হাসিয়ে আমারে দিবে দু’টি বাসি ফুল ! বিধি সর্ব্বশক্তিমান, নিতান্ত এ ভুল | নতুবা শকতি তার নাই কেন পুনর্ব্বার ফিরাইয়া দিতে মোর সে প্রেম–পুতুল ? বিধি সর্ব্বশক্তিমান, ইহা নহে ভুল,---- নতুবা আর কে পারে সমাহিত করিবারে অমন স্বরগ-শিশু , বিশ্বে যে অতুল ? পাব না প্রাণের ধন, পাব না সে ফুল | আর শুনিবে না প্রাণ সে ললিত কন্ঠতান--- প্রেমের পীযুষ-ভরা রাগিণী মঞ্জুল | শুধু স্মৃতি-কুঞ্জে ফুটে আছে “বাসি ফুল” সে মুখের স্মৃতি-সুখ ভরিয়ে রেখেছে বুক, অঙ্কিত সে চিরতরে, হইবে না ভুল | . ****************** . সূচিতে . . . মিলনসাগর |
কবি বেগম রোকেয়ার কবিতা |
এত তারা আছে, কেহ তোমারে করে না স্নেহ ? তাই তুমি, শশধর ! বসিয়া বিরলে, নিশীথে জুড়াও প্রাণ ভিজি আঁখিজলে | এ নিঠুর চরাচর শুনে না কাতর স্বর,--- ঢালে না করুণা-বারি যবে প্রাণ জ্বলে ! দুটি সান্ত্বনার কথা কেহ নাহি বলে | কি দেখিছ, শশধর ! আমার হৃদয় ? তোমার কলঙ্ক-সম অন্ধকারময় শুধু পাপ, তাপ, ভয়, শোকে পূর্ণ এ হৃদয়, এ নহে উজ্জ্বল শুভ্র সরলতাময় | কি দেখিবে, শশধর, এ পোড়া হৃদয় ? এ নহে কোমল স্নিগ্ধ স্বচ্ছ সুনির্ম্মল ,--- এ হৃদয়ে স্তরে স্তরে তীব্র হলাহল ! নৈরাশ্য বেদনা শত, কালানল-শিখা কত, কি করে দেখাব শশি ! তোমা সে-সকল ? এ নহে পবিত্র রম্য স্বচ্ছ সুনির্ম্মল ! তোমার কলঙ্ক, শশি ! মুছিবে কেমনে ? যাবে না কলঙ্ক তব কোন শুভক্ষণে ও কলঙ্ক হৃদি ‘পরে র’বে যুগ-যুগান্তরে ; তাই বুঝি ভাব সদা বসি’ যোগাসনে ---- আঁধার কালিমা-রেখা মুছিবে কেমনে ? . ****************** . সূচিতে . . . মিলনসাগর |
বুকে ল’য়ে গোটা কত সুরম্য ভবন | ওকি ও অনেক দূরে উত্তর-গিরির চূড়ে স্তুপাকার মুক্তা হেন ও কি দেখা যায় ? ও বুঝি কাঞ্চনজঙ্ঘা ? তাই তো কাঞ্চনজঙ্ঘা | কি হেতু “কাঞ্চন” নাম কে দিল উহার ? ও ত স্বর্ণবর্ণ নয়, মুক্তা-নিভ সমুদয় ধবল তুষার-স্তম্ভ অতি মনোহর ! মরি ! কিবা সমুজ্জ্বল রবি-করে ঝলমল করে ! কত মনোরম প্রাণমুগ্ধকর | শ্যামল ভূজররাজি যেন গো ভূপতি সাজি’ কাঞ্চনে মুকুট-রূপে পরেছে মাথায় ! এমন ভূষণ পেয়ে গিরিরাজ ধন্য হ’য়ে প্রণমিছে নতশিরে কাঞ্চনের পা’য় ! নির্মল তুষার গলে কাঞ্চনের পদতলে বহিছে নীহার –নদী কত না সুন্দর ! কে যাবে ও-হিমদেশে কে কহিবে দেখে এসে’ সে কেমন রম্যস্থান-সৌন্দর্য আকর ? না জানি কতই তাহা বিমল শীতল, আহা ! তাই বলি , ও কাঞ্চন ভূতলে অতুল , যশস্বী উহারে পেয়ে হ’ল গিরিকুল | কিন্তু সেই মহাকবি আঁকিয়া এমন ছবি আপনি অদৃশ্য হয়ে আছেন কোথায় ? পরস্পরে তরুলতা কহিছে তাহারি কথা যেন বলিতেছে, “বিভু এই ত হেথায় !” সেদিকে ফিরালে আঁখি বিস্ময়ে চাহিয়া থাকি বিভু যেন সরে যান মরীচিকা-প্রায় কিন্তু সে চরণ-রেখা সর্বত্রই যায় দেখা, কুসুম সৌরভে তাঁর গন্ধ পাওয়া যায় | ( ভাব-চক্ষু আছে যার দেখিতে কি বাকি তার ? সে মুদ্রিত চক্ষে তাঁর দরশন পায় | ) অস্পুট নীরব স্বরে প্রকৃতি প্রচার করে,---- শিল্পীর মহিমা শিল্প আপনি জানায় |” ****************** ঈগল্ স ক্রেশ্ নামক পর্ব্বত-শিখর হইতে ( আকাশ নির্ম্মল থাকিলে ) প্রকৃতিক সৌন্দর্য্য যেরূপ দেখায় তদবলম্বনে রচিত | গিরি কাঞ্চনজঙ্ঘা প্রায় সর্বদা মেঘের অন্তরালে লুক্কায়িত থাকে, সুতরাং তাহার দর্শন-লাভ সাধারণ ব্যপার নহে | . ****************** . সূচিতে . . . মিলনসাগর |
হৃদয়ের ধন তুমি রয়েছে হিয়ায় ! . ****************** . সূচিতে . . . মিলনসাগর |
এবে পোহাইল, আশার আলোকে হাসে দিননাথ | শিশির-সিক্ত কুসুম তুলিয়ে ডালা ভরে নিয়ে এসেছে “সওগাত” | . ****************** . সূচিতে . . . মিলনসাগর |
বাসিফুল কবি বেগম রোকেয়া ( প্রথম প্রকাশ – নবনূর, ফাল্গুন ১৩১০, পুনর্মুদ্রণ – মহিলা, বৈশাখ ১৩১২ ) “পিসীমা ! তোমার তরে আনিয়াছি ফুল,” |
আত্মহারা মন ! তুমি কোথায় কোথায় ? ঘুরিয়া বেড়াও তুমি কিসের আশায় ? কোন শ্মশানের ঘাটে, কোন নিরজন মাঠে ; কোন তটিনীর স্রোতে ভাসায়েছ কায় ? তাই কি খুঁজিতে গিয়ে পাই না তোমায় ? যথেষ্ট হয়েছে মন ! যেয়োনাক আর ভ্রমিতে কল্পনা রাজ্যে ছাড়িয়ে সংসার | এস শান্ত হও ভাই, আর ঘুরে কাজ নাই, জান তুমি চিরবন্দী সংসার-রাজার ? অলসের বেড়ী পায়, কত দূরে যাবে, হায় ! তব অপেক্ষায় আছে গৃহকারাগার | ভুলিয়ে আপন পর ত্যজি এ মায়ার ঘর, যেযো না স্বপনরাজ্যে খেলিতে আবার ! ( মনের উক্তি ) সোনার পিঞ্জরে ধরে রেখো না আমায় আমারে উড়িতে দাও দূর নীলিমায় ! খুঁজিব তারার দলে কোন্ গগনের তলে, আমার সে নিরমাতা রয়েছে রয়েছে কোথায়, যেজন স্বপন ঘোরে পাগল করেছে মোরে , এমন উদাসী যেই করেছে আমায় ; যাহার বাঁশীর স্বরে থাকিতে পারি না ঘরে, যাহার যশের গান জগত শুনায় ; সে অনন্ত প্রেমময় কেন চাহে এ হৃদয় অলক্ষিত আকর্ষণে কোথা লয়ে যায় ? দেখা দাও জগদীশ ! রয়েছ কোথায় ? অতল জলধিতলে, বিকচ কুসুমদলে, অথবা লুকায়ে আছ জলদের ছা’য় ? বল প্রভু, কোন খানে নীচু কিম্বা উচ্চ স্থানে গভীর গুহায় কিম্বা হিমাদ্রিচূড়ায় ---- জুড়াতে তাপিত প্রাণ থাক কি হে ভগবান ওয়েসিস---- বারিরূপে মরু সাহারায়, শোকার্ত্তের ক্ষত হৃদি আরোগ্য করিত বিধি, শীতল প্রলেপরূপে বিরাজ তথায় ? দেখা দাও প্রেমময় ! রয়েছ কোথায় ? কোথা আছ প্রেম-সিন্ধু জগত-ঈশ্বর ? আমি যদি হইতাম চারু সুধাকর, শূন্য পথে ঘুরিতাম নীলাকাশে ভাসিতাম, আমার আলোকে ধরা হ’ত মনোহর | তুমি থাক কোন্ খানে পিপাসা-ব্যাকুল প্রাণে তোমারে খুঁজিতে গিয়ে হতেম অমর | জলদ পবন ভরে উড়িয়ে গগন পরে আসিয়া পড়িত কভু আমার উপর | ধূসর মেঘের তলে লুকাতাম কুতুহলে বিস্ময়ে দেখিত চেয়ে তারকা নিকর ! দেখা দাও প্রেমসিন্ধু জগৎ ঈশ্বর ! অথবা হতেম যদি আকাশের তারা তোমারি বিধান মতে ভ্রমিয়া অনন্ত পথে, নীলাকাশে ছড়াতেম কনকের ধারা ! ঘুরিতে ফিরিতে কভু আপনা ভুলিয়া প্রভু ছুটিতাম তব পানে হয়ে আত্মহারা ! হায় ! কেন হই নাই আমি ক্ষুদ্রতারা ! অথবা হতেম যদি মলয় সমীর – তাপিতেরে জুড়াইয়া সৌরভের ভার নিয়া ছুটিতাম তব আশে হইয়া অধীর ! তোমারে খুঁজিতে গিয়ে স্বর্গের অমিয়া পিয়ে, অমর হতেম আমি সায়াহ্ন সমীর ! আমি কেন হই নাই মলয় সমীর ? আমি যদি হইতাম বসন্ত কোকিল – ললিত করুণ স্বরে সদা ডাকিতাম তোরে, আমার গানের তান বহিত অনিল ! প্রীতি ভক্তি মাখা প্রাণে তব স্নেহ গুণগানে রত থাকিতাম ভুলে সংসার জটিল | সাহায্য করিলে বায় উড়িতাম নীলিমায় দেখিতে বিস্তৃত কত গগন সুনীল ! অথবা হতেন যদি যূথিকা-মুকুল--- স্নিগ্ধ সাঁঝে ফুটিতাম, তোমারেই ভাবিতাম, দেখিতে তোমায় বিভু, হতেম আকুল ! তৃষিত বিহ্বল প্রাণে চাহিয়া তোমার পানে, জাগিয়া সারাটি নিশি আমি ক্ষুদ্র ফুল, প্রাণে মরিতাম পেতে তব পদধূল ! দেখা দাও দীনবন্ধু ! থাক হে কোথায়? তুমি প্রভু থাক যথা সকলি অমর তথা, বিচক প্রসূনমালা তথা না শুকায় | চির বসন্তের দেশে থাক কি মোহন বেশে | অমিয়া সরসী বক্ষে শতদল প্রায় ? প্রাণ মনমুগ্ধকর কোকিলের কুহুস্বর,--- সঙ্গীত-দেবতারূপে বিরাজ কি তায় ? ললিত লতিকাসনে খেলা করি ফুল্ল মনে, যাও কি মিশিয়া ধীরে মৃদু মলয়ায় ? সুখের স্বপন হয়ে সুধা বর্ষ এ হৃদয়ে দেখাও স্বরগধাম রচি কল্পনায় ? সুস্নিগ্ধ জলদপ্রায় ঢাল বারি এ ধরায় ভাস কি তটিনী-স্রোতে লহরীমালায় ? করি প্রীতি বরিষণ জুড়াও তাপিত জন, চাহিলে তোমার পানে শান্তির আশায় ? |