কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা |
বর্ষার মানভঞ্জন নায়কের উক্তি কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী” ২য় খন্ড, ( ১৮৯৪ ) থেকে নেওয়া | “সাহিত্য” পত্রিকার শ্রাবণ ১৩০১ (জুলাই ১৮৯৪) সংখ্যায় প্রকাশিত। ত্রিপদী বিধুমুখি করে মান, কিরূপে দেখালে প্রাণ হেরিতেছি অপরূপ ভাব | বরষার অবির্ভাবে, প্রফুল্ল সরস ভাবে, রহিয়াছে সকল স্বভাব | বন উপবন চয়, রসময় সমুদয় রসপূর্ণ যত জীবগণ | কিন্তু কি আশ্চর্য্য কব, এ সবার মাঝে তব কেন প্রিয়ে বিরস বদন | বুঝেছি কারণ তার, দোষ দিব কি তোমার বরষাকালেতে সব করে ; সুধাকর এই কালে, জড়িত জলদ জালে স্বভাবে মলিন ভাব ধরে | গগনের শশধরে, যদি এই ভাব ধরে শোভাহীন হয়ে সদা রয় ; তব মুখচন্দ্র তবে, কেন বল নাহি হবে সেরূপ বিরূপ অতিশয় | আকাশেতে জলধর, মনোহর নিশাকর ঢাকি আছে দিবস যামিনী ; কেন না তোমার তবে, শশীমুখ ঢাকা রবে অম্বরে অম্বরে বিনোদিনী | মান ভাঙ্গিবার তরে, ধরিলাম দুই করে মুখ-পদ্মে কর পদ্ম দিলে ; বুঝি এই ভাব তার, আগমনে বরষার কমলিনী মুদিতা সলিলে | এ কালের প্রতিকূল, কাননে কোকিলকুল কুহু কুহু কাকলি না করে | কোকিল বাদিনী বুঝি, তাই আছে মুখ বুজি মৌনবতী বরষার ডরে | গগনের যত তারা, বরষা কালেতে তারা সদা কাল নহে প্রকটিত ; তাই বুঝি জ্যোতিহারা, তোমার নয়ন-তারা অভিমানে রোয়েছে মুদিত | বরষার অনুক্ষণ, বারিধারা বরিষণ বারে বারে ধরা পূর্ণ তায় ; তাই বুঝি নিরন্তর, তব নেত্র-নীরধর নীর-ধারে ফেলিছে ধরায় | নায়িকার উক্তি পয়ার শুনিয়া শেষের শ্লেষ কুপিল কামিনী, বিধুমুখে মৃদুরবে কহিল মানিনী | বরষার ধর্ম্ম যদি বারি বরিষণ, তবে কেন বলহীন তোমার নয়ন | দুঃখিনীর দুখতাপে হইয়া সদয়, তোমার নয়নে কেন বৃষ্টি নাহি হয় | নায়কের উক্তি ত্রিপদী চেও না চেও না আর, অধীনের অশ্রুধার এক বিন্দু নাহি প্রাণধন, তোমার মিলন ছেদে, কাঁদিয়া কাঁদিয়া খেদে নীর-হীন করেছি নয়ন | নাহি আর জলধার, কোথা বল পাব ধার প্রেমাধার, ধার বটে ধারি ; প্রাণের সম্বল বল, দুই এক ফোঁটা জল যদি থাকে, দিতে নাহি পারি | যে হেতু যখন পুনঃ, তোমার নয়নাগুন করিবেক দহন আমারে, নিবারিতে সে অনল, তখন না পেলে জল প্রাণান্ত হইবে একেবারে | পয়ার শুনিয়া শুনিল না ভামিনী কামিনী, পূর্ব্ববৎ মৌনভাব রহিল মানিনী | ঘোমটা টানিয়া দিল মুখের উপরে, বারিদে বসনে বিধু আচ্ছাদন ক’রে | নায়কের পুনরুক্তি ত্রিপদী থাক থাক মনে থাক, বদনে বসন রাখ ঢাক ঢাক শশী ঢাক মেঘে, দীর্ঘশ্বাস বায়ু মোর, এখনি করিয়া জোর জলদে উড়াবে অতি বেগে | পয়ার তবু না কহিল কথা মানিনী রমণী, হাসিয়া কহিছে শুন কান্ত গুণমণি | ত্রিপদী এ কি বিপরীত ভাব, হোলে বর্ষা আবির্ভাব সতত চপলা চমকায়, তোমার অধরে আর, হাস্যকার চপলার চমক নাহিক হায় হায় | পয়ার দ্বিগুণ বাড়ায় মান যত পতি সাধে, ফলতঃ বাহিরে সেটা সাধে বাদ সাধে | পরে নিজ গাঢ় মান জানাবার তরে, ঘর ছেড়ে ছলেতে বাহিরে যাত্রা করে | মধুভাষে বঁধু কহে কি কর ললনা, যেও না যেও না ধনি, বাহিরে যেও না | ত্রিপদী প্রণয়িনী মান পালা, ঘোর কাল মেঘমালা ঝালাপালা করিল আমারে ; শত ফিরে ফিরে চাও, মাথা খাও ঘরে যাও দোহাই দোহাই বারে বারে | দুরন্ত অবোধ মন, ঢাকিতেছে ঘন ঘন গগন শোভন শশধরে ; কি জানি যদ্যপি পুন, প্রকাশিয়া নিজগুণ তবু মুখশশী গ্রাস করে | তাহা হ’লে আর প্রাণ, আমার চকোর প্রাণ রহিবে না শরীর-পিঞ্জরে ; তাই বলি প্রাণপ্রিয়ে, বাঁচাও ঘরেতে গিয়ে এসো এসো ধরি দুই করে | পয়ার নিবিড় নীরদ নব নিরখি নয়নে, বাহিরেতে গিয়া ধনি ভাবিতেছে মনে | ঘন ঘন ঘননাদ, গভীরা যামিনী, পলকে পলকে তার নলকে দামিনী | মানে মানে মান হরি মানিনী ভামিনী, গরবেতে গৃহে যায় গজেন্দ্রগামিনী | মানের নিগূঢ় ভাব শেষে গেল বোঝা, সুখেতে বঙ্কিমচন্দ্র হইলেন সোজা | . **************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |