কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রর কবিতা
*
শিবের দক্ষালয়ে যাত্রা                  
কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র

মহা রুদ্ররূপে মহাদেব সাজে |
ভবম্ভম্ ভবম্ভম্ শিঙা জোর বাজে ||
লাটাপট জটাজুট সংঘট্ট গঙ্গা |
ছলচ্ছল টলট্টল কলক্কল তরঙ্গা ||
ফণাফণ্ ফণাফণ্ ফণীফন্ন গাজে |
দীনেশ প্রতাপে নিশানাথ সাজে ||
ধকধ্বক্ ধকধ্বক্ জ্বলে বহ্নি ভালে |
ববম্বম্ ববম্বম্ মহাশব্ দ গালে ||
সহস্রে সহস্রে চলে ভূত দানা |
হুহুঙ্কার হাঁকে উড়ে সর্পফণা ||
চলে ভৈরবা ভৈরবী নন্দী ভৃঙ্গী |
মহাকাল বেতাল তাল ত্রিশৃঙ্গী ||
তলে ডাকিনী যোগিনী ঘোর বেশে |
চলে শাঁখিনী পেতিনী মুক্তকেশে ||
গিয়া দক্ষযজ্ঞে সবে যজ্ঞনাশে |
কথা না সরে দক্ষরাজে তরাসে ||
অদূরে মহারুদ্র ডাকে গম্ভীরে |
অরে রে অরে দক্ষ দে রে সতীরে ||
ভুজঙ্গপ্রয়াতে কহে ভারতী সে |
সতী দে সতী দে সতী দে সতী দে ||


.          **************                                                 
সূচিতে      

মিলনসাগর
*
অন্নদার ভবানন্দ ভবনে যাত্রা  
কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র

অন্নপূর্ণা উত্তরিলা গাঙ্গিনীর তীরে |
পার কর বলিয়া ডাকিলা পাটনীরে ||
সেই ঘাটে খেয়া দেয় ঈশ্বরী পাটনী |
ত্বরায় আনিল নৌকা বামাস্বর শুনি ||
ঈশ্বরীরে জিজ্ঞাসিল ঈশ্বরী পাটনী |
একা দেখি কুলবধূ কে বট আপনি ||
পরিচয় না দিলে করিতে না পরি পার |
ভয়করি কি জানি কে দেবে ফেরফার ||
ঈশ্বরীরে পরিচয় কহেন ঈশ্বরী |
বুঝহ ঈশ্বরী আমি পরিচয় করি ||
বিশেষণে সবিশেষ কহিবারে পারি |
জানহ স্বামীর নাম নাহি ধরে নারী ||
গোত্রের প্রধান পিতা মুখবংশজাত |
পরমকুলীন স্বামী বন্দ্যবংশখ্যাত ||
পিতামহ দিলা মোরে অন্নপূর্ণা নাম |
অনেকের পতি তেঁই পতি মোর বাম ||
অতি বড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপূণ |
কোন গুণ নাহি তাঁর কপালে আগুন ||
কুকথায় পঞ্চমুখ কণ্ঠভরা বিষ |
কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ ||
গঙ্গা নামে সতা তার তরঙ্গ এমনি |
জীবনস্বরূপা সে স্বামীর শিরোমণি ||
ভূত নাচাইয়া পতি ফেরে ঘরে ঘরে |
না মরে পাষাণ বাপ দিলা এমন বরে ||
অভিমানে সমুদ্রেতে ঝাপ দিলা ভাই |
যে মোরে আপনা ভাবে তারি ঘরে যাই ||
পাটনী বলিছে আমি বুঝিনু সকল |
যেখানে কুলীন জাতি সেখানে কন্দল ||
শীঘ্র আসি নায়ে চড় দিবা কিবা বল |
দেবী কন দিব আগে পারে লয়ে চল ||
যার নামে পার করে ভবপারাবার |
ভাল ভাগ্য পাটনী তাহারে করে পার ||
বসিলা নায়ের বাড়ে নামাইয়া পদ |
কিবা শোভা নদীতে ফুটিল কোকনদ ||
পাটনী বলিছে মাগো বৈস ভাল হয়ে |
পায়ে ধরে কি জানি কুমিরে যাবে লয়ে ||
ভবানী কহেন তোর নায়ে ভরা জল |
আলতা ধুইবে পদ কোথা থুব বল ||
পাটনি বলিছে মাগো শুন নিবেদন |
সেঁউতি উপরে রাখ রাঙা চরণ ||
পাটনীর বাক্যে মাতা হাসিয়া অন্তরে |
রাখিলা দুখানি পদ সেঁউতি উপরে ||
সেঁউতিতে পদ দেবী রাখিতে রাখিতে |
সেঁউতি হইল সোনা দেখিতে দেখিতে ||
সোনার সেঁউতি দেখি পাটনীর ভয় |
এ ত মেয়ে মেয়ে নয় দেবতা নিশ্চয় ||
তীরে উত্তরিল তরী তারা উত্তরিলা |
পূর্বমুখে সুখে গজগমনে চলিলা ||
সেঁউতি লইয়া কক্ষে চলিলা পাটনী |
পিছে দেখি তারে দেবী ফিরিলা আপনি ||
সভয়ে কহা পাটনী চক্ষে বহে জল |
দিয়াছ যে পরিচয় তা বুঝিনু ছল ||
যে দয়া করিল মোর এ ভাগ্য উদয় |
সেই দয়া হইতে মোরে দেহ পরিচয় ||
ছাড়াইতে নারি দেবী কহিলা হাসিয়া |
কহিয়াছি সত্যকথা বুঝহ ভাবিয়া ||
আমি দেবী অন্নপূর্ণা প্রকাশ কাশীতে |
চৈত্র মাসে মোর পূজা শুক্লা অষ্টমীতে ||
কতদিন ছিনু হরি হোড়ের নিবাসে |
ছাড়িলাম তার বাড়ি কন্দলের ত্রাসে ||
ভবানন্দ মুকুন্দার নিবাসে রহিব |
বর মাগ মনোনীত যাহা চাহ দিব ||
প্রণমিয়া পাটনী কহিছে জোড় হাতে |
আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে ||
তথাস্তু বলিয়া দেবী দিলা বরদান |
দুধে ভাতে থাকিবেক তোমার সন্তান ||
বর পেয়ে পাটনী ফিরিয়া ঘাটে যায় |
পুনর্বার ফিরে চাহে দেখিতে না পায় ||


.              **************   
.                                                                       
সূচিতে         

মিলনসাগর
*
রতি বিলাপ
কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র

পতি শোকে রতি কাঁদে                বিনাইয়া নানা ছাঁদে
ভাসে চক্ষু জলের তরঙ্গে |
কপালে কঙ্কণ মারে                      রুধির বহিছে ধারে
কাম-অঙ্গ ভস্ম লেপে অঙ্গে ||
আলু-খালু কেশ-বাস                       ঘন ঘন বহে শ্বাস
সংসার পূরিল হাহাকার |
কোথা গেল প্রাণনাথ                       আমারে কর সাথ
তোমা বিনা সকলি আঁধার ||
তুমি কাম আমি রতি                 আমি নারী তুমি পতি
দুই অঙ্গ একই পরাণ |
প্রথমে যে প্রীতি ছিল                  শেষে তাহা না রহিল
পিরীতির এ নহে বিধান ||
না দেখিব সে বদন                       না হেরিব সে নয়ন
না শুনিব সে মধুর বাণী |
আগে মরিবেন স্বামী                    পশ্চাতে মরিব আমি
এত দিন ইহা নাহি জানি ||
আহা আহা হরি হরি                       উহু উহু মরি মরি
হায় হায় গোসাঁই গোসাঁই |
হৃদয়েতে দিতে স্থান                    করিতে কতেক মান
এখন দেখিতে আর নাই ||
শিব শিব শিব নাম                       সব বলে শিবধাম
বামদেব আমার কপালে |
যার দৃষ্টে মৃত্যু হরে                      তার দৃষ্টে প্রভু মরে
এমন না দেখি কোন কালে ||
শিবের কপালে রয়ে                    প্রভুরে আহুতি লয়ে
না জানি বাড়িল কিবা গুণ |
একের কপালে রহে                     আরের কপাল দহে
আগুনের কপালে আগুন ||
অনলে শরীর ঢালি                       তথাপি রহিল গালি
মদন মরিলে মৈল রতি |
এ দুঃখে হইতে পার                  উপায় না দেখি আর
মরিলেও নাহি অব্যাহতি ||


আরে নিদারুণ প্রাণ                    কোন পথে পতি যান
আগে যারে পথ দেখাইয়া |
চরণ-রাজীব-রাজে                     মনঃশিলা পাছে বাজে
হৃদে ধরি লহ রে বহিয়া ||
আরে রে মলয়-বাত                   তোরে হৌক বজ্রাঘাত
মরে যা রে ভ্রমরা কোকিলা |
বসন্ত অল্পাযু হও                          বন্ধু হইয়া বন্ধু নও
প্রভু বধি সবে পলাইলা ||
কোথা গেল সুররাজ                   মোর মুণ্ডে হানি বাজ
সিদ্ধ কৈলা আপনার কর্ম |
অগ্নিকুণ্ড দেহ জ্বালি                   আমি তাহে দেহ ঢালি
অন্তকালে কর এই ধর্ম ||
বিরহ-সন্তাপ যত                       অনলে কি তাপ তত
কত তাপ তপনের তাপে |
ভারত বুঝায়ে কয়                    কাঁদালে কি আর হয়
এই ফল বিরহীর শাপে ||


.     **************    
.                                                                                          
সূচিতে     


মিলনসাগর
*
হরিহোড়ের বৃতান্ত
কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র

অন্নদার দাস হয়ে                    হরিহোড় নাম লয়ে
বসুন্ধর ভূমিষ্ঠ হইল |
দেখিয়া পুত্রের মুখ                  বিষ্ণু হোড় পায় সুখ
পদ্মিনীর আনন্দ বাড়িল ||
ষষ্ঠি পূজা হৈল সায়                  ছয় মাসে অন্ন খায়
যুবা হৈল নানা দুঃখ পায়ে |
বনে মাঠে বেড়াইয়া                 কাঠঘুঁটে কুড়াইয়া
বেচিয়া পোষয়ে বাপ-মায়ে ||
এক দিন শূণ্য পথে                 অন্নপূর্ণা সিংহরথে
কুতূহলে ভ্রমিতে ভ্রমিতে |
জয়া বিজয়ার সঙ্গে                   কথোপকথন-রঙ্গে
হরিহোড়ে পাইলা দেখিতে ||
মনে হৈল পূর্ব কথা               আপনি আসিয়া তথা
মায়া করি হইলেন বুড়ী |
কাঠ খড় জড়াইয়া                    সব ঘুঁটে কুড়াইয়া
রাখিলেন ভরি এক ঝুড়ি ||
হরিহোড় যেথা যান                কাঠ ঘুঁটে নাহি পান
আট দিক আন্ধার দেখিলা |
বিস্তর রোদন করি                 হরি হরি স্মরে হরি
বুড়ীটিরে দেখিতে পাইলা ||
দেখেন বুড়ীর কাছে              ঝুড়ি ভরা ঘুঁটে আছে
বোঝাবান্ধা কাঠ আছে তায় |
হরিহোড় কান্দি কহে                 বুড়ি মজাইল দহে
আজি বড় দেখি অনুপায় ||
কোথা হইতে আসি বুড়ী           ঘুঁটে লয়ে ভরে ঝুড়ি
সর্বনাশ করিল আমার |
কাড়ি নিলে হবে পাপ            বুড়ী পাছে দেয় শাপ
এ দুঃখের নাহি দেখি পার ||


বৃদ্ধ পিতা-মাতা ঘরে                আকুল অন্নের তরে
ঘুঁটে বেচা আমার সম্বল |
কিছু ঘুঁটে না পাইনু                 মিছে বেলা মজাইনু
এ ছার জীবনে কিবা ফল ||
দয়া করি হরপ্রিয়া                  হরিহোড়ে ডাক দিয়া
ছল করি লাগিলা কহিতে |
কাঠঘুঁটে কুড়াইয়া                    রাখিয়াছি সাজাইয়া
অরে বাছা না পারি বহিতে ||
মঙ্গল হইবে তোর                    অতি দূরে ঘর মোর
ঘুঁটেগুলি যদি দেহ বয়ে |
অর্ধেক আমার হবে                   অর্ধেক আপনি লবে
দয়া করে চল মোরে লয়ে ||
হরিহোড় এত শুনি                     অর্ধলাভ মনে গুণি
মাথায় লইয়া ঘুঁটে ঝুড়ি |
বাতে কুঁজে বেঁকে বেঁকে           লড়ী ধরে থেকে থেকে
আগে আগে চলিলেন বুড়ী ||
নিকটে হরির ঘর                       নহে অতি দূরতর
সাঁঝ কৈলা সেইখানে যেতে |
তাহারি উঠানে গিয়া                     বসিলেন হরপ্রিয়া
কহেন চলিতে নারি রেতে ||
কহিলা মধুর স্বরে                     থাকিলাম তোর ঘরে
হরি বলে এ হবে কেমনে |
ভাঙ্গা কুড়ে ছাওয়া পাতে          বৃদ্ধ পিতা মাতা তাতে
ঠাঁই নাহি হয় চারি জনে ||
অতিথি আপনি হবে                 উপোসী কেমনে রবে
অন্নের সংযোগ মোর নাই |
হেন ভাগ্য নাহি ধরি                   অতিথি সেবন করি
এই বেলা দেখ আর ঠাঁই ||
এই দেখ বৃদ্ধ বাপ                     অন্ন বিনা পান তাপ
বৃদ্ধ মাতা অন্ন বিনা মরে |
গেল চারিপ'র দিন                   অন্ন বিনা আমি ক্ষীণ
যম-যোগ্য অতিথি এ ঘরে ||
হরির শুনিয়া বাণী                      কহেন হরের রাণী
আরে বাছা না ভাবিহ দুখ |
ভারত সান্ত্বনা করে                   অন্নদা আইল ঘরে
ইতঃপর পাবে যত সুখ ||


.            **************            
.                                                                                            
সূচিতে     


মিলনসাগর