বল সখি কি করি উপায় |
আজ এত উচাটন,                কেনগো হইল মন,
গৃহে থাকা হল ঘোর দায় ||
ঘটিল বিপদ ঘোর,                কোথা সে হৃদয়চোর,
করে ধরি আন গো সজনি |
শারদ নিশির শোভা,                হইয়াছে মনোলোভা,
রাসরসে তুষিব এখনি ||
কোথা সে বঙ্কিম হরি,                বলনা কে নিল হরি,
নয়ন প্রহরী হতে মোর |
কে মোরে সাধিল বাদ,                কোথা গেল কালাচাঁদ,
এনে দেগো করে ধরি তোর ||
শুনিয়ে রাধার বাণী,                মনেতে প্রমাদ মানি,
খেদ চিত্তে চিত্রা কহে ধীরে |
কি কর কি কর রাই,                কিছু কি প্রবোধ নাই,
কেনগো ভাসিছ নেত্র নীরে ||
এ কেমন অনুমান,                বসন্তে শরদ্ জ্ঞান,
ওগো রাধে হোলে উন্মাদিনী |
কুটিলা শুনিলে পরে,                হাসিয়ে কহিবে পরে,
ধৈর্য্য ধর ওগো কমলিনী ||
সখীর বচন শুনে,                দগ্ধ হয়ে মনাগুনে,
কাতরে কহেন বিনোদিনী |
চল গো নিকুঞ্জে যাই,                ছার গৃহে কাজ নাই,
হই গিয়ে কাননবাসিনী ||
ধন্য ভাব শ্রীরাধার,                ধন্য বিরহ বিকার,
ধন্য কৃষ্ণপ্রাণা কমলিনী |
উঠিতে সামর্থ্য নাই,                তবু চলিলেন রাই,
বনদগ্ধা যেন কুরঙ্গিণী ||
সঙ্গিনীর ধরি কর,                কাঁপিছেন থর থর,
অগ্রসর হইয়ে কাননে |
যমুনার তটে গিয়ে,                রাসস্থলী নিরখিয়ে,
কহিছেন সজল নয়নে ||
ওগো প্রিয় সহচরি,                বল কি উপায় করি,
কই মোর হৃদয়রঞ্জন |
সকলি রয়েছে ওই,                পরাণ বল্লভ কই,
শূন্য কেন হেরি কুঞ্জবন ||
শ্যাম যদি হয়ে বাম,                ত্যজিলেন ব্রজধাম,
এরা কেন দহিছে জীবন |
কেন শশী দেয় দুখ,                কি তায় বাড়িবে সুখ,
কেন জ্বালা দেয় পুষ্পগণ ||
কেন সখি রতিপতি,                মোরে দুখ দেয় অতি,
কেন করে এতই পীড়ন |
কেন গো যমুনাজলে,                দুরন্ত অনল জ্বলে,
তরঙ্গে আতঙ্গে দহে মন ||
সব দুঃখ সহা যায়,                কন্দর্পে বুঝান দায়,
না দেখি উপায় আমি তার |
কি করি কোথায় যাই,                এ দায়ে নিস্তার পাই,
চিন্তানীরে কে করিবে পার ||
এইরুপে কমলিনী,                কৃষ্ণশোকে উন্মাদিনী,
ভমণ করেন বনে বনে |
হা কৃষ্ণ হা নাথ বলি,                বিরহ অনলে জ্বলি,
সর্ব্বদা পড়েন ধরাসনে ||
দহ্যমানা দুঃখানলে,                মগ্না হয়ে ভ্রমজলে,
কৃষ্ণকেলি তরু প্রতি কয় |
হরিপাল গ্রামে বাস,                শ্রীরাধাকৃষ্ণের দাস,
বনোয়ারি ভণে ভাবচয় ||

.    ******************     
.                                                                                            
সুচিতে...   




মিলনসাগর
কবি বনোয়ারিলাল রায়ের কবিতা
*
শ্রীমতীর ভ্রম বশতঃ কৃষ্ণকেলি তরুর প্রতি উক্তি
বনোয়ারিলাল রায়,
(কোকিলদূত কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া)

একাবলী ছন্দ

শুনহে সুজন শোভা
বঁধূর নামেতে তোমা
তাই হে তোমারে জি
জান কি কোথায় সে
যদ্যপি জানহ বলিয়া
বিরহবিকারে দহিছে
জানি হে বধুর সুহৃদ
করুণা করিয়ে আমা
ইহাতে অধিক বাড়ি
জনমের মত হইব ব
তোমার গৌরব সক
মোহনরূপেতে তিমি
ভেবে দেখ আমি তো
আনন্দ-সাগরে মগনা
পরাণ বঁধূর করেছি
রেখেছি মস্তকে আপ
আমার চিকুরে করি
অনাশে পুরাতে আ
যে জন হইতে বাড়ি
বিপদে তাহারে করহ ত্রাণ ||
এ কথা যদ্যপি না শুন রাগে |
মরিব এখনি তোমারি আগে ||
অবলা বধের হইবে ভাগী |
পাইবে যাতনা এ পাপ লাগি ||
সাধে কি সাধিয়ে এ রূপ বলি |
দারুণ জাতনা অনলে জ্বলি ||
তুমি হে সখার সুহৃদ হও |
আমারে এক্ষণে উপায় কও ||
কি রূপে এ দুখে পাইব ত্রাণ |
কি রুপে বজায় রহিবে মান ||
কি রূপে বাসেতে করিব বাস |
কি রূপে ঘুচিবে আমার ত্রাস ||
উপদেশ মোরে বলিয়া দেহ |
তুমি বই নাহি স্বজন কেহ ||
কি আর অধিক তোমারে কব |
কেনা হয়ে তব নিকটে রব ||

.      ******************     
.                                                                                       
সুচিতে...   




মিলনসাগর
*
শ্রীরাধার অভিমান প্রতি ভর্ত্সনা
বনোয়ারিলাল রায়,
(কোকিলদূত কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া)

পয়ার

বিরহ বিধুরা প্যারি করেন
অভিমানে অভিমানে করি
ওরে অভিমান তুই অতিশ
অকালে করেছ নাশ প্রেমের
এখনো আমার দেহে করিতে
আত বাদ সেধে তবু না পুরি
ভেবে দেখ তুমি মোর যাত
তব লাগি এ অভাগী হারায়ে
কে জানিত আগে তব কপট
ধরেছিলে বৈরি হয়ে সুহৃদে
দুর্জ্জনসদৃশ ভাব করিয়ে গো
ছলেতে হইয়ে বন্ধু করিলে
তুমি যদি মম দেহে না হতে
তা হলে আমার এত যাতনা
তব অভিমতে আমি হারাই
হেরি নাই দম্ভ করি বঁধূর ব
রখিতে তোমার মান না বুঝি
করিয়াছি সাধনের ধনে অয
সেই পাপে মনস্তাপে ব্রজ প
শূন্য করি হৃদি রাক্ত্য গেছেন
এক্ষণে করিবে মান কাহার
কে রাখিবে অভিমান তব স
তব লাগি কে মাখিবে আর
কে আর করিবে ভিক্ষা হই
ওরে অভিমান তুই বড়ই কঠিন |
এক ভাবে হরিতেছ কাল চিরদিন ||
দয়া শূন্য কায়া তব কিছু হায়া নাই |
তব লাগি নিরবধি কত দুঃখ পাই ||
এক্ষণে করুণা করি পরিত্যাগ কর |
তা হলে বঁধূর পাশে হই অগ্রসর ||
যত দিন রবে মম হৃদয় মন্দিরে |
তত দিন ভাসাইবে নয়নের নীরে ||
আর এক কথা বলি শুন অভিমান |
এত দিন মম দেহে আছ বর্ত্তমান ||
কি রূপ আকার তব পাই না দেখিতে |
দিতেছ যন্ত্রণা কত থাকি অলক্ষিতে ||
পারিতাম আমি যদি তোমারে ধরিতে |
সমুচিত প্রতিফল দিতাম ত্বরিতে ||
বল বল এক কথা শুধাই তোমারে |
কি সুখে রহেছ মম হৃদয় আগারে ||
হইয়াছি অনাথিনী বিনা কৃষ্ণধন |
আর কেন তুমি এত কর জ্বালাতন ||
তব অনুচর ক্রোধে লয়ে সঙ্গে করি |
স্বস্থানে প্রস্থান কর মোরে পরিহরি ||
কিম্বা যাও মধুপুরে ত্যজি এই দেশ |
নূতন রাণীর দেহে কর গে প্রবেশ ||
তা হলে বাড়িবে মান ওরে অভিমান |
নব অনুরাগে তথা জুড়াইবে প্রাণ ||
তুমি গেলে পাব আমি কৃষ্ণ দরশন |
কিছু উপকার মম কররে এখন ||
অধিক কি কব আর মনোযোগ কর |
মম দেহ পরিহরি হও স্থানান্তর ||
বনোয়ারিলাল কহে শুন গো শ্রীমতী |
অভিমানে এত বলা নাহি সাজে সতী ||

.            ******************     
.                                                                                        
সুচিতে...   




