কবি বিজয় গুপ্ত-র মনসামঙ্গল কাব্য যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
|
মন্ত্রবলে উপবন ততক্ষণে জীল || ডালে পাতে ফল ফুলে আমোদিত গন্ধে | ভ্রমে ভ্রমর মধুপে যত মকরন্দে || উপবন জীয়াইয়া সাধু যায় ঘর | চিন্তিয়া বিকল পদ্মা মনে পাইল ডর || এ সব দেখিয়া পদ্মার স্থির নহে হিয়া | সিংহাসনে শুইলা দেবী ঘরে দ্বার দিয়া || অধোমুখী হইয়া ভূমিতে অঙ্গ পড়ে | সজল নয়ন করি ঘনশ্বাস ছাড়ে || পরাভবলাগি ওষ্ঠ অধর শুকায় | জিনিবার তরে চান্দ না দেখে উপায় || উপবাস দুই দিন পদ্মার যন্ত্রণা | অষ্টনাগ লইয়া নেতা করয়ে মন্ত্রণা || অষ্টনাগ লইয়া নেতা রহিল পদ্মার পাশে | নেতা যত বলে পদ্মা কিছু না ভালবাসে || নেতা বলে পদ্মাবতী শুনহ বচন | শুনিয়া হাসিবে তোমা যত দেবগণ || কোন কার্য লাগিয়া তোমার উপবাস | শুনিয়া দেবগণে করিবে উপহাস || কি করিতে নারি আমি তোমার প্রসাদে | হস্তী যেন পলায় সিংহের বিষম নাদে || তোমার প্রসাদে আমি কোন কর্মে টুটা | বিপক্ষের দন্তে লওয়াইতে পারি কুটা || আমার বচন তুমি না করিও আন | স্নান ভোজন করিয়া রক্ষা কর প্রাণ || স্নান ভোজন কর তুমি থাক সুখে | কোন মন্ত্রণা করিলে এই দুঃখ ঘোচে || নিশ্বাস ছাড়িয়া পদ্মা হইল ঘরের বাহির | নয়নের জলধারে তিতিল শরীর || আঁচলে মুছিল নেতা নয়নের পানি | মনোদুঃখে মনসার মুখে নাহি বাণী ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
|
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ছয় কুমার বধ পালা
২
( বেদগুরু ভক্ত চান্দ ছোট জন নহে |
একমনে ভাবে শিব বাপ পিতামহে ||
শিব পূজে ভক্তি ভাবে অন্যে নাহি মন |
স্বপনেতে পিতামহ পায় মহাজ্ঞান ||
স্বপনে পাইল মন্ত্র হরিষ অন্তরে |
এক পুরুষ আসিয়া জন্মিল দেবপুরে ||
সেবকেরে জ্ঞান কহে জগতের নাথ |
বিষ নিবারিতে বস্তু দিল তার হাত ||
হেতাল কাষ্ঠের বাড়ি দেব অধিষ্ঠান |
তাহারে দেখিয়া সর্পের ভয়ে কাঁপে প্রাণ ||
স্বপনেতে জ্ঞান পায় তার পিতামহে |
পিতামহে জ্ঞান পেয়ে তার পুত্রে কহে ||
গুণে দর্পে চান্দর বাপ আছিল স্বতন্ত্র |
অন্তকালে চান্দর ঠাঁই কহে সেই মন্ত্র ||
বাপের ঠাঁই জ্ঞান পেয়ে বেড়ায় অহঙ্কারে |
তোমার তরে গালি পাড়ে লাগল পেলে মারে ||
যাবৎ চান্দর মনে থাকে মহাজ্ঞান |
কিসেরে ঘাটাবা চান্দ পাবা অপমান ||
মোর বুদ্ধি মত যদি তোমার মনে হয় |
মহাজ্ঞান হর তার চিন্তিয়া উপায় || )
নেতা বলে পদ্মাবতী স্থির কর হিয়া |
নটীর বেশে চল তুমি সকল জিনিয়া ||
সাধুর সহিত তুমি নিসঙ্গ করিয়া |
গুণের গামছা তার আনহ হরিয়া ||
নেতার হাতে পদ্মাবতী পাইয়া উপদেশ |
প্রভাত সময়ে পদ্মা ধরে নটীর বেশ ||
সহজে নাগিনী পদ্মা নানা মায়া জানে |
তাল যন্ত্র গন্ধর্ব ডাক দিয়া আনে ||
সংবাদ পাঠাইয়া আনে দুই বিদ্যাধরী |
ত্রিভুবন মোহ যায় পরমাসুন্দরী ||
পদ্মার বিষম মায়া জানে কোন জন |
সর্বাঙ্গ ভরিয়া পরে নাগ-আভরণ ||
জাতা দিয়া কেশ বান্ধিল দৃঢ় করি |
সোনার চাকি পরে কোণের উপরি ||
কহিতে না পারে পদ্মা যত করিল বেশ |
ধূপের ধুঁয়া দিয়া বাসিত করে কেশ ||
চক্ষু যেন নীলোৎপল দেখিতে পরতেক |
পরম সুন্দর পরে সুবর্ণের ঠেক ||
নাসিকা হারাল যেন তিলফুলের চাতুরি |
তাহার ঘর চাঁদে যেন করিয়াছে চুরি ||
( দাড়িম্বের বিজ য়েন দন্ত চোখ চোখ |
ভ্রূধনু জিনি দেখি তাহে পরে সুখ || )
মৃগমদ মিশাইয়া চন্দন দিল গায় |
কনক নূপুর দেবী তুলিয়া দিল পায় ||
সোনার বাউটী হাতে দেখিতে সুন্দর |
নাগ আবরণ সব থুইল অন্তর ||
গলায় তুলিয়া দিল পারিজাতের মালা |
কোন কালে নহে দেখি এমন রূপ বালা ||
ইহারে গঠিলা বিধি করিয়া নানা ছাঁদ |
ইহারে নিছিয়া ফেলাই কোটী কোটী চাঁদ ||
ইহারে গঠিলা বিধি করিয়া বড়াই |
সৌন্দর্য রাশি রাশি থুইল এক ঠাঁই ||
বৈরী নিপাতিতে পদ্মা কামরূপে চলে |
পদ্মার বরে সব থাকুক কুশলে ||
বিজয় গুপ্ত বলে গাইন সদাই আনন্দ |
এই কালে বল ভাই লাচারির ছন্দ ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর মনসা মঙ্গল
ছয় কুমার বধ পালা
৩
( সাজিল যে বিষহরি পদ্মা শিবের কুমারী হরিতে চান্দর মহাজ্ঞান | মায়ারূপে বেশ ধরি সাক্ষাতে নটের নারী ইন্দ্র ব্রহ্মা বিধি মোহ যান || ) ললিত সুবর্ণ থোপা সুঠাম বান্ধিল খোপা গলায় হার বান্ধিল বাওল | কাজলে রঞ্জিত আঁখি কর্ণে সুবর্ণের চাকি নামা কর্ণে পরে কর্ণ ফুল || বিচিত্র বসন পরে সুবর্ণ কঙ্কণ করে হাতে শোভে সুবর্ণ কেয়ূর | কস্তুরী কুসুম গায় চলন্ত নূপুর পায় রুণু রুণু বাজিছে নূপুর || যে দেখিবে সেই তুষ্ট দুই নাগ হইল নট্ট কাধে করি লইল মৃদঙ্গ | অপযশে নাহি ব্যথা দাসীরূপে চলে নেতা আরো নাগ লইলেক সঙ্গ || সাধিতে বিষম কাজ মনসার নাহি লাজ দেবকন্যা হইলেন নটী | কানাকানি করে দেবে মনসা কি করে এবে চন্ডিকা হাসেন খটখটি || সাজিয়া আসি সকলে আকাশ পথেতে চলে অবশেষে হইল দিনভাগ | বায়ুগতি অনুসারে চলিল চান্দের দ্বারে পঞ্চস্বরে গাহে নানা রাগ || মৃদঙ্গ হানিয়া যায় মনসা মধুর গায় বসন্তে কোকিল গায় সারি | শুনিয়া মধুর গীত অস্থির চান্দর চিত বিজয় গুপ্ত রচিল লাচারি ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
|
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ছয় কুমার বধ পালা
৪
গীত শুনিয়া চান্দর হৃদয় হইল রঙ্গ |
অকালের মেঘ যেন গর্জয়ে মৃদঙ্গ ||
পঞ্চস্বরে গাহে গীত কোকিলের স্বরে |
গীত শুনি চান্দ বেনে আনন্দে শিহরে ||
চান্দ বলে ধোনা তুমি হও সাবহিত |
বাহির মহলে নটী ভাল গাহে গীত ||
আমার দেশের নটী হইতে উপাধিক গণি |
নিকটে ডাকিয়া আন গীত কিছু শুনি ||
চান্দর বচনে ধোনা হাসে খটখটি |
উভালড়ে যায় ধনা যথা আছে নটী ||
স্বভাবে চঞ্চল বেটা চরিত্র বিকট |
হাতে ধরি নিল চান্দর নিকট ||
দূরে চান্দ পদ্মারে দেখি অন্তরে কৌতুক |
আড় আঁখি হাসে নটী দাঁড়াইয়া সম্মুখ ||
নানা মায়া জানে পদ্মা অশেষ উপায় |
মনে মনে চিন্তি আনিলেক কাম রায় ||
পদ্মা বলে কাম তুমি শ্রীকৃষ্ণের তনয় |
তুমি উপকার কর এই ত সময় ||
আমার কার্যে তুমি স্বভাবে ব্যথিত |
চান্দর মনে প্রবেশিয়া বিকল কর চিত ||
চন্দ্র দেখি ফোটে যেন কুমুদের ফুল |
মোর রূপ দেখি চান্দ হউক আকূল |
পদ্মার বচনে হাসে কাম মহাবীরে |
পঞ্চবান হানিলেক চান্দর শরীরে ||
পরমা সুন্দরী পদ্মা গাহে নানা গীত |
মনসার রূপে চান্দ হইল মোহিত ||
মৃদঙ্গের রাগ যেন গর্জে জলধর |
পদ্মাবতী গাহে যেন গুঞ্জরে ভ্রমর ||
স্বর্গ বিদ্যাধরী যেন মনসার ঠান |
দেখিয়া বিকল চান্দ স্থির নহে প্রাণ ||
যত গীত গাহে চান্দর মন নাহি তায় |
একদৃষ্টে সদাগর নটীর দিকে চায় ||
লাজ ভয় নাহি চান্দ মদনে বিকল |
মনে মনে হাসে নেতা সাধিলাম সকল ||
ধন্য ধন্য পদ্মাবতী চিন্তিল উপায় |
হেন পদ্মাবতী হবেন অবশ্য সহায় ||
বিজয় গুপ্ত বলে ভাই সানন্দ হৃদয় |
লাচারি প্রবন্ধ বল এই ত সময় ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর মনসা মঙ্গল
ছয় কুমার বধ পালা
৫
( মনসা নয়ন-কোণে সঘনে কটাক্ষ হানে শেল সম বাজে চান্দর বুকে | দেখিয়া নটীর বেশ কামে তনু হল শেষ নিজ নয়নেতে রূপ দেখে || তিলেক নাহি নিমেষ দেখিতে চঞ্চল বেশ আড় আঁখি চাহে সদাগর | কাতর হইল হৃদয় ছাড়িল ধর্মভয় কামে সাধু হইল কাতর || চান্দর মন বুঝি আশে ধোনা মনে মনে হাসে গেল ধোনা নটীর সদন | ধোনা অতি সুচতুর কহে বাক্য সুমধুর সাধু চাহে তোমার মিলন || হাসিয়া বলিল নটী হইবেনা আমি খাঁটি নাচি গাহি নগরে নগর | ধোনা বলে সুবদনী রাখহ সাধুর বাণী যাহা চাহ দিবে সদাগর | কথা শুনি ধোনা হাসে চলিল সাধুর পাশে সাধু নিধি পাইল হেন বাসে || চঞ্চল নয়নে চাহে কাম বানে প্রাণ দহে স্থির সাধু হবে আর কিসে || নটী বলে সাধু ভজি পাপকর্মে নাহি মজি যে ধন খুঁজি তাহা দেও মোরে | নটীকে করে সম্ভাষ যে ধনে তোমার আশ সত্য কহি দিব গো তোমারে || ( নটীর বোলে চান্দ হাসে কি ধন তোমার আইসে সত্য করি সেই ধন দিব আনি | বিজয় গুপ্ত ভনে রাখ মা রাঙ্গা চরণে একবার করহ পরিত্রাণ || )
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
|
মহাজ্ঞানের কিবা কাজ প্রাণ চাহিলে দি ||
সত্য করি বলিলাম তোমা না করিব আন |
কহিব মহাজ্ঞান তুমি মধু কর দান ||
চান্দর কথা শুনিয়া নটী করয়ে বিনয় |
আগে জ্ঞান কহ পাছে থাকিব নিশ্চয় ||
বিধাতা বিমুখ হইলে বুদ্ধিহীন হয় |
নটীর কানে চান্দ মহাজ্ঞান কয় ||
ভাল মন্দ নাহি জানে মদনে বিকল |
কহিল নটীর কাণে মহাজ্ঞান সকল ||
আঁচলের নিধি চান্দ ফেলিল সত্বরে |
নটীর কাণে মন্ত্র কহি আপনা পাসরে ||
কামে অচেতন চান্দ বুদ্ধি হইল শেষ |
সাধনের বস্তু দিল নটীরে সন্দেশ ||
সংসারের যত বিদ্যা পদ্মার হৃদয় |
শুদ্ধজ্ঞানে কহিলা চান্দ জানিয়া নিশ্চয় ||
দানে কল্পতরু তুমি রূপে যেন কাম |
আর কিছু ধন দিবা নটীরে ইনাম ||
তোমার সঙ্গে রতি রঙ্গে থাকিব নিশ্চয় |
বাহির হইতে আসি জল করিয়া ক্ষয় ||
চান্দর তরে এতেক বলিয়া মিছা সাচ |
হাতে ঝারি করিয়া গেল মন্ডপের পাছ ||
মানব হৃদয়ে পদ্মা মনে মনে গণে |
ঘরের পাছে থাকিয়া বলে চান্দ যেন শুনে ||
পদ্মা বলে চান্দ তুমি অবোধ চঞ্চল |
কামে অচেতন হয়ে হারালে সকল ||
তবে সে জানিলাম তেমার অবোধ চরিত্র |
কপটে হরিলাম জ্ঞান তোমার স্থির নহে চিত্ত ||
মহাজ্ঞান হরিলাম পাতিয়া মায়াজাল |
আজি হতে করিব তোমার সংসার পাখাল ||
জলন্ত অনল নিভে যেন পাইলে জল |
কোপ-জলে নিবাইল মদন অনল ||
( জলন্ত অনলে যেন পতঙ্গ পতন |
ধরফর করে চান্দ কোপে অচেতন || )
হেতালবাড়ি হাতে করি বাহিরে দিল লড় |
বাহিরে আসিয়া চান্দ বলে ধর ধর ||
কোপে রাঙ্গা আঁখি চান্দ চারিভিতে চায় |
পদ্মা আকাশে উঠিল চান্দ বলে হায় ||
পদ্মারে ধরিতে চান্দ বাড়াইল হাত |
লাথি মারি চান্দর ভাঙ্গিল ছয় দাঁত ||
দন্ত ভাঙ্গা গেল চান্দর রক্ত পড়ে ধারে |
বিষাদ ভাবিয়া কান্দে চান্দ সদাগরে ||
চান্দর দুঃখের কথা শুনে দুঃখ লাগে বড়ি |
সম্বেদ পড়িল ভাই বলরে লাচারি ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর মনসা মঙ্গল
ছয় কুমার বধ পালা
৭
মোরে লাজ দিল কাণী চক্ষুতে পড়য়ে পানী কাণী সাজি এল মোর ঘরে | পড়িলে আমার আগে হরিণে যেমন বাঘে দশন বহিয়া রক্ত পড়ে || ঘরে যাব কোন লাজে, অখ্যাতি বণিক মাঝে কি বলিব সোনেকার তরে | মুখে মোর হইল ঘা কি বলিবে সোনেকা বিজয় গুপ্ত বলে ভক্তি করে || ধরিয়া নটীর বেশ আসিল আমার দেশ স্ত্রী কলা ভাল ভান্ডি গেল | আমারে ভন্ডনা দিয়া মহাজ্ঞান হরি নিয়া বুকে পৃষ্ঠে হানিলেক শেল || মুখে মোর নাহি তন্ত্র ভাঙ্গিলেক ছয় দন্ত রক্ত বাহিয়া পড়ে নাকে মুখে | কি বুদ্ধি করিব ধনা হাসিবেক সর্বজনা ঘরে যাইব কোন মুখে || বিজয় গুপ্ত কবি ভণে কেবল মনসার সনে অকারণ বাড়াইলা বিবাদ ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
|
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ছয় কুমার বধ পালা
৮
বিষাদ ভাবিয়া কান্দে চান্দ অধিকারী |
আকাশে থাকিয়া হাসে দেবী বিষহরি ||
চান্দ বলে কাণী তুই অসতীর সীমা |
চরম-প্রহারে দিলি গুরুর দক্ষিণা ||
চান্দ বলে পলাইয়া গেলি তুই কাণী |
কার্য সিদ্ধি করি বল উপহাস বাণী ||
মহাজ্ঞান হরি মোর তোর এত রঙ্গ |
শত জ্ঞান গেলে চান্দ কার্যে না দেয় ভঙ্গ ||
মোর জ্ঞান শুন্য হেন তোর মনে লাগে |
এত বড় সাহস দেখাও মোর আগে ||
তর্জে গর্জে সদাগর বলে খরতর |
আকাশে থাকিয়া দেবী বলেন বর্বর ||
সাধারণ জন নহে চান্দ মহাবীর |
হেন নিধি নিল তবু আছয়ে সুস্থির ||
মহাদেবের পুত্র চান্দ চন্ডীর তনয় |
মহাজ্ঞান গেল তবু না হইল বিস্ময় ||
শিবের কুমারী পদ্মা জগতের মা |
সুখ মোক্ষ হইবে সেবিলে তাঁর পা ||
ভক্তের সহায় তুমি অভক্তের যম |
সেই পদ্মার বরে বাড়ুক সবার বিক্রম ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
মহাকালকূট বিষ বায়ুর আগে ধায় |
রক্তে মিশিয়া বিষ ছাইল সর্বগায় ||
ওষ্ঠে তালু ছাইলেক সকল শরীর |
টলমল করে আঁখি প্রাণ নহে স্থির ||
তুলারাশি মধ্যে পরে যেন অগ্নিকণা |
সর্বাঙ্গ ছাইল বিষে পোড়ে ছয়জনা ||
কেহ বলে আমার বড় জ্বলে সর্ব গাও |
কেহ বলে নিদ্রা আসে মুখে নাহি বাও ||
কেহ বলে কি কি খাইলাম কিছু ভাল নইল |
কেহ বলে বিষভাতে পদ্মা প্রাণ লইল ||
কেহ বলে নিদ্রা আসে মুখে নাহি বাণী |
ক্ষেপিল কালকূট বিষ হারাইলাম পরানী ||
মুখ বাহিয়া পড়ে লাল নাহি সরে রাও |
শরীর হইল কাল নাহি বহে বাও ||
কালনিদ্রা আসে যেন আঁখির জল ঝরে |
বিষে আচ্ছাদিল প্রাণ ধড়ফড় করে ||
শরীরে সামর্থ্য নাহি আপনা পাসরে |
আথালি পাথালি সবে স্থানে স্থানে পড়ে ||
কাল বিষে ঢলি পড়ে ছয় সহোদর |
নাগরথে চড়ি দেখে দেবী বিষহরি ||
ছয়পুত্র পড়ে সোনা দূর হইতে দেখে |
পুত্র পুত্র বলি সোনা উচ্চৈস্বরে ডাকে ||
কলা গাছ ভাঙ্গি যেন পড়ে ঠাঁই ঠাঁই |
পুত্র পুত্র বলি সোনা কান্দে পরিত্রাহি ||
ছয় পুত্র মৈল সোনার মনে বড় দুঃখ |
পুত্র কোলে করি কান্দে হাতে হানে বুক |
হিয়া হানি চুল ছিড়ি লোটে ভূমিতল |
হা হা পুত্র বলি রাণী হইল বিকল ||
পুত্র শোকে কান্দে সোনা অতি দীর্ঘ রায় |
বিজয় গুপ্ত স্তুতি করে মনসার পায় ||
দারুণ শোকে কান্দে সোনা দুঃখ লাগে বড়ি |
এইকালে বল ভাই করুণ লাচারি ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর মনসা মঙ্গল
ছয় কুমার বধ পালা
১০
ভূমিতলে গড়ি দিয়া দুই হাত প্রসারিয়া সোনেকা সুন্দরী বিলাপ যে করে | ছিড়িল গলার হার আর যত অলঙ্কার ধরিয়া রাখিতে কেহ নারে || কান্দিছে সোনেকা রাণী শিরে করাঘাত হানি ফেলাইল অঙ্গের ভূষণ | কারে বিধি হেন করে এক দিনে ছয় পুত্র মরে নিশ্চয় যে ত্যজিব জীবন || পাইলাম ছয় পুত না রহিল এক সুত সেবা করি মনসার পায় | স্বামী যে দোষ করিল হেন ছয় পুত্র মল দারুণ বিষেতে সব যায় || যেন পূর্ণ শশধর, ছয় পুত্র গুণাকর তারি লাগি প্রাণে লাগে তাপ | কিবা বিষ খাইয়া মরি কাটারিতে ভয় করি নহে আমি জলে দিব ঝাঁপ || করি ধ্যান মহাজপ কত করি স্তব জপ কত দুঃখে পাইলাম নিধি | না করি ডাকাতি চুরি সেবিয়া সে বিষহরি কোন দোষে করিল হেন বিধি || এক নয় দুই নয় রাড়ী হইল বধূ ছয় রূপে বেশে পরমা সুন্দরী | বিধাতা হৈল বৈরী কেমনে পরাণ ধরি ছয় বধূ ঘরে রবে রাড়ী || অতি পাপী সদাগর পদ্মা সহ অথান্তর এত হইল তাহার লাগিয়া | ঘরেতে আগুন দিয়া যাইব সব পুড়িয়া যোগী হইয়া খাইব মাগিয়া || রাজ্যের যে অধিকারী, তার প্রাণপ্রিয়া নারী ধনে জনে কিছু নহে উনা | বিধাতা টানিয়া লয় হারাইলাম পুত্র ছয় সংসারে ফুরাল বাসনা || আমি ত গরল খাব অগ্নি মাঝে প্রবেশিব জীবনেতে নাহি মোর সাধ | মরিল যে ছয় পুত্র কান্দি অন্ধ হইল নেত্র শোকে সোনা কান্দে উচ্চারায় | যত সব বন্ধুলোকে বেড়িয়া কান্দিছে শোকে বৈদ্য বিজয় গুপ্ত গীত গায় ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
|
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ছয় কুমার বধ পালা
১১
চম্পক নগরের রাজা নাম চন্দ্রধর |
পদ্মার বিবাদে সে হারাইল সকল ||
পুত্রহীন লোকের নাহিক পরলোক |
প্রভাত সময়ে কেহ না দেখিবে মুখ ||
চান্দর বংশে না রহিবে বীজের বেগুন |
চান্দর পিন্ডদান করিবে কোন জন ||
এতকালে এত সুখ ঘুচাইল গোসাঞি |
পরকালে জলাঞ্জলি দিবে হেন জন নাই ||
কহে বিজয় গুপ্ত সোনাই না কর বিষাদ |
আরো কত শত আছে নাগের বিবাদ ||
ছয় বধূ কান্দে হইয়া ধূলায় ধূসর |
রাজ্য বেড়িয়া উঠে ক্রন্দনের স্বর ||
বার্তা পাইয়া আইল সাধু স্থির নহে চিতে |
পুত্র পুত্র বলি সাধু পড়িল ভূমিতে ||
বাহিরে থাকিয়া বার্তা পাইল নৃপবরে |
প্রাণের দুর্লভ পুত্র নিল কোন চোরে ||
পুত্র পুত্র বলি চান্দ ডাকে উচ্চৈস্বরে |
আথে ব্যথে ধাইয়া গিয়া পুত্র কোলে করে ||
উলটী পালটী চাহে কান্দে সাধুর নন্দন |
ছয় পুত্র পড়িয়াছে নাহিক চেতন ||
মাথায় হাত দিয়া সাধু কান্দে দীর্ঘরায় |
ছয় বধূ কান্দে ধরি স্বামীগণের পায় ||
বার্তা পাইয়া সোমাই আসিল উভালড়ে |
বিকল হইয়া কান্দে চক্ষের জল ঝরে ||
ইষ্ট মিত্র বন্ধুবর্গ কান্দে সর্বজনা |
শত শত দাস কান্দে শোকে কান্দে ধনা ||
কান্দিতে কান্দিতে লোক হইলেক ভোলা |
গগনে হইল তখন দুই প্রহর বেলা ||
চান্দর দর্প ছিল কেবল মহাজ্ঞান |
কপটে মনসা দেবী হরিল সেই ধন ||
যেবা কিছু জানে তাহা কহিল কর্ণমুলে |
মনুষ্য না পাইয়া যেন ছটা মারে ভুলে ||
চান্দ বানিয়া কান্দে দুঃখ লাগে বড়ি |
সংবাদ পড়িল গাইন বলরে লাচারি ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ছয় কুমার বধ পালা
১২
কোন ছার দেব হয় লঘুজাতি কাণী |
ঘরে লুকাইয়া তারে দেও জল পানি ||
সেই ছার কাণীরে দেব বল কোন মুখে |
ছোট বড় লোক জন পূজে তারে সুখে ||
আর যদি শুনি আমি পুজহ কাণীরে |
আর না থুইব প্রাণ তোমার শরীরে ||
সোনেকা বলিল তুমি আপনা বুঝ |
মনুষ্য হইয়া তুমি দেবের সঙ্গে যুঝ ||
তুমি হেন স্বামী যার সে বাঁচে কেনে |
সহবাসে কাজ নেই চলিলাম বনে ||
কাননে চলিল তবে সোনেকা সুন্দরী |
ইহা দেখি ভয় পাইল চান্দ অধিকারী ||
সোমাই পন্ডিত বলে কার্যে দাও তাড়া |
শতেক ক্রন্দনে ফিরি না আসিবে মড়া ||
ক্রন্দন সম্বর সাধু কেন কর শোক |
মনদিয়া কুমার সবের চিন্ত পরলোক ||
প্রাচীন লোকের মুখে হেন কথা শুনি |
মরিলে নাগের ঘায় না পোড়ে আগুনি ||
স্রোতে ভাসাইয়া দাও যথা তথা যায় |
দৈবগতি গাড়ুরিয়া যদি লাগ পায় ||
এতেক শুনিয়া চান্দ ভাবে মনে মন |
সংবাদ দিয়া মালাকার আনিল তখন ||
চান্দর বোলে মালী আইল আথেব্যথে |
প্রণাম করিয়া মালী দাঁড়াইল সম্মুখে ||
চান্দ বলে মালাকার কর অবধান |
কলার ভেলা শীঘ্র করহ নির্মাণ ||
ছয় পুত্র ভাসাইয়া দিব গাঙ্গুরীতে |
এতেক বলিয়া চান্দ কান্দে বিপরীতে ||
চান্দর বচন মালী না করিল আন |
ভেলার ভেরুয়াখান করিল নির্মাণ ||
নেতের চান্দোয়া দিল নেতের মশারি |
গাঙ্গুরীতে ভাসাইয়া দিল শীঘ্র করি ||
তবে মনসা দেবী ভাবে মনে মন |
ভুরের নিকটে দেবী আসিল তখন ||
এসব দেখিয়া পদ্মা ভাবে মনে মন |
মন্ত্র বলে জীয়াইল কুমার ছয়জন ||
এতেক দেখিয়া পদ্মার কৌতুক বিস্তর |
গঙ্গার পুরী লইয়া চলিল ছয় কুমার ||
যত্ন করিয়া রাখিব তোমার ঠাঁই |
যখনে চাইব আমি তখনি যেন পাই ||
প্রণাম করিয়া চলে দেবী বিষহরি |
বিনয় করিয়া চলে আপনা পুরী ||
বিজয় গুপ্ত রচে পুঁথি মনসার বর |
ছয় কুমার বধ পালা এইখানে সোসর ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর মনসা মঙ্গল
ছয় কুমার বধ পালা
১ হেন মতে শঙ্কুর বধ করিল মনসায় | নেতা নেতা বলিয়া ডাকিল সর্বদায় || বুদ্ধি বল নেতা মোরে ধোপার কুমারী |
|
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ছয় কুমার বধ পালা
৬
কামে অচেতন চান্দ না করে বিচার |
ধন দিতে নটীকে সে বলে বার বার ||
চান্দর বচনে নটী হইল আগুসার |
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ছয় কুমার বধ পালা
৯
মহাজ্ঞান গেল চান্দর টুটিলেক বল |
অধিক পদ্মার সঙ্গে বাধিল কোন্দল ||
রাত্রি দিন গালি পাড়ে কোপে অহঙ্কারে |
কোপ মনে বেড়ায় চান্দ সর্প পেলে মারে ||
রাজ্যের ঠাকুর চান্দ পথে দিল থানা |
এই পাতায় কোনো ভুল-ত্রুটি চোখে পড়লে অথবা যদি কোথাও ভুল বলে মনে হয়, তাহলে আমাদের এই ইমেলে জানাবেন। আমরা শুধরে নেবার চেষ্টা করবো। srimilansengupta@yahoo.co.in
|
|
|