কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
ভাই ভাই
( সমবেত বাঙ্গালিদ্গের সভা দেখিয়া )
কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
১৮৭৮ সালে প্রকাশিত “কবিতাপুস্তক” গ্রন্থ থেকে নেওয়া। কবিতাটি সর্বপ্রথম “বঙ্গদর্শন” পত্রিকায় প্রকাশিত
হয়েছিল।




এক বঙ্গ ভূমে জনম সবার,
এক বিদ্যালয়ে জ্ঞানের সঞ্চার,
এক দুঃখে সবে করি হাহাকার,
.                   ভাই ভাই সবে, কাঁদ রে ভাই |
এক শোকে শীর্ণ সবার শরীর,
এক শোকে বর নয়নের নীর,
এক অপমানে সবে নতশির,
.                   অধম বাঙ্গালি মোরা সবাই ||


নাহি ইতিবৃত্ত নাহিক গৌরব,
নাহি আশা কিছু নাহিক বৈভব,
বাঙ্গালির নামে করে ছিছি রব,
.                  কোমল স্বভাব, কোমল দেহ |
কোমল করেতে ধর কমলিনী,
কোমল শয্যাতে, কোমল শিঞ্জিনী,
কোমল শরীর, কোমল যামিনী,
.                  কোমল পিরীত, কোমল স্নেহ ||


শিখিয়াছি শুধু উচ্চ চীত্কার !
“ভিক্ষা দাও !  ভিক্ষা দাও !  ভিক্ষা দাও !”  সার    
দেহি দেহি দেহ বল বার বার
.                  না পেলে গালি দাও মিছামিছি |
দানের অযোগ্য চাও তবু দান,
মানের অযোগ্য চাও তবু মান,
বাঁচিতে অযোগ্য রাখ তবু প্রাণ,
.                   ছিছি  ছিছি  ছিছি !
.                              ছি  ছি  ছি  ছি  ছি !


কার উপকার করেছ সংসারে ?
কোন্ ইতিহাসে তব নাম করে ?
কোন্ বৈজ্ঞানিক বাঙ্গালির ঘরে ?
.                 কোন্ রাজ্য তুমি করেছ জয় ?
কোন্ রাজ্য তুমি শাসিয়াছ ভাল ?
কোন্ মারাথনে ধরিয়াছ ঢাল ?
এই বঙ্গভূমি এ কাল সে কাল
.                 অরণ্য, অরণ্য অরণ্যময় ||


কে মিলাল আজি এ চাঁদের হাট ?
কে খুলিল আজ মনের কপাট ?
পড়াইব আজি এ দুঃখের পাঠ,
.                  শুন ছি ছি রব, বাঙ্গালির নামে,
য়ুরোপে মার্কিনে ছিছি  ছিছি বলে,
শুন ছিছি রব, হিমালয়তলে,
শুন ছিছি রব, সমুদ্রের জলে,
.                   স্বদেশে, বিদেশে, নগরে গ্রামে ||


কি কাজ বহিয়া এ ছার জীবনে,
কি কাজ রাখিয়া এ নাম ভুবনে,
কলঙ্ক থাকিতে কি ভয় মরণে ?
.                 চল সবে মরি পশিয়া জলে |
গলে গলে ধরি, চল সবে মরি,
সারি সারি সারি, চল সবে মরি,
শীতল সলিলে এ জ্বালা পাসরি,
.                    লুকাই এ নাম, সাগরতলে ||

.                     ****************                                   
.                                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
রাজার উপর রাজা
কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী” ২য় খন্ড, ১৯৫৫ থেকে নেওয়া |


গাছ পুঁতিলাম ফলের ফলের আশায়,
.                পেলাম কেবল কাঁটা |
সুখের আশায় বিবাহ করিলাম
.                পেলাম কেবল ঝাঁটা ||
বাসের জন্য ঘর করিলাম
.                ঘর গেল পুড়ে |
বুড়ো বয়সের জন্য পুঁজি করিলাম
.                সব গেল উড়ে ||
চাকুরির জন্য বিদ্যা করিলাম,
.                ঘটিল উমেদারি |
যশের জন্য কীর্ত্তি করিলাম,
.                ঘটিল টিটকারি ||
সুদের জন্য কর্জ্জ দিলাম,
.                আসল গেল মারা |
প্রীতির জন্য প্রাণ দিলাম,
.                শেষে কেঁদে সারা ||
ধানের জন্য মাঠ চষিলাম,
.                হলো খড় কুটো |
পারের জন্য নৌকা করিলাম,
.                নৌকা হলো ফুটো ||
লাভের জন্য ব্যবসা করিলাম,
.                সব লহনা বাকি |
সেটাম দিয়া আদালত করিলাম,
.                ডিক্রির বেলায় ফাঁকি ||
তবে আর কেন ভাই, বেড়াও ঘুরে,
.                বেড়ে ভবের হাট |
ঘূর্ণী জলে নৌকা যেমন, ঝড়ের কুটো
.                জ্বলন্ত আগুনের কাঠ ||
মুখে বল হরিনাম ভাই,
.                হৃদে ভাব হরি !
এ ব্যবসায় লোকসান নেই ভাই,
.                এসো লাভে ঘর ভরি ||
এ গুণেতে শত লাভ,
.                শত গুণে হাজার |
হাজারেতে লক্ষ লাভ,
.                ভারি ফলাও কারবার ||
ভাই বল হরি, হরি বোল,
.                ভাঙ্গ ভবের হাট !
রাজার উপর হওগে রাজা
.                লাট সাহেবের লাট ||

.                     ****************                                   
.                                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
দুর্গোত্সব
কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী” ২য় খন্ড, ১৯৫৫ থেকে নেওয়া |




বর্ষে বর্ষে এসো যাও এ বাঙ্গালা ধামে
কে তুমি ষোড়শী কন্যা, মৃগেন্দ্রবাহিনি ?
চিনিয়াছি তোরে দুর্গে,     তুমি নাকি ভব দুর্গে,
দুর্গতির একমাত্র সংহারকারিণী ||
মাটি দিয়ে গড়িয়াছি,      কত গেল খড় কাছি,
সৃজিবারে জগতের সৃজনকারিণী |
গড়ে পিটে হলো খাড়া,   বাজা ভাই ঢোল কাড়া,
কুমারের হাতে গড়া ঐ দীনতারিণী |
বাজা --- ঠমকি ঠমকি ঠিকি, খিনিকি
ঝিনিকি ঠিনি ||




কি সাজ সেজেছ মাতা রাঙ্গতার সাজে !
এ দেশে যে রাঙ্গই সাজ কে তোরে শিখালে ?
সন্তানে রাঙ্গতা দিলে         আপনি তাই পরিলে,
কেন মা রাঙ্গের সাজে এ বঙ্গ ভুলালে ?
ভারত রতন খনি,                রতন কাঞ্চন মণি,
সে কালে এদেশে মাতা, কত না ছড়ালে ?
বীরভোগ্যা বসুন্ধরা,       আজি তুমি রাঙ্গতা পরা,
ছিঁড়া ধুতি রিপু করা, ছেলের কপালে ?
তবে--- বাজা ঢোল কাঁশি মধুর
খেমটা তালে ||




কারে মা এনেছ সঙ্গে, অনন্তরঙ্গিণি !
কি শোভা হয়েছে আজি, দেখ রে সবার !
আমি বেটা লক্ষ্মীছাড়া, আমার ঘরে লক্ষ্মী খাড়া,
ঘরে হতে খাই তাড়া, ঘরখরচ নাই ||
হয়েছিল হাতে খড়ি,         ছাপার কাগজ পড়ি,
সরস্বতী তাড়াতাড়ি, এলে বুঝি তাই ?
করো না মা বাড়াবাড়ি, তোমায় আমায় ছাড়াছাড়ি,
চড়ে না ভাতের হাঁড়ি, বিদ্যায় কাজ নাই |
তাক্ তাক্ ধিনাক্ ধিনাক্ বাজনা
বাজা রে ভাই ||




দশ ভুজে দশায়ুধ কেন মাতা ধর ?
কেন মাতা চাপিয়াছ সিংহটার ঘাড়ে ?
ছুরি দেখে ভয় পাই,          ঢাল খাঁড়া কাজ নাই,
ও সব রাখুক গিয়ে রামদীন পাঁড়ে |
সিংহ চড়া ভাল নয়,           দাঁত দেখে পাই ভয়,
প্রাণ যেন খাবি খায়, পাছে লাফ ছাড়ে,
আছে ঘরে বাঁধা গাই,          চড়তে হয় চড় তাই,
তাও কিছু ভয় পাই পাছে সিঙ্গ নাড়ে |
সিংহপৃষ্ঠে মেয়ের পা !    দেখে কাঁপি
হাড়ে হাড়ে ||




তোমার বাপের কাঁধে ----নগেন্দ্রের ঘাড়ে
তুঙ্গ শৃঙ্গোপরে সিংহ ---দেখ গিরিবালে !
শিমলা পাহাড়ে ধ্বজা,           উড়ায় করিয়া মজা,
পিতৃ সহ বন্দী আছ, হর্য্যক্ষের জালে |
তুমি যারে কৃপা কর                সেই হয় ভাগ্যধর---
সিংহের চরণ দিয়ে কতই বাড়ালে !
জনমি ব্রাহ্মণ কুলে,                 শতদল পদ্ম তুলে
আমি পূজে পাদপদ্ম পড়িনু আড়ালে !
রুটি মাখন খাব মা গো ! আলোচাল ছাড়ালে ||




এই শুন পুনঃ বাজে মজাইয়া মন,
সিংহের গভীর কন্ঠ, ইংরেজ কামান !
দুড়ুম দুড়ুম দুম,             প্রভাতে ভাঙ্গায় ঘুম,
দুপুরে প্রদোষে ডাকে, শিহরয় প্রাণ !
ছেড়ে ফেলে ছেঁড়া ধুতি, জলে ফেলে খুঙ্গী পুঁথি,
সাহেব সাজিব আজ ব্রাহ্মণ সন্তান |
লুচি মন্ডার মুখে ছাই,    মেজে বস্যে মটন খাই,
দেখি মা পাই না পাই তোমার সন্ধান |
সোলা-টুপি মাথায় দিয়ে পাব জগতে সম্মান ||




এনেছ মা বিঘ্ন-হরে কিসের কারণে ?
বিঘ্নময় এ বাঙ্গালা, তা কি আছে মনে ?
এনেছ মা শক্তিধরে,          দেখি কত শক্তি ধরে ?
মেরেছ মা বারে বারে দুষ্টাসুরগণে,
মেরেছ তারকাসুর,               আজি বঙ্গ ক্ষুধাতুর,
অসুরে করিয়া ফের,       মায়ে পোয়ে মার্ লে ঢের,
মার দেখি এ অসুরে, ধরি ও চরণে ||
তখন --- “কত নাচ গো রণে !” বাজাব
প্রফুল্ল মনে ||




তোমার মহিমা মাতা বুঝিতে নারিনু,
কিসের লাগিয়া আন কাল বিষধরে ?
ঘরে পরে বিষধর,          বিষে বঙ্গ জ্বর জ্বর,
আবার এ অজগর দেখাও কিঙ্করে ?
হই মা পরের দাস,       বাঁধি আঁটি কেটে ঘাস,
নাহিক ছাড়ি নিশ্বাস কালসাপ ডরে |
নিতি নিতি অপমান,        বিষে জ্বর জ্বর প্রাণ,
কত বিষ কন্ঠ মাঝে, নীলকন্ঠ ধরে ;
বিষের জ্বালায় সদা প্রাণ ছটফট করে !




দুর্গা দুর্গা বল ভাই দুর্গাপূজা এলো,
পুঁতিয়া কলার তেড় সাজাও তোরণ |
বেছে বেছে তোল ফুল,        সাজাব ও পদমূল,
এবার হৃদয় খুলে পূজিব চরণ ||
বাজা ভাই ঢাক ঢোল,      কাড়া নাগড়া গন্ডগোল,
দেব ভাই পাঁটার ঝোল, সোনার বরণ ||
ন্যায়রত্ন এসো সাজি,            প্রতিপদ হল আজি,
জাগাও দেখি চন্ডীরে বসায়ে বোধন ?


১০

যা দেবী সর্ব্বভূতেষু – ছায়া রূপ ধরে !
কি পুঁথি পড়িলে বিপ্র ! কাঁদিল হৃদয় !
সর্ব্বভূতে সেই ছায়া !            হইল পবিত্র কায়া,
ঘুচিবে সংসারে মায়া, যদি তাই হয় ||
আবার কি শুনি কথা !       শক্তি নাকি যথা তথা ?
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু, শক্তিরূপে রয় ?
বাঙ্গালি ভূতের দেহ--       শক্তি ত না দেখে কেহ ;
ছিলে যদি শক্তিরূপে, কেন হলে লয় ?
আদ্যাশক্তি শক্তি দেহ ! জয় মা চন্ডির জয় !


১১

পরিল এ বঙ্গবাসী, নূতন বসন,
জীবন্ত কুসুমসজ্জা, যেন বা ধরায় |
কেহ বা আপনি পরে,        কেহ বা পরায় পরে,
যে যাহারে ভালবাসে, সে তারে সাজায় |
বাজারেতে হুড়াহুড়ি,       আপিসেতে তাড়াতাড়ি,
লুচি মন্ডা ছড়াছড়ি ভাত কেবা খায় ?
সুখের বড় বাড়াবাড়ি    টাকার বেলা ভাঁড়াভাঁড়ি,
এই দশা ত সকল বাড়ী, দোষিব বা কায় ?
বর্ষে বর্ষে ভুগি মা গো, বড়ই টাকার দায় !


১২

হাহাকার বঙ্গদেশে, টাকার জ্বালায় |
তুমি এলে শুভঙ্করি !  বাড়ে আরো দায় |
কেন এসো কেন কেন যাও,       কেন চাল কলা খাও,
তোমার প্রসাদে যদি টাকা না কুলায় |
তুমি ধর্ম্ম তুমি অর্থ,                  তার বুঝি এই অর্থ,
মা তুমি টাকারূপিণী ধরম টীকায় |
টাকা কাম, টাকা মোক্ষ,            রক্ষ মাতঃ রক্ষ রক্ষ,
টাকা দাও লক্ষ লক্ষ, নৈলে প্রাণ যায় |
টাকা ভক্তি, টাকা মতি,            টাকা মুক্তি, টাকা গতি,
না জানি ভকতিস্তুতি, নমামি টাকায় ?
হা টাকা যো টাকা দেবি,            মরি যেন টাকা সেবি,
অন্তিম কালে পাই মা যেন রূপার চাকায় ?


১৩

তুমিই বিষ্ণুর হস্তে সুদর্শন চক্র,
হে টাকে ! ইহ জগতে তুমি সুদর্শন |
শুন প্রভু রূপচাঁদ,              তুমি ভানু তুমি চাঁদ,
ঘরে এসো সোনার চাঁদ, দাও দরশন ||
আ মরি কি শোভা,     ছেলে বুড়ার মনোলোভা,
হৃদে ধর বিবির মুন্ড, লতায় বেষ্টন |
তব ঝন্ ঝন্ নাদে,           হারিয়া বেহালা কাঁদে,
তম্বুরা মৃদঙ্গ বীণা কি ছার বাদন !
পশিয়া মরম-মাঝে,             নারীকন্ঠ মৃদু বাজে,
তাও ছার তুমি যদি কর ঝন্ ঝন !
টাকা টাকা টাকা টাকা !
বাক্ সতে এসো রে ধন |


১৪

তোর লাগি সর্ব্বত্যাগী, ওরে টাকা ধন !
জনমি বাঙ্গালী-কুলে,   ভুলিনু ও রূপে !
তেয়াগিনু পিতা মাতা,          শত্রু যে ভগিনী ভ্রাতা,
দেখি মারি জ্ঞাতি গোষ্ঠী, তোরে প্রাণ সপে |
বুঝিয়া টাকার মর্ম্ম,          ত্যজেছি যে ধর্ম্ম কর্ম্ম,
করেছি নরকে ঠাঁই, ঘোর কৃমিরূপে ||
দুর্গে দুর্গে ডাকি আজ,        এ লোভে পড়ুক বাজ,
অসুরনাশিনি চন্ডি আয় চন্ডিরূপে !
এ অসুর নাশ মাত !
শুম্ভে নাশিলে যেরূপে !


১৫

এসো এসো মাতা জগন্মাতা, জগদ্ধাত্রী উমে
হিসাব নিকাশ আমি, করি তব সঙ্গে |
আজি পূর্ণ বার মাস,           পূর্ণ হলো কোন আশ ?
আবার পূজিব তোমা, কিসের প্রসঙ্গে ?
সেই ত কঠিন মাটি,             দিবা রাত্রি দুখে হাঁটি,
সেই রৌদ্র সেই বৃষ্টি, পীড়িতেছে অঙ্গে |
কি জন্য গেল বা বর্ষ ?        বাড়িয়াছে কোন হর্ষ ?
মিছামিছি আয়ুঃক্ষয়, কালের ভ্রূভঙ্গে |
বর্ষ কেন গণি তবে,               কেন তুমি এস ভবে,
পিঞ্জর যন্ত্রণা সবে বনের বিহঙ্গে ?
ভাঙ্গ মা দেহ-পিঞ্জর ! উড়িব মনের রঙ্গে |


১৬

ওই শুন বাজিতেছে গুম্ গাম্ গুম্
ঢাক ঢোল কাড়া কাঁশি নৌবত নাগরা |
প্রভাত সপ্তমী নিশি,             নেয়েছে শঙ্করী পিসী,
রাঁধিবে ভোগের রান্না, হাঁড়ি মাল্ শা ভরা |
কাঁদি কাঁদি কেটে কলা,        ভিজায়েছি ডাল ছোলা,
মোচা কুমড়া আলু বেগুন,
আছে কাঁড়ি করা ||
আর মা চাও বা কি ?            মট্ কিভরা আছে ঘি,
মিহিদানা সীতাভোগ, লুচি মনোহরা !
আজ এ পাহাড়ে মেয়ের,
ভাল করে পেট ভরা |


১৭

আর কি খাইবে মাতা ? ছাগলের মুন্ড ?
রুধিরে প্রবৃত্তি কেন হে শান্তিরূপিণি !
তুমি গো মা জগন্মাতা,      তুমি খাবে কার মাথা ?
তুমি দেহ তুমি আত্মা, সংসারব্যপিনি !
তুমি কার কে তোমার,     তোর কেন মায়াসংহার ?
ছাগলে এ তৃপ্তি কেন, সর্ব্বসংহারিণি ?
করি তোমায় কৃতাঞ্জলি,          তুমি যদি চাও বলি,
বলি দিব সুখ দুঃখ চিত্তবৃত্তি জিনি ;
ছ্যাডাং ড্যাড্যাং ড্যাং ড্যাং !
নাচো গো রণরঙ্গিণি !


১৮

ছয় রিপু বলি দিব, শক্তির চরণে
ঐশিকী মানসী শক্তি !    তীব্র জ্যোতির্ম্ময়ি !
বলি ত দিয়াছি সুখ,            এখন বলি দিব দুখ,
শক্তিতে ইন্দ্রিয় জিনি হইব বিজয়ী |
এ শক্তি দিতে কি পার ?      ঠুসে তবে পাঁঠা মার,
প্রণামামি মহামায়ে তুমি ব্রহ্মময়ী |
নৈলে তুমি মাটির ঢিপি,         দশমীতে গলা টিপি,
তোমারে ভাসিয়ে গাঁজা টিপি, সিদ্ধিরস্তু কই |
ঐটুকু মা ভাল দেখি, পূজি তোমার মৃন্ময়ী !


১৯

মন-বোতলে ভক্তি-ধেনো রাখিয়াছি তারা,
এঁটেছি সন্দেহ-ছিপি বিদ্যার গালাতে |
শিখিয়াছি লেখা পড়া,       দেবতার মেজাজ কড়া,
হইয়াছি আধ পোড়া, সংসারজ্বালাতে |
সাহেবের হুকুম চড়া,               গৃহিণীর নথনাড়া,
ঋণ কর্ লে দেশ ছাড়া, পারি না পালাতে |
তাতে আবার তুমি এলে,   টাকার হিসাব না করিলে
এতে কি মা ভক্তি মেলে সংসার লীলাতে ?
বোতলে এঁটেছি ছিপি !
পার কি তুমি খোলাতে ?


২০

কাজ নাই সে কথায় ; পূজা কর সবে |
দেশের উত্সব এ যে ঠেলিতে কে পারে ?
কর সবে গন্ডগোল,            দাও গোলে হরি বোল,
সাপুটি পাঁঠার ঝোল ফিরি দ্বারে দ্বারে---
যাত্রায় লেগেছে ধুম,           ছেলে বুড়ার নাহি ঘুম,
দেখ না জ্বলিছে আলো বঙ্গের সংসারে |
দেখ না বাজনা বাজে,            দেখ না রমণী সাজে,
কুসুমিত তরু যেন কাতারে কাতারে !
তবু ত এনেছ সুখ মাতা বঙ্গ-কারাগারে |


২১

বর্ষে বর্ষে এসো মা গো, খাও লুচি পাঁটা,
ছোলা কলা কচু ঘেচু যা যোটে কপালে,
যে হলো দেশের দশা,         নাই বড় সে ভরসা,
আস্ বে যাবে খাবে নেবে, সম্বত্সর কালে |
তুমি খাও কলা মূলো,        তোমার সন্তানগুলো,
মারিতেছে  ব্রান্ডি  পানি, মুর্গী  পালে পালে |
দীন কবি আমি মাতা,        পাতিয়া আঙ্গট পাতা,
তোমার প্রসাদ খাই, ঘৃত আলোচালে ||
প্রসীদ প্রসীদ দুর্গে, প্রসীদ নগেন্দ্রবালে !

.                     ********************************                       
.                                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
আদর
কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
১৮৭৮ সালে প্রকাশিত “কবিতাপুস্তক” গ্রন্থ থেকে। কবিতাটি সর্বপ্রথম “বঙ্গদর্শন” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।



মরুভূমি মাঝে যেন, একই কুসুম,
পূর্ণিত সুবাসে।
বরষার রাত্রে যেন একই নক্ষত্র,
আঁধার আকাশে॥
নিদাঘ সন্তাপে যেন একই সরসী,
বিশাল প্রান্তরে।
রতন শোভিত যেন একই তরণী,
অনন্ত সাগরে।
তেমনি আমার তুমি, প্রিয়ে, সংসার ভিতরে॥


চিরনিদ্রা যেন, একই রতন,
অমূল্য, অতুল।
চিরবিরহীর যেন, দিনেক মিলন,
বিধি অনুকূল॥
চির বিদেশীর যেন, একই বান্ধব,
স্বদেশ হইতে।
চিরবিধবার যেন, একই স্বপন,
পতির পিরিতে।
তেমনি আমার তুমি প্রাণাধিকে, এ মহীতে॥


সুশীতল ছায়া তুমি, নিদাঘ সন্তাপে,
রম্য বৃক্ষতলে।
শীতের আগুন তুমি, তুমি মোর ছত্র,
বরষার জলে॥
বসন্তের ফুল তুমি, তিরপিত আঁখি,
রূপের প্রকাশে।
শরতের চাঁদ তুমি, চাঁদবনি লো,
আমার আকাশে।
কৌমুদী মধুর হাসি, দুখের তিমির নাশে॥


অঙ্গের চন্দন তুমি, পাখার ব্যঞ্জন,
কুসুমের বাস।
নয়নের তারা তুমি, শ্বণেতে শ্রুতি,
দেহের নিশ্বাস॥
মনের আনন্দ তুমি, নিদ্রার স্বপন,
জাগ্রতে বাসনা।
সংসারে সহায় তুমি, সংসার বন্ধন,
বিপদে সান্ত্বনা।
তোমারি লাগিয়ে সই, ঘোর সংসার যাতনা॥

.                                      ****************                                   
.                                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
জলে ফুল
কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
১৮৭৮ সালে প্রকাশিত “কবিতাপুস্তক” গ্রন্থ থেকে নেওয়া। কবিতাটি সর্বপ্রথম “ভ্রমর” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।



কে ভাসাল জলে তোরে কাননসুন্দরী!
বসিয়া পল্লবাসনে,                        ফুটেছিলে কোন বনে,
নাচিতে পবন সনে, কোন বৃক্ষোপরি ?
কে ছিঁড়িল শাখা হতে শাখার মুঞ্জরী ?


কে আনিল তোরে ফুল, তরঙ্গিণী-তীরে ?
কাহার কুলেক বালা,                        আনিয়া ফুলের ডালা,
ফুলের আঙ্গুলে তুলে ফুল দিল নীরে ?
ফুল হতে ফুল খসি, জলে ভাসে ধীরে!


ভাসিছ সলিলে যেন, আকাশেতে তারা।
কিম্বা কাদম্বিনী গায়,                        যেন বিহঙ্গিনী প্রায়,
কিম্বা যেন মাঠে ভ্রমে, নারী পথহারা ;
কোথায় চলেছ, ধরি, তরঙ্গিণীধারা ?


একাকিনী ভাসি যাও, কোথায় অবলে!
তরঙ্গের রাশি রাশি,                        হাসিয়া বিকট হাসি,
তাড়াতাড়ি করি তোরে খেলে কুতূহলে ?
কে ভাসাল তোরে ফুল কাল নদীজলে!


কে ভাসাল তোরে ফুল, কে ভাসাল মোরে!
কাল স্রোতে তোর(ই) মত,        ভাসি আমি অবিরত,
কে ফেলেছে মোরে এই তরঙ্গের ঘোরে ?
ফেলিছে তুলিছে কভু, আছাড়িছে জোরে!


শাখার মুঞ্জরী আমি, তোরই মত ফুল।
বোঁটা ছিঁড়ে শাখা ছেড়ে,         ঘুরি আমি স্রোতে পড়ে,
আশার আবর্ত্ত বেড়ে, নাহি পাই কূল।
তোরই মত আমি ফুল, তরঙ্গে আকুল!


তুই যাবি ভেসে ফুল, আমি যাব ভেসে।
কেহ না ধরিবে তোরে,                কেহ না ধরিবে মোরে,
অনন্ত সাগরে তুই, মিশাইবি শেষে।
চল যাই দুই জনে অনন্ত উদ্দেশে।

.                                      ****************                                   
.                                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর