কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা |
মানস কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাল্য রচনা। যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী” ২য় খন্ড, ( ১৯৫৫ ) থেকে নেওয়া | এই কবিতা সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই লিখেছেন . . . "এই কবিতাগুলি লেখকের / কবির পঞ্চদশ বত্সর বয়সে লিখিত | লিখিত হওয়ার তিন বত্সর পরে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয় | প্রকাশিত হইয়া বিক্রেতার আলমারীতেই পচে—বিক্রয় হয় নাই | তাহার পর আর এ সকল পুনর্মুদ্রিত করিবার যোগ্য বিবেচনা করি নাই, এখনও আমার এমন বিবেচনা হয় না যে, ইহা পুনর্মুদ্রিত করা বিধেয় | বাল্যকালে কিরূপ লিখিয়াছিলাম, তাহা দেখাইয়া বাহাদুরী করিবার ভরসা কিছুমাত্র নাই ; কেন না, অনেকেই অল্প বয়সে এরূপ কবিতা লিখিতে পারে | যাহা অপাঠ্য, তাহা বালকপ্রণীত হউক বা বৃদ্ধপ্রণীত হউক, তুল্যরূপে পরিহার্য্য | অতএব কিছু পরিবর্ত্তন না করিয়া “ললিতা” নামক কাব্যখানি পুনর্মুদ্রিত করিতে পারিলাম না | “মানস” নামক কাব্যখানিতে পরিবর্ত্তন বড় সহজ নহে, এ জন্য সে চেষ্টা করিলাম না | তথাপি সামান্যরূপ পরিবর্ত্তন করা গিয়াছে |" ফলানি মূলানি চ ভক্ষয়ন্ বনে গিরীংশ্চ পশ্যন্ সরিতঃ সরাংসি চ | বনং প্রবিশ্যেব বিচিত্রপাদং সুখী ভবিষ্যামি তবাস্তু নির্বৃতিঃ || . বাল্মীকি | There is pleasure in the pathless Woods, There is a rapture on the lonely shore, Childe Harold হা ধরণি ধর কি রে হৃদয়মন্ডলে, ধর কি কোথাও মম, মনোমত স্থলে ? কি আছে সংসারে আর বাঁধিবারে মোরে ! যে কালে কেটেছে কাল ভরসার ডোরে || মনে করি কাঁদিব না রব অহঙ্কারে | আপনি নয়ন তবু ঝরে ধারে ধারে || গোপনে কাঁদিবে প্রাণ সকলি আঁধার | জীবন একই স্রোতে চলিবে আমার || আঁধার নিকুঞ্জ যেন নীরবেতে নদী | একাকী কুসুম তায় চলে নিরবধি || কারে নাহি বাসি ভাল, কেহ নাহি বাসে | হৃদে চাপা প্রেমাগুন, হৃদয় বিনাশে || সংসার বিজন বন, অন্তরে আঁধার | দেখিতে অপ্রেমী মুখ, না পারি রে আর || বিজন বিপিনময় দ্বীপে একা থাকি | ভাবিয়া মনের দুঃখ ভ্রমিব একাকী || দেখিব দ্বীপের শোভা মোহিত নয়নে | বিপিন বারিধি নীল বিশাল গগনে || চারি পাশে গরজিবে ভীষণ তরঙ্গে | শ্বেত ফেনা শিরোমালা নাচাইব রঙ্গে || শিরে মত্ত সমীরণ, শব্দ মিশে তার | থেকে থেকে রেগে রেগে ছাড়িব হুঙ্কার || নিরখিব নীরধারে ভীষণ ভূধর | ফুলায়ে বিশাল বক্ষ জলধি উপর || তুলিয়া ললাট ভীম প্রবেশ গগনে | গরজে গভীর স্বরে নব মেঘগণে || পদে তার আছাড়িবে প্রমত্ত তরঙ্গ, বুকে তার প্রহারিবে পাগল পবন | মহীধর মানিবে না অধমের রঙ্গ, ললাটের রাগে করি ভয় প্রদর্শন || কর্ক্কশ সানুতে তার বিহরি বিজনে | আ মরি এসব কবে হেরিব নয়নে || মোহে মন মজাইবে প্রকৃতি মোহিনী | জীবন যাইবে যেন স্বপনে যামিনী || আলো মাখা কালো বাস ঊষা পরে যবে | শুনিব সে তরতর জলনিধিরবে || দেখিব বিশাল বক্ষ মিলিছে আকাশে | শ্বেত শশিছায়া নীলে ধীরে ধীরে ভাসে || শিহরিবে হৃদি মোর, সে স্নিগ্ধ সমীরে | পাশে কুঞ্জ লতা ফুল নাচাবে সুধীরে || নিরখিব শশী শ্বেত-গগনমন্ডলে | কত মেঘ বায়ুভরে শ্বেতাকাশে চলে | গিরিপরে সুখ-তারা নেচে নিবে যায় | যেন শেষ মন আশা নিরাশা নিবায় || নাচাইবে কর তার জলের ভিতর | তাহারি পানেতে চেয়ে রব নিরন্তর || শুনিব সবুর মৃদু সমীরণ করে | সুধার শিশির মাখা নিকুঞ্জ নিকরে || পুলকে দেখিব আমি লোহিত আকাশে | পয়োধির পাশ থেকে কপন প্রকাশে || তরল তরঙ্গ মেঘ অনল সাগরে | রবি নিজে নভরাজ দেখাইবে করে | চঞ্চল সুনীল জলে তরুন তপন, . চিকিমিকি চিকিমিকি নাচাইবে কর | তরুলতা তৃণ মাঝে করিবে তখন, . ঝিকিমিকি ঝিকিমিকি নীহারনিকর || দ্বিপ্রহরে ঘননীল বিমল অম্বরে, রাগিয়া রহিলে রবি অনলসাগরে শ্বেত মেঘ অগ্নি মেখে ফিরিয়া বেড়ায়, রব তবে অন্ধকার নিকুঞ্জ মাঝার || দীর্ঘ ভীম তরুগণ আচ্ছাদে আধার, করিবেক চারুলতা স্নিগ্ধ চারি ধার || নীরব নিশ্চল দ্বীপে রহিবে সকল | স্পন্দহীন পত্র আর কুসুমের দল || শুনিব গরজে ঘোর তরঙ্গনিকরে | অথবা বিদরে বন এক পিকস্বরে || তরুলতা মাঝে দিয়া বিমল গগন | কিম্বা জলে রবিকর হবে দরশন || কালো জলে ঢাকা দিলে প্রদোষ আঁধার— অনিবার তরতর বিশাল বিস্তার –- সেই দুঃখস্বরে হৃদি, শিহরি চঞ্চল, কাঁদিবে ; না জানি কেন আঁখিময় জল ! মনে হয় যেন কোন সুখের সঙ্গীত | নাচাইয়ে হৃদি ডোরে জাগে আচম্বিত || আপনি ভাসিবে আঁখি দর দর ধারে | অনন্ত স্মরিব চেয়ে পয়োধির পারে || নবীনা রূপসী একা কাঁপে এক তারা, . যেন নব প্রণয়িনী প্রণয়সারে | ছেড়ে গেছে কর্ণহার একা পথহারা, . কত আশা কত ভয়ে কাঁপিছে অন্তরে || যখন সন্ধ্যায় শ্বেত অর্দ্ধ শশধরে ধীরে ধীরে ভেসে যাবে নীলের সাগরে আকাশ বারিধি সনে করি পরশন চারি পাশে ধরিবেক বিঘোর বসন বারেক ভাবিব সেই রমণীরতন রেখেছিল বেঁধে যার প্রেমমোহে মন || যবে ভাসি অর্দ্ধ শশী তারাময়াকাশে স্বপ্নভূমি সম ধরা অস্পষ্ট প্রকাশে ঝর্ঝর বাতাস বয় ক্ষীণালোকে যবে ধাইবে সমুদ্র স্থির অনিবার রবে অনিবার সর সর ঊর্দ্ধে তরুগণ দেখিব মিশিবে শূন্যে রমণীরতন || আঁখি আর নীলাকাশ মাঝে তার ছায়া | আলোময় বেশে সেই ফুলময় কায়া | নিবিড় কুন্তল দাম খেলিছে পবনে | মৃদু স্থির মোহময় প্রণয় বদনে || দেখিতে দেখিতে মোহে হারাব চেতন | চেয়ে রব ; জানিব না মিলাল কখন || পূর্ণ শশী মোহমন্ত্রে চন্দ্রিকায় যবে গিরি বারি বনাকাশ নিদ্রিত নীরবে || মনঃসুখে মনোদুখে মোহিত হৃদয়ে | তার মাঝে বেড়াইব চারু তরি লয়ে || ভাসিবে নিবিড় নীলে একা শশধর | দেখিব জ্বলিছে স্থির নক্ষত্রনিকর || পাশে নীল জল স্থির রব অনিবার | যেমন স্বপনে কথা যৌবনে আশার || একবার পরাশিবে মলয়সমীরে | যেমন সে পরশিত ভাগীরথীতীরে || ধূমেতে আকাশে মিশে তরুদলতীরে | পরস্পর গায় পড়ে ঢলে ধীরে ধীরে || প্রেমমোহ ভরে যেন, আবেগের রঙ্গে | প্রণয়ী ঢুলিয়া পড়ে প্রণয়ীর অঙ্গে || ভীম স্থির মাঝে কোন রব শুনিব না | তবে যদি নিরুপমা স্বর্গীয় ললনা শূন্যভরে শশিকরে স্বপ্নময় মিশে, বাজায় মুরলী মৃদু মনোমোহ ভরে, প্রকাশিয়ে যত জ্বালা প্রণয়ের বিষে, . গভীর কোমল ধীর যাতনার স্বরে || মনোসাধে মজে তায় ভাবিবেক মন, স্বপনে নিরাশা সঙ্গে আশার মিলন || মরি রে মোহিত মনে শুনিব সে স্বরে, . মোহভরে মুখ পানে চেয়ে রব তার | হা বিধাতঃ বল বল বারেক বল রে ; হবে কি এমন দিন কপালে আমার || অথবা দেখিব স্তব্ধ লতিকার কুঞ্জে | জ্বলে যথা শশিকর স্থির পাতাপুঞ্জে || নবীন কুসুম হাসি ছাড়িছে সুবাস | যেন তৃণ লতা মাঝে নক্ষত্র প্রকাশ || দেবের ললনা দলে নাচে মাঝে তার | চন্দ্রের কিরণে যেন চম্পকের হার || শত বীণা স্বর্গসুরে অপ্সরে বাজায় | শত গান এক সুরে শূন্যেতে মিশায় || ঝরে ফুল জ্বলে মণি দেহের বর্ত্তনে | কতই তরঙ্গ বয় আলোক বসনে || তারা গেলে হবে কুঞ্জে বিজন আঁধার | একাকী কাঁদিব দেখে ঝরা ফুলহার || নিমিষে ঘুচিবে স্বপ্ন বিজনমন্ডলে | সেই ফুল সেই লতা ধীরে ধীরে দোলে || কাননে সাগরে যবে অমাবস্যা বসি— কালো মেঘে ঢাকা শির ভীষণ রাক্ষসী— গিরিগুহা মাঝে গর্জ্জে ক্রোধ ঝটিকার | শুনে তাহে মিশাইব, অংশ হব তার || ভীমরবে প্রাণপণে পাগল পবন | ঘুরিয়া ঘুরিয়া রাগে করে গরজন || গরজিবে রেগে রেগে অসংখ্য তরঙ্গ | তমোমাঝে শ্বেত ফেনা আছাড়িবে অঙ্গ || শুনিব গভীর ধীর জলধরধ্বনি | ফাটাবে গগন হৃদি চেচায়ে অশনি || উপরি উপরি রেগে ছিড়িবে শিখর | পর্ব্বতে পর্ব্বতে যেন হতেছে সমর || ভয়ঙ্কর ভূতগণ, নেচে নেচে ঝড়ে, . উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিবেক ঝড়নাদ সঙ্গে | বিকট বদন ভঙ্গী গিরি পরি চড়্যে, . ভীম শ্বেত দন্তাবলী দেখাইবে রঙ্গে || পরেতে গভীর স্থির জগত্সংসার | কাঁদিয়া ঘুমালো যেন নবীন কুমার || যেন তাঁর করুণার প্রতিমা প্রকাশ | পূজিব গভীর মোহে, বিগত বিলাস || সঁপিয়া জীবন মন, যৌবন রতন | এমন সুধীর মনে হইবে পতন || ভাবিব ঝটিকা মত ছিল মম মন | এ গভীর স্থির মত হয়েছে এখন || কারো অনুরাগী নই বিনা সনাতন | জপিয়া পবিত্র নাম হইব পতন || অনন্ত মহিমা স্মরি ছাড়িব এ দেহ | জানিবে না শুনিবে না কাঁদিবে না কেহ || অনিবার জলরব কাঁদিবে কেবল | আছে কি পৃথিবি হেন বিমোহন স্থল ! . **************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |