কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
বায়ু
কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী” ২য় খন্ড, ( ১৯৫৫ ) থেকে নেওয়া |



জন্ম মম সূর্য্য-তেজে,  আকাশ মন্ডলে |
.          যথা ডাকে মেঘরাশি,
.          হাসিয়া বিকট হাসি,
.                       বিজলি উজলে ||
.           কেবা মম সম বলে,
হুহুঙ্কার করি যবে,  নামি রণস্থলে |
.           কানন ফেলি উপাড়ি,
.           গুঁড়াইয়া ফেলি বাড়ী,
.           হাসিয়া ভাঙ্গিয়া পাড়ি,
.                       অটল অচলে |
হাহাকার শব্দ তুলি এ সুখ অবনীতলে ||



পর্ব্বতশিখরে নাচি, বিষম তরসে,
.           মাতিয়া মেঘের সনে,
.           পিঠে করি বহি ঘনে,
.                         সে ঘন বরষে |
.           হাসে দামিনী সে রসে |
মহাশব্দে ক্রীড়া করি, সাগর উরসে ||
.           মথিয়া অনন্ত জলে,
.           সফেন তরঙ্গদলে.
.           ভাঙ্গি তুলে নভস্তলে,
.                        ব্যাপি দিগ্ দশে |
শীকরে আঁধারি জগৎ, ভাসাই দেশ অলসে ||



বসন্তে নবীন লতা,  ফুল দোলে তায় |
.             যেন বায়ু সে বা নহি,
.             অতি মৃদু মৃদু বহি,
.                         প্রবেশি তথায় ||
.             হেসে মরি যে লজ্জায় ---
পুষ্পগন্ধ চুরি করি,  মাখি নিজ গায়ে ||
.             সরোবরে স্নান করি,
.             যাই যথায় সুন্দরী,
.             বসে বাতায়নোপরি,
.                         গ্রীষ্মের জ্বালায় ||
.             তাহার অলকা ধরি,
.             মুখ চুম্বি ঘর্ম্ম হরি,
.             অঞ্চল চঞ্চল করি,
.                         স্নিগ্ধ করি কায় ||
আমার সমান কেবা যুবতীমন ভুলায় ?
  


বেণুখন্ড মধ্যে থাকি, বাজাই বাঁশরী |
.              রন্ধ্রে রন্ধ্রে যাই আসি,
.              আমিই মোহন বাঁশি,
.                         সুরের লহরী ||
.              আর কার গুণে হরি,
ভুলাইত বৃন্দাবনে, বৃন্দাবনেশ্বরী ?
.              ঢল ঢল চল চল,
.              চঞ্চল যমুনা জল,
.              নিশীথ ফুলে উজল,
.                         কানন বল্লরী,
তার মধ্যে বাজিতাম বংশীনাদ রূপ ধরি ||



জীবকন্ঠে যাই আসি,  আমি কন্ঠস্বর |
.              আমি বাক্য, ভাষা আমি,
.              সাহিত্য বিজ্ঞান স্বামী,
.                          মহীর ভিতর ||
.              সিংহের কন্ঠেতে আমিই হুঙ্কার
.              ঋষির কন্ঠেতে আমিই ওঙ্কার,
.              গায়ককন্ঠেতে আমিই ঝঙ্কার,
.                          বিশ্ব-মনোহর ||
.               আমিই রাগিণী আমি ছয় রাগ,
.               কামিনীর মুখে আমিই সোহাগ,
.             বালকের বাণী অমৃতের ভাগ,
.                           মম রূপান্তর ||
.              গুণ গুণ রবে ভ্রময়ে ভ্রমর,
.              কোকিল কুহরে বৃক্ষের উপর,
.              কলহংস নাদে সরসী ভিতর
.                             আমারি কিঙ্কর ||
আমি হাসি আমি কান্না, স্বররূপে শাসি নর ||



কে বাঁচিত এ সংসারে, আমার বিহনে ?
.              আমি না থাকিলে ভুবনে ?
.              আমিই জীবের প্রাণ,
.              দেহে করি অধিষ্ঠান
.                              নিশ্বাস বহনে |
.               উড়াই খগে গগনে |
দেশে দেশে লয়ে যাই, বহি যত ঘনে |
.              আনিয়া সাগরনীরে,
.              ঢালে তারা গিরিশিরে
.              সিক্ত করি পৃথিবীরে,
.                              বেড়ায় গগনে |
মম সম দোষে গুণে, দেখেছ কি কোন জনে ?



মহাবীর দেব অগ্নি জ্বালি সে অনলে |
.              আমিই জ্বালাই যাঁরে
আমিই নিবাই তাঁরে,
.                               আপনার বলে |
.                 মহাবলে বলী আমি, মন্থন করি সাগর |
.                 রসে সুরসিক আমি, কুসুমকুলনাগর ||
.                 শিহরে পরশে মম কুলের কামিনী |
.                 মজাইনু বাঁশী হয়ে, গোপের গোপিনী ||
.                 বাক্যরূপে জ্ঞান আমি স্বরূপে গীত |
.                 আমারি কৃপায় ব্যক্ত ভক্তি দম্ভ প্রীত ||
.                  প্রাণবায়ুরূপে আমি রক্ষা করি জীবগণ |
হুহু হুহু ! মম সম গুণবান্ আছে কোন জন ?

.                        ****************                                   
.                                                                                             
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
বসন্তের নিকট বিদায়
কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী” ২য় খন্ড, ( ১৯৫৫ ) থেকে নেওয়া |

ত্রিপদী

হা বসন্ত মনোহর,                      হা মোহন রূপধর,
হা রে হৃদি বিচঞ্চলকর |
লইয়ে রূপের ভার,                     কেন কর পরিহার,
এ মহী মন্ডল মনোহর ||
আর কিছু দিন ওরে,                    রহ রে ধরণী পরে,
বিদায় তোমারে নারি দিতে |
জানি জানি মরি মরি,                 এ পাপ পৃথিবী পরি,
নারো আর দিনেক রহিতে ||
যতেক তোমার শোভা,                মোহকর মনোলোভা,
উড়ে যায় নহে স্থিরতর |
খর দিনকর করে,                     ক্রমেতে মলিন করে,
মোহকর সে শোভা নিকর ||
তাপিত কুসুম ফুলে,                   মাথা তুলে দুলে দুলে,
মৃদু রবে মরুতেরে কয় |
“পাপ তাপে দহে দেহ,                   বসন্ত আনিয়া দেহ,
মরি সে কি ফিরিবার নয় ||”
না কুসুম সুন্দরী রে,               আসিবে আসিবে ফিরে,
সাধের বসন্ত মনোহর |
কিন্তু সে আসিলে ফের,          তোরা তো পাবি নে টের,
আজি যাবে পড়িয়া ভূপর ||
আ মরি অমনি দুখে,                বিদরে আমার বুকে,
এ অসার সংসারে রহিয়ে |
ফুলের বসন্ত মত,                       আশার যতন যত
যে সকল সুখের লাগিয়ে ||
আশা মোর সে বসন্ত,                বুঝি আমি হলে অন্ত,
তবে আসি হবে রে ঘটনা |
প্রখর দুখের রবি,                      চিরদিন বুঝি রবি,
অভাগারে দিবারে যন্ত্রণা ||
মরি আরে কেন আর,                কেঁদে মরি এ প্রকার,
মানবেরি এমন কপাল |
ইহ লোকে চির দীন,                     হৃদি রবে সুখহীন,
মনোদুখে কাটাইবে কাল |
পরিণামে নিত্য নামে,              পাবে সেই নিত্য ধামে,
নিত্যই বসন্ত বিকশিত |
যাই তথা যাই তূর্ণ,                          পরম প্রণয় পূর্ণ,
পরমেশে প্রেমে করি প্রীত ||
কি ছার মিছার আর,                      মুখাম্বুজ মহিলার,
মোহ ভরে করি নিরীক্ষণ |
তেমতি মোহিত মতি,                  সে প্রীতি প্রকৃতি প্রতি,
রাখিবেক করিয়া যতন ||
হা মলয় কেন তুমি, উন্মাদের প্রায় |
বেগ ভরে যাও দ্রুত, যথায় তথায় ||
প্রাণের প্রাণেশ্বরী, কুসুমের কুলে |
নাহিক নিরখি নেত্রে, জ্ঞান গেছ ভুলে ||
না রে চল ধীরে ধীরে,                   আসিবে বসন্ত ফিরে,
ফিরে আসি ফুটাইবে ফুল |
ফিরে ফুটাইলে ফুলে,                      লইও সৌরভ তুলে,
চুম্বিয়া সে কুসুমের কুল ||
কিন্তু রে কভু কি আর,                 আছে আশা ফিরিবার,
মানবের যৌবন বসন্ত |
ফুটায়ে প্রণয় ফুলে,                        মানবেরে দিবে তুলে,
সুখ রূপী সৌরভ অনন্ত ||
নারে সে কখনো আর,                   নহেকো রে ফিরিবার,
গেলে কাল আর নাহি ফেরে |
কেবলি চলিবে কাল,                        যদিন না ধরে কাল,
ছাড়ায়ে মায়ার যত ফেরে ||
আসিবে সে দিন যবে,                   কি সুখ দিবারে রবে,
যৌবন যুবতী প্রেম সুখ |
শুধু তারা দেবে জ্বালা,                     মনে হবে ঝালাপালা,
ভাবিয়া পাপের যত দুখ ||
তাই বলি পরিণামে,                        অধরেতে ধরি নামে,
ঈশ্বরে অন্তরে ভাবে যেই |
পরমেশ প্রেমাস্পদ,                    লাভ করি মোক্ষপদ,
নিত্যই বসন্ত পাবে সেই ||

.                                    ****************                                   
.                                                                                             
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
দূরদেশ গমনের বিদায়
কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী” ২য় খন্ড,  ( ১৯৫৫ ) থেকে নেওয়া |
১৭ ফেব্রুয়ারী , ১৮৫৩, “সংবাদ প্রভাকরে প্রকাশিত “|


পতি
ললিত
এবার দেখি আয়,                        দেখি দেখি এইবার,
দেখি ফিরে বিধুমুখ,                দেখি আঁখি ভরি লো |
আজিকার নিশি ভোরে          লয়ে যাবে কোথা মোরে,
কত দিন তোমা বিনে                রহিব কি করি লো ||
বিদরে বিদরে বুক,                হেরিব না বিধুমুখ,
বিধুমুখ হাসি ভরা,                রব স্বপ্নে স্মরি লো |
আসি কি না আসি ফিরে,        হেরি কি না প্রেয়সীরে,
জানি নে জানি নে কিছু,                বাঁচি কি না মরি লো ||
হেরি কি না হেরি আর,                শশিমুখে ফিরে বার,
জনমের মত তাই                হেরি ভাল করি লো |
সেই শেষ সুখ মরি,                বিধি বুঝি লয় হরি,
বুঝি নিশি পোহাইল,                তাই হৃদে ডরি লো ||
কি শুনি কি শুনি ধনি                কুহু কুহু করি ধ্বনি,
হৃদয়ে শিহরি মরি,                যে শুনেছি কাণে রে |
বুঝেছি বুঝেছি মরি,                পোহাইল বিভাবরী,
পোহাইল পোহাইল,                মন তা না মানে রে ||
হা রজনী একবার,                রহ রহ রহ আর,
একবার চাহি আমি,                 চন্দ্রমুখী পানে রে |
মুখ পানে চেয়ে রই,                নয়নে নয়ন হই,
একবার দীর্ঘশ্বাস,                সলিল নয়ন রে ||
একবার মরি মরি,                হৃদয়ে হৃদয়ে করি,
অধরে অধর ধরি,                জুড়াইব প্রাণে রে |
ধরি হৃদি হৃদি পরে,                কত দিবসের তরে,
জনমের মত কি না,                কে জানে কে জানে রে ||
না লো না লো মিছে বলি,         যামিনী গিয়াছে চলি,
ফিরিবে না, ফিরিবে না,         ফিরিবার নয় লো |
ওই দেখ নীল নিশি,                মৃদু আলো সনে মিশি,
ফিরিছে বিঘোর আলো,                চারিদিক ময় লো ||
অসীম আকাশে পশি,                নাহি রবি নাহি শশী,
গগনে নিভেছে যেন,                যত তারাচয় লো |
কি বলি গগনোপরে,                একাকী মধুর করে,
প্রভাতের সুখতারা,                কিবা শোভা হয় লো ||
এখনি আকাশোপর,                 প্রকাশিবে প্রভাকর,
এখনি যাইব কোথা,                ভেবে হৃদি দয় লো |
আসি লো আসি লো প্রিয়ে         আসি লো বিদায় নিয়ে,
চলিলাম কতদূরে                কি কপালে রয় লো ||
যথা যাব তথা রব,                প্রেমডোরে বাঁধা তব,
অন্তরে অন্তরে বাঁধা,                প্রণয়েরি পাশে লো |
স্বপনে নয়নে মনে,                হেরিব সে চন্দ্রাননে,
হেরিব সে বিধুমুখ,                মৃদু মৃদু হাসে লো ||
তোমা চিন্তা সর্ব্বক্ষণে,                শয়নে স্বপনে মনে,
এক আশে রবে প্রাণ,                ফিরি দেখা আশে লো |
সুখ শশী হলে হারা,                একা প্রভাতের তারা,
হবে মোর অন্ধকার,                হৃদয় আকাশে লো ||

স্ত্রী
ত্রিপদী

কেন আরে বিভাবরি,                পোহাইল মরি মরি,
পোহাইল দিবারে যাতনা |
কেন রে যামিনী ভাগে,                স্বপ্নে জানিবার আগে,
কেন কেন মরণ হলো না ||
জেনেছি জেনেছি আগে,                যখন যামিনী ভাগে,
হৃদি মোর হইল চঞ্চল |
তখন জেনেছি মনে,                    পাইব প্রাণের জনে
যবে মোর যা আছে সকল ||
তখনি ভেবেছি মনে,               কেন কেন কি কারণে,
হৃদি মোর চঞ্চল বিকল |
কেন রে অস্থির হিয়া,                ক্ষণে উঠি শিহরিয়া,
কেঁদে কেঁদে উঠিছে কেবল ||
প্রাণনাথ হৃদি পরে,                    হৃদি পরশিলে পরে,
অস্থির হৃদয় হব স্থির |
স্বর্গসুখ সম হিয়ে,                      তদুপরে হৃদি দিয়ে,
কত সুখে ঘুমাই গভীর ||
মরি মরি সে প্রকার,                যাইতে পাব না আর,
নিদ্রা তব হৃদির উপর |
হৃদিপরে হৃদি দিয়ে,                পয়োধরে পরশিয়ে,
জুড়াব না কাতর অন্তর ?
সেখানে যতেক জ্বালা,                নাহি করে ঝালাপালা,
শুধু যত সুখের স্বপন |
আর কি মধুরাকার,                হেরিব না ফিরে বার,
শশধর সমান বদন ||
নয়নে নয়ন করি,                        অধর অধরোপরি,
করিব না কি আর চুম্বন |
আর কি হে করে করে,                মিলাব না পরস্পরে,
স্কন্ধে কর করিয়ে ধারণ ||
না হে না হে সুখকাল,                     হয়েছে অতীত |
বিরহ বারিধি মাঝে,                     হয়েছে পতিত ||
জানি জানি সেই জ্বালা,                অহরহ ঝালা পালা,
করিবে আমারে মনে মনে |
না দেখে প্রিয়ের মুখ,                   একেলা দহিবে বুক,
মনাগুনে গোপনে গোপনে ||
শুধু প্রাণনাথ আশা,                   রবে এক হৃদে আশা,
সপ্রবল শয়নে স্বপনে |
আশা দিন অনুরাগী                 রব প্রাণে তার লাগি,
শুধু সেই দিন আশামনে ||
যেন যবে বিভাবরী,                    তমসা বসন পরি,
শশধর না করে প্রকাশ |
যদ্যপি তাহারোপরে,                    ভয়ঙ্কর জলধরে,
তাহা সহ ঢাকয়ে আকাশ ||
নিবিড় তিমিরময়,                         শুধু দরশন হয়,
শশী তারা নাহিক আকাশে |
শুধু ভেদি জলধর,                     যদি হয় ক্ষীণ কর,
এক তারা একাকী বিকাসে ||
তেমতি আমার বুকে,                অন্ধকার দুখে দুখে,
গেছে যত আশা যত সুখ |
শুধু প্রাণনাথ আসা                তারি প্রাণ ভরা আশা,
একাকী বিহরে মোর বুক ||
সে মুখ বাসর কবে,                 বল বল কবে হবে,
কবে হবে ফিরে দরশন |
করি তাহা জপমালা                 ভুলিব বিরহ জ্বালা
যদি পার ভুলিতে রতন ||


পতি
চৌপদী
যদি দেহে প্রাণ ধরি                 আসিব হে ত্বরা করি,
তোরে ফেলে প্রাণে মরি,            রহে না লো রহে না |
অন্তরে প্রণয় ডোরে,                যে দৃঢ় গেঁথেছে মোরে,
প্রাণেতে ত্যজিতে তোরে,            সহে না লো সহে না |
কিন্তু লো তরুণ করে,                 প্রকাশিল প্রভাকরে,
আর কথা পরস্পরে                কহে না লো কহে না |
তবে যাই সুনয়নি,                     যাইলো হৃদয় মণি,
যাই কিন্তু পদ ধনি,                 বহে না লো বহে না |

.                                    ****************                                   
.                                                                                             
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর