কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা |
আকবর শাহের খোষ রোজ কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী” ২য় খন্ড, ১৯৫৫ থেকে নেওয়া | রাজপুরী মাঝে কি সুন্দর আজি | বসেছে বাজার, রসের ঠাট, রমণীতে বেচে রমণীতে কিনে লেগেছে রমণীরূপের হাট || বিশালা সে পুরী নবমীর চাঁদ লাখে লাখে দীপ উজলি জ্বলে | দোকানে দোকানে কুলবালাগণে খরিদদার ডাকে, হাসিয়া ছলে || ফুলের তোরণ, ফুল আবরণ ফুলের স্তম্ভেতে ফুলের মালা | ফুলের দোকান ফুলের নিশান, ফুলের বিছানা ফুলের ডালা || লহরে লহরে ছুটিছে গোলাব, উঠিছে ফুয়ারা জ্বলিছে জল | তাধিনি তাধিনি নাচিতেছে নটী, গায়িছে মধুর গায়িকা দল || রাজপুরী মাঝে লেগেছে বাজার, বড় গুলজার সরস ঠাট | রমণীতে বেচে রমণীতে কিনে লেগেছে রমণীরূপের হাট || কত বা সুন্দরী, রাজার দুলালী, ওমরাহজায়া, আমীরজাদী | নয়নেতে জ্বালা, অধরেতে হাসি, অঙ্গেতে ভূষণ মধুর-নাদী || হীরা মতি চুণি বসন ভূষণ কেহ বা বেচিছে কেনে বা কেউ | কেহ বেচে কথা নয়ন ঠারিয়ে কেহ কিনে হাসি রসের ঢেউ || কেহ বলে সখি এ রতন বেচি হেন মহাজন এখানে কই ? সুপুরুষ পেলে আপনা বেচিয়ে বিনামূল্যে কেনা হইয়া রই || কেহ বলে সখি পুরুষ দরিদ্র কি দিয়ে কিনিবে রমণীমণি | চারি কড়া দিয়ে পুরুষ কিনিয়ে গৃহেতে বাঁধয়ে রেখ লো ধনি || পিঞ্জরেতে পুরি, খেতে দিও ছোলা, সোহাগ শিকলি বাঁধিও পায় | অবোধ বিহঙ্গ পড়িবে আটক তালি দিয়ে ধনি, নাচায়ো তায় || ২ এক চন্দ্রাননী, মরাল-গামিনী, সে রসের হাটে ভ্রমিছে একা | কিছু নাহি বেচে কিছু নাহি কিনে, কাহার(ও) সহিত না করে দেখা || প্রভাত-নক্ষত্র জিনিয়া রূপসী, দিশাহারা যেন বাজারে ফিরে | কান্ডারী বিহনে তরণী যেন বা ভাসিয়া বেড়ায় সাগরনীরে || রাজার দুলালী রাজপুতবালা চিতোরসম্ভবা কমলকলি | পতির আদেশে আসিয়াছে হেথা সুখের বাজার দেখিবে বলি || দেখে শুনে বামা সুখী না হইল---- বলে ছি ছি এ কি লেগেছে ঠাট | কুলনারীগণে, বিকাইছে লাজ বসিয়াছে ফেঁদে রসের হাট! ফিরে যাই ঘরে কি করিব একা এ রঙ্গসাগরে সাঁতার দিয়ে ? এত বলি সতী ধীরি ধীরি ধীরি নির্গমের দ্বারে গেল চলিয়ে || নির্গমের পথ অতি সে কুটিল, পেঁচে পেঁচে ফিরে, না পায় দিশে | হায় কি করিনু বলিয়ে কাঁদিল, এখন বাহির হইব কিসে ? না জানি বাদশা কি কল করিল ধরিতে পিঞ্জরে, কুলের নারী | না পায় ফিরিতে নারে বাহিরিতে নয়নকমলে বহিল বারি || ৩ সহসা দেখিল সমুখে সুন্দরী বিশাল উরস পুরুষ বীর | রতনের মালা দুলিতেছে গলে মাথায় রতন জ্বলিছে স্থির || যোড় করি কর, তারে বিনোদিনী বলে মহাশয় কর গো ত্রাণ || না পাই যে পথ পড়েছি বিপদে দেখাইয়ে পথ, রাখ হে প্রাণ || বলে সে পুরুষ অমিয় বচনে আহা মরি, হেন না দেখি রূপ | এসো এসো ধনি আমার সঙ্গেতে আমি আকবর---- ভারত-ভূপ || সহস্র রমণী রাজার দুলালী মম আজ্ঞাকারী, চরণ সেবে | তোমা সমা রূপে নহে কোন জন, তব আজ্ঞাকারী আমি হে এবে || চল চল ধনি আমার মন্দিরে আজি খোষ রোজ সুখের দিন | এ ভারত ভূমে কি আছে কামনা বলিও আমারে, শোধিব ঋণ || এত বলি তবে রাজরাজপতি বলে মোহিনীরে ধরিল করে | যূথপতি বল সে ভুজবিটপে টুটিল কঙ্কণ তাহার ভরে || শূকাল বামার বদন-নলিনী ডাকি ত্রাহি ত্রাহি ত্রাহি মে দুর্গে | ত্রাহি ত্রাহি ত্রাহি বাঁচাও জননি ! ত্রাহি ত্রাহি ত্রাহি ত্রাহি মে দুর্গে || ডাকে কালি কালি ভৈরবী করালি কৌষিকি কপালি কর মা ত্রাণ | অর্পণে অন্বিকে চামুন্ডে চন্ডিকে বিপদে বালিকে হারায় প্রাণ || মানুষের সাধ্য নহে গো জননি এ ঘোর বিপদে রক্ষিতে লাজ | সমর-রঙ্গিণি অসুর-ঘাতিনি এ অসুরে নাশি, বাঁচাও আজ || ৪ বহুল পুণ্যেতে অনন্ত শূন্যেতে দেখিল রমণী, জ্বলিছে আলো | হাসিছে রূপসী নবীনা ষোড়শী মৃগেন্দ্র বাহনে, মূরতি কালো || নরমুন্ডমালা দুলিছে উরসে বিজলি ঝলসে লোচন তিনে | দেখা দিয়া মাতা দিতেছে অভয় দেবতা সহায় সহায়হীনে || আকাশের পটে নগেন্দ্র-নন্দিনী দেখিয়া যুবতী প্রফুল্ল মুখ | হৃদি সরোবর পুলকে উছলে সাহসে ভরিল, নারীর বুক || তুলিয়া মস্তক গ্রীবা হেলাইল দাঁড়াইল ধনী ভীষণ রাগে | নয়নে অনল অধরেতে ঘৃণা বলিতে লাগিল নৃপের আগে || ছিছি ছিছি ছিছি তুমি হে সম্রাট্, এই কি তোমার রাজধরম | কুলবধূ ছলে গৃহেতে আনিয়া বলে ধর তারে নাহি শরম || বহু রাজ্য তুমি বলেতে লুটিলে, বহু বীর নাশি বলাও বীর | বীরপণা আজি দেখাতে এসেছ রমণীর চক্ষে বহায়ে নীর ? পরবাহুবলে পররাজ্য হর, পরনারী হর করিয়ে চুরি | আজি নারী হাতে হারাবে জীবন ঘুচাইব যশ মারিয়ে ছুরি || জয়মল্ল বীরে ছলেতে বধিলে ছলেতে লুটিয়ে চারু চিতোর | নারীপদাঘাতে আজি ঘুচাইব তব বীরপণা, ধরম চোর | এত বলি বামা হাত ছাড়াইল বলিতে ধরিল রাজার অসি | কাড়িয়া লইয়া, অসি ঘুরাইয়া, মারিতে তুলিল, নবরূপসী || ধন্য ধন্য বলি রাজা বাখানিল এমন কখন দেখিনে নারী | মানিতেছি ঘাট ধন্য সতী তুমি রাখ তরবারি ; মানিনু হারি || ৫ হাসিয়া রূপসী নামাইল অসি, বলে মহারাজ, এ বড় রস | রমণীর রণে হারি মান তুমি পৃথিবীপতির বাড়িল যশ || দুলায়ে কুন্ডল, অধরে অঞ্চল, হাসে খল খল, ঈষৎ হেলে | বলে মহাবীর, এই বলে তুমি রমণীরে বল করিতে এলে ? পৃথিবীতে যারে, তুমি দাও প্রাণ, সেই প্রাণে বাঁচে, বল হে সবে | আজি পৃথ্বীনাথ আমার চরণে প্রাণ ভিক্ষা লও বাঁচিবে তবে || যোড়ো হাত দুটো, দাঁতে কর কুটো করহ শপফ ভারতপ্রভু | শপথ করহ হিন্দুললনার হেন অপমান না হবে কভু || তুমি না করিবে, রাজ্যেতে না দিবে হইতে কখন এ হেন দোষ | হিন্দুললনারে যে দিবে লাঞ্ছনা তাহার উপরে করিবে রোষ || শপথ করিল, পরশিয়ে অসি, নারী আজ্ঞামত ভারতপ্রভু | আমার রাজ্যেতে হিন্দুললনার হেন অপমান না হবে কভু || বলে শুন ধনি হইয়াছি প্রীত দেখিয়া তোমার সাহস বল | যাহা ইচ্ছা তব মাগি লও সতি, পূরাব বাসনা, ছাড়িয়া ছল || এই তরবারি দিনু হে তোমারে হীরক-খচিত ইহার কোষ | বীরবালা তুমি তোমার সে যোগ্য না রাখিও মনে আমার দোষ || আজি হতে তোমা ভগিনী বলিনু, ভাই তব আমি ভাবিও মনে | যা থাকে বাসনা মাগি লও বর যা চাহিবে তাই দিব এখনে || তুষ্ট হয়ে সতী বলে ভাই তুমি সম্প্রীত হইনু তোমার ভাষে | ভিক্ষা যদি দিবা দেখাইয়া দাও নির্গমের পথ যাইব বাসে || দেখাইল পথ, আপনি রাজন্ বাহিরিল সতী, সে পুরী হতে | সবে বল জয়, হিন্দুকন্যা জয়, হিন্দুমতি থাক্ ধর্ম্মের পথে || ৬ রাজপুরী মাঝে, কি সুন্দর আজি বসেছে বাজার রসের ঠাট | রমণীতে কেনে রমণীতে বেচে লেগেছে রমণীরূপের হাট || ফুলের তোরণ ফুল আবরণ ফুলের স্তম্ভেতে ফুলের মালা | ফুলের দোকান ফুলের নিশান ফুলের বিছানা ফুলের ডালা || নবমীর চাঁদ বরষে চন্দ্রিকা লাখে লাখে দীপ উজলি জ্বলে | দোকানে দোকানে কুলবালাগণে ঝলসে কটাক্ষ হাসিয়া ছলে || এ হতে সুন্দর, রমণী-ধরম আর্য্যনারীধর্ম্ম, সতীত্ব ব্রত | জয় আর্য্য নামে, আজ ( ও ) আর্য্যধামে আর্য্যধর্ম্ম রাখে রমণী যত || জয় আর্য্যকন্যা এ ভুবন ধন্যা, ভারতের আলো, ঘোর আঁধারে | হায় কি কারণে, আর্য্যপুত্রগণে আর্য্যের ধরম রাখিতে নারে || . **************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |