কবি ভবতারিণী দেবীর কবিতা ও গান
*
কাশীযাত্রা
কবি ভবতারিণী দেবী
কাব্যগ্রন্থ শোক-সরযু থেকে নেওয়া, ১৯১৯

       অকালে মুদিল কি রে সরযু কুসুম মোর!
       আর ফুটিবে না কি মা! ফুরালো কি ফোটা তোর?
       আর হেরিব না কি মা, ও হাসি বদন খানি,
       আর শুনিব না কি মা, ও চারু অমিয় বাণী,
       চির মেঘে লুকাল কি আমার হৃদয়-শশী,
       চির তমসার তলে এবে কি রহিব বসি?
       ভাগ্যবতী চলে গেল, সারিয়া আপন কাজ,
       অভাগিনী মার---প্রাণে হানিয়া কঠোর বাজ।
সরযু!  তুই মোর একমাত্র ছিলি রে সুখের খনি,
       এ সংসারে একমাত্র মা বলিতে যাদুমণি!
       অল্পেতে বিধবা আমি হইয়া সরযুবালা,
       তোরে বুকে নিয়ে শুধু ভুলেছিনু সব জ্বালা।
       রাখিতাম সদা তোরে নয়নে নয়নে করি,
       ছাড়িতে না পারিতাম তিলেক পরাণ ধরি।
       তুইও ছিলিরে মায়ের ছায়া সম অনুগামী,
       তোরে হারাইয়া তবু বেঁচে কেন আছি আমি!
       তোরি ত মায়াতে মাগো আত্মীয় স্বজন ছাড়ি,
       জামাতা-ভবনে এসে পেতেছিনু ঘর বাড়ী ;
       তার সমুচিত ফল পেয়েছি পেয়েছি আমি,
       গৃহহীনা পথহীনা কাঁদি রে দিবস-যামী।
       মণিহারা ফণীসম লুটাইয়া যাতনায়
       উঠি শুধু চেয়ে তোর পতি পুত্র তনয়ায়।
       এ ভাবেতে বল! আর কাটাইব কতকাল,
       হে বিভু! করুণা কর তুমি যে দীনদয়াল।
       ঘুচাও আমার যত রোগ শোক মনস্তাপ,
       মরণ শান্তির জলে সান্ত করে দাও পাপ।
       কোথায় আছরে আজ প্রাণের সরযু ধন!
       কেন সব ফেলে চলে গেলে গো মা অকারণ?
       তনয় তনয়া তব একেবারে শিশু অতি
       ‘মা’ ‘মা’ বলে কেঁদে সারা---কি হবে তাদের গতি?
       আয় মা আয় মা ছুটে তুলেনে তাদের কোলে।
       না না, তুই কোথা! তুই নেই যে, গেছিস চলে!
       হায় হায় ও কমলে ছিল কি কীটের বাস
       একবিংশ বয়সেতে করিল জীবন নাশ।
       কোথা গেলি কোথা গেলি, ওরে মোর শতদল
       ওরে মোর প্রেমময়ী ওরে মোর নিরমল?
       একবার যে হেরেছে মধুর মূরতি তোর
       ভুলিতে পারেনি সে যে, ওরে নিরদয় চোর।
       ওরে সতী পতিব্রতা সদা পতিরত মন,
       প্রমদারঞ্জন বুকে প্রেমদা হৃদি-রঞ্জন।
       শ্বাশুড়ীর প্রাণাধিক প্রিয় আদরের বধু,
       পান করিতেন তিনি তোর মুখ-পদ্ম-মধু।
       হেরিলে শুকানো মুখ থুটে গিয়ে তাড়াতাড়ি,
       নিজ হাতে খাওয়াতেন এত ছিল বাড়াবাড়ি।
       সকলের ছিলি তুই অতি আদরের ধন,
       কেউত কখন তোরে করেনি মা অযতন।
       তবে কোন্ অপরাধে কোন্ অভিমানে ধনি,
       আমা সবে কাঁদাইয়া ছেড়ে গেলি এ ধরণী?
       যখন মনেতে তোর যে বাসনা জাগিয়াছে,
       অমনি, পূরেছে তাহা, কিছুই না বাকি আছে।
       পুত্রের হিতের লাগি বায়ু সেবনের তরে,
       প্রবাসে চাহিলে যেতে কত না হরষ ভরে।
       তের শ এগার সন কাল আশ্বিনের মাস,
       তাইত গেলাম সেই নিদারুণ-কাশীবাস।
       দরশন করি বুঝি পুণ্য ভূমি কাশীধাম,
       হয়ে গেল তোর মাগো পরিপূর্ণ মনস্কাম।
       তথায়, যে বিশ্বনাথে, না পূজিয়া কোনদিন,
       করিতে না জলপান সেই চির ভক্তাধীন
       তুষ্ট হয়ে, অবশেষে আদরে নিকটে তিনি
       ডাকিয়া নিলেন তোরে সুপবিত্রা সুহাসিনি?

.        
              *****************

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
গঙ্গাস্নান বিশ্বনাথ দর্শন
কবি ভবতারিণী দেবী
কাব্যগ্রন্থ শোক-সরযু থেকে নেওয়া, ১৯১৯

একে একে পঞ্চমাস কাশীবাস করি,
সরযু উঠিল মোর দিব্য তেজে ভরি---
কি আনন্দ কি উত্সাহ কি আগ্রহ ছিল তার ;
পদব্রজে হেরিবারে প্রতি মূর্ত্তি দেবতার।
রাজার ঘরণী হয়ে গজেন্দ্রগামিনী ধীরে
প্রতিদিন ঘুরিতেন মন্দিরে জাহ্নবী-তীরে
মনে পড়ে কতদিন প্রত্যুষে সিনান লাগি
রাত্রি শেষ প্রহরেতে উঠি থাকিতেন জাগি
মনে পড়ে পুণ্য তিথি সপ্তমীতে মোর সনে
জাহ্নবী গাহনে মাতা চলিলেন ফুল্লমনে।
অবগাহি, সে পবিত্র সলিলে সাঞ্জলি করে
দিলেন গো অর্ঘ্য দীননাথে অতি ভক্তিভরে।
পরে পূর্ণানন্দময়ী কত আনন্দিত মনে
চলিলেন সব চিন্তা ভুলি শম্ভু-দরশনে।
না জানি মা আমার কি মনের মানস করে,
পূজিলেন মুক্তিদাতা বিশ্বপিতা বিশ্বেশ্বরে।
তার প্রেম ভক্তিতে প্রসন্ন হয়ে গো প্রসন্ন,
তারে রাখিলেন নিজে পাশে করি অতি ধন্য।
আহা! কি ভাগ্যবানের বোঝা ভগবানে বয়,
তা’ তো’ দেখিলাম নিজ চক্ষে কভু মিথ্যা নয়।
আমি অভাগী বলে, বিশ্বনাথ না লয়ে মোরে,
লইলেন মোর সেই ভাগ্যবতী তনয়ারে।
ওরে মূঢ়মতি মন কেন নিন্দা বিধাতায়,
নিজ কর্ম্মফলে ভোগ তিনি কি করিবেন হায়!
থাক্ আর নাহি কাজ ও কথার প্রসঙ্গে,
মাতা পুরী হতে বাহিরিয়া শ্বাশুড়ীর  সঙ্গে
উপনীত হল আসি অন্নপূর্ণার মন্দিরে,
অতি ভক্তিভর্ বিধিমতে পূজিলেন তাঁরে।
পরে মার কাছে লয়ে গো জনমের বিদায়
আসি পড়িলেন ঢুণ্ডীরাজ গণেশের পায়।
পার্ব্বতীর প্রিয় পুত্র সিদ্ধিদাতার নিকটে,
ক্ষণকাল দাঁড়াইয়া পূজিলেন অকপটে।
এইরূপে সব দেবদেবী করিয়া পূজন,
মার আমার হইল অতি হরষিত মন।
পথশ্রীন্ত ক্লান্ত দেহ তাই অতি ধীরে ধীরে,
আসিছেন গজেন্দ্রগমনে ভবনে ফিরে।
আসি পতিপদে ভক্তিভরে করিল প্রণাম
আহা! যে পদ হয় গো সতীর মুক্তির সোপান।
তার পরে দেখিলেন দুটী তনয়া রতন।
অঙ্কে তুলি তাদের করিলেন মুখ চুম্বন,
আর কি তারা পাবে না মার কোলে সে যতন?

.               *****************

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
উপসংহার
কবি ভবতারিণী দেবী
কাব্যগ্রন্থ শোক-সরযু থেকে নেওয়া, ১৯১৯

একে মোরা নারী জাতি।                সহজেই অল্পমতি॥
তাহে নাহি শিক্ষা অতি।                ভাল ব্যাকরণ পুঁথি॥
কোথা পাব ভাব শুদ্ধি।                 পারিনি সাজাতে পংক্তি॥
নহে কবি-লেখা মোর।                  হল না লেখার জোর॥
উচু আশা হল নিচু।                    না পুরিল আশা কিছু॥
শোকে তাপে গাগলিনী।                বকিনু কি বকা আমি॥
না নিভিল শোকানল।                  মন দহিল কেবল॥
সুখলেশ নাহি জানি।                  আমি জনম দুখিনী॥
তাই বুঝি সরস্বতী।                    না চাহিল মমপ্রতি॥
নহে দোষ মাতঃ তব।                 মম কর্মফলৌদ্ভব॥
নাহিক ভাগ্যের বল।                  কেমনে ফলিবে ফল॥
চিরদিন আশা করে।                  থাকি আমি যারে ধরে॥
ভাসায় সে অশ্রুনীরে।                 যায় পার্শ্বে ফেলে মোরে॥
ভেবে তনু হল ক্ষীণ।                  কেমনে কাটাব দিন॥
চির রোগাধীন দেহ।                   মোরে নাহি চাহে কেহ॥
পড়েছি পাথারে আমি।                লও মাত কোলে তুমি॥
নিয়ে চল শান্তি ধামে।                 বৃথা কেন ধরাধামে॥
রাখিয়াছ ফেলে মোরে।               দিতে দুঃখ বারে বারে॥
আর নাহি সহে দুঃখ।                 গেছে মোর সব সুখ॥
নির্ব্বাপিত দীপ প্রায়।                 জীবন রয়েছে হায়॥
নেবে নেবে নাহি নেবে।               একি দায় হল এবে॥
আর নাহি সহ্য হয়।                   সে অসহ্য যাতনায়॥
হয়েছি কাতরা অতি।                কোথা মাগো ভগবতী॥
একবার কৃপাদৃষ্টি।                    কর কিঙ্করীর প্রতি॥
দাও আসি পদছায়া।                 হোক্ তার শান্তি কায়া॥
বিনা তুমি মহামায়া।                 কে আর করিবে দয়া॥
দাও গো নিবায়ে তার।                জ্বলন্ত জীবন ভার॥
আজ এই ভিক্ষা যাচে।                ভিখারিণী তব কাছে॥
পেলে আশ্বাসের বাণী।                চলে যাই অনাথিনী॥
তোমরাও ভগ্নিগণ।                    শুন মম নিবেদন॥
এসেছি তোদের কাছে।                বলিবার কিছু আছে॥
ক্ষমি দোষ ধর গুণ।                  করো মিনতি পূরণ॥
শোক সরোজের প্রতি।                করো সবে কৃপা দৃষ্টি॥
ঋণে গড়া তার দেহ।                 দয়া করে সবে চাহ॥
হয় গো সে অতি নিঃস্ব।              দয়ার সাগর বিশ্ব॥
করে দিও মুক্তি পার।                মাগে ভিক্ষা প্রতিকার॥

.               *****************

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
ও কেলে মাগি তুই চোখের মাথা খেয়ে
গান
কবি ভবতারিণী দেবী
কাব্যগ্রন্থ শোক-সরযু থেকে নেওয়া, ১৯১৯

ও কেলে মাগি তুই চোখের মাথা খেয়ে
একবার দেখলি না কো মেয়ের পানে চেয়ে,
তার মাথায় দিয়েছ দুখের ভরা
( যত পেয়েছ তত দিয়েছ )
ভরা ছাপিয়ে ওগো পড়েছে ধরা
কঠিন প্রাণে মাগো দেখ দাঁড়ায়ে,
এ কাউকে নাচিয়ে তুলেছ উপরে
কাউকে লুটালি মা ধরণী তলে।
কত র এক চখোমি বলব নাকি ভয়ে?
বুকে মেরেছ কেঁচা                        প্রাণে লেগেছে দারুণ ব্যথা
ব্যথা পেয়ে মুখে ফুটেছে কথা
এখন পড়া পাখী বোল ধরেছে,
সে তো থাকবে না কো সয়ে।
এখন বলছে ভব কেমন করে মা মুখ দেখাবি লোক-সমাজে গিয়ে।

.   *****************   

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কতই রঙ্গে ফেরগো মা রণরঙ্গিণি
শ্যামা সঙ্গীত
কবি ভবতারিণী দেবী
কাব্যগ্রন্থ শোক-সরযু থেকে নেওয়া, ১৯১৯

কতই রঙ্গে ফেরগো মা রণরঙ্গিণি।
কখন বসন পড়া,                কভু অসি ধরা
হও মা কখন এলোকেশী উলঙ্গিণী।
ভক্তের মন তুষিতে                মাগোশৈল সুতে!
নানা রূপে আসি দেখা দিলে এ মহীতে।
তুমি ভক্তবাঞ্ছা কল্পতরু ও মাতঙ্গিণী!
কখনো হো মা উগ্রচণ্ডা নৃমুণ্ডমালিনী,
কখনও হও মা মধুর শ্বেত সরোজ-বাসিনী।
কখনো হও মা দশভূজা মহিষ মর্দ্দিনী।
কখনো হও মা চতুর্ভূজা সিংহ বাহিনী।
গোপী গোষ্ঠে হেরি তোরে অষ্টভূজা গিরিনন্দিনী
না পেয়ে তোমার অন্ত মাগো অনন্তরূপিনি!
ভব এসে হলেন তব চরণ ভিখারিনী।

.   *****************   

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কালী পদ ও কি অতুল সম্পদ
শ্যামা সঙ্গীত
কবি ভবতারিণী দেবী
কাব্যগ্রন্থ শোক-সরযু থেকে নেওয়া, ১৯১৯

কালী পদ ও কি অতুল সম্পদ!
চিনলি নারে আমার মন অবোধ সে পদ
শব রূপে শিব যার পদতলে,
আছেন পড়ে নীরবেতে কুতূহলে।
এ হেন মায়ের চরণ কমলে,
ও মন ভোমরা তুই রৈলিনা ভুলে!
ভাল যদি চাও রাঙা পদে ধাও,
লভিলে সে পদ না রবে বিপদ,
ডঙ্কা মেরে চলে যাবি পাবি ব্রহ্মপদ
চেয়ে থাকবে যত যমের দূত॥

.   *****************   

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
আমার বাবা পাগল, মা পাগলী
শ্যামা সঙ্গীত
কবি ভবতারিণী দেবী
কাব্যগ্রন্থ শোক-সরযু থেকে নেওয়া, ১৯১৯

আমার বাবা পাগল, মা পাগলী,
তাইতে আমিও পাগলিনী                জানে সকলি,
কালী নামের ধ্বনি তুলি,
যাব গেয়ে পথের অলি, গলি,
সবাই বলবে মাগীর হল কুমতি।
বলে বলুক মন তাতে নাইকো ক্ষতি!
আমার হৃদয় ভরা যে কালী,
তাতে এসে মিশেছেন মা কালী,
ওরে বিধি কি সুখের সংযোগ ঘটালি,
আমার আঁধার হৃদে কালী নামের বাতি জ্বালালি।

.   *****************   

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর