কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
সাবিত্রী
কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী” ২য় খন্ড,  ( ১৯৫৫ ) থেকে নেওয়া |


.            ১

তমিস্রা রজনী ব্যাপিল ধরণী,
দেখি মনে মনে পরমাদ গণি,
বনে একাকিনী বসিলা রমণী
.           কোলেতে করিয়া স্বামীর দেহ |
আঁধার গগন ভুবন আঁধার,
অন্ধকার গিরি বিকট আকার,
দুর্গম কান্তার ঘোর অন্ধকার,
.           চলে না ফেরে না নড়ে না কেহ ||


.              ২

কে শুনেছে হেথা মানবের রব ?
কেবল গরজে হিংস্র পশু সব,
কখন খসিছে বৃক্ষের পল্লব,
.             কখন বসিছে পাখী শাখায়
ভয়েতে সুন্দরী বনে একেশ্বরী,
কোলে আরও টানে পতিদেহ ধরি,
পরশে অধর অনুভব করি,
.              নীরবে কাঁদিয়া চুম্বিছে তায় ||


.                ৩

হেরে আচম্বিতে এ ঘোর সঙ্কটে,
ভয়ঙ্কর ছায়া আকাশের পটে,
ছিল যত তারা তাহার নিকটে
.              ক্রমে ম্লান হয়ে গেল নিবিয়া |
সে ছায়া পশিল কাননে ,--- অমনি,
পলায় শ্বাপদ উঠে পদধ্বনি,
বৃক্ষশাখা কত ভাঙ্গিল আপনি,
.               সতী ধরে শবে বুকে আঁটিয়া ||


.                     ৪

সহসা উজলি ঘোর বনস্থলী,
মহাগদাপ্রভা, যেন বা বিজলি,
দেখিয়া সাবিত্রী যেন রত্নাবলী,
.                ভাসিল নিঝরে আলোক তার |
মহাগদা দেখি প্রণমিলা সতী,
জানিল কৃতান্ত পরলোকপতি,
এ ভীষণা ছায়া তাঁহারই মূরতি,
.                ভাগ্যে যাহা থাকে হবে এবার ||


.                       ৫

গভীর নিস্বনে কহিলা শমন,
থর থর করি কাঁপিল গহন,
পর্ব্বতগহ্বরে ধ্বনিল বচন,
.                 চমকিল পশু বিবর মাঝে |
“ কেন একাকিনী মানবনন্দিনী,
শব লয়ে কোলে যাপিছ যামিনী,
ছাড়ি দেহ শবে ; তুমি ত অধীনী,
.                মম সঙ্গে তব বাদ কি সাজে ||


.                     ৬

“এ সংসারে কাল বিরামহীন,
নিয়মের রথে ফিরে রাত্রি দিন,
যাহারে পরশে সে মম অধীন,
.            স্থাবর জঙ্গম জীব সবাই |
সত্যবানে আসি কাল পরশিল,
লতে তারে মম কিঙ্কর আসিল,
সাধ্বী অঙ্গ ছুঁয়ে লইতে নারিল,
.           আপনি লইতে এসেছি তাই ||”      


.               ৭

সব হলো বৃথা না শুনিল কথা,
না ছাড়ে সাবিত্রী শবের মমতা,
নারে পরশিতে সাধ্বী পতিব্রতা,
.               অধর্ম্মের ভয়ে ধর্ম্মের পতি |
তখন কৃতান্ত কহে আর বার,
অনিত্য জানিও এ ছার সংসার,
স্বামী পুত্র বন্ধু নহে কেহ কার,
.               আমার আলয়ে সবার গতি ||


.               ৮

“রত্নছত্র শিরে রত্নভূষা অঙ্গে,
রত্নাসনে বসি মহিষীর সঙ্গে,
ভাসে মহারাজা সুখের তরঙ্গে,
.                 আঁধারিয়া রাজ্য লই তাহারে |
বীরদর্প ভাঙ্গি লই মহাবীরে,
রূপ নষ্ট করি লই রূপসীরে,
জ্ঞান লোপ করি গরাসি জ্ঞানীরে,
.                 সুখ আছে শুধু মম আগারে ||
     
              
.                 ৯

“অনিত্য সংসার পুণ্য কর সার,
কর নিজ কর্ম্ম নিয়ত যে যার,
দেহান্তে সবার হইবে বিচার,
.               দিই আমি সবে করমফল |
যত দিন সতী তব আয়ু আছে,
করি পুণ্য কর্ম্ম এসো স্বামী পাছে—
অনন্ত যুগান্ত রবে কাছে কাছে,
.              ভুঞ্জিবে অনন্ত মহা মঙ্গল ||


.                    ১০

“অনন্ত বসন্তে তথা অনন্ত যৌবন,
অনন্ত প্রণয়ে তথা অনন্ত মিলন,
অনন্ত সৌন্দর্য্যে হয় অনন্ত দর্শন,
.                 অনন্ত বাসনা, তৃপ্তি অনন্ত |
দম্পতি আছয়ে, নাহি বৈধব্য-ঘটনা,
মিলন আছয়ে, নাহি বিচ্ছেদযন্ত্রণা,
প্রণয় আছয়ে, নাহি কলহ গঞ্জনা,
.                  রূপ আছে, নাহি রিপু দুরন্ত ||


.                   ১১

“রবি তথা আলো করে, না করে দাহন,
নিশি স্নিগ্ধকরী,  নহে তিমির কারণ,
মৃদু গন্ধবহ ভিন্ন নাহিক পবন,
.                কলা নাহি চাঁদে, নাহি কলঙ্ক |
নাহিক কন্টক তথা কুসুম রতনে,
নাহিক তরঙ্গ স্বচ্ছ কল্লোলিনীগণে,
নাহিক অশনি তথা সুবর্ণের ঘনে,
.                 পঙ্কজ সরসে নাহিক পঙ্ক ||


.                     ১২

“নাহি তথা মায়াবেশ বৃথায় রোদন,
নাহি তথা ভ্রান্তিবশে বৃথায় মনন,
নাহি তথা রিপুবশে বৃথায় যতন,
.                নাহি শ্রমলেশ, নাহি অলস |
ক্ষুধা তৃষ্ণা তন্দ্রা নিদ্রা শরীরে না রয়,
নারী তথা প্রণয়িনী বিলাসিনী নয়,
দেবের কৃপায় দিব্য জ্ঞানের উদয়,
.                দিব্য নেত্রে নিরখে দিক্ দশ ||

                  
.                  ১৩

“জগতে জগতে দেখে পরমাণুরাশি
মিলিছে ভাঙ্গিছে পুনঃ ঘুরিতেছে আসি,
লক্ষ লক্ষ বিশ্ব গড়ি ফেলিছে বিনাশি,
.               অচিন্ত্য অনন্ত কালতরঙ্গে |
দেখে লক্ষ কোটী ভানু অনন্ত গগনে,
অনন্ত বর্ত্তন রব শুনিছে শ্রবণে,
.                 মাতিছে চিত্ত সে গীতের সঙ্গে ||


.                    ১৪

“দেখে কর্ম্মক্ষেত্রে নর কত দলে দলে,
নিয়মের জালে বাঁধা ঘুরিছে সকলে,
ভ্রমে পিপীলিকা যেন নেমীর মন্ডলে,
.               নির্দ্দিষ্ট দূরতা লঙ্ঘিতে নারে |
ক্ষণকাল তবে সবে ভবে দেখা দিয়া,
জলে যেন জলবিম্ব যেতেছে মিশিয়া,
পুণ্যবলে পুণ্যধামে মিলিছে আসিয়া,
.                পুণ্যই সত্য অসত্য সংসার ||


.                 ১৫

“তাই বলি কন্যে,  ছাড়ি দেহ মায়া,
ত্যজ বৃথা ক্ষোভ ; ত্যজ পতিকায়া,
ধর্ম্ম আচরণে হও তার জায়া,
.                 গিয়া পুণ্যধাম |
গৃহে যাও ত্যজি কানন বিশাল
থাক যত দিন না পরশে কাল,
কালের পরশে মিটিবে জঞ্জাল,
.                 সিদ্ধ হবে কাম ||”


.               ১৬

শুনি যমবাণী জোড় করি পাণি,
ছাড়ি দিয়া শবে, তুলি মুখখানি
ডাকিছে সাবিত্রী ; -- “কোথায় না জানি,
.                কোথা ওহে কাল |
দেখা দিয়া রাখ এ দাসীর প্রাণ,
কোথা গেলে পাব কালের সন্ধান,
পরশিয়ে কর এ সঙ্কটে ত্রাণ,
.                   মিটাও জঞ্জাল ||


.                ১৭

“স্বামিপদ যদি সেবে থাকি আমি,
কায় মনে যদি পূজে থাকি স্বামী,
যদি থাকে বিশ্বে কেহ অন্তর্য্যামী,
.                 রাখ মোর কথা |
সতীত্বে যদ্যপি থাকে পুণ্যফল,
সতীত্বে যদ্যপি থাকে কোন বল,
পরশি আমরে, দিয়ে পদে স্থল,
.                 জুড়াও এ ব্যথা ||”
       
         
.               ১৮

নিয়মের রথ ঘোষিল ভীষণ,
আসি প্রবেশিল সে ভীম কানন,
পরশিল কাল সতীত্ব রতন,
.                সাবিত্রী সুন্দরী !
মহাগদা তবে চমকে তিমিরে,
শবপদরেণু তুলি লয়ে শিরে,
ত্যজে প্রাণ সতী অতি ধীরে ধীরে
.               পতি কোলে করি ||


.               ১৯

বরষিল পুষ্প অমরের দলে,
সুগন্ধি পবন বহিল ভূতলে,
তুলিল কৃতান্ত শরীরিযুগলে,
.                বিচিত্র বিমানে |
জনমিল তথা দিব্য তরুবর,
সুগন্ধি কুসুমে শোভে নিরন্তর,
বেড়িল তাহাতে লতা মনোহর,
.                সে বিজন স্থান ||

.             ****************                                   
.                                                                                             
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর