কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
কামিনীর প্রতি উক্তি
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
এই কবিতাটি বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম প্রকাশিত রচনা, ১৮ই মার্চ ১৮৫৩ তারিখের "সংবাদ প্রভাকর" পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

 
( রূপক )
তোমাতে লো ষড় ঋতু

পয়ার

অপরূপূ দেখ একি, শরীরে তোমার |
একঠাঁই ষড় ঋতু, করিছে বিহার ||
নিদাঘ, বরষা, আর, শরদ হেমন্ত |
নিরখি শিশির আর দুরন্ত বসন্ত ||
এ সবার সেনা আদি, তোমাতে বিহরে |
গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরদাদি, কহি পরে পরে ||


গ্রীষ্ম
তখন সিন্দুর বিন্দু, অতি খরতর |
ক্রোধভরে করে কর, বসি মুখোপর ||
সে রবি রক্তিম রাগে, শুন হেতু তার |
নিরখিল নিজ প্রিয়া, চরণে তোমার ||
প্রফুল্লিতা কমলিনী, প্রেমভরে বসি |
নখরের ছলে কোলে, উপপতি শশী ||
নলিনী শশাঙ্ক সহ, করিতেছে বাস |
প্রভাকর করে তাই, প্রকোপ প্রকাশ ||
অতি ক্রোধযুক্ত রবি, হোয়েছে এবার |
তাই লো আরক্ত ছবি, দেখিতেছি তার ||
ঠেকে শিখে দিবাকর, রমণীর রীতি |
সামলিতে অন্য নারী, ধাইল ঝাটতি ||
তোমার পঙ্কজ মুখ, প্রাণের রমণী |
আগুলিতে আগে ভাগে, আইল অমনি ||
বদন সরোজ কোলে, সিন্দুর তপন |
বিশেষ কারণ তার, বুঝেছি এখন ||
পতিরে পাইয়া কোলে, সুখে আনন্দিত |
তোমার বদন পদ্ম, হোলো বিকসিত ||
প্রবল প্রভাবে ঘন, বহে সমীরণ |
তোমা হেরে দীর্ঘশ্বাস, ছাড়িছে পবন ||
যে অনল নিদাঘেতে, দহে ত্রিভুবনে |
সে অনল আছে ওই, তোমার নয়নে ||
গ্রীষ্ম ভয়ে হরি সহ, বাস করে করী |
তাহাও তোমাতে সখি, দরশন করি ||
করিয়াছে স্থিতি তব, কটিতে কেশরী |
আছে কুম্ভ জাগাইয়া, কক্ষোপরি করী ||
গ্রীষ্মে তরু সুশোভিত, ফলে অহরহ |
তুমি তরু শোভিতেছ দুই ফল সহ ||
এ সবেতে পরাভব, নিদাঘ পলায় |
আইল স্বদল সহ, বরষা তথায় ||


বর্ষা
নিরন্তর, নীরধর, নিরখি চাঁচরে |
হাসি ছলে সৌদামিনী, নাচিছে অধরে ||
হানিছে তাহার সদা, অশনি আমার |
হৃদয় বিদরে তায়, জর জর কায় ||
যে সময়ে ঘাম বারি, ও দেহে নিরখি |
বরষার বারিধারা, তারে বলি সখি ||
ঘোমটায় যবে ঢাকো, মুখ শশধরে |
বরষায় শশী ঢাকা, যেন জলধরে ||
ধরিতে আমার কর, মুদিয়াছ করে |
কমল মুদিত যেন বরষার ডরে ||
উপরে ধোরেছে কালো, তব পয়োধর |
গিরিশিরে শোভে যেন, নব পয়োধর ||
বিধুমুখি তাহে এই, বিনতি হে করি |
চাতক হইতে মোরে, দেহ প্রাণেশ্বরী ||
বরষার মনোহর, তরু শোভাকর |
দাড়িম্ব দেখি লো ধনি, তব পয়োধর ||
গিরি পরি নব লতা, শোভে এ সময় |
সে গিরি তোমার কুচ, হার লতা হয় ||
এ সবেতে, পরাভব, বরষা পলায় |
আইল স্বদল সহ, শরদ তথায় ||


শরদ
শরদের সুধাকরে, সুধা করে কত |
সে ভার নিরখি তব, মুখে অবিরত ||
কিন্তু যে কলঙ্ক কালি, থাকে শশধরে |
সে কলঙ্ক নাহি তব, মুখের ভিতরে ||
যদিও নাহিক মৃগ, আছে কিছু তার |
মৃগের নয়ন করে, বদনে বিহার ||
বসন বারিদ পুন, হইয়াছে দূর |
পুনরায় প্রকাশিত, তপন সিন্দূর ||
কর কমলিনী সদা, আছে বিকসিত |
কঙ্কণের নাদে অলি, গায় সুললিত ||
শরদে মরাল কুল, সুখে কেলি করে |
তোমাতে মরাল ভাব, গমনের তরে ||
চন্দ্রিকা হোয়েছে প্রিয়ে, অতি পরিষ্কার |
নিরখি তাহার আভা, বরণে তোমার ||
প্রফুল্লিতা কুমুদিনী, চন্দ্র মনোহরা |
হেরি তব নয়নেতে, বিষামৃত ভরা ||
যদি বল চন্দ্রকোলে, আছে কুমুদিনী |
দূর ঘুচে একত্রিত, অপূর্ব্ব কাহিনী ||
তার হেতু ইন্দীবর, তোমার নয়নে |
শরণ লোয়েছে গিয়ে, পতি নিকেতনে ||
এ সবেতে পরাভব, শরদ পলায় |
আইল স্বদল সহ, হেমন্ত তথায় ||


হেমন্ত
----        ----        ----    (অস্পষ্ট )
কখনো সদয় হও, কভু মান কর ||
নিদাঘ, শরদ, বর্ষা, এই ঋতু চয় |
বিশেষ বসন্ত কাল, হয় রসময় ||
এই হেতু ধনি এই, ষড় ঋতুগণ |
তোমারে সরস ভাব, করিছে বর্ণন ||
কিন্তু তাহে বর্ণিত, না হবে, তব মান |
সে মান বর্ণিতে আমি, হই ম্রিয়মাণ ||
এ কথা যদ্যপি তুমি, কহ সুলোচনা |
হেমন্ত, শিশির ছলে, মানের রচনা ||
ফলত ঘটিল তাই, আমার কপালে |
মান করি নিজ দেহে, হিম দেখাইলে ||
বিরস হোয়েছে তব, মুখ সুধাকর |
মুদিত হোয়েছে দেখি, আঁখি ইন্দীবর ||
এখন কমল কর, নহে বিকসিত |
সিন্দূর রবির ছবি, নহে প্রভান্বিত ||
নীহার নয়ন নীর, নিরবধি বহে |
যে জল শীতল অতি, সে আমারে দহে ||
শীতের স্বভাবে বারি, হোয়েছে শীতল |
কিন্তু তব অশ্রুরূপে, দহে মোরে জল ||
শীতের প্রতাপে বহ্নি, তাপহীন হয় |
মানে তাই জ্যোতিহীন, তব নেত্রদ্বয় ||
এ সবেতে পরাভব, হেমন্ত পলায় |
আইল স্বদল সহ, শিশির তথায় ||


শিশির
নয়নের দীপ্তি হর, ঘন ঘোরতর |
কুাআশায় ঢাকিয়াছে, রবি শশধর ||
ঘোমটা কুআশা ঘোর, করি দরশন |
মুখ শশী, ভালে রবি, করে আচ্ছাদন ||
থর থর কলেবর, শীতে যে প্রকার |
সে রূপ কাঁপিছে দেহ, পরশে তোমার ||
হইতেছে রোমাঞ্চিত, বিকল শরীর |
উহু উহু, ভীম-হিম, করিছে অস্থির ||
যেমন শিশিরে, কালো, স্নিগ্ধ হয় জল |
তেমনি তোমার অঙ্গ, কালো, সুশীতল ||
জল হোতে উঠে ধূম, অনল সমান |
তোমার নিশ্বাসে ধূম যদি কর মান ||
এ সবেতে পরাভব, শিশির পলায় |
আইল স্বদল সহ, বসন্ত তথায় ||


বসন্ত
সরস বসন্ত করে,  মুগ্ধ ত্রিভুবন |
তুমিও স্বরূপে মুগ্ধ, করিছ তেমন ||
সুচারু বিমল শশী, তোমার বদন |
ইন্দীবর,  নেত্রবর,  প্রফুল্ল এখন ||
কমলে কমল কত, কমল কাননে
হাতে পায় পদ্ম, পদ্ম, হৃদয় বদনে ||
প্রকটিত ফুলকুল, সৌরভ কি কব |
কিন্তু সে সৌরভ পাই, মুখপদ্মে তব ||
ভ্রমর ভ্রমণ করে, শুনি গুণ গুণ |
বুঝেছি নূপুর তব, করে রুণ রুণ ||
কিবা কুহু কুহু করে, কোকিল কলাপ |
বুঝেছি সে রব তব, মধুর আলাপ ||
তোমার সুগন্ধ যুক্ত, কমল বদন |
তাহা হোতে আসিতেছে, মৃদু শ্বাস ঘন ||
মুখের সৌরভ লোয়ে, আসিছে নিশ্বাস |
নাবুঝে কহিছে, লোক, দক্ষিণ বাতাস ||
বসন্ত বৃক্ষের ডালে, নবীন পল্লব |
তাহার প্রমাণ দেখি, অধরেতে তব ||
বসন্তে প্রকাশ পায়, স্মরধনু শর |
তা হেরি কটাক্ষে তব, ভ্রূযুগ উপর ||
কিন্তু প্রাণ তব স্থানে, নিজে নাই স্মর |
কেবল রোয়েছে তার, ধনু আর শর ||
বুঝেছি কারণ সখি, যাহে নাহি স্মর |
পলায়েছে মনসিজ, হেরে কুচ হর ||
শক্ত নহে শিব সহ, করিবারে রণ |
ধনুর্ব্বাণ ফেলে দিয়ে, পলালো মদন ||
দেখ দেখ বিধুমুখি, ঈশ্বর কৌশল
স্থাপিত কোরেছে ঋতু, তোমাতে সকল ||

.                                      ****************                                   
.                                                                                                           
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর