কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা |
ললিতা কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাল্য রচনা। যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী” ২য় খন্ড, ( ১৯৫৫ ) থেকে নেওয়া | এই কবিতা সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই লিখেছেন . . . "এই কবিতাগুলি লেখকের / কবির পঞ্চদশ বত্সর বয়সে লিখিত | লিখিত হওয়ার তিন বত্সর পরে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয় | প্রকাশিত হইয়া বিক্রেতার আলমারীতেই পচে—বিক্রয় হয় নাই | তাহার পর আর এ সকল পুনর্মুদ্রিত করিবার যোগ্য বিবেচনা করি নাই, এখনও আমার এমন বিবেচনা হয় না যে, ইহা পুনর্মুদ্রিত করা বিধেয় | বাল্যকালে কিরূপ লিখিয়াছিলাম, তাহা দেখাইয়া বাহাদুরী করিবার ভরসা কিছুমাত্র নাই ; কেন না, অনেকেই অল্প বয়সে এরূপ কবিতা লিখিতে পারে | যাহা অপাঠ্য, তাহা বালকপ্রণীত হউক বা বৃদ্ধপ্রণীত হউক, তুল্যরূপে পরিহার্য্য | অতএব কিছু পরিবর্ত্তন না করিয়া “ললিতা” নামক কাব্যখানি পুনর্মুদ্রিত করিতে পারিলাম না | “মানস” নামক কাব্যখানিতে পরিবর্ত্তন বড় সহজ নহে, এ জন্য সে চেষ্টা করিলাম না | তথাপি সামান্যরূপ পরিবর্ত্তন করা গিয়াছে |" ভৌতিক গল্প “O Love ! in such a wilderness as this, Where transport with security entwine, Here is the Empire of thy perfect bliss. And here art thou a God indeed divine,” Gertrude of Wyoming. “ But mortal pleasure, what art thou in truth ! The torrents’ smoothness ere it dash below.” Ibid. প্রথম সর্গ ১ মহারণ্যে অন্ধকার, গভীর নিশায় নির্ম্মল আকাশ নীলে, শশী ভেসে যায় || কাননের পাতা ছাদ, নাচে শশিকরে | পবন দোলায় তারে সুমধুর স্বরে || নীচে তার অন্ধকারে, আছে ক্ষুদ্র নদী | অন্ধকার মহাস্তব্ধ, বহে নিরবধি || ভীম তরুশাখা যথা পড়িয়াছে জলে, কল কল করি বারি সুরবে উছলে || আঁধারে অস্পষ্ট দেখি, যেন বা স্বপন ! কলিকাস্তবময় ক্ষুদ্র তরুগণ || শাখার বিচ্ছেদে, কভু শশধরকর, স্থানে স্থানে পড়িয়াছে, নীল জলোপর || ঘোর স্তব্ধ নদীতটে : শুধু ক্ষণে ক্ষণে, কোন কীট যায় আসে নাড়া দিয়ে বনে || শুধু অন্ধকার মাঝে, অলক্ষ্য শরীর | কোন হিংস্র পশু ছাড়ে নিশ্বাস গভীর || অসংখ্য পত্রের শুধু, ভীষণ মর্ম্মর | আর শুধু শুনি এক, সঙ্গীতের স্বর || গভীর সঙ্গীত সেই ! ভাসে নদী দিয়ে | ভাঙ্গিল গভীর স্তব্ধ স্বরে শিহরিয়ে--- কখন কোমল স্থির করুণার স্বরে, যেন কোন বিরহিণী কেঁদে কেঁদে মরে || শুনিয়ে তা মনে হয়, ঈষৎ আভাসে, যেন কত সুখস্বপ্ন, হয়েছে বিনাশ ; কি কারণে দুঃখোদয় কিসের স্মরণে, কিছুই বুঝি না তবু, উচাটন মনে || ফুলিয়া উঠেছে ধ্বনি, স্থির শূন্য কেটে | ইচ্ছা করে গগনেতে উঠে যাই ফেটে || ছেঁড়ে হৃদয়ের ডোর গভীর যাতনে | ইচ্ছা করে গলি গিয়ে মিশি গান সনে || আর যদি সঙ্গীতের দেহ দেখা পাই ! যতনেতে আলিঙ্গিয়া, মোহে মরে যাই || ২ নদীতীরে বৃক্ষ নাহি ছিল এক স্থানে | দীর্ঘ তৃণে চন্দ্রকর জ্বলিছে সেখানে || ছোট গাছে তারামত ফুল্ল পুষ্পদলে | স্থির তার প্রতিরূপ স্থির নদীজলে || সুখস্বপ্নে যেন তারা, নিদ্রাভরে হাসে | গগন গুমুরে মরে, সুখময় বাসে || সেই স্থানে বসি এক নারী একাকিনী | ফুলহীন বনে যেন স্থলকমলিনী || মিশেছে সে চন্দ্রিকায় ; ভাবে তায় চিত্ত শুধু সে স্বপ্নের ছায়া, অসত্য অনিত্য || যৌবন আশার সম ফুল্ল রূপ তার | দেখিয়া ফিরালে আঁখি, দেখি ফিরে বার || স্থিরা ধীরা সুকোমলা বিমলা অবলা | সবে নব পুরিতেছে যৌবনের কলা || মোহন সঙ্গীতে মন বেঁধেছে যতনে | প্রেম যেন শুনিতেছে আশার বচনে || বদনে ললিত রেখা কত হয়ে যায় | রক্তিম নীরদ যেন শারদ সন্ধ্যায় || গলিল নয়নপদ্ম ; মুগ্ধ তার মন, প্রাণ মন জ্ঞান ধন জীবন যৌবন, সকলি করেছে যেন গীতে সমর্পণ || কোথা হতে আসে সেই সুমধুর গান ? কেন তাতে এত আশা ? কে হরিল প্রাণ ? ৩ ললিতা তাহার নাম--- রাজার নন্দিনী | জননী না ছিল তার, বিমাতা বাঘিনী | রাজা বড় নিষ্ঠুর সতত দেয় জ্বালা ; গোপনে কতই কাঁদে মাতৃহীনা বালা | দুর্জ্জনের সাথে তার বিবাহ সম্বন্ধ— শুনে কেঁদে কেঁদে তার চক্ষু যেন অন্ধ | মন্মথ নামেতে যুবা, সুঠাম সুন্দর, বচনে অমিয় ক্ষরে নারীমনোহর | মোহিল ললিতাচিত তার দরশনে | গোপনে বিবাহ হৈল মিলিল দুজনে | জানিল বিবাহবার্ত্তা দুরন্ত রাজন্ | কন্যারে ডাকিয়া বলে পরুষ বচন || এ পুরী আঁধার কেন কর কলঙ্কিনী | শীঘ্র যাও দেশান্তর না হতে যামিনী || কাল যদি দেখি তোরে, বধিব পরাণ | ভয়ে বালা সেই দন্ডে করিলা প্রস্থান || মন্মথ লইয়া তারে তুলিল নৌকায় | ভয়ে ভীত দুই জনে নদী বেয়ে যায় || পথিমধ্যে দস্যুদল আসিয়া রোধিল | ললিতারে কাড়ি লয়ে বনে প্রবেশিল || অলঙ্কার কেড়ে নিয়ে ছেড়ে দিল তারে | ললিতা একাকী ফিরে নদী ধারে ধারে || কোথায় মন্মথ গেল, তরি কোন্ ভিতে | রজনী গভীরা তবু ভয় নাই চিতে | এমন সময় শোনে সঙ্গীতের ধ্বনি | মন্মথ গাইছে গীত বুঝিল অমনি || বুঝিল সঙ্কেত করে সেই প্রিয়জন, নদীতীরে চন্দ্রালোকে বসিল তখন | তীরেতে লাগিল তরি অতিদ্রুত হয়ে | দেখিতে দেখিতে দুয়ে দুয়ের হৃদয়ে || কতই আদর করে, পেয়ে সোহাগিনী | কতই রোদন করে কাতরা কামিনী || ৪ তখন ললিতা কয়, “আর জ্বালা নাহি সয়, পড়িয়া দস্যুর হাতে, যে দুঃখ হে পেয়েছি | কাড়ি নিল অলঙ্কার, লাঞ্ছনা কত আমার, তীরে তীরে কেঁদে কেঁদে এতদূর এসেছি || দেখা হবে তব সাথ, হেন নাহি জানি নাথ, দয়া করি কালী আজি রেখেছেন চরণে |” পতি বলে “শুন প্রিয়ে, তোমা ধনে হারাইয়ে, মরিব বলিয়ে আজি, প্রবেশিনু কাননে || দেখিলাম দুই ধার, মহারণ্যে অন্ধকার, নীরবে নির্ম্মলা নদী, তার মাঝে বহিছে | ভীষণ বিজন স্তব্ধ, নাহি জীব নাহি শব্দ, তরুদলে ঢুলে জলে, ঘুমাইয়া রহিছে || যে স্থির অরণ্য নদী, যেন বা সৃজনাবধি, কোন জীব কোন কীট, তথা নাহি নড়েছে | প্রথমে যে ছিল যথা, এখনও রয়েছে তথা, মৃত্যুর ভীষণ ছায়া, সর্ব্বস্থানে পড়েছে || ভয়েতে গগন পানে, চাহিলে ভুলিনু প্রাণে, বিমল সুনীলাকাশে, শশী হেসে যেতেছে | ভাবিলাম প্রকৃতির, সকলি গভীর স্থির, শধু এ হৃদয় কেন, এত দুঃখ পেতেছে | মরি যদি পারিতাম, গোলে জল হইতাম, এ স্থির সলিলে মিশে, হৃদয় ঘুমাইত | তথা রিপু চিন্তাহীন, রহিতাম চিরদিন, ললিতার দুঃখ তবে, কিসে হৃদে আইত || ৫ “ভাবি এ প্রকার, ছাড়িতে হুঙ্কার, কাঁপিল কানন স্তব্ধ | শিহরি অন্তরে, কি জানি কি ডরে, কাঁপে হৃদি শুনি শব্দ || হুতাশ নাশিতে, সঙ্কেত বাঁশীতে, গায়িলাম দুখ যত | বাজাইয়া তায়, মরি লো তোমায়, সঙ্কেত করেছি কত ! একবার যাই, মুরলী বাজাই, আপনি নয়ন ঝোরে | গলে হৃদি দুখে, এক মাত্র সুখে ; বাঁশী কি মোহিল মোরে ! গাই পরক্ষণে, দেখি নিশাবনে, একাকিনী রূপবতী | হয়ে চমকিত, তরি এই ভীত, হইলাম শীঘ্রগতি || কে জানে কেমনে, আশা এলো মনে, আমারি ললিতা হবে | কত ভাগ্য ধনি, পাই হারা মণি, আর ছাড়া নাহি হবে ?” ৬ ললিতা “নারে প্রাণ নারে, আর হে তোমারে, আঁখি ছাড়া করিব না | রহিব দুজনে, গোপন কাননে, দেখিবে না কোন জনা || কাজ নাই দেশে, তথা শুধু দ্বেষে, হেন প্রেম নাশ করে | গঞ্জন যন্ত্রণা, কলঙ্ক রটনা, মিলন না হয় ডরে || যেখানে প্রণয়, হৃদয়ে না রয়, যেখানে তোমা না পাই | সে দেশ কি দেশ, সে গৃহে বিদ্বেষ, কখন যেন না যাই || এখানে মন্মথ, প্রণয়ের পথ, কলঙ্কের কাঁটা হীন | হেরি তব মুখে, নিরমল সুখে, স্বর্গসুখে হব লীন || জ্বালা পৃথিবীর, সব হবে স্থির, শুধু সুখময় মন | লইয়ে মন্মথ, যাহা মনোমত, করিব সকল ক্ষণ ||” মন্মথ “হে বিধি হে বিধি কর কর বিধি, এই কপালে আমার | বল তার চেয়ে, স্বর্গপদ পেয়ে, কি সুখে আছে হে আর || বিচ্ছেদ যাতনা, দিব না দিব না, এ জনমে প্রেয়সীরে | কাল পূর্ণ হলে, সুখে তব কোলে, মরে যীব ধীরে ধীরে ||” দ্বিতীয় সর্গ ১ মরি প্রেম যার মনে, সে কি চায় রাজ্যধনে, প্রিয়মুখ ত্রিসংসার তায় | হৃদে তার যে রতন, আলো করে ত্রিভুবন, অন্য মণি নিবায় বিভায় || এক মোহে সদা মত্ত, না জানে আপনি মর্ত্ত্য, যাহা দেখে তাই প্রেমাকুল || রবি শশী তারাকাশ, পয়োদ পবনশ্বাস, সাগর শিখর বনফুল || যেন লক্ষ বিদ্যাধরে, সদা কর্ণে গান করে, কি মধুর শব্দহীন ভাষা | হেরিয়ে সামান্য কলি, নয়ন সলিলে গলি, উছলে অনন্ত ভালবাসা || প্রেমে যার মন বাঁধা, না পারে দিবারে বাধা, সমুদ্র শিখর নদী বনে | তবে যদি করে বিধি, চির বিরহের বিধি, তবু স্বর্গ মনের মিলনে || কলঙ্ক বিপদ ক্লেশ, ঝটিকার ধরি বেশ, শিরোপরি গরজয়ে যত | আশ্রয় করিয়া আশা, প্রণয়ীতে ভালবাসা, প্রণয়ীর প্রাণে বাড়ে তত || জ্বালা সয় নিরবধি, সেও ভাল পায় যদি, একবার আঁখির মিলন | দুঃখের গভীর বনে, সেই স্বপ্নে সুখ মনে, প্রেম রীতি কে জানে কেমন || ২ চলিল চরণ চন্দ্রবদনী | ঢলিয়ে ঢলিয়ে মন্দচরণী | উষার প্রখর তারকা ধনী | চলিল গজেশগামিনী || উভয়ে মরেছে হৃদি যাতনে | উভয়ে পেয়েছে প্রাণরতনে | কাঁধে কাঁধে ধরি চলে কাননে | গভীর নীরব যামিনী || শিরোপরে শাখা বিনান ঘন | আসিবে কেমনে শশিকিরণ | তরল তিনির ভীষণ বন | দেখিয়া শিহরে কামিনী | আঁধার আকাশে নক্ষত্রাবলি | তেমনি কাননে কুসুম কলি | আমোদে হৃদয়ে যেতেছে গলি | সে সব নীরদ দামিনী || ভীষণ তিমিরে ভীষণ স্থির | মাঝে মাঝে খসে পত্র শাখীর | ধীরে ধীরে ঝরে নির্ঝর নীর | আঁধারে নিরখে রঙ্গিণী || লাগিয়া নির্ঝরে ঈষৎ আলো | দেখে ফুলময় সে জল কালো | আঁধারে কুসুম পরশে গাল | শিহরে সরোজ অঙ্গিনী || যেতে পতি সনে চন্দ্রবদনী | মরি কি সঙ্গীত শুনিল ধনী | ললিত মোহন গভীর ধ্বনি | নির্ঝর নিনাদ সঙ্গিনী || নীরব কানন উঠে শিহরি | শিহরে দুজনে দুজনে ধরি | হৃদয়ে হৃদয়ে গাঁথিল মরি | বাঁধিল মনঃকুরঙ্গিনী || ৩ স্তব্ধ বনে অন্ধকারে, ভেসে ভেসে চারি ধারে মোহে তায় দুই জনে, আপনাকে ভুলিল | দুজনার মুখ চেয়ে, দুজনারে বুকে পেয়ে, প্রেম আর সেই গানে, এক হয়ে মিলিল || জ্ঞান পেয়ে কহে কেন, এ গহনে ধ্বনি হেন, এ ধ্বনি দেবের যেন, চল দেখি যাইয়ে | আ মরি ! কহিছে ধনী, শুনি নাই হেন ধ্বনি, হরিল কানন ভয়, হৃদয় নাচাইয়ে || বনমাঝে যায় কত, ধ্বনি সুনিকট তত, দেখে শেষে তরু কত, কুঞ্জ এক ঘেরেছে | স্থির শোভা কিবা তার, বুঝি প্রেম আপনার, সাধের প্রমোদাগার, তার মাঝে করেছে || ৪ এ কুঞ্জ হইতে যেন আসিছে সঙ্গীত | হেন ভাবি দুই জনে আইল ত্বরিত || নিকুঞ্জ প্রবেশ মাত্র থামিল সে ধ্বনি | কানন পূর্ব্বের মত নীরব অমনি || আশ্চর্য্য হইয়া দোঁহে রহিলেক স্থির | দেখিতেছে শোভা কুঞ্জ গগন শরীর || কেহ নাই বন কিম্বা গগন ভিতর | তথাপি কেমনে এলো এ মধুর স্বর || ললিতার জ্ঞান হলো প্রবেশ সময় | যেন কোন স্বপ্ন-দৃষ্ট মত শোভাময় দুই মনোরম রূপ নারী নরাকারে, দেখিল চকিত মত নিকুঞ্জের ধারে || মন্মথ মোহিনী প্রতি কহিছে হে প্রিয়ে | দেখি কালিকার দিন এখানে রহিয়ে || আজিকার মত যদি কালিকায় হবে | দেব কি মানব যক্ষ জানা যাবে তবে || আজিকার মত এসো রই এই স্থানে | এমন মোহন স্থান পাবে কোন্ খানে || ৫ মোহিনী মন্মথ সনে মনোমত স্থলে | এমন যামিনী যাপে এমন বিরলে || এমন বিপদহীন বিজন কানন | এমন বিরল প্রেম গভীর এমন || কে জানে সে সত্য কি না স্বপন নিশার | বনে এলে কে জানিত হেন হবে তার || রবে না এমন সুখ মানব কপালে | ভাবিয়ে বিচল চিত্ত এ সুখের কালে || এই ভয় মনোমাঝে হয় আর যায় | যেন কোন মেঘ-ছায়া পড়িছে ধরায় || এই মত গেল নিশি নিকুঞ্জ মন্দিরে | সে দিন কাটালে সুখে নিশি এলো ফিরে || ৬ কাননে যামিনী পরকাশে, নিরমল নীলে শশী ভাসে | নিশীথে নিদ্রিত বন, নিদ্রা যায় মেঘগণ, নিদ্রা যায় বাতাস আকাশে || উঠিল নীরবে আচম্বিত, প্রেমময় ললিত সঙ্গীত | স্থির শূন্যে ভেসে যায়, গগন গহন তায়, শিহরিছে পুলক পূরিত || যেন কেহ বিরহের জ্বরে, প্রেমময়ী পরশে শিহরে | নাথহৃদে ছিল ধনী, গলিল শুনিয়ে ধ্বনি, মোহে মিশে প্রাণে প্রাণেশ্বরে || গভীর নিশ্বাসে থামে গান, অবকাশে তারা পায় জ্ঞান | জানিল সে কালিকার, সেই ধ্বনি পুনর্ব্বার, হেথা হতে গেছে অন্য স্থান || প্রেয়সীরে কহিছে মন্মথ, ধ্বনি যে জুড়ায় শ্রুতিপথ | এখানে গেয়েছে কাল, কামিনি লো কি কপাল ! আজ ধ্বনি অন্য স্থান গত || আজি গীত গাইছে যথায়, চল মোরা যাইব তথায় | কে গায় কিসের তরে, কেন গায় স্থানান্তরে, করি চল যাহে জানা যায় || নাথ সনে লক্ষ্য করি ধ্বনি, চলে বনে শশাঙ্কবদনী | ঘন গাঁথা তরুদলে, ঘন তম তার তলে, ভয়ঙ্কর নীরব কেমনি || পূর্ব্বমত নিকুঞ্জ মন্ডলে, আসিল সে প্রেমিক যুগলে পূর্ব্বমত স্বপ্নসম, দুই রূপ নিরুপম, যথা হইতে দ্রুত গেল চলে || ৭ কাঁপিয়ে বিষম ভয়ে বলে হাঁ রে বিধি | এমন সুখেতে কেন হেন কর বিধি || পৃথিবীতে কোন স্থান সুখের কি নয় ? কানন বাসেও কি গো বিপদ নিশ্চয় || দেবতা কুপিত বলি দুজনাতে ভীত | কি হবে তৃতীয় রাত্রে দেখিতে চিন্তিত || তৃতীয় নিশিথে গীত আর এক স্থানে | পূর্ব্বমত তথা গিয়া ভয়ে মরে প্রাণে || সেই মত পেলে ভয় চতুর্থ রজনী | পঞ্চম রজনীযোগে কোথায় সে ধ্বনি ? ৮ তমিস্রা পঞ্চম নিশা, গগন মন্ডলে | ভীষণ আঁধার বসি, ঘন বনতলে || নীরব নিস্পন্দ তম, সঙ্গীতের আশে | সময় হইল তবু, সে ধ্বনি না আসে || বিকট আননে ভয়, ঘুমায় কাননে | দেখে স্তব্ধ স্পন্দহীন, যত তরুগণে--- পাপান্ধ-তিমিরময়, যেন কার মন, নীরবে করাল কার্য্য, করিছে কল্পন || শুধু শুষ্ক পাতা খসি, মাঝে মাঝে পড়ে | যথা পড়ে তথা পচে, নাহি আর নড়ে || পাইয়া অলক্ষ্য লক্ষ্য, কুসুমের বাস | আমোদ আঁধার দেহ, না ছাড়ে নিশ্বাস || পত্র-চন্দ্রাতপ তলে, ক্ষুদ্র খাল চলে | নাহি দেখা যায় ভাল, নাহি শব্দ জলে || ঘুমায়ে পড়িয়ে জলে, পুষ্পবৃক্ষাবলী | আঁধারে কলিকাগুচ্ছ, নিরখি কেবলি || নীরবে ঝরিয়া ফুল, স্তব্ধে ভেসে যায় | পতিহীনা বিরহীর, প্রেম আশা প্রায় || শুষ্ক ফল খসি জলে, পড়ে একবার | অমনি চমকে বুক, মন্মথ বামার || অন্ধকার মাঝে আলো দুয়ের বদন | বরষার শশী যেন, মেঘে আচ্ছাদন || ভীম স্তব্ধে ভয়ে ভীত, বসি তারা তথা | উড়ু উড়ু করে প্রাণ, নাহি সরে কথা || ভাবে আজি কেন, এত কাঁদিছে অন্তর | বলিতে বলিতে নারে, হৃদি গরগর || সুখের কাননে আজি, কেন কাল ভাব | ভীষণ স্বপন যেন, দেখিছে স্বভাব || আপনি নয়ন কেন, ঝরে অকারণ | বুঝি আজি ছেড়ে যাবে, জীবন রতন || হৃদে ধরি পরস্পরে, মুখপানে চায় | কেঁদে যেন কি বলিবে, বলিতে না পায় || ললিতা লুকাল মাথা, প্রাণনাথ কোলে | কাঁদিয়ে মুছায় পতি, প্রিয়া আঁখিজলে || ৯ এখনো এলো না কেন সঙ্গীতের ধ্বনি | ভীষণ নীরব ! হা রে ! আছে কি ধরণী ? অকস্মাৎ কোথা হয় গভীর গর্জ্জন | কাঁপিল গভীর বন কাঁপিল দুজন || অদ্ভুত নিনাদ উড়ে যায় বন দিয়ে | অন্ধকার ভীমতল হইল আসিয়ে || ভীমতর নাদে যেন কাঁপে নভ হৃদি | কাঁদিয়া উঠিল দোঁহে, “হা বিধি ! হা বিধি !” ১০ গভীর জলদ নাদ, গড়ায় আকাশ ছাদ, থেকে থেকে উচ্চতর স্বনে | পবন করিছে জোর, যেন সাগরের সোর , হুঙ্কারে গরজে প্রাণপণে || বারেক চঞ্চলাভায়, দেখি নীল মেঘ গায়, কটা মাথা নাড়ে ক্ষিপ্তবন | পাতা উড়ে ঢাকে ঘনে, পড়িতেছে ঘোর স্বনে, বড় বড় মহীরুহগণ || ঘোরতর চীত্কার, লক্ষ লক্ষ অনিবার, মানুষ চিবায় ভূতগণে | সমুদ্র সমান সোরে, বরিষা আছাড়ে জোরে রেগে রেগে গর্জ্জে বায়ু সনে || উপরি উপরি ধ্বনি, আছাড়ে সহস্রাশনি, খন্ডে খন্ডে ছেঁড়ে বা গগন | বিদারিয়ে বিটপীরে, বজ্রাগ্নি পোড়ায় শিরে, কাঁদে যত সিংহ ব্যাঘ্রগণ || ১১ ভীষণ নীরব ! যেন মরেছে ধরণী | হে ধাতঃ কাঁপালো স্তব্ধ আবার কি ধ্বনি || বলিছে গম্ভীর স্বরে, “রে নরযুগল | দেবের নিকুঞ্জে এসে পাও কর্ম্মফল ||” ফিরে বার ঘর ঘর, গরজিল জলধর, মাতিল মরুৎ ফিরে বার | চেচায় অশনি ঘন, ভীমবলে তরুগণ, মত্ত শির নাড়িছে আবার || ১২ থামিল ঝটিকারণ, হলো নিশাশেষ | শ্বেতমেঘময়াকাশে, উদিল নিশেশ || জলে করে জলময়, কানন নিকুঞ্জ | তরু লতা তৃণ ভূম, পুষ্পলতা পুঞ্জ || ফুলময় ছোট খাল বিমল চঞ্চল | ছায়াকারী শাখা হতে ঝরে বিন্দুজল || উজ্জল পুলিনতলে ম্লান তারা মত | মরিয়ে রয়েছে ঝড়ে ললিতা মন্মথ || মানবের কি কপাল ! সংসার কি ছার | বহিতে জীবন ভার কে চাহিবে আর ? নাথভূজে মাথা দিয়ে পড়েছে মোহিনী | মুখে মুখে কাঁদে যেন দুটি সরোজিনী || ললিতার মুখশশী ভিজে বরিষায় | সরোজ শিশির মাথা মাটিতে লোটায় || শীতল ললাটে জলে জ্বলে শশধর | জলে ভিজে পড়ে আছে অলকানিকর || ফুটায় কবরী চারু, দীর্ঘ তৃণোপরে | মন্মথ রয়েছে তবু নাহি তুলে ধরে || এখনো সুস্থির মুখ রূপের ছায়ার | প্রাণ গেল তবু রূপ নাহি ছাড়ে তায় || সেরূপ ঘুমায় যেন, সন্ধ্যা ধরাপরে ; ভয়ে প্রকৃতির যেন নিশ্বাস না সরে || স্থির শ্বেত ভাল সেই, নহে নিরমল | দেখিলে শিহর হয় শরীর বিকল || পড়ি তায় মরণের ভয়ঙ্কর ছায়া | চন্দ্রিকায় যেন কালো, কাদম্বিনী কায়া || যেন চন্দ্রকরে স্থির বারিধি, বিস্তর | পড়ে তায় শিখরীর ছায়া অন্ধকার || কোমল পল্লব নীল মুদেছে নয়ন | এরি কি কটাক্ষে ছিল সুখের স্বপন ? এখনি কেঁদেছে কত কাঁদিবে না আর | সফরী সমান নাহি নাচিবে আবার || বুঝি তার প্রিয় তারা মন্মথ বদনে | চাহিতে চাহিতে বুঝি মুদেছে মরণে || মানবের কি কপাল ! এই সে হৃদয় | কোথা তার প্রেম মোহ কোথা আশা ভয় ! বিবাস বিমল পড়ি শশীর কিরণে ! ভিতর নিস্পন্দ যেন জগৎ এক্ষণে || একে বৃন্তে দুটি ফুল মুখে মুখ দিয়ে | সে হৃদি কুসুমাসনে পড়েছে ছিঁড়িয়ে || তেমনি একাঙ্গে এরা থেকে চিরকাল | মরিল অধরাধরে কি সুখ কপাল || যার লাগি ছিল বেঁচে পারিত বাঁচিতে | তারি সনে মরে গেল তাহারি হৃদিতে || সুখের কপাল ! কত সংসার যাতনা | বিকার বিয়োগ শোক সহিতে হলো না || ছিঁড়িয়াছে ভীম ঝড়ে একই প্রহারে | কাটে নি ক্রমশঃ কীট, প্রাণের সুসারে || গভীর গোপনগামী সুখ-স্রোতোপরে | পড়ে নাই ভেসে ভেসে ডুবিতে সাগরে || যা হবার হইয়াছে এই মাত্র স্থির | এই আছে অবশেষ, সে প্রেমশশীর || ওইখানে দেহাম্বুজ মাটি হয়ে যাবে | জানিবে কে ? দেখিবে কে ? কেঁদে কে ভিজাবে ? চন্দ্রিকার নীলাকাশ গায়, দুটি দেবদারু দেখা যায় | ভীম বনে তলে তার, অতি স্তব্ধ অনিবার, কাল যেন প্রহরী তাহার || সেই নদী সেই তরুবরে, দুখময় তর তর স্বরে , বারেক না ক্ষান্ত আছে, নক্ষত্রমন্ডলী কাছে, অদ্যাপি বিলাপ কেন করে || গম্ভীর সে ধ্বনি নিরবধি, যেন বা সন্ধ্যায় শরন্নদী | শুনিলে শিহরি স্মরি, মেধার মারুতোপরি, জানিনে যেতেছি কি জলধি || শ্যামলা গুল্মিনী চির নব, ব্যাপিয়াছে সেই স্থান সব | তারাফুল তারা ধরে, অনন্ত আমোদ করে, সুধাপানে শিহরিছে নভ || এ কাননে গভীর এমন, কে করে রে বাঁশরী বাদন | অনিবার নিশাভাগে, যেন কার অনুরাগে, গায় সাধে মনের যাতন || মোহমন্ত্রে তার স্থির বন, শোনে ধ্বনি-বিহীন স্পন্দন | পত্রটি নাহিক সরে, যেতে যেতে শুনে স্বরে, নাহি সরে নীরধরগণ || চন্দ্রিকার শূন্য কুঞ্জোপর, মোহন স্বপ্নজ শোভাধর | কারা যেন শুনে তায়, উড়ে নীল নভ গায়, মর্ম্মরিত প্রচুর অম্বর || তাহে কত সুধাবাস ঝরে, কুসুম বরিষে কুঞ্জোপরে | ভাঙ্গে স্বপ্ন ঊষা আসি, অমনি নীরব বাঁশী, গল্যে যায় সে রূপ নিকরে || ধূলি হয়ে এই কুঞ্জবনে মন্মথ-মোহিনী নাথ সনে | প্রতি নিশি এই মত, হয় যথা নিদ্রাগত, ললিতা মন্মথ দুই জনে || . **************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |