কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রর কবিতা |
রতি বিলাপ কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র পতি শোকে রতি কাঁদে বিনাইয়া নানা ছাঁদে ভাসে চক্ষু জলের তরঙ্গে | কপালে কঙ্কণ মারে রুধির বহিছে ধারে কাম-অঙ্গ ভস্ম লেপে অঙ্গে || আলু-খালু কেশ-বাস ঘন ঘন বহে শ্বাস সংসার পূরিল হাহাকার | কোথা গেল প্রাণনাথ আমারে কর সাথ তোমা বিনা সকলি আঁধার || তুমি কাম আমি রতি আমি নারী তুমি পতি দুই অঙ্গ একই পরাণ | প্রথমে যে প্রীতি ছিল শেষে তাহা না রহিল পিরীতির এ নহে বিধান || না দেখিব সে বদন না হেরিব সে নয়ন না শুনিব সে মধুর বাণী | আগে মরিবেন স্বামী পশ্চাতে মরিব আমি এত দিন ইহা নাহি জানি || আহা আহা হরি হরি উহু উহু মরি মরি হায় হায় গোসাঁই গোসাঁই | হৃদয়েতে দিতে স্থান করিতে কতেক মান এখন দেখিতে আর নাই || শিব শিব শিব নাম সব বলে শিবধাম বামদেব আমার কপালে | যার দৃষ্টে মৃত্যু হরে তার দৃষ্টে প্রভু মরে এমন না দেখি কোন কালে || শিবের কপালে রয়ে প্রভুরে আহুতি লয়ে না জানি বাড়িল কিবা গুণ | একের কপালে রহে আরের কপাল দহে আগুনের কপালে আগুন || অনলে শরীর ঢালি তথাপি রহিল গালি মদন মরিলে মৈল রতি | এ দুঃখে হইতে পার উপায় না দেখি আর মরিলেও নাহি অব্যাহতি || আরে নিদারুণ প্রাণ কোন পথে পতি যান আগে যারে পথ দেখাইয়া | চরণ-রাজীব-রাজে মনঃশিলা পাছে বাজে হৃদে ধরি লহ রে বহিয়া || আরে রে মলয়-বাত তোরে হৌক বজ্রাঘাত মরে যা রে ভ্রমরা কোকিলা | বসন্ত অল্পাযু হও বন্ধু হইয়া বন্ধু নও প্রভু বধি সবে পলাইলা || কোথা গেল সুররাজ মোর মুণ্ডে হানি বাজ সিদ্ধ কৈলা আপনার কর্ম | অগ্নিকুণ্ড দেহ জ্বালি আমি তাহে দেহ ঢালি অন্তকালে কর এই ধর্ম || বিরহ-সন্তাপ যত অনলে কি তাপ তত কত তাপ তপনের তাপে | ভারত বুঝায়ে কয় কাঁদালে কি আর হয় এই ফল বিরহীর শাপে || . ************** . সূচিতে মিলনসাগর |
হরিহোড়ের বৃতান্ত কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র অন্নদার দাস হয়ে হরিহোড় নাম লয়ে বসুন্ধর ভূমিষ্ঠ হইল | দেখিয়া পুত্রের মুখ বিষ্ণু হোড় পায় সুখ পদ্মিনীর আনন্দ বাড়িল || ষষ্ঠি পূজা হৈল সায় ছয় মাসে অন্ন খায় যুবা হৈল নানা দুঃখ পায়ে | বনে মাঠে বেড়াইয়া কাঠঘুঁটে কুড়াইয়া বেচিয়া পোষয়ে বাপ-মায়ে || এক দিন শূণ্য পথে অন্নপূর্ণা সিংহরথে কুতূহলে ভ্রমিতে ভ্রমিতে | জয়া বিজয়ার সঙ্গে কথোপকথন-রঙ্গে হরিহোড়ে পাইলা দেখিতে || মনে হৈল পূর্ব কথা আপনি আসিয়া তথা মায়া করি হইলেন বুড়ী | কাঠ খড় জড়াইয়া সব ঘুঁটে কুড়াইয়া রাখিলেন ভরি এক ঝুড়ি || হরিহোড় যেথা যান কাঠ ঘুঁটে নাহি পান আট দিক আন্ধার দেখিলা | বিস্তর রোদন করি হরি হরি স্মরে হরি বুড়ীটিরে দেখিতে পাইলা || দেখেন বুড়ীর কাছে ঝুড়ি ভরা ঘুঁটে আছে বোঝাবান্ধা কাঠ আছে তায় | হরিহোড় কান্দি কহে বুড়ি মজাইল দহে আজি বড় দেখি অনুপায় || কোথা হইতে আসি বুড়ী ঘুঁটে লয়ে ভরে ঝুড়ি সর্বনাশ করিল আমার | কাড়ি নিলে হবে পাপ বুড়ী পাছে দেয় শাপ এ দুঃখের নাহি দেখি পার || বৃদ্ধ পিতা-মাতা ঘরে আকুল অন্নের তরে ঘুঁটে বেচা আমার সম্বল | কিছু ঘুঁটে না পাইনু মিছে বেলা মজাইনু এ ছার জীবনে কিবা ফল || দয়া করি হরপ্রিয়া হরিহোড়ে ডাক দিয়া ছল করি লাগিলা কহিতে | কাঠঘুঁটে কুড়াইয়া রাখিয়াছি সাজাইয়া অরে বাছা না পারি বহিতে || মঙ্গল হইবে তোর অতি দূরে ঘর মোর ঘুঁটেগুলি যদি দেহ বয়ে | অর্ধেক আমার হবে অর্ধেক আপনি লবে দয়া করে চল মোরে লয়ে || হরিহোড় এত শুনি অর্ধলাভ মনে গুণি মাথায় লইয়া ঘুঁটে ঝুড়ি | বাতে কুঁজে বেঁকে বেঁকে লড়ী ধরে থেকে থেকে আগে আগে চলিলেন বুড়ী || নিকটে হরির ঘর নহে অতি দূরতর সাঁঝ কৈলা সেইখানে যেতে | তাহারি উঠানে গিয়া বসিলেন হরপ্রিয়া কহেন চলিতে নারি রেতে || কহিলা মধুর স্বরে থাকিলাম তোর ঘরে হরি বলে এ হবে কেমনে | ভাঙ্গা কুড়ে ছাওয়া পাতে বৃদ্ধ পিতা মাতা তাতে ঠাঁই নাহি হয় চারি জনে || অতিথি আপনি হবে উপোসী কেমনে রবে অন্নের সংযোগ মোর নাই | হেন ভাগ্য নাহি ধরি অতিথি সেবন করি এই বেলা দেখ আর ঠাঁই || এই দেখ বৃদ্ধ বাপ অন্ন বিনা পান তাপ বৃদ্ধ মাতা অন্ন বিনা মরে | গেল চারিপ'র দিন অন্ন বিনা আমি ক্ষীণ যম-যোগ্য অতিথি এ ঘরে || হরির শুনিয়া বাণী কহেন হরের রাণী আরে বাছা না ভাবিহ দুখ | ভারত সান্ত্বনা করে অন্নদা আইল ঘরে ইতঃপর পাবে যত সুখ || . ************** . সূচিতে মিলনসাগর |