কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা |
মন এবং সুখ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী” ( ২য় খন্ড ) থেকে নেওয়া | ১ এই মধুমাসে, মধুর বাতাসে, শোন লো মধুর বাঁশী | এই মধু বনে, শ্রীমধুসূদনে দেখ লো সকলে আসি || মধুর সে গায় মধুর বাজায়, মধুর মধুর ভাষে | মধুর আদরে, মধুর অধরে, মধুর মধুর হাসে || মধুর শ্যামল, বদন কমল, মধুর চাহনি তায় | কনক নূপুর, মধুকর যেন, মধুর বাজিছে পায় || মধুর ইঙ্গিতে, আমার সঙ্গেতে, কহিল মধুর বাণী | সে অবধি চিতে, মাধুরি হেরিতে, ধৈরয নাহিক মানি || এ সুখ রঙ্গেতে পর লো অঙ্গেতে মধুর চিকণ বাস | তুমি মধুফুল, পর কানে দুল, পুরাও মনের আশ || গাঁথি মধুমালা, পর গোপবালা হাস লো মধুর হাসি | চল যথা বাজে, যমুনার কূলে, শ্যামের মোহন বাঁশী || ২ চল যথা বাজে, যমুনার কূলে ধীরে ধীরে ধীরে বাঁশী || ধীরে ধীরে যথা, উঠিছে চাঁদনি, স্থল জল পরকাশি || ধীরে ধীরে রাই, চল ধীরে যাই, ধীরে ধীরে ফেল পদ | ধীরে ধীরে শুন, নাদিছে যমুনা, কল কল গদ গদ || ধীরে ধীরে জলে, রাজহংস চলে, ধীরে ধীরে ভাসে ফুল | ধীরে ধীরে বায়ু, বহিছে কাননে দোলায়ে আমার দুল || ধীরে যাবি তথা, ধীরে কবি কথা রাখিবি দোহায় মান | ধীরে ধীরে তার বাঁশীটি কাড়িবি, ধীরেতে পুরিবি তান || ধীরে শ্যাম নাম, বাঁশীতে বলিবি, শুনিব কেমন বাজে | ধীরে ধীরে চূড়া কাড়িয়ে পরিবি, দেখিব কেমন সাজে || ধীরে বনমালা, গলাতে দোলাবি, দেখিব কেমন দোলে | ধীরে ধীরে তার, মন করি চুরি, লইয়া আসিবি চলে || ৩ শুন মোর মন মধুরে মধুরে, জীবন করহ সায় | ধীরে ধীরে ধীরে, সরল সুপথে, নিজ গতি রেখ তায় || এ সংসার ব্রজ, কৃষ্ণ তাহে সুখ, মন তুমি ব্রজনারী | নিতি নিতি তার, বংশীরব শুনি, হতে চাও অভিসারী || যাও যাবে মন, কিন্তু দেখ যেন, একাকী যেও না রঙ্গে | মাধুর্য্য ধৈরয, সহচরী দুই, রেখ আপনার সঙ্গে || ধীরে ধীরে ধীরে, কাল নদীতীরে ধরম কদম্ব তলে | মধুর সুন্দর, সুখ নটবর, ভজ মন কুতূহলে || . **************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
সংযুক্তা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী” ( ২য় খন্ড ) থেকে নেওয়া | ১ স্বপ্ন ১ নিশীথে শুইয়া , রজত পালঙ্কে পুষ্পগন্ধি শির, রাখি রামা অঙ্কে, দেখিয়া স্বপন, শিহরে সশঙ্কে মহিষীর কোলে, শিহরে রায় | চমকি সুন্দরী, নৃপে জাগাইল বলে প্রাণনাথ, এ বা কি হইল, লক্ষ যোধ রণে, যে না চমকিল মহিষীর কোলে সে ভয় পায় ! ২ উঠিয়া নৃপতি কহে মৃদু বাণী যে দেখিনু স্বপ্ন, শিহরে পরাণি, স্বর্গীয়া জননী চৌহানের রাণী বন্য হস্তী তাঁরে মারিতে ধায় | ভয়ে ভীত প্রায় রাজেন্দ্রঘরণী আমার নিকটে আসিল অমনি বলে পুত্র রাখ, মরিল জননী বন্যহস্তি-শূন্ডে প্রাণ বা যায় || ৩ ধরি ভীম গদা মারি হস্তিতুন্ডে, না মানিল গদা, বাড়াইয়া শুন্ডে, জননীকে ধরি, উঠাইলে মুন্ডে ; পড়িয়া ভূমেতে বধিল প্রাণ | কুস্বপন আজি দেখিলাম রাণি, কি আছে বিপদ কপালে না জানি মত্ত হস্তী আসি বধে রাজেন্দ্রাণী আমি পুত্র নারি করিতে ত্রাণ || ৪ শুনিয়াছি নাকি তুরষ্কের দল আসিতেছে হেথা, লঙ্ঘি হিমাচল কি হবে রণে, ভাবি অমঙ্গল, বুঝি এ সামান্য স্বপন নয় | জননীরূপেতে বুঝি বা স্বদেশ, বুঝি বা তুরষ্ক মত্ত হস্তী বেশ, বার বার বুঝি এইবার শেষ ! পৃথ্বীরাজ নাম বুঝি না রয় || ৫ শুনি পতিবাণী যুড়ি দুই পাণি জয় জয় জয় বলে রাজরাণী জয় জয় জয় ! পৃথ্বীরাজে জয়--- জয় জয় জয় ! বলিল বামা | কার সাধ্য তোমা করে পরাভব ইন্দ্র চন্দ্র যম বরুণ বাসব ! কোথাকার ছার তুরষ্ক পহ্লব জয় পৃথ্বীরাজ প্রথিতনামা || ৬ আসে আসুক না পাঠান পামর, আসে আসুক না আরবি বানর, আসে আসুক না নর না অমর | কার সাধ্য তব শকতি সয় ? পৃথ্বীরাজ সেনা অনন্ত মন্ডল পৃথ্বীরাজভুজে অবিজিত বল অক্ষয় ও শিরে কিরীট কুন্ডল জয় জয় পৃথ্বীরাজের জয় || ৭ এত বলি বামা দিল করতালি দিল করতালি গৌরবে উছলি, ভূষণে শিঞ্জিনী, নয়নে বিজলি দেখিয়া হাসিল ভারতপতি | সহসা কঙ্কণে লাগিল কঙ্কণ, আঘাতে ভাঙ্গিয়া খসিল ভূষণ, নাচিয়া উঠিল দক্ষিণ নয়ন, কবি বলে তালি না দিও সতি || ২ | রণসজ্জা ১ রণসাজে সাজে চৌহানের বল, অশ্ব গজ রথ পদাতির দল, পতাকার রবে, পবন চঞ্চল, বাজিল বাজনা ---ভীষণ নাদ | ধূলিতে পূরিল গগনমন্ডল, ধূলিতে পূরিল যমুনার জল, ধূলিতে পূরিল অলক কুন্তল, যথা কুলনারী গণে প্রমাদ || ২ দেশ দেশ হতে এলো রাজগণ স্থানেশ্বর পদে বধিতে যবন সঙ্গে চতুরঙ্গ সেনা অগণন— হর হর বলে যতেক বীর | মদবার হতে আইল সমর আবু হতে এলো দুরন্ত প্রমর আর্য্য বীরদল ডাকে হর ! হর ! উছলে কাঁপিয়া কালিন্দী-নীর || ৩ গ্রীবা বাঁকাইয়া চলিল তুরঙ্গ শুন্ড আছাড়িয়া চলিল মাতঙ্গ ধনু আস্ফালিয়া--- শুনিতে আতঙ্গ--- দলে দলে দলে পদাতি চলে | বসি বাতায়নে কনৌজনন্দিনী দেখিলা অদূরে চলিছে বাহিনী ভারত ভরসা, ধরম রক্ষিণী--- ভাসিলা সুন্দরী নয়নজলে || ৪ সহসা পশ্চাতে দেখিল স্বামীরে, মুছিলা অঞ্চলে নয়নের নীরে, যুড়ি দুই কর বলে “হেন বীরে রণসাজে আমি সাজাব আজ |” পরাইল ধনী কবচকুন্ডল মুকুতার দাম বক্ষে ঝলমল ঝলসিল রত্ন কিরীট মন্ডল ধনু হস্তে হাসে রাজেন্দ্ররাজ || ৫ সাজাইয়া নাথে যোড় করি পাণি ভারতের রাণী কহে মৃদু বাণী সুখী প্রাণেশ্বর তোমার বাখানি এ বাহিনীপতি চলিলা রণে | লক্ষ যোধ প্রভু তব আজ্ঞাকারী, এ রণসাগরে তুমি হে কান্ডারী মথিবে সে সিন্ধু নিয়ত প্রহারি সেনার তরঙ্গ তরঙ্গসনে || ৬ আমি অভাগিনী জনমি কামিনী অবরোধে আজি রহিনু বন্দিনী না হতে পেলাম তোমার সঙ্গিনী, অর্দ্ধাঙ্গ হইয়া রহিনু পাছে | যবে পশি তুমি সমর-সাগরে খেদাইবে দূরে ঘোরির বানরে না পাব দেখিতে দেখিব ত পরে, তব বীরপনা ! না রব কাছে || ৭ সাধ প্রাণনাথ সাধ নিজ কাজ তুমি পৃথ্বীপতি মহা মহারাজ হানি শত্রুশিরে বাসবের বাজ ভারতের বীর আইস ফিরে | নহে যদি শম্ভু হয়েন নির্দ্দয় যদি হয় রণে পাঠানের জয় না আসিও ফিরে,-- দেহ যেন বয় রণক্ষেত্রে ভাসি শত্রুরুধিরে || ৮ কত সুখ প্রভু, ভুঞ্জিলে জীবনে ! কি সাধ বা বাকি এ তিন ভুবনে ? নয় গেল প্রাণ, ধর্ম্মের কারণে? চিরদিন রহে জীবন কার ? যুগে যুগে নাথ ঘোষিবে সে যশ গৌরবে পূরিত হবে দিক্ দশ এ কান্ত শরীর এ নব বয়স স্বর্গ গিয়ে প্রভু পাবে আবার || ৯ করিলাম পণ শুন হে রাজন নাশিয়া ঘোরীরে, জিনি এই রণ নাহি যতক্ষণ কর আগমন, না খাব কিছু, না করিব পান | জয় জয় বীর জয় পৃথ্বীরাজ, লভ পূর্ণ জয় সমরেতে আজ যুগে যুগে প্রভু ঘোষিবে এ কাজ হর হর শম্ভো কর কল্যাণ || ১০ হর হর হর ! বম্ বম্ কালী ! বম্ বম্ বলি রাজার দুলালি, করতালি দিল-- দিল করতালি রাজরাজপতি ফুল্ল হৃদয় | ডাকো বামা জয় জয় পৃথ্বীরাজ জয় জয় জয় জয় পৃথ্বীরাজ— জয় জয় জয় জয় পৃথ্বীরাজ কর, দুর্গে, পৃথ্বীরাজের জয় || ১১ প্রসারিয়া রাজ মহা ভূজদ্বয়ে, কমনীয় বপু, ধরিল হৃদয়ে, পড়ে অশ্রুধারা চারি গন্ড বয়ে, চুম্বিল সুবাহু চন্দ্রবদনে | স্মরি ইষ্টদেবে বাহিরিল বীর, মহাগজপৃষ্ঠে শোভিল বীর, মহিষীর চক্ষে বহে ঘন নীর ! কে জানে এতই জল নয়নে ! ১২ লুটাইয়া পড়ি ধরণীর তলে তবু চন্দ্রাননী জয় জয় বলে জয় জয় বলে--- নয়নের জলে জয় জয় কথা না পায় ঠাঁই || কবি বলে মাতা মিছে গাও জয় কাঁদ যতক্ষণ দেহ প্রাণ বয়, ও কান্না রহিবে এ ভারতময় আজিও আমরা কাঁদি সবাই || ৩| চিতারোহণ ১ কত দিন রাত পড়ে রহে রাণী না খাইল অন্ন না খাইল পানি কি হইল রণে কিছুই না জানি, মুখে বলে পৃথ্বীরাজের জয় | হেন কালে দূত আসিল দিল্লীতে রোদন উঠিল পল্লীতে পল্লীতে— কেহ নারে কারে ফুটিয়া বলিতে, হায় হায় শব্দ ! ফাটে হৃদয় ! ২ মহারবে যেন সাগর উছলে উঠিল রোদন ভারতমন্ডলে ভারতের রবি গেল অস্তাচলে প্রাণ তো গেলই, গেল যে মান | আসিছে যবন সামাল সামাল ! আর যোদ্ধা নাই কে ধরিবে ঢাল ? পৃথ্বীরাজ বীরে হরিয়াছে কাল, এ ঘোর বিপদে কে করে ত্রাণ || ৩ ভূমিশয্যা ত্যজি উঠে চন্দ্রাননী, সখীজনে ডাকি বলিল তখনি, সম্মুখ সমরে বীরশিরোমণি গিয়াছে চলিয়া অনন্ত স্বর্গে | আমিও যাইব সেই স্বর্গপুরে, বৈকুন্ঠেতে গিয়া পূজিব প্রভুরে, পূরাও রে সাধ ; দুঃখ যাক দূরে সাজা মোর চিতা সজনীবর্গে || ৪ যে বীর পড়িল সম্মুখ সমরে অনন্ত মহিমা তার চরাচরে সে নহে বিজিত ; অপ্সরে কিন্নরে, গায়িছে তার অনন্ত জয় | বল সখি সবে জয় জয় বল, জয় জয় বলি চড়ি গিয়া চল জ্বলন্ত চিতার প্রচন্ড অনল, বল জয় পৃথ্বীরাজের জয় || ৫ চন্দনের কাষ্ঠ এলো রাশি রাশি কুসুমের হার যোগাইল দাসী কতন ভূষণ কর পরে হাসি বলে যাব আজি প্রভুর পাশে | আয় আয় সখি, চড়ি চিতানলে কি হবে রহিয়ে ভারতমন্ডলে ? আয় আয় সখি যাইব সকলে যথা প্রভু মোর বৈকুন্ঠবাসে || ৬ আরোহিলা চিতা কামিনীর দল চন্দনের কাষ্ঠে জ্বলিল অনল সুগন্ধে পূরিল গগনমন্ডল --- মধুর মধুর সংযুক্তা হাসে | বলে সবে বল পৃথ্বীরাজ জয় জয় জয় জয় পৃথ্বীরাজ জয় করি জয়ধ্বনি সঙ্গে সখীচয় চলি গেলা সতী বৈকুন্ঠবাসে || ৭ কবি বলে মাতা কি কাজ করিলে সন্তানে ফেলিয়া নিজে পলাইলে, এ চিতা অনল কেন বা জ্বালিলে, ভারতের চিতা, পাঠান ডরে | সেই চিতানল, দেখিল সকলে আর না নিবিল ভারতমন্ডলে দহিল ভারত তেমনি অনলে শতাব্দী শতাব্দী শতাব্দী পরে || . **************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |