কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
চন্দ্রদূত
কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী” ২য় খন্ড, ( ১৯৫৫ ) থেকে নেওয়া |
৩০ মার্চ্চ , ১৮৫৩ সংবাদ প্রভাকরে প্রকাশিত

( রূপক )

ত্রিপদী
দ্বিযাম যামিনী যায়,    আ মরি কি শোভা তায়,
নিরখি নির্ম্মল নদী তীরে |
নিরমল নীলাকাশ,          সীমা বিনা সুপ্রকাশ,
মাঝে হেরি মধুর শশিরে ||
যেন কোন নব বালা,       পাইয়া বিরহ জ্বালা,
মলিনতা মধুর বদনে |
গগন গহন বনে,            মনোদুখে মরি মনে,
ভ্রমিতেছে গজেশ গমনে ||
সেই রূপ মনোহর,             রূপ ধরি শশধর
আলো করে ধরণী আকাশ |
গগনের যত তারা,          হইয়াছে কর হারা,
অল্প তারা আকাশ প্রকাশ ||
মাঝে মাঝে শশধরে        ঢাকে ক্ষীণ জলধরে,
মরি যেন নাথ দরশনে |
রহি গুরুজন মাঝে,       মোহিনী মহিলা লাজে,
ঢাকা দেয় বদন বসনে ||
চন্দ্রিকা বসন পরা,          গভীর নিশীথে ধরা,
মোহ মন্ত্রে যেন নিদ্রা যায় |
ঘোর স্তব্ধ ত্রিভুবন,       দেখিয়া চাহিছে মন,
আরাধিতে অচিন্ত্য স্রষ্টায় ||
শুধু হয় শব্দ তায়,           পরশি নিকুঞ্জ গায়,
চলিছে সমীর মৃদু স্বরে |
পূর্ণ নদী স্থির নীরে,         শুধু শব্দ ধীরে ধীরে,
মধুর মলয় মন্দ করে ||
আহা মরি মরি কি রে,        এমন নদীর তীরে,
কে রে শত শোভা ধরি বসি |
বুঝি এ বিরহ লাগি,            প্রণয়িনী অনুরাগী
যুবক জনেক যেন শশী ||
তৃণের কুসুম কুঞ্জ,          ললিতা লতিকা পুঞ্জ
ঘেরি তারে বারি ধারে রয় |
যেমন মলিন শশী,             মলিন বদনে বসি,
দীর্ঘশ্বাসে বিদরে হৃদয় ||
আঁখি হতে বারে বারে,   ধারা বহে ধারে ধারে,
তাহাতে কতই শোভা ধরে |
যেন সে নয়ন জলে,       শশী পশি ছায়া ছলে,
চুম্বন গন্ডেতে তার করে ||
নিরখি নয়ন ভরি,              মধুর চন্দ্রমাপরি,
শেষে শশী সম্বোধিয়া কয় |
আরে মনোহর শশী,           গগন মন্ডলে পশি
পার যেতে ত্রিভুবন ময় ||
তাই বলি শশধর,              আমার বচন ধর,
যাও সেই মোহিনীর কাছে |
যার তরে আশা পথে    আরোহিয়া মনোরথে,
আগে মোর পরাণ গিয়াছে ||

পয়ার
কিন্তু রে কি হেরি তোর, হৃদয় মাঝায় |
কি রে সে কালীর রেখা, লেখা দেখা যায় ||
বুঝি মম মনোরমা, ভাবিয়া আমায় |
আসিবার কথা লিখে, দেছে তোর গায় ||
না রে আর কেন মজি, মিছার স্বপনে |
জানি ভাল ভাবে না সে, অনুগত জনে ||

ত্রিপদী
বুঝি মোর দুখে দুখী,           নাহি দেখি বিধুমুখী,
বুঝি চাঁদ করেছ রোদন |
হৃদয়েরি রেখাচয়,            আঁখি ধারা চিহ্ন রয়,
ও যে নহে কলঙ্ক কখন ||
বুঝি তারি দেখা তরে,         আকাশ রোদন করে,
তারারূপ সহস্র নয়নে |
নীহার নয়ন ধারা,             ফেলিছে যতেক তারা,
শত শত বিন্দু বরিষণে ||
তাই বলি নিশাপতি,              রতনে যতনে অতি,
ঝটিতি কর হে দরশন |
এই ভাষা কহ গিয়ে,          আশা বিনে ফিটে হিয়ে,
তার লাগি মলো একজন ||

পয়ার
শশি হে বসিয়ে আর, বিলম্ব না কর |
এমন অচল কেন, রও শশধর ||
বুঝেছি বুঝি হে তব, যেই ভাব মনে |
যে কারণে যেতে নারো, নারী নিকেতনে ||
মোহিনীর মুখ রূপ, করি দরশন |
কত লাজ কত জ্বালা, পেয়েছ তখন ||
তত আর নাহি দুখ, তার অদর্শনে |
সুখেতে আকাশ মাঝে, প্রকাশ আপনে ||
সাধেতে সাধিতে বাদ, আপনার প্রতি |
যাবে না যামিনীনাথ, যথায় যুবতী ||
ইহা যদি নিশানাথ, না মান আপনি |
আদি অন্ত জানি আমি, বলিব এখনি ||

চৌপদী
ললনা লগনে লাজ,         পেয়ে মানে দ্বিজরাজ,
লুকালে মেঘের মাঝ,         ঘোমটা ধরিয়া রে |
এই কথা মূঢ়ে কয়,            তাই অমানিশা হয়,
কেহ কহে তাহা নয়,        গিয়াছে মরিয়া রে ||
মহিলার মুখাকারে,         অভিমানে আপনারে,
একেবারে নাশিবারে,     গমন করিয়া রে |
মহেশ ললাট স্থলে,            ধিকি ধিকি বহ্নি জ্বলে,
ঝাঁপ দিলে সে অনলে,   পরাণ হরিয়া রে ||
বিমল বারিধি জলে,            ডুবেছিলে কেহ বলে,
মূঢ়ে বলে বারি তলে,   ছায়া সে পড়িয়া রে |
ভয় এই পাছে তায়,         কামিনী তথায় যায়,
ছিলে কম্পমান কায়;        সলিলে লভিয়া রে ||
পরেতে জানিয়া ভাল,         করিছে বিরহ কাল,
কামিনী বদন কাল,        তাই ফিরে আইলে |
ফিরে এলে সিন্ধু হতে,   বলে নর শতে শতে
যে তুমি এমনি মতে,    সমুদ্রে জন্মাইলে ||
বিধু মুখ মহিলার ,       দেখ নাহি ফিরে বার,
নাহি দেখি শোভা তার,   আজো না পলাইলে |
যেতে বলি যতবার,          তত কর অস্বীকার
বুঝেছি কারণ তার,        জ্বালা পাবে যাইলে |

পয়ার
নাহি ডর শশধর, ধর হে বচন |
চরণে শরণ তার, করিও গ্রহণ ||
প্রমদার পদতলে, পড়ি নিরন্তর |
  তোমার সদৃশ আছে, দশ শশধর ||
বিশেষতঃ পদে যদি, না পড় প্রথমে |
মুখের সম্মুখে কথা, কহ যদি তমে ||
তখনি ঘটিবে কুহু, যেন নিশাকর |
ললনা ললাটে আছে, সিন্দূর ভাস্কর ||

ত্রিপদী
তাহে যদি বল তবে,               কেন দিন-পতি রবে,
ললনার ললাট উপর |
প্রেয়সীর পদদ্বয়,                   সদা কিবা শোভা হয়,
যুগল কমল মনোহর ||
নখর নিকর তায়,                    শশী সম শোভা পায়,
কমলের কোলে শশধর |
ক্রোধে রক্ত দিবাপতি,              জানিল অসতি অতি,
পদরূপা নলিনী নিকর ||
ঠেকে শিখে নারী রীতে,            আর পদ্ম আগুলিতে,
বদন কমল কামিনীর |
সিন্দূর বিন্দুর রূপ,                   নারী মুখে অপরূপ,
দিনেশ বসিল হয়ে স্থির ||
যদি বল কি প্রকারে,               চিনিবে তুমি হে তারে,
দেখ নাই আগে তো সে জনে |
জান যদি আপনার,                  কুমুদিনী প্রেমাধার,
তারে তবে চিনিবে নয়নে ||

চৌপদী
যাও যাও সুধাকর,        কেন হে বিলম্ব কর,
একবার শশধর,                যাও যাও যাও রে |
প্রাণের প্রেয়সী পাশে,         বল গিয়ে যদি আসে,
ধরিব পরাণ পাশে,        বধিও না তাও রে ||
নহে রহ এই স্থলে,        অহরহ কোন ছলে,
যেও না হে অস্তাচলে,        এই ভিক্ষা দাও রে |
মোহিনীর মুখ তোরে,    জ্ঞান করি প্রেম ডোরে,
বাঁধিয়া বাঁচাব মোরে,          যেও না কোথাও রে ||
মনে হয় সে রজনী,     যখন রমণী মণি,
অধরে অধরে ধনী,        ধরিল আমায় রে |
সে কি এই নদী তীরে,   এই সে নিকুঞ্জ কি রে,
তোরি তরে কলঙ্কীরে,   দেখেছি কি তায় রে ||
হা নিকুঞ্জ মনোহর,     হা মধুর শশধর,
হে তটিনী স্থিরতর,     ধরি সবে পায় রে |
ফিরে দেখা একবার,     মোহিনী মধুরাকার,
একবার দেখা আর,     হৃদি ফেটে যায় রে ||
ফিরে দরশন করি,       তটিনীর তটোপরি,
চম্পকের শাখা ধরি,    আমা পানে চায় রে |
কি শুনি কি শুনি মরি,   মোহন স্বরেতে করি,
কে রে মোর নাম ধরি,   ডাকিল কোথায় রে ||
বুঝি মোর প্রাণেশ্বরী,     এহো অনুগতে স্মরি,
রাখি গে হৃদয়োপরি,     আঁখি আঁখি করি রে |
না রে মিছে কেন আর,  স্বপ্ন দেখে বারে বারে,
মজি সুখে মিছে কার,     যাতনায় মরি রে ||
নাহিক কপাল তার,        প্রাণেশ্বরী পাইবার,
এত আশা অভাগার,       সম্বরি সম্বরি রে |
যত সুখ আশা আর,       সব করি পরিহার,
শেষ আসা আশা সার,      তা কিসে পাসরি রে ||
যদিও জানি রে মনে,      পাইব না প্রিয়জনে,
গোপনেতে প্রাণপণে,       তবু আশা ধরি রে |
যদ্যপি স্বপ্নে বা ভ্রমে,       ছায়া সুখে কোন ক্রমে,
পাই যদি প্রিয়তমে,           হৃদয় ভিতরি রে ||
দারুণ বিধির বিধি,          চেতনে হরিল নিধি,
জ্বালা জ্বালাইল বিধি,        মরি মরি মরি রে |
কিন্তু আশা পাছে পাছে,     তাই চাঁদ তোর কাছে,
যেতে বলি যথা আছে,       আমার সুন্দরী রে ||

.                                  ****************                                   
.                                                                                             
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর