কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
হেমন্ত বর্ণনাছলে স্ত্রীর সহিত পতির কথোপকথন
কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী” ২য় খন্ড,  ( ১৯৫৫ ) থেকে নেওয়া |
১০ জানুয়ারী ১৮৫৩, সংবাদ প্রভাকর-এ প্রকাশিত


পতি
লঘু ত্রিপদী

রাখ রাখ প্রিয়ে,           বসন ঢাকিয়ে
জলদ চাঁচর চয় |
দেখে জলধর,            ভয়ে শশধর,
হুতাশেতে ম্লান হয় ||
আরো মোর প্রাণ,      ভয়ে ম্রিয়মাণ,
দেখে নিজ প্রাণ শশী |
কুমুদিনী সতী,          ম্লান প্রাণপতি,
বিষাদিত জলে পশি ||
পেয়ে মনস্তাপ,        দেহ অভিশাপ,
যে সতিনী তব কোলে |
যে সতিনী তার,        তাহারি প্রকার,
ডুবিয়ে মরিবে জলে ||
তাহে এই ভয়,         পাছে সিদ্ধি হয়,
যে পাপ কুমুদিনীর |
সতিনী তাহার,        নয়নে তোমার,
পাছে সখি বহে নীর ||
তাই লো সুখদে,        জলদ জলদে,
কর কর আচ্ছাদন |
নিশাপতি তবে,       ভীত আর নবে,
শাপ হবে বিমোচন ||

নারী
যে ছিল তপন,            খর বিলক্ষণ,
যখন শরদ দিবা |
এ যে দিনপতি,     তেজে ক্ষীণ অতি,
তাহার কারণ কিবা ||


পতি
দ্বাদশ তপন,               বিহরি গগন,
বিতরিত খর কর |
কিন্তু খসি পরে,        দশ দিবাকরে,
গেল তব নখোপর ||
এক রবি খসি,      তব ভালে পশি,
সিন্দুর বিন্দুর রূপে |
দ্বাদশ দিনেশ,         এক অবশেষ,
উজ্জ্বল হবে কি রূপে ||

নারী
কেন হে কমল,         ত্যজিল কমল,
হেমন্তের আগমনে |
পাছে বা পলায়,       প্রাণ পদ্ম তায়,
এ ভয় তা দরশনে ||

পতি
করাল মরাল,         মনে জানি কাল
কমল কমল হরি
ভয় যুক্ত হিয়ে,         বহে পলাইয়ে,
তোমারে আশ্রয় করি ||
হেরিয়ে নখরে,       পতি দিবাকরে,
তাহার নিকটে যায় |
তোমার গমন,         হংস নিদর্শন,
দেখিলেক সে তথায় ||
ভয়ে হয়ে ভীত,    পলাতে চিন্তিত,
ত্রাণ স্থানে নিরুপায় |
হইয়ে অগতি,       ত্যজে বসুমতী,
শেষেতে পলায়ে যায় ||

নারী
শরদ স্বভাব,          ত্যজিব স্বভাব,
ধরিল মলিন ভাব |
অতি মনোহর,           পদার্থ নিকর,
হইলেক রসাভাব ||
বিধুম্লান অতি            দীন দিনপতি,
নলিনী মলিনী হয় |
আর তরুদলে,        ফল নাহি ফলে,
পূর্ণ পক্ক পত্রচয় ||

পতি
না লো প্রাণ সখি,       বিটপি নিরখি,
হেমন্তে তোমার প্রাণ |
নব পল্লবিত,        ফলে সুশোভিত,
তুমি তরু করি জ্ঞান ||
অধরেতে তব,            নবীন পল্লব,
পল্লবিত তরু তাই |
সেই তরুফল            ও দুই শ্রীফল,
   তোমাতে দেখিতে পাই ||

নারী
কেন কেন কান্ত,         হয়েছে একান্ত
নীরব কোকিলকুল |
কি হেতু বল না,       না করে কলনা,
হিমে কেন প্রতিকূল ||

পতি
শুন প্রাণ বলি,        কোকিল কাকলী,
যেহেতু হইল হারা |
মধুস্বরে তব,             হইয়ে নীরব,
তোমারে শাঁপিছে তারা ||
ভব বিধুমুখ,             হইবেক মূক,
যেমন তাহারা হয় |
তাই বুঝি প্রাণ,        যবে কর মান,
ও মুখ নীরবে রয় ||

নারী
কেন ফণিবর,           প্রবেশি বিবর,
পাতালে গমন করে |

পতি
বেণী লো তোমারি,    দেখিতে না পারি
পলাইল বিষধরে ||
যদি বল ধনি,            দূর হলে ফণি,
অবনী মন্ডল হতে |
আর ধরাতল,            কিছু হলাহল,
রহিবে না কোনমতে ||
তা নয় তা নয়,           বহু বিষ রয়,
তোমার নয়নে প্রাণ |
সে গরল পারে,      সংহার সংসারে,
করিবারে সমাধান ||
কিন্তু চমত্কার,         সর্প বিষাধার,
সবে ত্যজে যত্ন করি |
নয়ন গরলে,          যতনে সকলে,
বাঞ্ছা করে ডুবে মরি ||
গরল অহির,            শুধু কলহির,
ইচ্ছাক্রমে হয় পান |
নয়ন গরল,         প্রেমিকে কেবল,
পান করে ওরে প্রাণ ||
কিন্তু চমত্কার,       বিষনাশকার,
অমৃত বিষেরি কাছে |
কেন রে এ বিধি,       নয়ন সন্নিধি,
অধরে অমৃত আছে ||
বুঝেছি কারণ,       একত্রে স্থাপন,
যেহেতু গরলামৃত |
সর্পের দংশনে,       ছিল ওঝাগণে,
গরলে করিতে মৃত ||
নয়ন গরল,           করিতে বিফল,
অবনীতে কেহ নাই ||
মুখ সুধাধার,         নিকটে তাহার,
নাশার্থ রয়েছে তাই ||

নারী
তাড়ায়ে মলয়,           কাল হিমালয়
এলো কোথা হোতে বল |
হয় অনুমান,           জনমের স্থান,
সে গিরি অতি শীতল ||

পতি
মোর বোধ হয়,       এলো হিমালয়,
কুচ গিরি হোতে তোর |
কেন না সে স্থল,       বড়ই শীতল,
স্নিগ্ধ কর হৃদি মোর ||

নারী
কোথায় মলয়,              এমন সময়,
রহিলেক লুকাইয়ে |
হেরি হিমালয়ে,         বোধ হয় ভয়ে,
সে গেল বা পলাইয়ে ||

পতি
হিমালয় ভয়ে,           ত্রিভুবন ময়ে,
আর তার স্থান নাই |
পায় তব পাশে,        আশ্রয় নিশ্বাসে,
এ সৌরভ তথা তাই ||

নারী
কেন হে নীহার,         বর্ষে অনিবার,
গগনে রজনীভাগে |
কিবা শোভা মরি,     সদা ইচ্ছা করি ,
রাখিব নয়ন আগে ||

পতি
পতি শশধরে,            দরশন করে,
রজনী মলিন ভাব |
বলে কেন নাথ,       হেরি অকস্মাৎ,
হোলে হাস্যরসাভাব ||
করি অপরাধ,          দিয়েছে বিষাদ,
বুঝি এই অভাগিনী |
কাতরে নাথেরে,     এ মিনতি করে,
শেষে কাঁদে সে রজনী ||
সে রোদন ছলে,       নয়নেরি জলে,
নীহার বর্ষণ করে |
এই সে কারণ,            নীহার বর্ষণ,
কহে যত মুঢ় নরে ||
কিন্তু আমি বল    সে মিথ্যা কেবলি ,
সত্য যাহা আমি কই |
শশাঙ্ক গগনে,           ও মুখ দর্শনে,
মলিন কাঁদিছে ওই ||
যত তারাগণে          তোমার নয়নে,
কাঁদিতেছে অবিরত |
নয়নের জলে,        নীহারের ছলে,
পতন করিতে রত ||

নারী
হয়েছে শীতল,         দেখিতেছি জল,
পুন শীত কি কারণ |

পতি
বুঝি কি কারণে,          কুরঙ্গ নয়নে,
কেঁদেছিল প্রাণধন ||
সেই অশ্রুজল,           বহ্নি বক্ষস্থল,
কুচ হিমালয় শৈল ||
সে গিরি পর্শনে,         নয়ন জীবনে,
অতিশয় হিম হৈল ||
সেই বিন্দু জল,         পড়িয়ে ভূতল,
জলে গিয়ে মিশাইল |
অশ্রু পরশনে,        জল সেইক্ষণে,
অতি শীতল হইল ||

.                                  ****************                                   
.                                                                                             
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর