্ দে না ? ভাল জ্বালা, “বংশী বাজায় চিকণ কালা ?” সুর দাও সঙ্গে | ইন্দ্র স্বর্গে খায় সুধা, স্বর্গ ছাড়া কি বসুধা ? কত স্বর্গ বাঙ্গালায় মদের তরঙ্গে | টলমল বসুন্ধরা ভবানী ভ্রূভঙ্গে || ৯ যে ভাবে দেহের হিত, না বুঝি তাহার চিত, আত্মহিত ছেড়ে কেবা, পরহিতে চলে ? না জানি দেশ বা কার ? দেশে কার উপকার ? আমার কি লাভ বল, দেশ ভাল হলে ? আপনার হিত করি, এত শক্তি নাহি ধরি দেশহিত করিব কি, একা ক্ষুদ্র প্রাণী | ঢাল মদ ! তামাক দে ! লাও ব্রান্ডি পানি | ১০ মনুষ্যত্ব ? কাকে বলে ? স্পিচ দিই টোনহলে, লোকে আসে দলে দলে, শুনে পায় প্রীত | নাটক নবেল কত, লিখিয়াছে শত শত, এ কি নয় মনুষ্যত্ব ? নয় দেশহিত ? ইংরেজি বাঙ্গালা ফেঁদে, পলিটিক্ স লিখি কেঁদে, পদ্য লিখি নানা ছাঁদে, বেচি সস্তা দরে | অশিষ্টে অথবা শিষ্টে, গালি দিই অষ্টে পৃষ্ঠে , তবু বল দেশহিত কিছু নাহি করে ? নিপাত যাউক দেশ ! দেখি বসে ঘরে || ১১ হাঁ ! চামেলি ফুলিচম্পা ! মধুর অধর কম্পা ! হাম্বীর কেদার ছায়ানট সুমধুর ! হুক্কা না দুরন্ত বোলে ? শের মে ফুল না ডোলে ! পিয়ালা ভর দে মুঝে ! রঙ্ ভরপুর ! সুপ চপ কটলেট, আন বাবা প্লেট প্লেট কুক্ বেটা ফাষ্টরেট, যত পার খাও ! মাথামুন্ড পেটে দিয়ে, পড় বাপু জমি নিয়ে, জনমি বাঙ্গালিকুলে, সুখ কব়্যে যাও | পতিতপাবনি সুরে, পতিতে তরাও || ১২ যাব ভাই অধঃপাতে, কে যাইবি আয় সাতে কি কাজ বাঙ্গালি নাম, রেখে ভূমন্ডলে ? লেখাপড়া ভস্ম ছাই, কে কবে শিখেছে ভাই, লইয়া বাঙ্গালি দেহ, এই বঙ্গস্থলে ? হংসপুচ্ছ লয়ে করে, কেরাণির কাজ করে, মুন্সেফ চাপরাশি আর ডিপুটী পিয়াদা | অথবা স্বাধীন হয়ে, ওকালতি পাশ লয়ে, খোশামুদি জুয়াচুরি, শিখিছে জিয়াদা ! সার কথা বলি ভাই, বাঙ্গালিতে কাজ নাই, কি কাজ সাধিব মোরা, এ সংসারে থাকি, মনোবৃত্তি আছে যাহা, ইন্দ্রিয় সাগরে তাহা বিসর্জ্জন করিয়াছি, কিবা আছে বাকি ? কেহ দেহভার বয়ে, যমে দাও ফাঁকি ? ১৩ ধর তবে গ্লাস আঁটি, জ্বলন্ত বিষের বাটি শুন তবলার চাঁটি, বাজে খন্ খন্ | নাচে বিবি নানা ছন্দ, সুন্দর খামিরা গন্ধ, গম্ভীর জীমূতমন্দ্র হুঁকার গর্জ্জন || সেজে এসো সবে ভাই, চল অধঃপাতে যাই, অধম বাঙ্গালি হতে, হবে কোন কাজ ? ধরিতে মনুষ্যদেহ, নাহি করে লাজ ? ১৪ মর্কটের অবতার, রূপগুণ সব তার বাঙ্গালির অধিকার, বাঙ্গালি ভূষণ ! হা ধরণি, কোন্ পাপে, কোন্ বিধাতার শাপে হেন পুত্রগণ গর্ব্ভে, করিলে ধারণ ? বঙ্গদেশ ডুবাবারে, মেঘে কিম্বা পারাবারে, ছিল না কি জলরাশি ? কে শোষিল নীরে ? আপনা ধ্বংসিতে রাগে কতই শকতি লাগে ? নাহি কি শকতি তত বাঙ্গালি শরীরে ? কেন আর জ্বলে আলো বঙ্গের মন্দিরে ? ১৫ মরিবে না ? এসো তবে, উন্নতি সাধিয়া সবে, লভি নাম পৃথিবীতে, পিতৃ সমতুল ! ছাড়ি দেহ খেলা ধূলা, ভাঙ বাদ্যভান্ডগুলা মারি খেদাইয়া দাও, নর্ত্তকীর কুল | মারিয়া লাঠির বাড়ি, বোতল ভাঙ্গহ পাড়ি, বাগান ভাঙ্গিয়া ফেল পুকুরের তলে | সুখ নামে দিয়ে ছাই, দুঃখ সার কর ভাই, কভু না মুছিবে কেহ, নয়নের জলে, যত দিন বাঙ্গালিকে লোকে ছি ছি বলে || . **************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |