কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা |
বসন্তের নিকট বিদায় কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী” ২য় খন্ড, ( ১৯৫৫ ) থেকে নেওয়া | ত্রিপদী হা বসন্ত মনোহর, হা মোহন রূপধর, হা রে হৃদি বিচঞ্চলকর | লইয়ে রূপের ভার, কেন কর পরিহার, এ মহী মন্ডল মনোহর || আর কিছু দিন ওরে, রহ রে ধরণী পরে, বিদায় তোমারে নারি দিতে | জানি জানি মরি মরি, এ পাপ পৃথিবী পরি, নারো আর দিনেক রহিতে || যতেক তোমার শোভা, মোহকর মনোলোভা, উড়ে যায় নহে স্থিরতর | খর দিনকর করে, ক্রমেতে মলিন করে, মোহকর সে শোভা নিকর || তাপিত কুসুম ফুলে, মাথা তুলে দুলে দুলে, মৃদু রবে মরুতেরে কয় | “পাপ তাপে দহে দেহ, বসন্ত আনিয়া দেহ, মরি সে কি ফিরিবার নয় ||” না কুসুম সুন্দরী রে, আসিবে আসিবে ফিরে, সাধের বসন্ত মনোহর | কিন্তু সে আসিলে ফের, তোরা তো পাবি নে টের, আজি যাবে পড়িয়া ভূপর || আ মরি অমনি দুখে, বিদরে আমার বুকে, এ অসার সংসারে রহিয়ে | ফুলের বসন্ত মত, আশার যতন যত যে সকল সুখের লাগিয়ে || আশা মোর সে বসন্ত, বুঝি আমি হলে অন্ত, তবে আসি হবে রে ঘটনা | প্রখর দুখের রবি, চিরদিন বুঝি রবি, অভাগারে দিবারে যন্ত্রণা || মরি আরে কেন আর, কেঁদে মরি এ প্রকার, মানবেরি এমন কপাল | ইহ লোকে চির দীন, হৃদি রবে সুখহীন, মনোদুখে কাটাইবে কাল | পরিণামে নিত্য নামে, পাবে সেই নিত্য ধামে, নিত্যই বসন্ত বিকশিত | যাই তথা যাই তূর্ণ, পরম প্রণয় পূর্ণ, পরমেশে প্রেমে করি প্রীত || কি ছার মিছার আর, মুখাম্বুজ মহিলার, মোহ ভরে করি নিরীক্ষণ | তেমতি মোহিত মতি, সে প্রীতি প্রকৃতি প্রতি, রাখিবেক করিয়া যতন || হা মলয় কেন তুমি, উন্মাদের প্রায় | বেগ ভরে যাও দ্রুত, যথায় তথায় || প্রাণের প্রাণেশ্বরী, কুসুমের কুলে | নাহিক নিরখি নেত্রে, জ্ঞান গেছ ভুলে || না রে চল ধীরে ধীরে, আসিবে বসন্ত ফিরে, ফিরে আসি ফুটাইবে ফুল | ফিরে ফুটাইলে ফুলে, লইও সৌরভ তুলে, চুম্বিয়া সে কুসুমের কুল || কিন্তু রে কভু কি আর, আছে আশা ফিরিবার, মানবের যৌবন বসন্ত | ফুটায়ে প্রণয় ফুলে, মানবেরে দিবে তুলে, সুখ রূপী সৌরভ অনন্ত || নারে সে কখনো আর, নহেকো রে ফিরিবার, গেলে কাল আর নাহি ফেরে | কেবলি চলিবে কাল, যদিন না ধরে কাল, ছাড়ায়ে মায়ার যত ফেরে || আসিবে সে দিন যবে, কি সুখ দিবারে রবে, যৌবন যুবতী প্রেম সুখ | শুধু তারা দেবে জ্বালা, মনে হবে ঝালাপালা, ভাবিয়া পাপের যত দুখ || তাই বলি পরিণামে, অধরেতে ধরি নামে, ঈশ্বরে অন্তরে ভাবে যেই | পরমেশ প্রেমাস্পদ, লাভ করি মোক্ষপদ, নিত্যই বসন্ত পাবে সেই || . **************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
দূরদেশ গমনের বিদায় কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী” ২য় খন্ড, ( ১৯৫৫ ) থেকে নেওয়া | ১৭ ফেব্রুয়ারী , ১৮৫৩, “সংবাদ প্রভাকরে প্রকাশিত “| পতি ললিত এবার দেখি আয়, দেখি দেখি এইবার, দেখি ফিরে বিধুমুখ, দেখি আঁখি ভরি লো | আজিকার নিশি ভোরে লয়ে যাবে কোথা মোরে, কত দিন তোমা বিনে রহিব কি করি লো || বিদরে বিদরে বুক, হেরিব না বিধুমুখ, বিধুমুখ হাসি ভরা, রব স্বপ্নে স্মরি লো | আসি কি না আসি ফিরে, হেরি কি না প্রেয়সীরে, জানি নে জানি নে কিছু, বাঁচি কি না মরি লো || হেরি কি না হেরি আর, শশিমুখে ফিরে বার, জনমের মত তাই হেরি ভাল করি লো | সেই শেষ সুখ মরি, বিধি বুঝি লয় হরি, বুঝি নিশি পোহাইল, তাই হৃদে ডরি লো || কি শুনি কি শুনি ধনি কুহু কুহু করি ধ্বনি, হৃদয়ে শিহরি মরি, যে শুনেছি কাণে রে | বুঝেছি বুঝেছি মরি, পোহাইল বিভাবরী, পোহাইল পোহাইল, মন তা না মানে রে || হা রজনী একবার, রহ রহ রহ আর, একবার চাহি আমি, চন্দ্রমুখী পানে রে | মুখ পানে চেয়ে রই, নয়নে নয়ন হই, একবার দীর্ঘশ্বাস, সলিল নয়ন রে || একবার মরি মরি, হৃদয়ে হৃদয়ে করি, অধরে অধর ধরি, জুড়াইব প্রাণে রে | ধরি হৃদি হৃদি পরে, কত দিবসের তরে, জনমের মত কি না, কে জানে কে জানে রে || না লো না লো মিছে বলি, যামিনী গিয়াছে চলি, ফিরিবে না, ফিরিবে না, ফিরিবার নয় লো | ওই দেখ নীল নিশি, মৃদু আলো সনে মিশি, ফিরিছে বিঘোর আলো, চারিদিক ময় লো || অসীম আকাশে পশি, নাহি রবি নাহি শশী, গগনে নিভেছে যেন, যত তারাচয় লো | কি বলি গগনোপরে, একাকী মধুর করে, প্রভাতের সুখতারা, কিবা শোভা হয় লো || এখনি আকাশোপর, প্রকাশিবে প্রভাকর, এখনি যাইব কোথা, ভেবে হৃদি দয় লো | আসি লো আসি লো প্রিয়ে আসি লো বিদায় নিয়ে, চলিলাম কতদূরে কি কপালে রয় লো || যথা যাব তথা রব, প্রেমডোরে বাঁধা তব, অন্তরে অন্তরে বাঁধা, প্রণয়েরি পাশে লো | স্বপনে নয়নে মনে, হেরিব সে চন্দ্রাননে, হেরিব সে বিধুমুখ, মৃদু মৃদু হাসে লো || তোমা চিন্তা সর্ব্বক্ষণে, শয়নে স্বপনে মনে, এক আশে রবে প্রাণ, ফিরি দেখা আশে লো | সুখ শশী হলে হারা, একা প্রভাতের তারা, হবে মোর অন্ধকার, হৃদয় আকাশে লো || স্ত্রী ত্রিপদী কেন আরে বিভাবরি, পোহাইল মরি মরি, পোহাইল দিবারে যাতনা | কেন রে যামিনী ভাগে, স্বপ্নে জানিবার আগে, কেন কেন মরণ হলো না || জেনেছি জেনেছি আগে, যখন যামিনী ভাগে, হৃদি মোর হইল চঞ্চল | তখন জেনেছি মনে, পাইব প্রাণের জনে যবে মোর যা আছে সকল || তখনি ভেবেছি মনে, কেন কেন কি কারণে, হৃদি মোর চঞ্চল বিকল | কেন রে অস্থির হিয়া, ক্ষণে উঠি শিহরিয়া, কেঁদে কেঁদে উঠিছে কেবল || প্রাণনাথ হৃদি পরে, হৃদি পরশিলে পরে, অস্থির হৃদয় হব স্থির | স্বর্গসুখ সম হিয়ে, তদুপরে হৃদি দিয়ে, কত সুখে ঘুমাই গভীর || মরি মরি সে প্রকার, যাইতে পাব না আর, নিদ্রা তব হৃদির উপর | হৃদিপরে হৃদি দিয়ে, পয়োধরে পরশিয়ে, জুড়াব না কাতর অন্তর ? সেখানে যতেক জ্বালা, নাহি করে ঝালাপালা, শুধু যত সুখের স্বপন | আর কি মধুরাকার, হেরিব না ফিরে বার, শশধর সমান বদন || নয়নে নয়ন করি, অধর অধরোপরি, করিব না কি আর চুম্বন | আর কি হে করে করে, মিলাব না পরস্পরে, স্কন্ধে কর করিয়ে ধারণ || না হে না হে সুখকাল, হয়েছে অতীত | বিরহ বারিধি মাঝে, হয়েছে পতিত || জানি জানি সেই জ্বালা, অহরহ ঝালা পালা, করিবে আমারে মনে মনে | না দেখে প্রিয়ের মুখ, একেলা দহিবে বুক, মনাগুনে গোপনে গোপনে || শুধু প্রাণনাথ আশা, রবে এক হৃদে আশা, সপ্রবল শয়নে স্বপনে | আশা দিন অনুরাগী রব প্রাণে তার লাগি, শুধু সেই দিন আশামনে || যেন যবে বিভাবরী, তমসা বসন পরি, শশধর না করে প্রকাশ | যদ্যপি তাহারোপরে, ভয়ঙ্কর জলধরে, তাহা সহ ঢাকয়ে আকাশ || নিবিড় তিমিরময়, শুধু দরশন হয়, শশী তারা নাহিক আকাশে | শুধু ভেদি জলধর, যদি হয় ক্ষীণ কর, এক তারা একাকী বিকাসে || তেমতি আমার বুকে, অন্ধকার দুখে দুখে, গেছে যত আশা যত সুখ | শুধু প্রাণনাথ আসা তারি প্রাণ ভরা আশা, একাকী বিহরে মোর বুক || সে মুখ বাসর কবে, বল বল কবে হবে, কবে হবে ফিরে দরশন | করি তাহা জপমালা ভুলিব বিরহ জ্বালা যদি পার ভুলিতে রতন || পতি চৌপদী যদি দেহে প্রাণ ধরি আসিব হে ত্বরা করি, তোরে ফেলে প্রাণে মরি, রহে না লো রহে না | অন্তরে প্রণয় ডোরে, যে দৃঢ় গেঁথেছে মোরে, প্রাণেতে ত্যজিতে তোরে, সহে না লো সহে না | কিন্তু লো তরুণ করে, প্রকাশিল প্রভাকরে, আর কথা পরস্পরে কহে না লো কহে না | তবে যাই সুনয়নি, যাইলো হৃদয় মণি, যাই কিন্তু পদ ধনি, বহে না লো বহে না | . **************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |