কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
ললিতা
কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাল্য রচনা।
যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী” ২য় খন্ড, ( ১৯৫৫ ) থেকে নেওয়া |

এই কবিতা সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই লিখেছেন . . .
"এই কবিতাগুলি লেখকের / কবির পঞ্চদশ বত্সর বয়সে লিখিত |  লিখিত হওয়ার তিন বত্সর পরে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয় |  
প্রকাশিত হইয়া বিক্রেতার আলমারীতেই পচে—বিক্রয় হয় নাই | তাহার পর আর এ সকল পুনর্মুদ্রিত করিবার যোগ্য বিবেচনা
করি নাই, এখনও আমার এমন বিবেচনা হয় না যে, ইহা পুনর্মুদ্রিত করা বিধেয় |
বাল্যকালে কিরূপ লিখিয়াছিলাম, তাহা দেখাইয়া বাহাদুরী করিবার ভরসা কিছুমাত্র নাই ; কেন না, অনেকেই অল্প বয়সে এরূপ
কবিতা লিখিতে পারে | যাহা অপাঠ্য, তাহা বালকপ্রণীত হউক বা বৃদ্ধপ্রণীত হউক, তুল্যরূপে পরিহার্য্য | অতএব
কিছু পরিবর্ত্তন না করিয়া
 “ললিতা” নামক কাব্যখানি পুনর্মুদ্রিত করিতে পারিলাম না | “মানস” নামক কাব্যখানিতে পরিবর্ত্তন
বড় সহজ নহে, এ জন্য সে চেষ্টা করিলাম না | তথাপি সামান্যরূপ পরিবর্ত্তন করা গিয়াছে |"



ভৌতিক গল্প

“O Love ! in such a wilderness as this,
Where transport with security entwine,
Here is the Empire of thy perfect bliss.
And here art thou a God indeed divine,”
Gertrude of Wyoming.

“ But mortal pleasure, what art thou in truth !
The torrents’ smoothness ere it dash below.”
Ibid.


প্রথম সর্গ



মহারণ্যে অন্ধকার, গভীর নিশায়
নির্ম্মল আকাশ নীলে, শশী ভেসে যায় ||
কাননের পাতা ছাদ, নাচে শশিকরে |
পবন দোলায় তারে সুমধুর স্বরে ||
নীচে তার অন্ধকারে, আছে ক্ষুদ্র নদী |
অন্ধকার মহাস্তব্ধ, বহে নিরবধি ||
ভীম তরুশাখা যথা পড়িয়াছে জলে,
কল কল করি বারি সুরবে উছলে ||
আঁধারে অস্পষ্ট দেখি, যেন বা স্বপন !
কলিকাস্তবময় ক্ষুদ্র তরুগণ ||
শাখার বিচ্ছেদে, কভু শশধরকর,
স্থানে স্থানে পড়িয়াছে, নীল জলোপর ||
ঘোর স্তব্ধ নদীতটে : শুধু ক্ষণে ক্ষণে,
কোন কীট যায় আসে নাড়া দিয়ে বনে ||
শুধু অন্ধকার মাঝে, অলক্ষ্য শরীর |
কোন হিংস্র পশু ছাড়ে নিশ্বাস গভীর ||
অসংখ্য পত্রের শুধু, ভীষণ মর্ম্মর |
আর শুধু শুনি এক, সঙ্গীতের স্বর ||
গভীর সঙ্গীত সেই ! ভাসে নদী দিয়ে |
ভাঙ্গিল গভীর স্তব্ধ স্বরে শিহরিয়ে---
কখন কোমল স্থির করুণার স্বরে,
যেন কোন বিরহিণী কেঁদে কেঁদে মরে ||
শুনিয়ে তা মনে হয়, ঈষৎ আভাসে,
যেন কত সুখস্বপ্ন, হয়েছে বিনাশ ;
কি কারণে দুঃখোদয় কিসের স্মরণে,
কিছুই বুঝি না তবু, উচাটন মনে ||
ফুলিয়া উঠেছে ধ্বনি, স্থির শূন্য কেটে |
ইচ্ছা করে গগনেতে উঠে যাই ফেটে ||
ছেঁড়ে হৃদয়ের ডোর গভীর যাতনে |
ইচ্ছা করে গলি গিয়ে মিশি গান সনে ||
আর যদি সঙ্গীতের দেহ দেখা পাই !
যতনেতে আলিঙ্গিয়া, মোহে মরে যাই ||




নদীতীরে বৃক্ষ নাহি ছিল এক স্থানে |
দীর্ঘ তৃণে চন্দ্রকর জ্বলিছে সেখানে ||
ছোট গাছে তারামত ফুল্ল পুষ্পদলে |
স্থির তার প্রতিরূপ স্থির নদীজলে ||
সুখস্বপ্নে যেন তারা, নিদ্রাভরে হাসে |
গগন গুমুরে মরে, সুখময় বাসে ||
সেই স্থানে বসি এক নারী একাকিনী |
ফুলহীন বনে যেন স্থলকমলিনী ||
মিশেছে সে চন্দ্রিকায় ; ভাবে তায় চিত্ত
শুধু সে স্বপ্নের ছায়া, অসত্য অনিত্য ||
যৌবন আশার সম ফুল্ল রূপ তার |
দেখিয়া ফিরালে আঁখি, দেখি ফিরে বার ||
স্থিরা ধীরা সুকোমলা বিমলা অবলা |
সবে নব পুরিতেছে যৌবনের কলা ||
মোহন সঙ্গীতে মন বেঁধেছে যতনে |
প্রেম যেন শুনিতেছে আশার বচনে ||
বদনে ললিত রেখা কত হয়ে যায় |
রক্তিম নীরদ যেন শারদ সন্ধ্যায় ||
গলিল নয়নপদ্ম ; মুগ্ধ  তার মন,
প্রাণ মন জ্ঞান ধন জীবন যৌবন,
সকলি করেছে যেন গীতে সমর্পণ ||
কোথা হতে আসে সেই সুমধুর গান ?
কেন তাতে এত আশা ?  কে হরিল প্রাণ ?



ললিতা তাহার নাম--- রাজার নন্দিনী |
জননী না ছিল তার, বিমাতা বাঘিনী |
রাজা বড় নিষ্ঠুর সতত দেয় জ্বালা ;
গোপনে কতই কাঁদে মাতৃহীনা বালা |
দুর্জ্জনের সাথে তার বিবাহ সম্বন্ধ—
শুনে কেঁদে কেঁদে তার চক্ষু যেন অন্ধ |
মন্মথ নামেতে যুবা, সুঠাম সুন্দর,
বচনে অমিয় ক্ষরে নারীমনোহর |
মোহিল ললিতাচিত তার দরশনে |
গোপনে বিবাহ হৈল মিলিল দুজনে |
জানিল বিবাহবার্ত্তা দুরন্ত রাজন্ |
কন্যারে ডাকিয়া বলে পরুষ বচন ||
এ পুরী আঁধার কেন কর কলঙ্কিনী |
শীঘ্র যাও দেশান্তর না হতে যামিনী ||
কাল যদি দেখি তোরে, বধিব পরাণ |
ভয়ে বালা সেই দন্ডে করিলা প্রস্থান ||
মন্মথ লইয়া তারে তুলিল নৌকায় |
ভয়ে ভীত দুই জনে নদী বেয়ে যায় ||
পথিমধ্যে দস্যুদল আসিয়া রোধিল |
ললিতারে কাড়ি লয়ে বনে প্রবেশিল ||
অলঙ্কার কেড়ে নিয়ে ছেড়ে দিল তারে |
ললিতা একাকী ফিরে নদী ধারে ধারে ||
কোথায়  মন্মথ গেল, তরি কোন্ ভিতে |
রজনী গভীরা তবু ভয় নাই চিতে |
এমন সময় শোনে সঙ্গীতের ধ্বনি |
মন্মথ  গাইছে গীত বুঝিল অমনি ||   
বুঝিল সঙ্কেত করে সেই প্রিয়জন,
নদীতীরে চন্দ্রালোকে বসিল তখন |
তীরেতে লাগিল তরি অতিদ্রুত হয়ে |
দেখিতে দেখিতে দুয়ে দুয়ের হৃদয়ে ||
কতই আদর করে, পেয়ে সোহাগিনী |
কতই রোদন করে কাতরা কামিনী ||




তখন ললিতা কয়,                “আর জ্বালা নাহি সয়,
পড়িয়া দস্যুর হাতে, যে দুঃখ হে পেয়েছি |
কাড়ি নিল অলঙ্কার,                লাঞ্ছনা কত আমার,
তীরে তীরে কেঁদে কেঁদে এতদূর এসেছি ||
দেখা হবে তব সাথ,                হেন নাহি জানি নাথ,
দয়া করি কালী আজি রেখেছেন চরণে |”
পতি বলে “শুন প্রিয়ে,              তোমা ধনে হারাইয়ে,
মরিব বলিয়ে আজি, প্রবেশিনু কাননে ||
দেখিলাম দুই ধার,       
             মহারণ্যে অন্ধকার,
নীরবে নির্ম্মলা নদী, তার মাঝে বহিছে |
ভীষণ বিজন স্তব্ধ,           
       নাহি জীব নাহি শব্দ,
তরুদলে ঢুলে জলে, ঘুমাইয়া রহিছে ||
যে স্থির অরণ্য নদী,   
               যেন বা সৃজনাবধি,
কোন জীব কোন কীট, তথা নাহি নড়েছে |
প্রথমে যে ছিল যথা,                এখনও রয়েছে তথা,
মৃত্যুর ভীষণ ছায়া, সর্ব্বস্থানে পড়েছে ||
ভয়েতে গগন পানে,      
            চাহিলে ভুলিনু প্রাণে,
বিমল সুনীলাকাশে, শশী হেসে যেতেছে |
ভাবিলাম প্রকৃতির,      
              সকলি গভীর স্থির,
শধু এ হৃদয় কেন, এত দুঃখ পেতেছে |
মরি যদি পারিতাম,        
           গোলে জল হইতাম,
এ স্থির সলিলে মিশে, হৃদয় ঘুমাইত |
তথা রিপু চিন্তাহীন,        
            রহিতাম চিরদিন,
ললিতার দুঃখ তবে, কিসে হৃদে আইত ||



“ভাবি এ প্রকার,
                ছাড়িতে হুঙ্কার,
কাঁপিল কানন স্তব্ধ |
শিহরি অন্তরে,                কি জানি কি ডরে,
কাঁপে হৃদি শুনি শব্দ ||
হুতাশ নাশিতে,                 সঙ্কেত বাঁশীতে,
গায়িলাম দুখ যত |
বাজাইয়া তায়,                মরি লো তোমায়,
সঙ্কেত করেছি কত !
একবার যাই,        
              মুরলী বাজাই,
আপনি নয়ন ঝোরে |
গলে হৃদি দুখে,        
           এক মাত্র সুখে ;
বাঁশী কি মোহিল মোরে !
গাই পরক্ষণে,                     দেখি নিশাবনে,
একাকিনী রূপবতী |
হয়ে চমকিত,    
                  তরি এই ভীত,
হইলাম শীঘ্রগতি ||
কে জানে কেমনে,      
         আশা এলো মনে,
আমারি ললিতা হবে |
কত ভাগ্য ধনি,                   পাই হারা মণি,
আর ছাড়া নাহি হবে ?”



ললিতা

“নারে প্রাণ নারে,        আর হে তোমারে,
আঁখি ছাড়া করিব না |
রহিব দুজনে,                গোপন কাননে,
দেখিবে না কোন জনা ||
কাজ নাই দেশে,        তথা শুধু দ্বেষে,
হেন প্রেম নাশ করে |
গঞ্জন যন্ত্রণা,                    কলঙ্ক রটনা,
মিলন না হয় ডরে ||
যেখানে প্রণয়,                হৃদয়ে না রয়,
যেখানে তোমা না পাই |
সে দেশ কি দেশ,        সে গৃহে বিদ্বেষ,
কখন যেন না যাই ||
এখানে মন্মথ,                প্রণয়ের পথ,
কলঙ্কের কাঁটা হীন |
হেরি তব মুখে,                নিরমল সুখে,
স্বর্গসুখে হব লীন ||
জ্বালা পৃথিবীর,                সব হবে স্থির,
শুধু সুখময় মন |
লইয়ে মন্মথ,                যাহা মনোমত,
করিব সকল ক্ষণ ||”

মন্মথ

“হে বিধি হে বিধি        কর কর বিধি,
এই কপালে আমার |
বল তার চেয়ে,                স্বর্গপদ পেয়ে,
কি সুখে আছে হে আর ||
বিচ্ছেদ যাতনা,        দিব না দিব না,
এ জনমে প্রেয়সীরে |
কাল পূর্ণ হলে,                সুখে তব কোলে,
মরে যীব ধীরে ধীরে ||”



দ্বিতীয় সর্গ



মরি প্রেম যার মনে,                সে কি চায় রাজ্যধনে,
প্রিয়মুখ ত্রিসংসার তায় |
হৃদে তার যে রতন,                আলো করে ত্রিভুবন,
অন্য মণি নিবায় বিভায় ||
এক মোহে সদা মত্ত,                না জানে আপনি মর্ত্ত্য,
যাহা দেখে তাই প্রেমাকুল ||
রবি শশী তারাকাশ,                      পয়োদ পবনশ্বাস,
সাগর শিখর বনফুল ||
যেন লক্ষ বিদ্যাধরে,                     সদা কর্ণে গান করে,
কি মধুর শব্দহীন ভাষা |
হেরিয়ে সামান্য কলি,                      নয়ন সলিলে গলি,
উছলে অনন্ত ভালবাসা ||
প্রেমে যার মন বাঁধা,          
        না পারে দিবারে বাধা,
সমুদ্র শিখর নদী বনে |
তবে যদি করে বিধি,     
                চির বিরহের বিধি,
তবু স্বর্গ মনের মিলনে ||
কলঙ্ক বিপদ ক্লেশ,         
               ঝটিকার ধরি বেশ,
শিরোপরি গরজয়ে যত |
আশ্রয় করিয়া আশা,   
                   প্রণয়ীতে ভালবাসা,
প্রণয়ীর প্রাণে বাড়ে তত ||
জ্বালা সয় নিরবধি,         
              সেও ভাল পায় যদি,
একবার আঁখির মিলন |
দুঃখের গভীর বনে,       
                সেই স্বপ্নে সুখ মনে,
প্রেম রীতি কে জানে কেমন ||




চলিল চরণ চন্দ্রবদনী |
ঢলিয়ে ঢলিয়ে মন্দচরণী |
উষার প্রখর তারকা ধনী |
চলিল গজেশগামিনী ||
উভয়ে মরেছে হৃদি যাতনে |
উভয়ে পেয়েছে প্রাণরতনে |
কাঁধে কাঁধে ধরি চলে কাননে |
গভীর নীরব যামিনী ||
শিরোপরে শাখা বিনান ঘন |
আসিবে কেমনে শশিকিরণ |
  তরল তিনির ভীষণ বন |
দেখিয়া শিহরে কামিনী |
আঁধার আকাশে নক্ষত্রাবলি |
তেমনি কাননে কুসুম কলি |
আমোদে হৃদয়ে যেতেছে গলি |
সে সব নীরদ দামিনী ||
ভীষণ তিমিরে ভীষণ স্থির |
মাঝে মাঝে খসে পত্র শাখীর |
ধীরে ধীরে ঝরে নির্ঝর নীর |
আঁধারে নিরখে রঙ্গিণী ||
লাগিয়া নির্ঝরে ঈষৎ আলো |
দেখে ফুলময় সে জল কালো |
আঁধারে কুসুম পরশে গাল |
শিহরে সরোজ অঙ্গিনী ||
যেতে পতি সনে চন্দ্রবদনী |
মরি কি সঙ্গীত শুনিল ধনী |
ললিত মোহন গভীর ধ্বনি |
নির্ঝর নিনাদ সঙ্গিনী ||
নীরব কানন উঠে শিহরি |
শিহরে দুজনে দুজনে ধরি |
হৃদয়ে হৃদয়ে গাঁথিল মরি |
বাঁধিল মনঃকুরঙ্গিনী ||




স্তব্ধ বনে অন্ধকারে,     
        ভেসে ভেসে চারি ধারে
মোহে তায় দুই জনে, আপনাকে ভুলিল |
দুজনার মুখ চেয়ে,           
       দুজনারে বুকে পেয়ে,
প্রেম আর সেই গানে, এক হয়ে মিলিল ||
জ্ঞান পেয়ে কহে কেন,                এ গহনে ধ্বনি হেন,
এ ধ্বনি দেবের যেন, চল দেখি যাইয়ে |
আ মরি ! কহিছে ধনী,      
          শুনি নাই হেন ধ্বনি,
হরিল কানন ভয়, হৃদয় নাচাইয়ে ||
বনমাঝে যায় কত,                    ধ্বনি সুনিকট তত,
দেখে শেষে তরু কত, কুঞ্জ এক ঘেরেছে |
স্থির শোভা কিবা তার,        
       বুঝি প্রেম আপনার,
সাধের প্রমোদাগার, তার মাঝে করেছে ||




এ কুঞ্জ হইতে যেন আসিছে সঙ্গীত |
হেন ভাবি দুই জনে আইল ত্বরিত ||
নিকুঞ্জ প্রবেশ মাত্র থামিল সে ধ্বনি |
কানন পূর্ব্বের মত নীরব অমনি ||
আশ্চর্য্য হইয়া দোঁহে রহিলেক স্থির |
দেখিতেছে শোভা কুঞ্জ গগন শরীর ||
কেহ নাই বন কিম্বা গগন ভিতর |
তথাপি কেমনে এলো এ মধুর স্বর ||
ললিতার জ্ঞান হলো প্রবেশ সময় |
যেন কোন স্বপ্ন-দৃষ্ট মত শোভাময়
দুই মনোরম রূপ নারী নরাকারে,
দেখিল চকিত মত নিকুঞ্জের ধারে ||
মন্মথ মোহিনী প্রতি কহিছে হে প্রিয়ে |
দেখি কালিকার দিন এখানে রহিয়ে ||
আজিকার মত যদি কালিকায় হবে |
দেব কি মানব যক্ষ জানা যাবে তবে ||
আজিকার মত এসো রই এই স্থানে |
এমন মোহন স্থান পাবে কোন্ খানে ||




মোহিনী মন্মথ সনে মনোমত স্থলে |
এমন যামিনী যাপে এমন বিরলে ||
এমন বিপদহীন বিজন কানন |
এমন বিরল প্রেম গভীর এমন ||
কে জানে সে সত্য কি না স্বপন নিশার |
বনে এলে কে জানিত হেন হবে তার ||
রবে না এমন সুখ মানব কপালে |
ভাবিয়ে বিচল চিত্ত এ সুখের কালে ||
এই ভয় মনোমাঝে হয় আর যায় |
যেন কোন মেঘ-ছায়া পড়িছে ধরায় ||
এই মত গেল নিশি নিকুঞ্জ মন্দিরে |
সে দিন কাটালে সুখে নিশি এলো ফিরে ||




কাননে যামিনী পরকাশে,
             নিরমল নীলে শশী ভাসে |
নিশীথে নিদ্রিত বন,   
              নিদ্রা যায় মেঘগণ,
নিদ্রা যায় বাতাস আকাশে ||
উঠিল নীরবে আচম্বিত,     
            প্রেমময় ললিত সঙ্গীত |
স্থির শূন্যে ভেসে যায়,
            গগন গহন তায়,
শিহরিছে পুলক পূরিত ||
যেন কেহ বিরহের জ্বরে,
              প্রেমময়ী পরশে শিহরে |
নাথহৃদে ছিল ধনী,    
          গলিল শুনিয়ে ধ্বনি,
মোহে মিশে প্রাণে প্রাণেশ্বরে ||
গভীর নিশ্বাসে থামে গান,    
       অবকাশে তারা পায় জ্ঞান |
জানিল সে কালিকার,
          সেই ধ্বনি পুনর্ব্বার,
হেথা হতে গেছে অন্য স্থান ||
প্রেয়সীরে কহিছে মন্মথ,             ধ্বনি যে জুড়ায়
শ্রুতিপথ |
এখানে গেয়েছে কাল,
       কামিনি লো কি কপাল !
আজ ধ্বনি অন্য স্থান গত ||
আজি গীত গাইছে যথায়,
            চল মোরা যাইব তথায় |
কে গায় কিসের তরে,        কেন গায় স্থানান্তরে,
করি চল যাহে জানা যায় ||
নাথ সনে লক্ষ্য করি ধ্বনি,
            চলে বনে শশাঙ্কবদনী |
ঘন গাঁথা তরুদলে,      
     ঘন তম তার তলে,
ভয়ঙ্কর নীরব কেমনি ||
পূর্ব্বমত নিকুঞ্জ মন্ডলে,              আসিল সে প্রেমিক
যুগলে
পূর্ব্বমত স্বপ্নসম,     
         দুই রূপ নিরুপম,
যথা হইতে দ্রুত গেল চলে ||




কাঁপিয়ে বিষম ভয়ে বলে হাঁ রে বিধি |
এমন সুখেতে কেন হেন কর বিধি ||
পৃথিবীতে কোন স্থান সুখের কি নয় ?
কানন বাসেও কি গো বিপদ নিশ্চয় ||
দেবতা কুপিত বলি দুজনাতে ভীত |
কি হবে তৃতীয় রাত্রে দেখিতে চিন্তিত ||
তৃতীয় নিশিথে গীত আর এক স্থানে |
পূর্ব্বমত তথা গিয়া ভয়ে মরে প্রাণে ||
সেই মত পেলে ভয় চতুর্থ রজনী |
পঞ্চম রজনীযোগে কোথায় সে ধ্বনি ?




তমিস্রা পঞ্চম নিশা, গগন মন্ডলে |
ভীষণ আঁধার বসি, ঘন বনতলে ||
নীরব নিস্পন্দ তম, সঙ্গীতের আশে |
সময় হইল তবু, সে ধ্বনি না আসে ||
বিকট আননে ভয়, ঘুমায় কাননে |
দেখে স্তব্ধ স্পন্দহীন, যত তরুগণে---
পাপান্ধ-তিমিরময়, যেন কার মন,
নীরবে করাল কার্য্য, করিছে কল্পন ||
শুধু শুষ্ক পাতা খসি, মাঝে মাঝে পড়ে |
যথা পড়ে তথা পচে, নাহি আর নড়ে ||
পাইয়া অলক্ষ্য লক্ষ্য, কুসুমের বাস |
আমোদ আঁধার দেহ, না ছাড়ে নিশ্বাস ||
পত্র-চন্দ্রাতপ তলে, ক্ষুদ্র খাল চলে |
নাহি দেখা যায় ভাল, নাহি শব্দ জলে ||
ঘুমায়ে পড়িয়ে জলে, পুষ্পবৃক্ষাবলী |
আঁধারে কলিকাগুচ্ছ, নিরখি কেবলি ||
নীরবে ঝরিয়া ফুল, স্তব্ধে ভেসে যায় |
পতিহীনা বিরহীর, প্রেম আশা প্রায় ||
শুষ্ক ফল খসি জলে, পড়ে একবার |
অমনি চমকে বুক, মন্মথ বামার ||
  অন্ধকার মাঝে আলো দুয়ের বদন |
বরষার শশী যেন, মেঘে আচ্ছাদন ||
ভীম স্তব্ধে ভয়ে ভীত, বসি তারা তথা |
উড়ু উড়ু করে প্রাণ, নাহি সরে কথা ||
ভাবে আজি কেন, এত কাঁদিছে অন্তর |
বলিতে বলিতে নারে, হৃদি গরগর ||
সুখের কাননে আজি, কেন কাল ভাব |
ভীষণ স্বপন যেন, দেখিছে স্বভাব ||
আপনি নয়ন কেন, ঝরে অকারণ |
বুঝি আজি ছেড়ে যাবে, জীবন রতন ||
হৃদে ধরি পরস্পরে, মুখপানে চায় |
কেঁদে যেন কি বলিবে, বলিতে না পায় ||
ললিতা লুকাল মাথা, প্রাণনাথ কোলে |
কাঁদিয়ে মুছায় পতি, প্রিয়া আঁখিজলে ||




এখনো এলো না কেন সঙ্গীতের ধ্বনি |
ভীষণ নীরব ! হা রে ! আছে কি ধরণী ?
অকস্মাৎ কোথা হয় গভীর গর্জ্জন |
কাঁপিল গভীর বন কাঁপিল দুজন ||
অদ্ভুত নিনাদ উড়ে যায় বন দিয়ে |
অন্ধকার ভীমতল হইল আসিয়ে ||
ভীমতর নাদে যেন কাঁপে নভ হৃদি |
কাঁদিয়া উঠিল দোঁহে, “হা বিধি ! হা বিধি !”


১০


গভীর জলদ নাদ,        গড়ায় আকাশ ছাদ,
থেকে থেকে উচ্চতর স্বনে |
পবন করিছে জোর,        যেন সাগরের সোর ,
হুঙ্কারে গরজে প্রাণপণে ||
বারেক চঞ্চলাভায়,        দেখি নীল মেঘ গায়,
কটা মাথা নাড়ে ক্ষিপ্তবন |
পাতা উড়ে ঢাকে ঘনে,           পড়িতেছে ঘোর স্বনে,
বড় বড় মহীরুহগণ ||
ঘোরতর চীত্কার,        লক্ষ লক্ষ অনিবার,
মানুষ চিবায় ভূতগণে |
সমুদ্র সমান সোরে,        বরিষা আছাড়ে জোরে
রেগে রেগে গর্জ্জে বায়ু সনে ||
উপরি উপরি ধ্বনি,           আছাড়ে সহস্রাশনি,
খন্ডে খন্ডে ছেঁড়ে বা গগন |
বিদারিয়ে বিটপীরে,         বজ্রাগ্নি পোড়ায় শিরে,
কাঁদে যত সিংহ ব্যাঘ্রগণ ||


১১


ভীষণ নীরব ! যেন মরেছে ধরণী |
হে ধাতঃ কাঁপালো স্তব্ধ আবার কি ধ্বনি ||
বলিছে গম্ভীর স্বরে, “রে নরযুগল |
দেবের নিকুঞ্জে এসে পাও কর্ম্মফল ||”
ফিরে বার ঘর ঘর,                গরজিল জলধর,
মাতিল মরুৎ ফিরে বার |
চেচায় অশনি ঘন,                ভীমবলে তরুগণ,
মত্ত শির নাড়িছে আবার ||


১২


থামিল ঝটিকারণ, হলো নিশাশেষ |
শ্বেতমেঘময়াকাশে, উদিল নিশেশ ||
জলে করে জলময়, কানন নিকুঞ্জ |
তরু লতা তৃণ ভূম, পুষ্পলতা পুঞ্জ ||
ফুলময় ছোট খাল বিমল চঞ্চল |
ছায়াকারী শাখা হতে ঝরে বিন্দুজল ||
উজ্জল পুলিনতলে ম্লান তারা মত |
মরিয়ে রয়েছে ঝড়ে ললিতা মন্মথ ||
মানবের কি কপাল ! সংসার কি ছার |
বহিতে জীবন ভার কে চাহিবে আর ?
  নাথভূজে মাথা দিয়ে পড়েছে মোহিনী |
মুখে মুখে কাঁদে যেন দুটি সরোজিনী ||
ললিতার মুখশশী ভিজে বরিষায় |
সরোজ শিশির মাথা মাটিতে লোটায় ||
শীতল ললাটে জলে জ্বলে শশধর |
জলে ভিজে পড়ে আছে অলকানিকর ||
ফুটায় কবরী চারু, দীর্ঘ তৃণোপরে |
মন্মথ রয়েছে তবু নাহি তুলে ধরে ||
এখনো সুস্থির মুখ রূপের ছায়ার |
প্রাণ গেল তবু রূপ নাহি ছাড়ে তায় ||
সেরূপ ঘুমায় যেন, সন্ধ্যা ধরাপরে ;
ভয়ে প্রকৃতির যেন নিশ্বাস না সরে ||
স্থির শ্বেত ভাল সেই, নহে নিরমল |
দেখিলে শিহর হয় শরীর বিকল ||
পড়ি তায় মরণের ভয়ঙ্কর ছায়া |
চন্দ্রিকায় যেন কালো, কাদম্বিনী কায়া ||
যেন চন্দ্রকরে স্থির বারিধি, বিস্তর |
পড়ে তায় শিখরীর ছায়া অন্ধকার ||
কোমল পল্লব নীল মুদেছে নয়ন |
এরি কি কটাক্ষে ছিল সুখের স্বপন ?
 এখনি কেঁদেছে কত কাঁদিবে না আর |
সফরী সমান নাহি নাচিবে আবার ||
বুঝি তার প্রিয় তারা মন্মথ বদনে |
চাহিতে চাহিতে বুঝি মুদেছে মরণে ||
মানবের কি কপাল ! এই সে হৃদয় |
কোথা তার প্রেম মোহ কোথা আশা ভয় !
বিবাস বিমল পড়ি শশীর কিরণে !
ভিতর নিস্পন্দ যেন জগৎ এক্ষণে ||
একে বৃন্তে দুটি ফুল মুখে মুখ দিয়ে |
সে হৃদি কুসুমাসনে পড়েছে ছিঁড়িয়ে ||
তেমনি একাঙ্গে এরা থেকে চিরকাল |
মরিল অধরাধরে কি সুখ কপাল ||
যার লাগি ছিল বেঁচে পারিত বাঁচিতে |
তারি সনে মরে গেল তাহারি হৃদিতে ||
সুখের কপাল ! কত সংসার যাতনা |
বিকার বিয়োগ শোক সহিতে হলো না ||
ছিঁড়িয়াছে ভীম ঝড়ে একই প্রহারে |
কাটে নি ক্রমশঃ কীট, প্রাণের সুসারে ||
গভীর গোপনগামী সুখ-স্রোতোপরে |
    পড়ে নাই ভেসে ভেসে ডুবিতে সাগরে ||
যা হবার হইয়াছে এই মাত্র স্থির |
এই আছে অবশেষ, সে প্রেমশশীর ||
ওইখানে দেহাম্বুজ মাটি হয়ে যাবে |
জানিবে কে ?  দেখিবে কে ? কেঁদে কে ভিজাবে ?


চন্দ্রিকার নীলাকাশ গায়,
            দুটি দেবদারু দেখা যায় |
ভীম বনে তলে তার,    
        অতি স্তব্ধ অনিবার,
কাল যেন প্রহরী তাহার ||
সেই নদী সেই তরুবরে,    
               দুখময় তর তর স্বরে ,
বারেক না ক্ষান্ত আছে,          নক্ষত্রমন্ডলী কাছে,
অদ্যাপি বিলাপ কেন করে ||
গম্ভীর সে ধ্বনি নিরবধি,
               যেন বা সন্ধ্যায় শরন্নদী |
শুনিলে শিহরি স্মরি,
        মেধার মারুতোপরি,
জানিনে যেতেছি কি জলধি ||
শ্যামলা গুল্মিনী চির নব,     
       ব্যাপিয়াছে সেই স্থান সব |
তারাফুল তারা ধরে,        অনন্ত আমোদ করে,
সুধাপানে শিহরিছে নভ ||
এ কাননে গভীর এমন,
             কে করে রে বাঁশরী বাদন |
অনিবার নিশাভাগে,        যেন কার অনুরাগে,
গায় সাধে মনের যাতন ||
মোহমন্ত্রে তার স্থির বন,   
         শোনে ধ্বনি-বিহীন স্পন্দন |
পত্রটি নাহিক সরে,
     যেতে যেতে শুনে স্বরে,
নাহি সরে নীরধরগণ ||
চন্দ্রিকার শূন্য কুঞ্জোপর,
            মোহন স্বপ্নজ শোভাধর |
কারা যেন শুনে তায়,        উড়ে নীল নভ গায়,
মর্ম্মরিত প্রচুর অম্বর ||
তাহে কত সুধাবাস ঝরে,
           কুসুম বরিষে কুঞ্জোপরে |
ভাঙ্গে স্বপ্ন ঊষা আসি,
      অমনি নীরব বাঁশী,
গল্যে যায় সে রূপ নিকরে ||
ধূলি হয়ে এই কুঞ্জবনে মন্মথ-মোহিনী নাথ সনে |
প্রতি নিশি এই মত,        হয় যথা নিদ্রাগত,
ললিতা মন্মথ দুই জনে ||

.                                  ****************                                   
.                                                                                             
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর