কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
জীবন ও সৌন্দর্য্য অনিত্য
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী” ২য় খন্ড,  ( ১৯৫৫ ) থেকে নেওয়া |


.                    চৌপদী
যামিনী যামেক যায়, সেবিতে শীতল বায়,
সঙ্গে করি ললনায়, রসময় বসিয়া |
বসি নিশাকর করে, ধরিয়ে প্রেয়সীকরে,
প্রেম আলাপন করে, সরসেতে রসিয়া ||
শুন ওলো প্রাণেশ্বরি, তব মুখ রূপ ধরি,
ওই কি গগনোপরি, রূপে মনো হরে লো |
বুঝি বা সে শশী হবে, বুঝিলাম অনুভবে,
নহিলে কে আর তবে, হেন রূপ ধরে লো ||
কিম্বা তব মুখ ছায়া, দরি তব মুখ কায়া,
গগনে শোভিল গিয়া, আলো করি করে লো |
তা নয় তা নয় সখি, উহাতে কলঙ্ক লখি,
কলঙ্ক তো না নিরখি, ও মুখ উপরে লো ||
যদি তব মুখোপরে, সে কলঙ্ক না বিহরে,
রবে তো কেমন কোরে, ছায়ার ভিতরে লো |
দেখ লো নয়ন তারা, গগনে যতেক তারা,
কত শোভা করি তারা, সুখেতে বিহরে লো ||
যেন তব নেত্রবর, তারা হেন দীপ্তিকর,
আহা কিবা মনোহর, অন্তর শীহরে লো |
কিন্তু দেখ হায় হায়, চপল চপলা প্রায়,
তারা এক খসি যায়, কি দুখের তরে লো |
বুঝেছি বুঝি লো প্রিয়ে, তব নেত্র নিরখিয়ে,
হইয়ে ব্যথিত হিয়ে, লুকালো অন্তরে লো |
কিন্তু বিপরীত হায়, গগনের তারা যায়,
দেখিয়ে পলায়ে যায়, অভিমান ভরে লো |
তায় করি দরশন, মম নেত্র তারাগণ,
অভিমানে পলায়ন, না করে না করে লো |
কিন্তু যত দেখে তায়, যত আরো, দৃঢ় চায়,
কুমুদিনী যেন পায়, পতি শশধরে লো ||
যতেক বলিল পতি, না শুনিলে রসবতী,
চাহিয়ে গগন প্রতি, স্থির নেত্রে রহিল |
পল্লব নাহিক সরে, বঙ্কিমাক্ষে ভাব ভরে ;
এক দৃষ্টে দৃষ্টি করে, অন্য দিক্ নহিল ||
তবে মুখ অধোকরে, অতিশয় দুঃখভরে,
কম্পাইয়ে পয়োধরে, দীর্ঘশ্বাস বহিল |
তখন নয়ন তার, উজ্জ্বল হীরকাকার,
ফেলিলেক অশ্রুধার, দুঃখে পতি কহিল ||
ওলো প্রাণ প্রেমাধার, সহে না সহে না আর,
এই বিন্দু অশ্রুধার, প্রাণে নাহি সহিল |
শুনেছি প্রবলানল, জলে করে সুশীতল,
কিন্তু তব অশ্রুজল, মোরে আরো দহিল ||
চন্দ্রমুখী কয় তায়, দেখ সখা হায় হায়,
এখনি দেখিনু যায়, গগন উপরি হে |
এই দেখি যে তারায়, প্রজ্বলিত স্বর্ণ প্রায়,
অপরূপ শোভা পায়, কতবার ধরি হে ||
মুহূর্ত্তেকে মধ্য তায়, কেহ না দেখিতে পায়,
কোথা গেল হায় হায়, স্থান পরিহরি হে |
কোথা তার এ সময়, মনোহর অঙ্গ রয়,
কোথা রয় করচয়, মরি মরি মরি হে ||
কিন্তু তো তাহারি সম, জীবন যৌবন মম,
তবে কেন তার তম, মিছামিছি করি হে |
যৌবন লাবণ্য নিয়ে, তোমার হইয়ে প্রিয়ে,
আজি আছি বিনাশিয়ে, কাল যাব মরি হে |

.                       ****************                                   
.                                                                                             
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
প্রথম চরণে স্ত্রীর উক্তি দ্বিতীয় চরণে পতির উত্তর
কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী” ২য় খন্ড, ( ১৯৫৫ ) থেকে নেওয়া |
সংবাদ প্রভাকর , ২৫ ফেব্রুয়ারী , ১৮৫২  


               পয়ার

স্ত্রীং |  কহ না কি হেতু, কান্ত, শশী অস্তে চলে |
পং  |  তব মুখে মূক হোয়ে, চলে অস্তাচলে ||
স্ত্রীং |  দশদিগ্ কেন প্রাণ, প্রকাশিত হয় |
পং  |  তব মুখ আলোকেতে, হয় প্রভাময় ||
স্ত্রীং |  কি হেতু কোকিলকুল, কুহু কুহু করে |
পং  |  তোমার মধুর স্বর, পাইবার তরে ||
স্ত্রীং |  সে রবে কি হেতু প্রাণ, হোয়েছে বিকল |
পং  |  আমারে নির্দ্দয় বোলে, পাও প্রতিফল ||
স্ত্রীঁ   |  গন্ধবহ গন্ধ বহে, ভ্রমে কি কারণ |
পং  |  তব মুখ পদ্মগন্ধ, করিবে গ্রহণ ||
স্ত্রীং |  অনিল অনল সম, কেন হয় জ্ঞান |
পুং  |  পরস্পর সখা তারা, জান না কি প্রাণ ||
স্ত্রীং |  সখা হোলে একাঙ্গ কি, হয় গুণমণি |
পং  |  ভাবের এমনি ভাব, এভাব এমনি ||
স্ত্রীং |  তবে কেন তুমি আমি, এক অঙ্গ নই |
পুং  |  দেহে যদি নই, কিন্তু অন্তরেতে হই ||
স্ত্রীং |  কেন পতি, দীনপতি, উঠিছে গগনে |
পং  |  ওমুখ নলিনী ফুল্ল, করণ কারণে ||
স্ত্রীং |  কোথায় যাইছে সব, মধুকরগণ |
পং  |  বদন কমল তব, করে অন্বেষণ ||

.                       ****************                                   
.                                                                                             
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
বর্ষার মানভঞ্জন
নায়কের উক্তি
কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী” ২য় খন্ড, ( ১৮৯৪ ) থেকে নেওয়া |
“সাহিত্য” পত্রিকার শ্রাবণ ১৩০১ (জুলাই ১৮৯৪) সংখ্যায় প্রকাশিত।


ত্রিপদী
বিধুমুখি করে মান,                কিরূপে দেখালে প্রাণ
হেরিতেছি অপরূপ ভাব |
বরষার অবির্ভাবে,                     প্রফুল্ল সরস ভাবে,
রহিয়াছে সকল স্বভাব |
বন উপবন চয়,                             রসময় সমুদয়
রসপূর্ণ যত জীবগণ |
কিন্তু কি আশ্চর্য্য কব,                এ সবার মাঝে তব
কেন প্রিয়ে বিরস বদন |
বুঝেছি কারণ তার,                দোষ দিব কি তোমার
বরষাকালেতে সব করে ;
সুধাকর এই কালে,                    জড়িত জলদ জালে
স্বভাবে মলিন ভাব ধরে |
গগনের শশধরে,                       যদি এই ভাব ধরে
শোভাহীন হয়ে সদা রয় ;
তব মুখচন্দ্র তবে,                     কেন বল নাহি হবে
সেরূপ বিরূপ অতিশয় |
আকাশেতে জলধর,                    মনোহর নিশাকর
ঢাকি আছে দিবস যামিনী ;
কেন না তোমার তবে,                 শশীমুখ ঢাকা রবে
অম্বরে অম্বরে বিনোদিনী |
মান ভাঙ্গিবার তরে,                    ধরিলাম দুই করে
মুখ-পদ্মে কর পদ্ম দিলে ;
বুঝি এই ভাব তার,                      আগমনে বরষার
কমলিনী মুদিতা সলিলে |
এ কালের প্রতিকূল,                   কাননে কোকিলকুল
কুহু কুহু কাকলি না করে |
কোকিল বাদিনী বুঝি,                তাই আছে মুখ বুজি
মৌনবতী বরষার ডরে |
গগনের যত তারা,                   বরষা কালেতে তারা
সদা কাল নহে প্রকটিত ;
তাই বুঝি জ্যোতিহারা,                 তোমার নয়ন-তারা
অভিমানে রোয়েছে মুদিত |
বরষার অনুক্ষণ,                          বারিধারা বরিষণ
বারে বারে ধরা পূর্ণ তায় ;
তাই বুঝি নিরন্তর,                         তব নেত্র-নীরধর
নীর-ধারে ফেলিছে ধরায় |


নায়িকার উক্তি

পয়ার
শুনিয়া শেষের শ্লেষ কুপিল কামিনী,
বিধুমুখে মৃদুরবে কহিল মানিনী |
বরষার ধর্ম্ম যদি বারি বরিষণ,
তবে কেন বলহীন তোমার নয়ন |
দুঃখিনীর দুখতাপে হইয়া সদয়,
তোমার নয়নে কেন বৃষ্টি নাহি হয় |


নায়কের উক্তি

ত্রিপদী
চেও না চেও না আর,                অধীনের অশ্রুধার
এক বিন্দু নাহি প্রাণধন,
তোমার মিলন ছেদে,                কাঁদিয়া কাঁদিয়া খেদে
নীর-হীন করেছি নয়ন |
নাহি আর জলধার,                   কোথা বল পাব ধার
প্রেমাধার, ধার বটে ধারি ;
প্রাণের সম্বল বল,                     দুই এক ফোঁটা জল
যদি থাকে, দিতে নাহি পারি |
যে হেতু যখন পুনঃ,                    তোমার নয়নাগুন
করিবেক দহন আমারে,
নিবারিতে সে অনল,                 তখন না পেলে জল
প্রাণান্ত হইবে একেবারে |

পয়ার
শুনিয়া শুনিল না ভামিনী কামিনী,
পূর্ব্ববৎ মৌনভাব রহিল মানিনী |
ঘোমটা টানিয়া দিল মুখের উপরে,
বারিদে বসনে বিধু আচ্ছাদন ক’রে |


নায়কের পুনরুক্তি

ত্রিপদী
থাক থাক মনে থাক,                     বদনে বসন রাখ
ঢাক ঢাক শশী ঢাক মেঘে,
দীর্ঘশ্বাস বায়ু মোর,                   এখনি করিয়া জোর
জলদে উড়াবে অতি বেগে |

পয়ার
তবু না কহিল কথা মানিনী রমণী,
হাসিয়া কহিছে শুন কান্ত গুণমণি |

ত্রিপদী
এ কি বিপরীত ভাব,                   হোলে বর্ষা আবির্ভাব
সতত চপলা চমকায়,
তোমার অধরে আর,                      হাস্যকার চপলার
চমক নাহিক হায় হায় |

পয়ার
দ্বিগুণ বাড়ায় মান যত পতি সাধে,
ফলতঃ বাহিরে সেটা সাধে বাদ সাধে |
পরে নিজ গাঢ় মান জানাবার তরে,
ঘর ছেড়ে ছলেতে বাহিরে যাত্রা করে |
মধুভাষে বঁধু কহে কি কর ললনা,
যেও না যেও না ধনি, বাহিরে যেও না |

ত্রিপদী
প্রণয়িনী মান পালা,                   ঘোর কাল মেঘমালা
ঝালাপালা করিল আমারে ;
শত ফিরে ফিরে চাও,                মাথা খাও ঘরে যাও
দোহাই দোহাই বারে বারে |
দুরন্ত অবোধ মন,                      ঢাকিতেছে ঘন ঘন
গগন শোভন শশধরে ;
কি জানি যদ্যপি পুন,                    প্রকাশিয়া নিজগুণ
তবু মুখশশী গ্রাস করে |
তাহা হ’লে আর প্রাণ,                 আমার চকোর প্রাণ
রহিবে না শরীর-পিঞ্জরে ;
তাই বলি প্রাণপ্রিয়ে,                  বাঁচাও ঘরেতে গিয়ে
এসো এসো ধরি দুই করে |

পয়ার
নিবিড় নীরদ নব নিরখি নয়নে,
বাহিরেতে গিয়া ধনি ভাবিতেছে মনে |
ঘন ঘন ঘননাদ, গভীরা যামিনী,
পলকে পলকে তার নলকে দামিনী |
মানে মানে মান হরি মানিনী ভামিনী,
গরবেতে গৃহে যায় গজেন্দ্রগামিনী |
মানের নিগূঢ় ভাব শেষে গেল বোঝা,
সুখেতে বঙ্কিমচন্দ্র হইলেন সোজা |

.                                  ****************                                   
.                                                                                             
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর