বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন – জন্মগ্রহণ করেন অবিভক্ত বাংলার রংপুরের পায়রাবন্দ,
মিঠাপুকুর গ্রামের এক রক্ষণশীল সম্ভান্ত জমিদার পরিবারে। তাঁর জন্মদিন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তিনি নিজে
তাঁর “অবরোধবাসিনী”-তে লিখেছেন যে তিনি তাঁর ভাগ্নে আবদুল হালিম গজনভীর (হালু) থেকে এক বছরের
ছোট ছিলেন। সেভাবে হিসেব করলে তাঁর জন্ম-সন দাঁড়ায় ১৮৭৭। কবি সুফিয়া কামালের অনুমোদন পায়
৯ই ডিসেম্ব ১৮৮০ তারিখটিই। হাসিনা জোয়ার্দার ও সফিউদ্দীন জোয়ার্দার এই তারিখের সপক্ষে তথ্যপ্রমান
দিয়েছিলেন। বাংলাদেশে ৯ই ডিসেম্বরকেই রোকেয়া দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
“বেগম রোকেয়া” নামে সকলে তাঁকে জেনেছেন। কিন্তু তিনি নিজে কোথাও তাঁর নামের আগে বেগম কথাটি
ব্যবহার করেন নি। তাঁর প্রকৃত নাম “রোকেয়া খাতুন”। বিয়ের পর তিনি মিসেস আর.এস. হোসেন সাক্ষর
করতেন। ইংরেজিতে লিখতেন “ROQUIAH KHATUN”।
পিতা জাহিরউদ্দীন মহম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের নিজে ছিলেন জ্ঞানপিপাসু মানুষ, তাই তিনি তাঁর
সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য উত্সাহ ছিল প্রচুর। কিন্তু সামাজিক গোঁড়ামীর ঊর্দ্ধে তিনি উঠতে পারেননি। তাই
পিতৃগৃহে রোকেয়াকে কঠিন পর্দাপ্রথার ভেতরেই কাটাতে হয়েছিল।
মাতৃভাষা বাংলা হলেও, সেই সময়ে বর্ধিষ্ণু মুসলমান পরিবারে উর্দু, আরবী, ফারসীর চলই বেশী ছিল।
বড়দা আবোল আসাদ ইব্রাহিম সাবের ছিলেন ভাইবোনদের প্রতি অতি স্নেহপরায়ন এবং তিনি নিজে
রোকেয়াকে ইংরেজী ভাষা শেখান। রোকেয়ার বড়বোন করিমুন্নেসা খাতুনের কাছে তিনি শেখেন বাংলা।
করিমুন্নেসার শশুরবাড়ী ছিল কলকাতায় এবং তিনি ছিলেন কবি। করিমুন্নেসা নিজের চেষ্টায় আয়ত্ত
করেছিলেন আরবী, ফারসী ও বাংলা। বেগম রোকেয়ার (ডাক নাম রকু) জীবনে তাঁর এই দাদা ও দিদির
অবদান ছিল অপরিসীম।
১৮৯৬ সালে, কবির ১৬ বছর বয়েসে তাঁর বিয়ে হয় বিহারের ভাগলপুরের, উর্দুভাষী, খান বাহাদুর সৈয়দ
সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। খান বাহাদুর ছিলেন একজন উচ্চশিক্ষিত, স্পষ্টবাদী, তেজস্বী এবং কর্মদক্ষ
সৎমানুষ। তিনি ছিলেন বিপত্নিক এবং প্রথমপক্ষের একটি কন্যা সন্তানসহ।
বয়সের তফাত থাকলেও বেগম রোকেয়া তাঁর স্বামীর কাছ থেকে বিদ্যাশিক্ষা ও সাহিত্যচর্চার জন্য সকল
প্রকার সহযোগিতা লাভ করেছিলেন। দাদার কাছে যে ইংরেজী শিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছিল স্বামীর কাছে তা
সম্পূর্ণ হয়। খান বাহাদুরের সজত্ন চেষ্টায় তিনি ইংরেজী ও উর্দুতে প্রভূত জ্ঞান লাভ করেছিলেন। দাদা
ইব্রাহিম ও দিদি করিমুন্নেসার যত্নে যে কুড়িটি ফোটা শুরু করেছিল তা সৈয়দ সৈখাওয়াত হোসেনের প্রেম-
ছায়ায় পরিপূর্ণভাবে ফুটে ওঠে।
এই সময়ে কবি “নবনূর”, “মহিলা, “নবপ্রভা” প্রভৃতি পত্রিকায় কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। তাঁর
একমাভ উপন্যাস “পদ্মরাগ”-ও এই সময়ে (১৯১২ সাল নাগাদ) রচিত হয়। উপন্যাসটি উত্সর্গ করেন
তাঁর পরম স্নেহের দাদা আবোল আসাদ ইব্রাহিম সাবের সাহেবকে। কিন্তু তা প্রকাশিত করতে করতে কেটে
যায় আরও ১২ বছর। মাদ্রাজের কমলা মাতমিয়া নাথান ও ভারতের নাইটেঙ্গেল সরোজিনী নাইডুর
সম্পাদিত Indian Ladies Magazine এ প্রকাশিত হয় তাঁর অনবদ্য কল্পকাহিনী “Sultana’s Dream”।
১৯০৯ সালের ৩রা মে তারিখে তাঁর স্বামী বহুমুত্র রোগের প্রকোপে পরলোক গমন করেন কলকাতায়। তিনি
দুটি শিশুকন্যার মা হয়েছিলেন। একটি পাঁচ মাস ও অন্যটি চার মাস বয়সে মারা যায়। মাত্র ১৩ বছরের
দাম্পত্য জীবন এখানেই শেষ হয়ে যায়। সপত্নী কন্য ও জামাতার দিক থেকে শুরু হলো সম্পত্তির কারণে
নিগ্রহ।
শুরু হলো ভিন্ন এক নির্ভিক জীবন। মৃত্যুর আগে তাঁর স্বামী তাঁকে একটি স্কুল খোলার জন্য দশ হাজার টাকা
গিয়ে গিয়েছিলেন। তাই দিয়ে বিহারের ভাগলপুরে প্রতিষ্ঠা করলেন একটি গার্লস স্কুল।
ভাগলপুরের তদানিন্তন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ শাহ আবদুল মালেকের সরকারী বাসভবন গোলকুঠি-তে
১লা অক্টোবর ১৯০৯ তারিখে শুরু করলেন স্বামীর নামে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। স্কুলটি শুরু
হয় মাত্র পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে, যার মধ্যে চার জনই ছিলেন মালেক সাহেবের কন্যা। কিন্তু সেই স্কুল দীর্ঘস্থায়ী
হয় নি, শ্বশুরবাড়ীর আত্মীয়জনদের অত্যাচার অসহনীয় হয়ে ওঠার জন্য। ১৯১০ সালের ৩রা ডিসেম্বর মাসে
তিনি ভাগলপুরের পাট তুলে দিয়ে কলকাতায় মালেক সাহেবের বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
১৯১১ সালের ১৬ মার্চ, ১৩নং ওয়ালিউল্লাহ লেনে বাড়ী ভাড়া করে, আটজন ছাত্রীকে নিয়ে, আবার প্রতিষ্ঠা
করেন কলকাতার সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল। এই বাড়ীতে তিনি নিজেও থাকতেন। মৌলভী সৈয়দ
আহমদ আলী স্কুলের সেক্রেটারী নিযুক্ত হন। ১৯১৩ সালের ৯মে তারিখে স্কুলটি স্থানান্তরিত করা হয় ১৩নং
ইইরোপিয়ান অ্যাসাইলাম লেনে। ১৯১৫ সালে পঞ্চম শ্রেণী শুরু হলে স্কুলটি প্রাইমারি বিদ্যালয়ে উন্নীত করা
হয়। সেই বছরই ২৭শে ফেব্রুয়ারী তারিখে স্কুলের আবার স্থানান্তরিত করা হয় ৮৬এ লোয়ার
সার্কুলার রোডে (অধুনা আচার্য্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড)। ছাত্রি সংখ্যা বেড়ে হলো ৮৪ জন। ১৯২৭ সালে
স্কুলটি ইংরেজী বিদ্যালয়ে পরিণত হলো। শুরু করা হলো কিন্ডারগার্টেন শাখাও। তখন ছাত্রী সংখ্যা ছিল
১২৮। ১৯২৯ সালে ছাত্রী সংখ্যা দাঁড়ালো ১৩৩। ১৯৩১ সালে প্রথমবারের জন্য তিনজন ছাত্রী এই স্কুল থেকে
ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বসে। ৭৫ শতাংশ পাশের হার হয়েছিল সেবার। ১৯৩২ সালে আবার
স্কুলটিকে স্থানান্তরিত করা হয় ১৬২নং লোয়ার সার্কুলার রোডে (অধুনা আচার্য্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড)।
১৯৩৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর তারিখে স্কুলটিকে সরকার অধিগ্রহণ করেন। বর্তমান নাম সাখাওয়াত
মেমোরিয়াল সরকারী বালিকা বিদ্যালয়। এই স্কুলটি আজ পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের অন্যতম
।
স্কুলটির বর্তমান ঠিকানা ১৭নং লর্ড সিনহা রোড, কলকাতা ৭০০০৭১। এই স্কুলের প্রাক্তনীদের ওয়েবসাইটে
যেতে এখানে ক্লিক্ করুন . . . www.sakhawatalumni.com
৯ই ডিসেম্বর ১৯৩২ তারিখে “নারীর অধিকার” লেখাটি অসমাপ্ত রেখেই তিনি পরলোক গমন করেন।
কলকাতার কাছে সোদপুরে কোথাও তাঁকে সমাহিত করা হয়। কিন্তু তার সন্ধান আজ আর কারোরই জানা
নেই।
১৯১৬ সালে বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠা করেন একটি মহিলা সংগঠন “আঞ্জুমান এ খাওয়াতীন এ ইসলাম”। তিনি
নিজে হলেন সাধারণ সম্পাদিকা এবং সভাপতি হলেন আয়েশা খাতুন। মুসলমান নারীসমাজের কল্যাণসাধন,
অচেতন নারীমনে সাড়া জাগানো এবং অসহায় নারীদের সহায়তাই এই সংগঠনের লক্ষ্য ছিল।
তাঁর রচনার মধ্যে রয়েছে প্রবন্ধ-গ্রন্থ “মোতিচূর” (প্রথম খণ্ড, ১৯০৪), কল্পকাহিনী “Sultana’s Dream” (১৯০৮),
প্রবন্ধ-গ্রন্থ “মোতিচূর” (দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯২২), উপন্যাস “পদ্মরাগ” (লেখা ১৯১২, প্রকাশনা ১৯৩৪), নকশাধর্মী
রচনাগ্রন্থ “অবরোধ-বাসিনী” (১৯৩১)। এ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত বহু বাংলা ও
ইংরেজি প্রবন্ধ এবং কবিতা, যা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। ৯ ডিসেম্বর ২০০১ তারিখে কলকাতার ৬০নং
পটুয়াতলা লেনের “বিশ্বকোষ পরিষদ”-এর উদ্যোগে, ডঃ মীরাতুন নাহারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়
“রোকেয়া রচনাসংগ্রহ”। এই গ্রন্থ সেই অভাব পূরণ করতে পেরেছে বলে আমরা মনে করি।
এই মহীয়সী নারী তাঁর কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়ে, নারীবাদের এক নতুন সংজ্ঞা তৈরী করে দিয়ে গেলেন।
আমরা মিলনসাগরে কবি রোকেয়া বেগমের কবিতা তুলে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে
আমাদের এই প্রচেষ্টাকে সফল মনে করবো। এই পাতা তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
কবি বেগম রোকেয়ার মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।
উত্স - ডঃ মীরাতুন নাহারের সম্পাদনায় “রোকেয়া রচনাসংগ্রহ”, ২০০১।
. ডঃ শিশিরকুমার দাশ, সংসদ বাংলা সাহিত্য সঙ্গী, ২০০৩।
. উইকিপেডিয়া
আমাদের ই-মেল - srimilansengupta@yahoo.co.in
এই পাতা প্রকাশ - ১২.৬.২০১৪
ফেসবুক শেয়ার বোতাম - ৯.১২.২০১৬
...