মিলনসাগর
*
মুরলী দর্শনে শ্রীমতীর খেদ
বনোয়ারিলাল রায়,
(কোকিলদূত কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া)

পয়ার

রাধানাথে না হেরি
ভ্রমিছেন যুথভ্রষ্টা যে
এমন সময়ে সেই ত
দেখিলেন বাঁশী এক
বাঁশী হেরি শশীমুখী
বলেন হৃদয়ে রাখি
মরিরে কৃষ্ণের বাঁ
শ্রীকরের ধন হয়ে
সর্ব্বদা রহিতে তুমি
কঠিন মাটিতে কে
তোমারে হেরিতে
তুমি যে যত্নের ধন
ওরে বাঁশী তব সম
তব রবে ত্রিভূবন
এমনি তোমার বল
বনে বসি সবে টেনে
গুণের সাগর তুমি
করিয়াছ দর্পচূর্ণ স
তোমারে অমান্য কে
শিবের বাঞ্ছিত তুমি
আমরা তোমার দাসী অন্য জানি নাই |
আহা মরি তব দশা হেরে দুঃখ পাই ||
তব লাগি হইতাম কানন বাসিনী |
তব লাগি মোর নাম রাধা কলঙ্কিণী ||
ভাবি নাই কুল যশ পতি গৃহ ধন |
তব লাগি করিয়াছি সব বিসর্জ্জন ||
তব লাগি পাইতাম শ্যাম দরশন |
আজ কেন বাঁশী তব হেরি এ লক্ষণ ||
রাখিতে তোমার মান হইয়ে রমণী |
কি না কর্ম করিয়াছি জানতো আপনি ||
ভাবিতাম বাঁশী সবে শুন বলি সার |
তব তুল্য মাধবের প্রিয় নাহি আর ||
যাঁহার চরণ যোগী যোগে করে ধ্যান |
পেয়েছিলে সে ধনের অধরেতে স্থান ||
পুঞ্জ পুঞ্জ পূণ্য তব ভাবিতাম মনে |
এ আর কেমন হেরি এ রূপ লক্ষণে ||
বুঝিলাম কোন দোষ নাহিরে তোমার |
মম লাগি পাইতেছ যাতনা অপার ||
ওরে বাঁশী আমি তব দুঃখের কারণ |
মম সমা পাপিয়সী কে আছ এমন ||
ধরিতে আমার নাম তুমিরে বাঁশরি |
এই জন্য তব দুঃখ অনুভব করি ||
যদি না করিতে তুমি এ নাম ধারণ |
তা হলে কি দশা তব হইত এমন ||
ধরিয়ে আমার নাম মজিলে বিপাকে |
ওরে বাঁশী অভিষাপ করনা আমাকে ||
যদি বল নারী হত্যা অধর্ম ঘটিবে |
কোন পাপ তাপ নাই নিশ্চয় জানিবে ||
শাস্ত্রের বচন আর কহে সাধুগণ |
বৈরি বিনাশিতে পাপ নাহি কদাচন ||
যেন তেন প্রকারেন শত্রু বিনাশিবে |
পুরুষ রমণী কোন নাহি বিচারিবে ||
তার সাক্ষী তব কৃষ্ণ হয়ে .... |
স্তনপানে পুতনার বধেছেন প্রাণ ||
অতএব ইহা কর যাতে প্রাণ যায় |
আমারে বধিলে তব পাপ নাহি তায় ||
এভাবে মুলী লয়ে খেদে কমলিনী |
ভ্রমেণ বকুলকুঞ্জে যেন উন্মাদিনী ||
কুহু কুহু স্বরে পিক তরুতে কুহরে |
হইয়ে চঞ্চলা অতি আতঙ্গে শিহরে ||
কাতরে কোকিলে কয় করিয়ে বিনয় |
বনোয়ারী কহে করি কৃষ্ণ পদাশ্রয় ||

.            ******************     
.                                                                                        
সুচিতে...   




মিলনসাগর
*
শ্রীমতীর কোকিলের প্রতি ভর্ত্সনা
বনোয়ারিলাল রায়,
(কোকিলদূত কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া)

পয়ার

কেনরে কোকিল তুমি
কি লাভ হইবে বল ক
অবলা বধের ভয় নাহি
কি জন্যে আইলে এই
কি সুখে হইলে সুখী সু
দেখিয়ে কুঞ্জের দশা দ
বুঝি তুমি নেত্রহীন হবে
নতুবা কি দিতে এত জ্বা
বুঝিতে না পারি আমি
কিসে এত দুঃখে হল
কোন সুখ চিহ্ন নাহি হে
কি ভেবে ডাকিছ বল
একবার মুখ তুলি কর
কি রূপ হয়েছে এই র
বৃন্দাবন বাসী বৃক্ষ লতা
কি ভাবে করিছে সবে
হেরিতে না হবে শ্রম তো
না হইবে সব স্থানে করি
বসিয়ে বয়েছ তুমি উ
সহজে দেখিতে পায় হে
আর এক কথা বলি শু
কেহ যদি কোন স্থানে করে আগমন ||
আছে রীত অগ্রে জ্ঞাত হতে বিবরণ |
দেখে শুনে কার্য করে সাধু বিচক্ষণ ||
তোমার স্বভাব হেরি বিপরিত অতি |
বুঝিলাম শুদ্ধ তব অধর্মেতে মতি ||
এমন কর্মেতে হবে কলঙ্ক ঘোষণা |
কিসে মান অপমান নাহি বিবেচনা ||
পিককুলে কেন মিছে রাখ অপযশ |
ভস্মরাশি ভস্ম করে কি হবে পৌরষ ||
যে কথায় রস নাই মিখ্যা সে বচন |
যে ধনে সুব্যয় নাই মিথ্যা সেই ধন ||
যে কুলে সন্তান নাই মিথ্যা সেই কুল |
যে ফুলেতে মধু নাই মিথ্যা সেই ফুল ||
যে আশা সুসার নয় মিথ্যা সেই আশা |
যে বাসায় পক্ষি নাই মিথ্যা সেই বাসা ||
যাতে পরকাল নাই মিথ্যা সেই ধর্ম্ম |
যে কর্ম্মে সুযশ নাই মিথ্যা সে কর্ম্ম ||
ভেবে দেখ সাধু নাহি করে অপকর্ম্ম |
প্রাণপণে রক্ষা করে আপনার ধর্ম্ম ||
ভেকে যদি নৃত্য করে ফণির মাথায় |
হরি যদি করি হয়ে দূরেতে পলায় ||
ইন্দুরে যদ্যপি করে বিড়ালে নিধন |
তথাপি না করে সাধু অহিত সাধন ||
পর দুঃখানলে সাধু গলে ঘৃত মত |
কায়মনো বাক্যে করে সদুপায় যত ||
বৈরির বিপদে কার নাহি হয় তোষ |
অহিত করলে তবু না করেন রোষ ||
এমনি উদার ভাব গুণের আধার |
ভুলে যান কুটিলের কুট ব্যবহার ||
পুরস্কার জ্ঞান করি নিজ তিরস্কার |
সাধিতে তাহার হিত বাসনা অপার ||
অতএব বিপরীত ভাব কেন ধর |
আমাদের দুঃখরাশি নিরীক্ষণ কর ||
আমার বচন কিছু শুনে কাজ নাই |
স্বচক্ষো হের না তুমি এই ভিক্ষা চাই ||
ওই দেখ রসহীন তরুলতা সব |
ফল ফুল দূরে থাকু বিহীন পল্লব ||
কে আর করিবে যত্ন কে ঢালিবে জল |
শুকায়েছে তরুলতা স্থাবর সকল ||
কি কহিব কাননের ছিল শোভা কত |
ফল ফুলে লম্বমানা ছিল শাখী যত ||
এক্ষণে সে সব কথা হয়েছে স্বপন |
তারোপরে তুমি কেন কররে পীড়ন ||
ওই দেখ পুষ্প বন হইয়াছে বন |
শুকায়েছে তাপে আর কে করে যতন ||
পূর্ব্বে কত মধুকর করিত ভ্রমণ |
*
শ্রীমতীর ভ্রম ও নিশিতে কুঞ্জে গমন
বনোয়ারিলাল রায়,
(কোকিলদূত কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া)

ত্রিপদী
এখন সে পথে অলি
হেরিলে প্রফুল্ল হোতো
এখন হেরিলে পরে ম
ওই দেখ বারীহীন স
বৃন্দাবনে জল নাহি দে
শ্রীকৃষ্ণ বিরহ ভানু হ
এককালে শুখাইল সরো
মরেছে মরালগণ সার
জলে জলজন্তু নাই হী
জলে স্থলে সম বহ্নি
জ্বলে প্রাণ না হেরিয়ে
ওই দেখ ডালে বসে
শ্রীকৃষ্ণ বিরহে দগ্ধ হ
ওই দেখ পশু সব তে
স্থানে স্থানে পড়ে আ
এ সব হেরিয়ে দয়া না
জ্বালার উপর জ্বালা
বুঝিলাম কিছু দয়া মা
তা হলে না দিতে দুঃখ এত অসম্ভব ||

.            ******************     
.                                                                                       
সুচিতে...   




মিলনসাগর