কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
মন এবং সুখ
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী”  ( ২য় খন্ড ) থেকে নেওয়া |




এই মধুমাসে,                 মধুর বাতাসে,
শোন লো মধুর বাঁশী |
এই মধু বনে,                       শ্রীমধুসূদনে
দেখ লো সকলে আসি ||
মধুর সে গায়              মধুর বাজায়,
মধুর মধুর ভাষে |
মধুর আদরে,               মধুর অধরে,
মধুর মধুর হাসে ||
মধুর শ্যামল,                  বদন কমল,
মধুর চাহনি তায় |
কনক নূপুর,                   মধুকর যেন,
মধুর বাজিছে পায় ||
মধুর ইঙ্গিতে,             আমার সঙ্গেতে,
কহিল মধুর বাণী |
সে অবধি চিতে,          মাধুরি হেরিতে,
ধৈরয নাহিক মানি ||
এ সুখ রঙ্গেতে          পর লো অঙ্গেতে
মধুর চিকণ বাস |
তুমি মধুফুল,                পর কানে দুল,
পুরাও মনের আশ ||
গাঁথি মধুমালা,              পর গোপবালা
হাস লো মধুর হাসি |
চল যথা বাজে,             যমুনার কূলে,
শ্যামের মোহন বাঁশী ||



চল যথা বাজে,               যমুনার কূলে
ধীরে ধীরে ধীরে বাঁশী ||
ধীরে ধীরে যথা,             উঠিছে চাঁদনি,
স্থল জল পরকাশি ||
 ধীরে ধীরে রাই,              চল ধীরে যাই,
ধীরে ধীরে ফেল পদ |
ধীরে ধীরে শুন,              নাদিছে যমুনা,
কল কল গদ গদ ||
ধীরে ধীরে জলে,            রাজহংস চলে,
ধীরে ধীরে ভাসে ফুল |
ধীরে ধীরে বায়ু,             বহিছে কাননে
দোলায়ে আমার দুল ||
ধীরে যাবি তথা,             ধীরে কবি কথা
রাখিবি দোহায় মান |
ধীরে ধীরে তার              বাঁশীটি কাড়িবি,
ধীরেতে পুরিবি তান ||
ধীরে শ্যাম নাম,               বাঁশীতে বলিবি,
শুনিব কেমন বাজে |
ধীরে ধীরে চূড়া               কাড়িয়ে পরিবি,
দেখিব কেমন সাজে ||
ধীরে বনমালা,               গলাতে দোলাবি,
দেখিব কেমন দোলে |
ধীরে ধীরে তার,               মন করি চুরি,
লইয়া আসিবি চলে ||



শুন মোর মন                        মধুরে মধুরে,
জীবন করহ সায় |
ধীরে ধীরে ধীরে,                  সরল সুপথে,
নিজ গতি রেখ তায় ||
এ সংসার ব্রজ,                কৃষ্ণ তাহে সুখ,
মন তুমি ব্রজনারী |
নিতি নিতি তার,                বংশীরব শুনি,
হতে চাও অভিসারী ||
যাও যাবে মন,                 কিন্তু দেখ যেন,
একাকী যেও না রঙ্গে |
মাধুর্য্য ধৈরয,                      সহচরী দুই,
রেখ আপনার সঙ্গে ||
ধীরে ধীরে ধীরে,               কাল নদীতীরে
ধরম কদম্ব তলে |
মধুর সুন্দর,                       সুখ নটবর,
ভজ মন কুতূহলে ||

.                                      ****************                                   
.                                                                                                           
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
সংযুক্তা
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী”  ( ২য় খন্ড ) থেকে নেওয়া |


১ স্বপ্ন

নিশীথে শুইয়া ,               রজত পালঙ্কে
পুষ্পগন্ধি শির,                রাখি রামা অঙ্কে,
দেখিয়া স্বপন,                   শিহরে সশঙ্কে
মহিষীর কোলে, শিহরে রায় |
চমকি সুন্দরী,                নৃপে জাগাইল
বলে প্রাণনাথ,                এ বা কি হইল,
লক্ষ যোধ রণে,                যে না চমকিল
মহিষীর কোলে সে ভয় পায় !


উঠিয়া নৃপতি                 কহে মৃদু বাণী
যে দেখিনু স্বপ্ন,                শিহরে পরাণি,
স্বর্গীয়া জননী                চৌহানের রাণী
বন্য হস্তী তাঁরে মারিতে ধায় |
ভয়ে ভীত প্রায়                রাজেন্দ্রঘরণী
আমার নিকটে                 আসিল অমনি
বলে পুত্র রাখ,                মরিল জননী
বন্যহস্তি-শূন্ডে প্রাণ বা যায় ||


ধরি ভীম গদা                মারি হস্তিতুন্ডে,
না মানিল গদা,                বাড়াইয়া শুন্ডে,
জননীকে ধরি,                উঠাইলে মুন্ডে ;
পড়িয়া ভূমেতে বধিল প্রাণ |
কুস্বপন আজি                দেখিলাম রাণি,
কি আছে বিপদ                কপালে না জানি
মত্ত হস্তী আসি                বধে রাজেন্দ্রাণী
আমি পুত্র নারি করিতে ত্রাণ ||


শুনিয়াছি নাকি                তুরষ্কের দল
আসিতেছে হেথা,         লঙ্ঘি হিমাচল
কি হবে রণে,                ভাবি অমঙ্গল,
বুঝি এ সামান্য স্বপন নয় |
জননীরূপেতে                 বুঝি বা স্বদেশ,
বুঝি বা তুরষ্ক                মত্ত হস্তী বেশ,
বার বার বুঝি                এইবার শেষ !
পৃথ্বীরাজ নাম বুঝি না রয় ||


শুনি পতিবাণী                যুড়ি দুই পাণি
জয় জয় জয়                 বলে রাজরাণী
জয় জয় জয় !                 পৃথ্বীরাজে জয়---
জয় জয় জয় ! বলিল বামা |
কার সাধ্য তোমা        করে পরাভব
ইন্দ্র চন্দ্র যম                বরুণ বাসব !
কোথাকার ছার                তুরষ্ক পহ্লব
জয় পৃথ্বীরাজ প্রথিতনামা ||


আসে আসুক না         পাঠান পামর,
আসে আসুক না         আরবি বানর,
আসে আসুক না        নর না অমর |
কার সাধ্য তব শকতি সয় ?
পৃথ্বীরাজ সেনা                 অনন্ত মন্ডল
পৃথ্বীরাজভুজে                অবিজিত বল
অক্ষয় ও শিরে                 কিরীট কুন্ডল
জয় জয় পৃথ্বীরাজের জয় ||


এত বলি বামা                 দিল করতালি
দিল করতালি                 গৌরবে উছলি,
ভূষণে শিঞ্জিনী,                নয়নে বিজলি
দেখিয়া হাসিল ভারতপতি |
সহসা কঙ্কণে                 লাগিল কঙ্কণ,
আঘাতে ভাঙ্গিয়া         খসিল ভূষণ,
নাচিয়া উঠিল                দক্ষিণ নয়ন,
কবি বলে তালি না দিও সতি ||


২ |  রণসজ্জা


রণসাজে সাজে                 চৌহানের বল,
অশ্ব গজ রথ                পদাতির দল,
পতাকার রবে,                পবন চঞ্চল,
বাজিল বাজনা ---ভীষণ নাদ |
ধূলিতে পূরিল                   গগনমন্ডল,
ধূলিতে পূরিল                যমুনার জল,
ধূলিতে পূরিল                 অলক কুন্তল,
যথা কুলনারী গণে প্রমাদ ||


দেশ দেশ হতে                      এলো রাজগণ
স্থানেশ্বর পদে                        বধিতে যবন
সঙ্গে চতুরঙ্গ                   সেনা অগণন—
হর হর বলে যতেক বীর |
মদবার হতে                       আইল সমর
আবু হতে                 এলো দুরন্ত প্রমর
আর্য্য বীরদল                ডাকে হর ! হর !
উছলে কাঁপিয়া কালিন্দী-নীর ||



গ্রীবা বাঁকাইয়া                     চলিল তুরঙ্গ
শুন্ড আছাড়িয়া                    চলিল মাতঙ্গ
ধনু আস্ফালিয়া---         শুনিতে আতঙ্গ---
দলে দলে দলে পদাতি চলে |
বসি বাতায়নে                 কনৌজনন্দিনী
দেখিলা অদূরে                চলিছে বাহিনী
ভারত ভরসা,                ধরম রক্ষিণী---
ভাসিলা সুন্দরী নয়নজলে ||


সহসা পশ্চাতে                 দেখিল স্বামীরে,
মুছিলা অঞ্চলে                    নয়নের নীরে,
যুড়ি দুই কর                বলে “হেন বীরে
রণসাজে আমি সাজাব আজ |”
পরাইল ধনী                কবচকুন্ডল
মুকুতার দাম                বক্ষে ঝলমল
ঝলসিল রত্ন                কিরীট মন্ডল
ধনু হস্তে হাসে রাজেন্দ্ররাজ ||


সাজাইয়া নাথে                যোড় করি পাণি
ভারতের রাণী                কহে মৃদু বাণী
সুখী প্রাণেশ্বর                 তোমার বাখানি
এ বাহিনীপতি চলিলা রণে |
লক্ষ যোধ প্রভু                 তব আজ্ঞাকারী,
এ রণসাগরে                তুমি হে কান্ডারী
মথিবে সে সিন্ধু                 নিয়ত প্রহারি
সেনার তরঙ্গ তরঙ্গসনে ||


আমি অভাগিনী                জনমি কামিনী
অবরোধে আজি        রহিনু বন্দিনী
না হতে পেলাম                তোমার সঙ্গিনী,
অর্দ্ধাঙ্গ হইয়া রহিনু পাছে |
যবে পশি তুমি                সমর-সাগরে
খেদাইবে দূরে                ঘোরির বানরে
না পাব দেখিতে                দেখিব ত পরে,
তব বীরপনা ! না রব কাছে ||


সাধ প্রাণনাথ                 সাধ নিজ কাজ
তুমি পৃথ্বীপতি                 মহা মহারাজ
হানি শত্রুশিরে                বাসবের বাজ
ভারতের বীর আইস ফিরে |
নহে যদি শম্ভু                 হয়েন নির্দ্দয়
যদি হয় রণে                পাঠানের জয়
না আসিও ফিরে,--         দেহ যেন বয়
রণক্ষেত্রে ভাসি শত্রুরুধিরে ||


কত সুখ প্রভু,                ভুঞ্জিলে জীবনে !
কি সাধ বা বাকি        এ তিন ভুবনে ?
নয় গেল প্রাণ,                ধর্ম্মের কারণে?
চিরদিন রহে জীবন কার ?
যুগে যুগে নাথ                 ঘোষিবে সে যশ
গৌরবে পূরিত                 হবে দিক্ দশ
এ কান্ত শরীর                এ নব বয়স
স্বর্গ গিয়ে প্রভু পাবে আবার ||


করিলাম পণ                শুন হে রাজন
নাশিয়া ঘোরীরে,        জিনি এই রণ
নাহি যতক্ষণ                 কর আগমন,
না খাব কিছু, না করিব পান |
জয় জয় বীর                জয় পৃথ্বীরাজ,
লভ পূর্ণ জয়                 সমরেতে আজ
যুগে যুগে প্রভু                ঘোষিবে এ কাজ
হর হর শম্ভো কর কল্যাণ ||

১০
হর হর হর !                 বম্ বম্ কালী !
বম্ বম্ বলি                রাজার দুলালি,
করতালি দিল--                দিল করতালি
রাজরাজপতি ফুল্ল হৃদয় |
ডাকো বামা জয়           জয় পৃথ্বীরাজ
জয় জয় জয়                 জয় পৃথ্বীরাজ—
জয় জয় জয়                 জয় পৃথ্বীরাজ
কর, দুর্গে, পৃথ্বীরাজের জয় ||



১১
প্রসারিয়া রাজ                মহা ভূজদ্বয়ে,
কমনীয় বপু,                ধরিল হৃদয়ে,
পড়ে অশ্রুধারা                চারি গন্ড বয়ে,
চুম্বিল সুবাহু চন্দ্রবদনে |
স্মরি ইষ্টদেবে                বাহিরিল বীর,
মহাগজপৃষ্ঠে                 শোভিল বীর,
মহিষীর চক্ষে                বহে ঘন নীর !
কে জানে এতই জল নয়নে !

১২
লুটাইয়া পড়ি                ধরণীর তলে
তবু চন্দ্রাননী                জয় জয় বলে
জয় জয় বলে---         নয়নের জলে
জয় জয় কথা না পায় ঠাঁই ||
কবি বলে মাতা         মিছে গাও জয়
কাঁদ যতক্ষণ                 দেহ প্রাণ বয়,
ও কান্না রহিবে                এ ভারতময়
আজিও আমরা কাঁদি সবাই ||


৩|  চিতারোহণ


কত দিন রাত                পড়ে রহে রাণী
না খাইল অন্ন                না খাইল পানি
কি হইল রণে                কিছুই না জানি,
মুখে বলে পৃথ্বীরাজের জয় |
হেন কালে দূত                আসিল দিল্লীতে
রোদন উঠিল                 পল্লীতে পল্লীতে—
কেহ নারে কারে         ফুটিয়া বলিতে,
হায় হায় শব্দ ! ফাটে হৃদয় !



মহারবে যেন                সাগর উছলে
উঠিল রোদন                ভারতমন্ডলে
ভারতের রবি                গেল অস্তাচলে
প্রাণ তো গেলই, গেল যে মান |
আসিছে যবন                 সামাল সামাল !
আর যোদ্ধা নাই         কে ধরিবে ঢাল ?
পৃথ্বীরাজ বীরে                 হরিয়াছে কাল,
এ ঘোর বিপদে কে করে ত্রাণ ||


ভূমিশয্যা ত্যজি         উঠে চন্দ্রাননী,
সখীজনে ডাকি                বলিল তখনি,
সম্মুখ সমরে                 বীরশিরোমণি
গিয়াছে চলিয়া অনন্ত স্বর্গে |
আমিও যাইব                 সেই স্বর্গপুরে,
বৈকুন্ঠেতে গিয়া         পূজিব প্রভুরে,
পূরাও রে সাধ ;          দুঃখ যাক দূরে
সাজা মোর চিতা সজনীবর্গে ||


যে বীর পড়িল                 সম্মুখ সমরে
অনন্ত মহিমা                 তার চরাচরে
সে নহে বিজিত        ;         অপ্সরে কিন্নরে,
গায়িছে তার অনন্ত জয় |
বল সখি সবে                জয় জয় বল,
জয় জয় বলি                চড়ি গিয়া চল
জ্বলন্ত চিতার                প্রচন্ড অনল,
বল জয় পৃথ্বীরাজের জয় ||


চন্দনের কাষ্ঠ                এলো রাশি রাশি
কুসুমের হার                     যোগাইল দাসী
কতন ভূষণ                   কর পরে হাসি
বলে যাব আজি প্রভুর পাশে |
আয় আয় সখি,                  চড়ি চিতানলে
কি হবে রহিয়ে                ভারতমন্ডলে ?
আয় আয় সখি                   যাইব সকলে
যথা প্রভু মোর বৈকুন্ঠবাসে ||

আরোহিলা চিতা        কামিনীর দল
চন্দনের কাষ্ঠে                জ্বলিল অনল
সুগন্ধে পূরিল                গগনমন্ডল ---
মধুর মধুর সংযুক্তা হাসে |
বলে সবে বল                 পৃথ্বীরাজ জয়
জয় জয় জয়                পৃথ্বীরাজ জয়
করি জয়ধ্বনি                 সঙ্গে সখীচয়
চলি গেলা সতী বৈকুন্ঠবাসে ||


কবি বলে মাতা         কি কাজ করিলে
সন্তানে ফেলিয়া                নিজে পলাইলে,
এ চিতা অনল                কেন বা জ্বালিলে,
ভারতের চিতা, পাঠান ডরে |
সেই চিতানল,                 দেখিল সকলে
আর না নিবিল                 ভারতমন্ডলে
দহিল ভারত                 তেমনি অনলে
শতাব্দী শতাব্দী শতাব্দী পরে ||

.                                      ****************                                   
.                                                                                                           
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর