কবি বিজয় গুপ্ত-র মনসামঙ্গল কাব্য
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
১  
মনসার জন্ম পালা

গৌরী কোন্দল পালা     

মনসা বিবাহ পালা     

অষ্ট নাগের জন্ম পালা   

অমৃত মথন পালা   

বনবাস পালা       

হাসন হুসন যুদ্ধ পালা     

গুয়াবাড়ি কাটা পালা       

ধন্বন্তরি বধ পালা     
১০
ছয় কুমার বধ পালা     
  ১. হেন মতে শঙ্কুর বধ করিল মনসায়    
২. বেদগুরু ভক্ত চান্দ ছোট জন নহে   
৩. সাজিল যে বিষহরি পদ্মা শিবের কুমারী    
৪.গীত শুনিয়া চান্দর হৃদয় হইল রঙ্গ    
৫. মনসা নয়ন-কোণে সঘনে কটাক্ষ হানে    
৬. কামে অচেতন চান্দ না করে বিচার   
৭. মোরে লাজ দিল কাণী চক্ষুতে পড়য়ে পানী     
৮. বিষাদ ভাবিয়া  কান্দে চান্দ অধিকারী   
৯. মহাজ্ঞান গেল চান্দর টুটিলেক বল   
১০. ভূমিতলে গড়ি দিয়া  দুই হাত প্রসারিয়া   
১১. চম্পক নগরের রাজা নাম চন্দ্রধর   
১২. কোন ছার দেব হয় লঘুজাতি কাণী   
১১
ঝালুবাড়ির পূজা পালা  
১২
যমযুদ্ধ পালা      
১৩
যাত্রাপাটন পাটন পালা     
১৪
বস্তুবদল পালা     
১৫
ডিঙ্গা বুড়ান, লক্ষ্মীন্দরের জন্ম ও চান্দ লাঞ্ছনা পালা
১৬
লখিন্দরের বিবাহের জোড়ানি পালা    
১৭
লোহার বাসর ঘর নির্মাণ পালা     
১৮
লখিন্দর বিবাহ পালা       
১৯
লখিন্দর দংশন পালা   
২০
ভাসান পালা      
২১
স্বর্গারোহণ পালা     
মন্ত্রবলে উপবন ততক্ষণে জীল  ||
ডালে পাতে ফল ফুলে আমোদিত গন্ধে |
ভ্রমে ভ্রমর মধুপে যত মকরন্দে  ||
উপবন জীয়াইয়া সাধু যায় ঘর |
চিন্তিয়া বিকল পদ্মা মনে পাইল ডর ||
এ সব দেখিয়া পদ্মার স্থির নহে হিয়া |
সিংহাসনে শুইলা দেবী ঘরে দ্বার দিয়া  ||
অধোমুখী হইয়া ভূমিতে অঙ্গ পড়ে |
সজল নয়ন করি ঘনশ্বাস ছাড়ে ||
পরাভবলাগি ওষ্ঠ অধর শুকায় |
জিনিবার তরে চান্দ না দেখে উপায় ||
উপবাস দুই দিন  পদ্মার যন্ত্রণা |
অষ্টনাগ লইয়া নেতা করয়ে মন্ত্রণা ||
অষ্টনাগ লইয়া নেতা রহিল পদ্মার পাশে |
নেতা যত বলে পদ্মা কিছু না ভালবাসে  ||
নেতা বলে পদ্মাবতী শুনহ বচন |
শুনিয়া হাসিবে তোমা যত দেবগণ ||
কোন কার্য লাগিয়া তোমার উপবাস |
শুনিয়া দেবগণে করিবে উপহাস ||
কি করিতে নারি আমি তোমার প্রসাদে |
হস্তী যেন পলায় সিংহের বিষম নাদে ||
তোমার প্রসাদে আমি কোন কর্মে টুটা |
বিপক্ষের দন্তে লওয়াইতে পারি কুটা ||
আমার বচন তুমি না করিও আন |
স্নান ভোজন করিয়া রক্ষা কর প্রাণ ||
স্নান ভোজন কর তুমি থাক সুখে |
কোন মন্ত্রণা করিলে এই দুঃখ ঘোচে ||
নিশ্বাস ছাড়িয়া পদ্মা হইল ঘরের বাহির |
নয়নের জলধারে তিতিল শরীর ||
আঁচলে মুছিল নেতা নয়নের পানি |
মনোদুঃখে মনসার মুখে নাহি বাণী ||

.                                   ****************                         
সূচি...    


মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল

ছয় কুমার বধ পালা

               ২
( বেদগুরু ভক্ত চান্দ ছোট জন নহে |
একমনে ভাবে শিব বাপ পিতামহে ||
শিব পূজে ভক্তি ভাবে অন্যে নাহি মন |
স্বপনেতে পিতামহ পায় মহাজ্ঞান ||
স্বপনে পাইল মন্ত্র হরিষ অন্তরে |
এক পুরুষ আসিয়া জন্মিল দেবপুরে ||
সেবকেরে জ্ঞান কহে জগতের নাথ |
বিষ নিবারিতে বস্তু দিল তার হাত ||
হেতাল কাষ্ঠের বাড়ি দেব অধিষ্ঠান |
তাহারে দেখিয়া সর্পের ভয়ে কাঁপে প্রাণ ||
স্বপনেতে জ্ঞান পায় তার পিতামহে |
পিতামহে জ্ঞান পেয়ে তার পুত্রে কহে ||
গুণে দর্পে চান্দর বাপ আছিল স্বতন্ত্র  |
অন্তকালে চান্দর ঠাঁই কহে সেই মন্ত্র ||
বাপের ঠাঁই জ্ঞান পেয়ে বেড়ায় অহঙ্কারে |
তোমার তরে গালি পাড়ে লাগল পেলে মারে ||
যাবৎ চান্দর মনে থাকে মহাজ্ঞান |
কিসেরে ঘাটাবা চান্দ পাবা অপমান ||
মোর বুদ্ধি মত যদি তোমার মনে হয় |
মহাজ্ঞান হর তার চিন্তিয়া উপায় ||  )
নেতা বলে পদ্মাবতী স্থির কর হিয়া |
নটীর বেশে চল তুমি সকল জিনিয়া ||
সাধুর সহিত তুমি নিসঙ্গ করিয়া |
গুণের গামছা তার আনহ হরিয়া ||
নেতার হাতে পদ্মাবতী পাইয়া উপদেশ |
প্রভাত সময়ে পদ্মা ধরে নটীর বেশ ||
সহজে নাগিনী পদ্মা নানা মায়া জানে |
তাল যন্ত্র গন্ধর্ব ডাক দিয়া আনে ||
সংবাদ পাঠাইয়া আনে দুই বিদ্যাধরী |
ত্রিভুবন মোহ যায় পরমাসুন্দরী  ||
পদ্মার বিষম মায়া জানে কোন জন |
সর্বাঙ্গ ভরিয়া পরে নাগ-আভরণ ||
জাতা দিয়া কেশ বান্ধিল দৃঢ় করি |
সোনার চাকি পরে কোণের উপরি ||
কহিতে না পারে পদ্মা যত করিল বেশ |
ধূপের ধুঁয়া দিয়া বাসিত করে কেশ ||
চক্ষু যেন নীলোৎপল দেখিতে পরতেক |
পরম সুন্দর পরে সুবর্ণের ঠেক ||
নাসিকা হারাল যেন তিলফুলের চাতুরি |
তাহার ঘর চাঁদে যেন করিয়াছে চুরি ||
( দাড়িম্বের বিজ য়েন দন্ত চোখ চোখ |
ভ্রূধনু জিনি দেখি তাহে পরে সুখ || )
মৃগমদ মিশাইয়া চন্দন দিল গায় |
কনক নূপুর দেবী তুলিয়া দিল পায় ||
সোনার বাউটী হাতে দেখিতে সুন্দর |
নাগ আবরণ সব থুইল অন্তর ||
গলায় তুলিয়া দিল পারিজাতের মালা |
কোন কালে নহে দেখি এমন রূপ বালা  ||
ইহারে গঠিলা বিধি করিয়া নানা ছাঁদ |
ইহারে নিছিয়া ফেলাই কোটী কোটী চাঁদ ||
ইহারে গঠিলা বিধি করিয়া বড়াই |
সৌন্দর্য রাশি রাশি থুইল এক ঠাঁই ||
বৈরী নিপাতিতে পদ্মা কামরূপে চলে |
পদ্মার বরে সব থাকুক কুশলে ||
বিজয় গুপ্ত বলে গাইন সদাই আনন্দ |
এই কালে বল ভাই লাচারির ছন্দ ||

.              ****************                                                                 
সূচি...    


মিলনসাগর
*
মনসামঙ্গল কাব্যের সূচি
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল

ছয় কুমার বধ পালা



( সাজিল যে বিষহরি                 পদ্মা শিবের কুমারী
হরিতে চান্দর মহাজ্ঞান |
মায়ারূপে বেশ ধরি                 সাক্ষাতে নটের নারী
ইন্দ্র ব্রহ্মা বিধি মোহ যান || )
ললিত সুবর্ণ থোপা                  সুঠাম বান্ধিল খোপা
গলায় হার বান্ধিল বাওল |
কাজলে রঞ্জিত আঁখি                 কর্ণে সুবর্ণের চাকি
নামা কর্ণে পরে কর্ণ ফুল ||
বিচিত্র বসন পরে                       সুবর্ণ কঙ্কণ করে
হাতে শোভে সুবর্ণ কেয়ূর |
কস্তুরী কুসুম গায়                        চলন্ত নূপুর পায়
রুণু রুণু বাজিছে নূপুর ||
যে দেখিবে সেই তুষ্ট                     দুই নাগ হইল নট্ট
কাধে করি লইল মৃদঙ্গ |
অপযশে নাহি ব্যথা                  দাসীরূপে চলে নেতা
আরো নাগ লইলেক সঙ্গ ||
সাধিতে বিষম কাজ                     মনসার নাহি লাজ
দেবকন্যা হইলেন নটী |
কানাকানি করে দেবে                  মনসা কি করে এবে
চন্ডিকা হাসেন খটখটি ||
সাজিয়া আসি সকলে                  আকাশ পথেতে চলে
অবশেষে হইল দিনভাগ |
বায়ুগতি অনুসারে                      চলিল চান্দের দ্বারে
পঞ্চস্বরে গাহে নানা রাগ ||
মৃদঙ্গ হানিয়া যায়                          মনসা মধুর গায়
বসন্তে কোকিল গায় সারি |
শুনিয়া মধুর গীত                       অস্থির চান্দর চিত
বিজয় গুপ্ত রচিল লাচারি ||

.                                                          ****************                                                
সূচি...    


মিলনসাগর
*
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল

ছয় কুমার বধ পালা

                ৪
গীত শুনিয়া চান্দর হৃদয় হইল রঙ্গ |
অকালের মেঘ যেন গর্জয়ে মৃদঙ্গ ||
পঞ্চস্বরে গাহে গীত কোকিলের স্বরে |
গীত শুনি চান্দ বেনে আনন্দে শিহরে ||
চান্দ বলে ধোনা তুমি হও সাবহিত |
বাহির মহলে নটী ভাল গাহে গীত ||
আমার দেশের নটী হইতে উপাধিক গণি |
নিকটে ডাকিয়া আন গীত কিছু শুনি ||
চান্দর বচনে ধোনা হাসে খটখটি |
উভালড়ে যায় ধনা যথা আছে নটী  ||
স্বভাবে চঞ্চল বেটা চরিত্র বিকট |
হাতে ধরি নিল চান্দর নিকট ||
দূরে চান্দ পদ্মারে দেখি অন্তরে কৌতুক |
আড় আঁখি হাসে নটী দাঁড়াইয়া সম্মুখ ||
নানা মায়া জানে পদ্মা অশেষ উপায়  |
মনে মনে চিন্তি আনিলেক কাম রায় ||
পদ্মা বলে কাম তুমি শ্রীকৃষ্ণের তনয়  |
তুমি উপকার কর এই ত সময়  ||
আমার কার্যে তুমি স্বভাবে ব্যথিত |
চান্দর মনে প্রবেশিয়া বিকল কর চিত ||
চন্দ্র দেখি ফোটে যেন কুমুদের ফুল |
মোর রূপ দেখি চান্দ হউক আকূল  |    
পদ্মার বচনে হাসে কাম মহাবীরে  |
পঞ্চবান হানিলেক চান্দর শরীরে ||
পরমা সুন্দরী পদ্মা গাহে নানা গীত |
মনসার রূপে চান্দ হইল মোহিত ||
মৃদঙ্গের রাগ যেন গর্জে জলধর |
পদ্মাবতী গাহে যেন গুঞ্জরে ভ্রমর ||
স্বর্গ বিদ্যাধরী যেন মনসার ঠান |
দেখিয়া বিকল চান্দ স্থির নহে প্রাণ ||
যত গীত গাহে চান্দর মন নাহি তায় |
একদৃষ্টে সদাগর নটীর দিকে চায় ||
লাজ ভয় নাহি চান্দ মদনে বিকল |
মনে মনে হাসে নেতা সাধিলাম সকল ||
ধন্য ধন্য পদ্মাবতী চিন্তিল উপায় |
হেন পদ্মাবতী হবেন অবশ্য সহায় ||
বিজয় গুপ্ত বলে ভাই সানন্দ হৃদয় |
লাচারি প্রবন্ধ বল এই ত সময় ||

.              ****************                                                                 
সূচি...    


মিলনসাগর
*
*
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল

ছয় কুমার বধ পালা



( মনসা নয়ন-কোণে                  সঘনে কটাক্ষ হানে
শেল সম বাজে চান্দর বুকে |
দেখিয়া নটীর বেশ                   কামে তনু হল শেষ
নিজ নয়নেতে রূপ দেখে ||
তিলেক নাহি নিমেষ                  দেখিতে চঞ্চল বেশ
আড় আঁখি চাহে সদাগর |
কাতর হইল হৃদয়                    ছাড়িল ধর্মভয়
কামে সাধু হইল কাতর ||
চান্দর মন বুঝি আশে               ধোনা মনে মনে হাসে
গেল ধোনা নটীর সদন |
ধোনা অতি সুচতুর                  কহে বাক্য সুমধুর
সাধু চাহে তোমার মিলন ||
হাসিয়া বলিল নটী                    হইবেনা আমি খাঁটি
নাচি গাহি নগরে নগর |
ধোনা বলে সুবদনী                   রাখহ সাধুর বাণী
যাহা চাহ দিবে সদাগর |
কথা শুনি ধোনা হাসে                 চলিল সাধুর পাশে
সাধু নিধি পাইল হেন বাসে ||
চঞ্চল নয়নে চাহে                     কাম বানে প্রাণ দহে
স্থির সাধু হবে আর কিসে ||
নটী বলে সাধু ভজি                   পাপকর্মে নাহি মজি
যে ধন খুঁজি তাহা দেও মোরে |
নটীকে করে সম্ভাষ                   যে ধনে তোমার আশ
সত্য কহি দিব গো তোমারে ||
( নটীর বোলে চান্দ হাসে            কি ধন তোমার আইসে
সত্য করি সেই ধন দিব আনি |
বিজয় গুপ্ত ভনে                      রাখ মা রাঙ্গা চরণে
একবার করহ পরিত্রাণ ||  )

.                                                          ****************                                                
সূচি...    


মিলনসাগর
মহাজ্ঞানের কিবা কাজ প্রাণ চাহিলে দি ||
সত্য করি বলিলাম তোমা না করিব আন |
কহিব মহাজ্ঞান তুমি মধু কর দান ||
চান্দর কথা শুনিয়া নটী করয়ে বিনয় |
আগে জ্ঞান কহ পাছে থাকিব নিশ্চয় ||
বিধাতা বিমুখ হইলে বুদ্ধিহীন হয় |
নটীর কানে চান্দ মহাজ্ঞান কয় ||
ভাল মন্দ নাহি জানে মদনে বিকল |
কহিল নটীর কাণে মহাজ্ঞান সকল ||
আঁচলের নিধি চান্দ ফেলিল সত্বরে |
নটীর কাণে মন্ত্র কহি আপনা পাসরে ||
কামে অচেতন চান্দ বুদ্ধি হইল শেষ |
সাধনের বস্তু দিল নটীরে সন্দেশ ||
সংসারের যত বিদ্যা পদ্মার হৃদয় |
শুদ্ধজ্ঞানে কহিলা চান্দ জানিয়া নিশ্চয় ||
দানে কল্পতরু তুমি রূপে যেন কাম |
আর কিছু ধন দিবা নটীরে ইনাম ||
তোমার সঙ্গে রতি রঙ্গে থাকিব নিশ্চয় |
বাহির হইতে আসি জল করিয়া ক্ষয় ||
চান্দর তরে এতেক বলিয়া মিছা সাচ |
হাতে ঝারি করিয়া গেল মন্ডপের পাছ ||
মানব হৃদয়ে পদ্মা মনে মনে গণে |
ঘরের পাছে থাকিয়া বলে চান্দ যেন শুনে ||
পদ্মা বলে চান্দ তুমি অবোধ চঞ্চল |
কামে অচেতন হয়ে হারালে সকল ||
তবে সে জানিলাম তেমার অবোধ চরিত্র |
কপটে হরিলাম জ্ঞান তোমার স্থির নহে চিত্ত ||
মহাজ্ঞান হরিলাম পাতিয়া মায়াজাল |
আজি হতে করিব তোমার সংসার পাখাল ||
জলন্ত অনল নিভে যেন পাইলে জল |
কোপ-জলে নিবাইল মদন অনল ||
( জলন্ত অনলে যেন পতঙ্গ পতন |
ধরফর করে চান্দ কোপে অচেতন ||  )
হেতালবাড়ি হাতে করি বাহিরে দিল লড় |
বাহিরে আসিয়া চান্দ বলে ধর ধর ||
কোপে রাঙ্গা আঁখি চান্দ চারিভিতে চায় |
পদ্মা আকাশে উঠিল চান্দ বলে হায় ||
পদ্মারে ধরিতে চান্দ বাড়াইল হাত |
লাথি মারি চান্দর ভাঙ্গিল ছয় দাঁত ||
দন্ত ভাঙ্গা গেল চান্দর রক্ত পড়ে ধারে |
বিষাদ ভাবিয়া কান্দে চান্দ সদাগরে ||
চান্দর দুঃখের কথা শুনে দুঃখ লাগে বড়ি |
সম্বেদ পড়িল ভাই বলরে লাচারি ||

.              ****************                                                                 
সূচি...    


মিলনসাগর
*
*
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল

ছয় কুমার বধ পালা



মোরে লাজ দিল কাণী                  চক্ষুতে পড়য়ে পানী
কাণী সাজি এল মোর ঘরে |
পড়িলে আমার আগে                    হরিণে যেমন বাঘে
দশন বহিয়া রক্ত পড়ে ||
ঘরে যাব কোন লাজে,                অখ্যাতি বণিক মাঝে
কি বলিব সোনেকার তরে |
মুখে মোর হইল ঘা                    কি বলিবে সোনেকা
বিজয় গুপ্ত বলে ভক্তি করে ||
ধরিয়া নটীর বেশ                      আসিল আমার দেশ
স্ত্রী কলা ভাল ভান্ডি গেল |
আমারে ভন্ডনা দিয়া                   মহাজ্ঞান হরি নিয়া
বুকে পৃষ্ঠে হানিলেক শেল ||
মুখে মোর নাহি তন্ত্র                    ভাঙ্গিলেক ছয় দন্ত
রক্ত বাহিয়া পড়ে নাকে মুখে |
কি বুদ্ধি করিব ধনা                      হাসিবেক সর্বজনা
ঘরে যাইব কোন মুখে ||
বিজয় গুপ্ত কবি ভণে                   কেবল মনসার সনে
অকারণ বাড়াইলা বিবাদ ||

.                                                          ****************                                                
সূচি...    


মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল

ছয় কুমার বধ পালা

               ৮
বিষাদ ভাবিয়া  কান্দে চান্দ অধিকারী  |
আকাশে থাকিয়া হাসে দেবী বিষহরি ||
চান্দ বলে কাণী তুই অসতীর সীমা |
চরম-প্রহারে দিলি গুরুর দক্ষিণা ||
চান্দ বলে পলাইয়া গেলি তুই কাণী  |
কার্য সিদ্ধি করি বল উপহাস বাণী ||
মহাজ্ঞান হরি মোর তোর এত রঙ্গ |
শত জ্ঞান গেলে চান্দ কার্যে না দেয় ভঙ্গ ||
মোর জ্ঞান শুন্য হেন তোর মনে লাগে |
এত বড় সাহস দেখাও মোর আগে  ||
তর্জে গর্জে সদাগর বলে খরতর |
আকাশে থাকিয়া দেবী বলেন বর্বর ||
সাধারণ জন নহে চান্দ মহাবীর |
হেন নিধি নিল তবু আছয়ে সুস্থির ||
মহাদেবের পুত্র চান্দ চন্ডীর তনয় |
মহাজ্ঞান গেল তবু না হইল বিস্ময় ||
শিবের কুমারী পদ্মা জগতের মা |
সুখ মোক্ষ হইবে সেবিলে তাঁর পা ||
ভক্তের সহায় তুমি অভক্তের যম |
সেই পদ্মার বরে বাড়ুক সবার বিক্রম ||

.              ****************                                                                 
সূচি...    


মিলনসাগর
*
মহাকালকূট বিষ বায়ুর আগে ধায় |
রক্তে  মিশিয়া বিষ ছাইল সর্বগায়  ||
ওষ্ঠে তালু ছাইলেক সকল শরীর |
টলমল করে আঁখি প্রাণ নহে স্থির ||
তুলারাশি মধ্যে পরে যেন অগ্নিকণা |
সর্বাঙ্গ ছাইল বিষে পোড়ে ছয়জনা ||
কেহ বলে আমার বড় জ্বলে সর্ব গাও |
কেহ বলে  নিদ্রা আসে মুখে নাহি বাও ||
কেহ বলে কি কি খাইলাম কিছু ভাল নইল  |
কেহ  বলে  বিষভাতে পদ্মা প্রাণ লইল ||
কেহ বলে নিদ্রা আসে মুখে নাহি বাণী |
ক্ষেপিল কালকূট বিষ হারাইলাম পরানী  ||
মুখ বাহিয়া পড়ে লাল নাহি সরে রাও |
শরীর হইল কাল নাহি বহে বাও ||
কালনিদ্রা আসে যেন আঁখির জল ঝরে |
বিষে আচ্ছাদিল প্রাণ ধড়ফড় করে ||
শরীরে সামর্থ্য নাহি আপনা পাসরে |
আথালি পাথালি সবে স্থানে স্থানে পড়ে ||
কাল বিষে ঢলি পড়ে ছয় সহোদর |
নাগরথে চড়ি দেখে দেবী বিষহরি ||
ছয়পুত্র পড়ে সোনা দূর হইতে দেখে |
পুত্র পুত্র বলি সোনা উচ্চৈস্বরে ডাকে ||
কলা গাছ ভাঙ্গি যেন পড়ে ঠাঁই ঠাঁই |
পুত্র পুত্র বলি সোনা কান্দে পরিত্রাহি ||
ছয় পুত্র মৈল সোনার মনে বড় দুঃখ |
পুত্র কোলে করি কান্দে হাতে হানে বুক |
হিয়া হানি চুল ছিড়ি লোটে ভূমিতল |
হা হা পুত্র বলি রাণী হইল বিকল  ||
পুত্র শোকে কান্দে সোনা অতি দীর্ঘ রায় |
বিজয় গুপ্ত স্তুতি করে মনসার পায় ||
দারুণ শোকে কান্দে সোনা দুঃখ লাগে বড়ি |
এইকালে বল ভাই করুণ লাচারি ||

.              ****************                                                                 
সূচি...    


মিলনসাগর
*
*
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল

ছয় কুমার বধ পালা

১০

ভূমিতলে গড়ি দিয়া                            দুই হাত প্রসারিয়া
সোনেকা সুন্দরী বিলাপ যে করে |
ছিড়িল গলার হার                               আর যত অলঙ্কার
ধরিয়া রাখিতে কেহ নারে ||
কান্দিছে সোনেকা রাণী                        শিরে করাঘাত হানি
ফেলাইল অঙ্গের ভূষণ |
কারে বিধি হেন করে                      এক দিনে ছয় পুত্র মরে
নিশ্চয় যে ত্যজিব জীবন ||
পাইলাম ছয় পুত                                না রহিল এক সুত
সেবা করি মনসার পায় |
স্বামী যে দোষ করিল                             হেন ছয় পুত্র মল
দারুণ বিষেতে সব যায় ||
যেন পূর্ণ শশধর,                                  ছয় পুত্র গুণাকর
তারি লাগি প্রাণে লাগে তাপ |
কিবা বিষ খাইয়া মরি                        কাটারিতে ভয় করি
নহে আমি জলে দিব ঝাঁপ ||
করি ধ্যান মহাজপ                              কত করি স্তব জপ
কত দুঃখে পাইলাম নিধি |
না করি ডাকাতি চুরি                        সেবিয়া সে বিষহরি
কোন দোষে করিল হেন বিধি ||
এক নয় দুই নয়                                রাড়ী হইল বধূ ছয়
রূপে বেশে পরমা সুন্দরী |
বিধাতা হৈল বৈরী                              কেমনে পরাণ ধরি
ছয় বধূ ঘরে রবে রাড়ী  ||
অতি পাপী সদাগর                              পদ্মা সহ অথান্তর
এত হইল তাহার লাগিয়া |
ঘরেতে  আগুন দিয়া                            যাইব সব পুড়িয়া
যোগী হইয়া খাইব মাগিয়া ||
রাজ্যের যে অধিকারী,                         তার প্রাণপ্রিয়া নারী
ধনে জনে কিছু নহে উনা |
বিধাতা টানিয়া লয়                             হারাইলাম পুত্র ছয়
সংসারে ফুরাল বাসনা ||
আমি ত গরল খাব                          অগ্নি মাঝে প্রবেশিব
জীবনেতে নাহি মোর সাধ |
মরিল যে ছয় পুত্র                            কান্দি অন্ধ হইল নেত্র
শোকে সোনা কান্দে উচ্চারায় |
যত সব বন্ধুলোকে                         বেড়িয়া কান্দিছে শোকে
বৈদ্য বিজয় গুপ্ত গীত গায় ||

.                                                          ****************                                                
সূচি...    


মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল

ছয় কুমার বধ পালা

                 ১১
চম্পক নগরের রাজা নাম চন্দ্রধর |
পদ্মার বিবাদে সে হারাইল সকল ||
পুত্রহীন লোকের নাহিক পরলোক |
প্রভাত সময়ে কেহ না দেখিবে মুখ ||
চান্দর বংশে না রহিবে বীজের বেগুন |
চান্দর পিন্ডদান করিবে কোন জন ||
এতকালে এত সুখ ঘুচাইল গোসাঞি |
পরকালে জলাঞ্জলি দিবে হেন জন নাই ||
কহে বিজয় গুপ্ত সোনাই না কর বিষাদ |
আরো কত শত আছে নাগের বিবাদ ||
ছয় বধূ কান্দে হইয়া ধূলায় ধূসর |
রাজ্য বেড়িয়া উঠে ক্রন্দনের স্বর ||
বার্তা পাইয়া আইল সাধু স্থির নহে চিতে |
পুত্র পুত্র বলি সাধু পড়িল ভূমিতে ||
বাহিরে থাকিয়া বার্তা পাইল নৃপবরে |
প্রাণের দুর্লভ পুত্র নিল কোন চোরে ||
পুত্র পুত্র বলি চান্দ ডাকে উচ্চৈস্বরে |
আথে ব্যথে ধাইয়া গিয়া পুত্র কোলে করে ||
উলটী পালটী চাহে কান্দে সাধুর নন্দন |
ছয় পুত্র পড়িয়াছে নাহিক চেতন ||
মাথায় হাত দিয়া সাধু কান্দে দীর্ঘরায় |
ছয় বধূ কান্দে ধরি স্বামীগণের পায় ||
বার্তা পাইয়া সোমাই আসিল উভালড়ে |
বিকল হইয়া কান্দে চক্ষের জল ঝরে ||
ইষ্ট মিত্র বন্ধুবর্গ কান্দে সর্বজনা |
শত শত দাস কান্দে শোকে কান্দে ধনা ||
কান্দিতে কান্দিতে লোক হইলেক ভোলা |
গগনে হইল তখন দুই প্রহর বেলা ||
চান্দর দর্প ছিল কেবল মহাজ্ঞান |
কপটে মনসা দেবী হরিল সেই ধন  ||
যেবা কিছু জানে তাহা কহিল কর্ণমুলে |
মনুষ্য না পাইয়া যেন ছটা মারে ভুলে ||
চান্দ বানিয়া কান্দে দুঃখ লাগে বড়ি |
সংবাদ পড়িল গাইন বলরে লাচারি ||

.              ****************                                                                 
সূচি...    


মিলনসাগর
*
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল

ছয় কুমার বধ পালা

               ১২
কোন ছার দেব হয় লঘুজাতি কাণী  |
ঘরে লুকাইয়া তারে দেও জল পানি ||
সেই ছার কাণীরে দেব বল কোন মুখে |
ছোট বড় লোক জন পূজে তারে সুখে ||
আর যদি শুনি আমি পুজহ কাণীরে |
আর না থুইব প্রাণ তোমার শরীরে ||
সোনেকা বলিল তুমি আপনা বুঝ |
মনুষ্য হইয়া তুমি দেবের সঙ্গে যুঝ ||
তুমি হেন স্বামী যার সে বাঁচে কেনে |
সহবাসে কাজ নেই চলিলাম বনে ||
কাননে চলিল তবে সোনেকা সুন্দরী |
ইহা দেখি ভয় পাইল চান্দ অধিকারী ||
সোমাই পন্ডিত বলে কার্যে দাও তাড়া  |
শতেক ক্রন্দনে ফিরি না আসিবে মড়া ||
ক্রন্দন সম্বর সাধু কেন কর শোক |
মনদিয়া কুমার সবের চিন্ত পরলোক ||
প্রাচীন লোকের মুখে হেন কথা শুনি |
মরিলে নাগের ঘায় না পোড়ে আগুনি ||
স্রোতে ভাসাইয়া দাও যথা তথা যায় |
দৈবগতি গাড়ুরিয়া যদি লাগ পায় ||
এতেক শুনিয়া চান্দ ভাবে মনে মন |
সংবাদ দিয়া মালাকার আনিল তখন ||
চান্দর বোলে মালী আইল আথেব্যথে |
প্রণাম করিয়া মালী দাঁড়াইল সম্মুখে ||
চান্দ বলে মালাকার কর অবধান |
কলার ভেলা শীঘ্র করহ নির্মাণ ||
ছয় পুত্র ভাসাইয়া দিব গাঙ্গুরীতে |
এতেক বলিয়া চান্দ কান্দে বিপরীতে ||
চান্দর বচন মালী না করিল আন |
ভেলার ভেরুয়াখান করিল নির্মাণ ||
নেতের চান্দোয়া দিল নেতের মশারি |
গাঙ্গুরীতে ভাসাইয়া দিল শীঘ্র করি ||
তবে মনসা দেবী ভাবে মনে মন |
ভুরের নিকটে দেবী আসিল তখন ||
এসব দেখিয়া পদ্মা ভাবে মনে মন |
মন্ত্র বলে জীয়াইল কুমার ছয়জন ||
এতেক দেখিয়া পদ্মার কৌতুক বিস্তর |
গঙ্গার পুরী লইয়া চলিল ছয় কুমার ||
যত্ন করিয়া রাখিব তোমার ঠাঁই |
যখনে চাইব আমি তখনি যেন পাই ||
প্রণাম করিয়া চলে দেবী বিষহরি |
বিনয় করিয়া চলে আপনা পুরী ||
বিজয় গুপ্ত রচে পুঁথি মনসার বর |
ছয় কুমার বধ পালা এইখানে সোসর ||

.              ****************                                                                 
সূচি...    


মিলনসাগর
*
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল

ছয় কুমার বধ পালা


হেন মতে শঙ্কুর বধ করিল মনসায়  |
নেতা নেতা বলিয়া ডাকিল সর্বদায় ||
বুদ্ধি বল নেতা মোরে ধোপার কুমারী  |
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল

ছয় কুমার বধ পালা

                ৬
কামে অচেতন চান্দ না করে বিচার |
ধন দিতে নটীকে সে বলে বার বার ||
চান্দর বচনে নটী হইল আগুসার |
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল

ছয় কুমার বধ পালা

              ৯
মহাজ্ঞান গেল চান্দর টুটিলেক বল |
অধিক পদ্মার সঙ্গে বাধিল কোন্দল ||
রাত্রি দিন গালি পাড়ে কোপে অহঙ্কারে |
কোপ মনে বেড়ায় চান্দ সর্প পেলে মারে ||
রাজ্যের ঠাকুর চান্দ পথে দিল থানা |
এই পাতায় কোনো ভুল-ত্রুটি চোখে পড়লে অথবা যদি
কোথাও ভুল বলে মনে হয়, তাহলে আমাদের এই ইমেলে
জানাবেন। আমরা শুধরে নেবার চেষ্টা করবো।
srimilansengupta@yahoo.co.in