কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
বিচিত্র নাটক
( তিন মিত্রের কথোপকথন )
কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী” ২য় খন্ড, ( ১৯৫৫ ) থেকে নেওয়া |


প্রথম মিত্র
কি বিষাদে মুখখানি, হাসি-ভরা নাই |
বেণা-বনে বোসে কেন, উঠ উঠ  ভাই ||

দ্বিতীয় মিত্র
দেখিয়া দেশের গতি, কেঁদে মরি মনে |
সে দুখে বসিয়া আছি, বিরস বদনে ||

তৃতীয় মিত্র
সখা রে বচন ধর,                         মিছা দুখ পরিহর,
নিজ সুখে সুখী হও ভাই |

দ্বিতীয় মিত্র
নিজ সুখ এ সংসারে,                      বন বন বল কারে,
আমি তো সে সুখ দেখি নাই ||

তৃতীয় মিত্র
না জেনে কহিছ ভাই,                      সংসারে সুখ নাই,
জান না তো কার কাছে পাবে |
রাখ রে মানস পুরী,                       প্রমদার প্রেমে পূরি,
কত সুখে তোমারে মজাবে ||
পদে পদে প্রেম পথে,                        মজাইব মনোরথে,
মহিলার মোহন বদনে |
মোহ মন্ত্রে রবে বাঁধা,                  মানিবে না কোন বাধা,
কত সুখে রবে মনে মনে ||

প্রথম মিত্র
এ কথাটি ভাল বটে, রটে ধরাময় |
পরম পুলকপ্রদ, প্রমদা প্রণয় ||
বিশেষতঃ কত তাহে, ধর্ম্মের সঞ্চার |
বিবাহ বিশেষ তাই, বিধি বিধাতার ||
নর নারী উভয়েতে, হইয়া মিলিত |
আরাধনে করিবেক, পরমেশ প্রীত ||

দ্বিতীয় মিত্র
ছিছি ছিছি কেন ছার,                   মুখাম্বুজে মহিলার,
মরিয়াছ মোহিত হইয়া |
জানি জানি যত জ্বালা,                  দেয় প্রণয়িনী বালা,
হারিয়াছি বারেক ঠেকিয়া ||
সবে তার এক দিন,                    হই আমি প্রেমাধীন,
নাকে কাণে খৎ দি হে তায় |
আদরে ভাঙ্গাতে মান,                     হইয়াছি অপমান,
না ভাঙ্গিল আমার কথায়||

প্রথম মিত্র
সব তার সহিলাম,                      কত কথা কহিলাম,
মধুর মিনতি কত করি |
রামায়ণ আদি নিয়া,                    সব কথা কাটাইয়া,
তবু মানে রহিলা সুন্দরী ||
সামান্য রতন নহে, রমণ রূপসী
তার না ভাঙ্গিবে মান, বেণা-বনে বসি ||
তাই বলি উঠ ভাই, পরিহরি দুখ |
বল তুমি বল কারে, পৃথিবীর সুখ ||

দ্বিতীয় মিত্র
অনিত্য সকল সুখ, নিত্য কারে বলি |
সকল সংসার সুখ, স্বপনে কেবলি ||
পৃথিবীতে আছে সুখ, কেবলি স্বপনে |
স্বপ্ন বিনে আর সুখ, নাহি জানি মনে ||
স্বপনে স্বকরে পাই, সংসার মন্ডল |
স্বপনে নারীর দেখি, লপন কমল ||
ভারত জনম ভূমি, সতীত্ব অঙ্গনা |
শশিমুখী সরস্বতী, আর কত জনা ||

তৃতীয় মিত্র
সে সব স্বপন ভাই, শ্রবণে তোমার |
শ্রবণে প্রবেশ করে, শত সুধাধার ||
কবি দেখ ছেলে দেখ, দেখ গিয়া মেয়ে |
স্বপনে জিনেছ ভাই, সকলের চেয়ে ||
মধুর সরল ভাষে, মুগ্ধ কর মন |
করণায় ভেসে যায়, নীরেতে নয়ন ||
বিশেষ রসিক তুমি, জানি ইহাতেই |
স্বপ্ন দরশনে দেখ, সতীত্ব নিজেই ||

প্রথম মিত্র
এখন হে জানিলাম, স্বপ্নে যত সুখ |
 এসো মিত্র স্বপ্নে মোরা, ঘুচাইব দুখ ||

তৃতীয় মিত্র
স্বপনে আমার ভাই, মন নাহি ভজে |
আসল পাইলে বল, নকলে কে মজে ||
বিশেষ একেতে আমি, ডরি হে কতক |
একেবারে তাড়াবো না দেশের রক ||

প্রথম মিত্র
এই দোষে চিরকাল, মরিলি রে তুই |
ভাল কথা তোর মুখে শুনি নি কভুই ||

তৃতীয় মিত্র
তুমিই তো ওই রসে, মজিয়াছ ভাই |
সে কথা শুনেছি ভাল, কামিনীর ঠাঁই ||
চতুর জামাই হও, শ্বশুরের ঘরে |
ফুল খেলা কত জানো, বাগান ভিতরে ||
কিন্তু আহা মরি মরি, কামিনীর রূপ |
কি মোহন মন্ত্র দিয়ে, বর্ণেছ স্বরূপ ||
মধুর মোহন ভাষে, মোহিনী বর্ণন |
বুঝি হে কখনো আর, ভুলিবে না মন ||
এই সময়ে শ্যামাচন্দ্র বিশ্বদাস ও গুপ্ত নাম কয়েক
জন পুলিশ সংক্রান্ত শস্ত্রধারী আসিয়া কহিল যে,
চোর চোর ধর চোর, এই জন চোর |
পর ধন কর চুরি, এত সাধ্য তোর ||


তৃতীয় মিত্র
বাহারে ! এ যে হে বড়, বাহারে চাতুরী |
বল দেখি কার কিবা,    করিয়াছি চুরি ||

গুপ্ত
কার কি করেছো চুরি, এ তো নাহি জানি |

বিশ্বদাস
বলেছে তোমারে চোর, শুধু অনুমানি ||

তৃতীয় মিত্র
ভাল ভাল এত বুদ্ধি, প্রশংসার বটে |
না জানিয়া চোর বলা, সুবুদ্ধিতে ঘটে ||

শ্যামাচন্দ্র
না জানিয়া তোরে কভু, চোর বলি নাই |
তাহার কারণ তবে, শুন মোর ঠাঁই ||
সে কালের কালী বাবু, বড় ধনবান
পোরেছিল ছ পাড়ের, ধুতি একখান ||
তুমিও তো ছ পাড়ের, ধুতি পরিয়াছ |
তাই বলি তার ধুতি, চুরি করিয়াছ ||

তৃতীয় মিত্র
বটে বটে দিব্য আছে, এই পৃথিবীতে |
দু খানি ছপেড়ে ধুতি, নারিবে জন্মিতে ||

শ্যামাচন্দ্র
চোপ্ চোপ্ চোপ্ রহ,  মৎ কর সোর |
পুলিসের ম্যাজিষ্ট্রেটি, পদ আছে মোর ||
আমি বলিতেছি তুই, চুরি কোরেছিস্ |
আমার কথায় হয়, ডিক্রী বা ডিস্মিস্ ||

তৃতীয় মিত্র
যো হুকুম খোদা-বন্দ, হইল ইয়াদ্ |
বল দেখি কত দিন, খাটিব মিয়াদ ||

গুপ্ত
মানিলাম নাহি তুমি, করিয়াছ চুরি |
তবু দোষ দেখাইতে, পারি ভূরি ভূরি ||

প্রথম মিত্র
কেবলি দেখায়ে দোষ, কি লাভ তোমার |

গুপ্ত
দোষ দেখানো হে বাপু, ব্যবসা আমার ||
তোমারো সহস্র দোষ, দেখাইতে পারি |
বিশ্বদাস তাহে মোর, আছে সহকারী ||

প্রথম মিত্র
ভাল ভাল সাধু সাধু কি নাম তোমার |
অসার সংসারে শুধু, তুমি প্রশংসার ||

গুপ্ত
গুপ্ত রাখিলাম বাপু, নামটি আমার |
  গু আছে প্রথমে তার মধ্যেতে পকার ||
তিন জন, পুলিস প্রহরী
কথার গতিক বড়, উত্তম না ঘটে |
স্বস্থানে প্রস্থান করা, যুক্তি মত বটে ||
ইঁহারা প্রস্থান করুন |

তৃতীয় মিত্র
সময় হোতেছে নশ,                      যাই নিজ নিজ বাস,
কি করিব ভেবে দেখি মনে |
তুমি যাও এই বেলা,                     কর গিয়া ফুল খেলা,
যামিনীতে কামিনীর সনে ||
তুমি ত্যজিবে না বনে,                 ভাবো গিয়ে নিজ মনে,
আজিকে দেখিবে কি স্বপন |
আমি বাড়ী গিয়ে ভাই,                      মনসুখে নিদ্রা যাই,
স্বপন কি না, না জানি কখন ||
তবে গো বিদায় হই,                        প্রণয়েতে যেন রই,
এই আশা করে মোর মন |
যদি কোন কথা মোর,                 হয়ে থাকে অতি জোর,
Then beg your pardon.

.                                  ****************                                   
.                                                                                             
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর