কবি বিজয় গুপ্ত-র মনসামঙ্গল কাব্য যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
|
লঘুজাতি কাণী কহে অশেষ লাঞ্ছনা | চম্পক নগরে মোর পূজা করা মানা || যত গালি চান্দ মোরে দেয় দন্ডে দন্ডে | তোমার দিক চাহি তার মুন্ড রাখি কন্ঠে || বাম পায়ে ভাঙ্গে ঘট নাহি করে শঙ্কা | হেতালের বাড়ি দিয়া কাঁক করিল বেঁকা || বিষ খেয়ে মরি কিবা সমুদ্রে দিব ঝাঁপ | চান্দর নাম শুনি মোর ডরে লাগে তাপ || তাহার ঘরণী সোনা অতি বুদ্ধিমতি | শিশুকাল হইতে মোরে পূজে দিবারাতি || নাগে নষ্ট করিল তাহার পুত্র ছয়জন | পুত্র শোকে গালি দেয় মোরে সর্বক্ষণ || ঝালুয়ার মন্ডপে তারে দিছি পুত্রবর | কোন বুদ্ধি করিব বল দেব মহেশ্বর || মোর বরে তাহার গর্ভে জন্মিবে কুমার | তাহা হইতে হবে মোর বাদের উদ্ধার || তোমার চরণে বাপ মোর নিবেদন | সেনেকার গর্ভে জন্ম হইবে কোনজন || মোর যাত্রাফলে কার্য দৈবযোগ ঘটে | দূরের সাধন আসি মিলিল নিকটে || অনুরুদ্ধ ঊষা দুই দেবচরিত্র হতে | আজ্ঞা কর দুইজনে নেই পৃথিবীতে || অনিরুদ্ধের জন্ম হবে সোনেকার উদরে | ঊষা জন্ম লওয়াইব সাহে বানিয়ার ঘরে || পরম সুন্দর হইবে প্রথম যৌবন | দুইজনের করাইব বিবাহের ঘটন || আপনার নিজ কার্য করিয়া সাধন | আরবার আনিব তোমার সদন || পদ্মার বচনে শিব ভাবে মনে মন | কহিতে লাগিলা ঊষা অনিরুদ্ধের কথন || ঊষা অনুরুদ্ধ আমি দিব তোমার হাতে | আমার গোচরে পালন করিও ভালমতে || অনিরুদ্ধ ঊষা মোর প্রাণের দোসর | মর্ত্যলোকে দুঃখ তারে না দিও বিস্তর || মোর বোল না শুনিয়া যদি দাও তাপ | তুমি নহে কন্যা আমার আমি নহে বাপ || মহাদেব পদ্মাবতী যত কহে কথা | তাহা শুনিয়া উষার মনে লাগে ব্যথা || বিজয় গুপ্ত কবি কহে সঙ্কেত প্রবন্ধ | পয়ার এড়িয়া বল লাচারির ছন্দ ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
|
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
যমযুদ্ধ পালা
৩
উষারে বেড়িয়া কান্দে যত দেব গণ |
অধোমুখী হইয়া কান্দে দেব নারায়ণ ||
জয়া বিজয়া কান্দে আপনে ভবানী |
আরের কি কাজ কান্দে গঙ্গাঠাকুরাণী ||
কার্তিক গনেশ কান্দে ভবানী নন্দন |
চারিদিকে হুড়াহুড়ি কান্দে দেবগণ ||
রম্ভা উর্বশী কান্দে আরো চিত্ররেখা |
না জানি কতদিনে আর হয় দেখা ||
ঊষার ক্রন্দন যদি হইল অবসান |
অনিরুদ্ধ কান্দে শিবের বিদ্যমান ||
অনিরুদ্ধ বলে শিব ঠাকুরালী ভাল |
গোরা কাটিয়া গাছ উপরে জল ঢাল ||
কামদেবের তনয় অনুরুদ্ধ ছাওয়াল চরিত |
শিবের চরণ ধরি কান্দে বিপরীত ||
বৈদ্য বিজয় গুপ্তের সরস রচিত |
চন্ডিকার প্রসাদে রচিল মনসার গীত ||
লাজ ভয় এড়ি ঊষা উচ্চৈস্বরে কান্দে |
এই কালে বল ভাই লাচারির ছন্দে ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর মনসা মঙ্গল
যমযুদ্ধ পালা
২
পূর্ব জনমের ফলে মনসা হরিল ছলে মোরা অভাগিনী অভাজন | ভুমে লোটাইয়া গাও ধরিয়া শিবের পাও তুমি শিব সংহার কারণ || পোড়া কপালের ফলে হারালাম এক কালে মোরে শাপ দিলা অকারণ | তব কন্যা পদ্মাবতী কপট করিল অতি কামরূপে ভুলাইল মন || ঐ যে নাগের পরে ওই খাইয়াছে মোরে ওর লাগি যাব ক্ষিতিতল | চাহিল যে বিষদৃষ্টে তাল ভঙ্গ পাও টুটে এনা দোষে দিলা মোরে ফল || মুই অভাগিনী নারী দুর্লভ অমরা পুরী ছাড়িয়া যাইতে দুঃখ লাগে | যোনিতে কঠোর বাস শুনে মোর লাগে ত্রাস কত পাপ করিলাম যুগে যুগে || অনুরুদ্ধ মোর পতি বাসুদেবের নাতি কামদেব আমার শ্বশুর | পালিয়া গৌরব তার না রাখিলা একবার তুমি শিব নিদয় নিষ্ঠুর || মহাদেব বলে ঊষা তোমার দৈবের দশা এ হেন করিল দৈবগতি | এতকাল মোর আগে নৃত্য কর অনুরাগে তাহে কেন এল পদ্মাবতী || আর না ভাবিও মনে সপিলাম পদ্মার স্থানে পদ্মা তোমা করিবেন উদ্ধার | মর্ত্যে ভুঞ্জিয়া রাজ সাধিয়া পদ্মার কাজ নিকটে আসিও আরবার || শিবের সদয় ভাবে প্রশংসিল সর্বদেবে উষারাণী হইল নিঃশব্দ | পদ্মাবতীর শ্রীচরণে সানন্দে বিজয় ভণে শুনিয়া কৌতুক সভাসদ ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
|
কবি বিজয় গুপ্তর মনসা মঙ্গল
যমযুদ্ধ পালা
৪
ছাড়িয়া লাজ ভয়ে শিবের সাক্ষাতে কয়ে তুমি দেব ভুবন কারণ | তুমি দেব ত্রিপুরারি হইলা আমার বৈরী বিনা অপরাধে দিলা শাপি | শিশু হতে করি আশ তাখে তুমি করিলা নাশ তোমার পায়ে আমি বড় পাপী || নিজ অনুগত জন শাপি দিলা কি কারণ মোর পিতামহ বনমালী | তোমা সেবক বাণ অসুর ঊষার জনক মোর শ্বশুর যাহার কারণ কইলা যুদ্দ ভারি || তিলেক গৌরব তার না রাখিলা একবার তুমি শিব নিদয় নিঠুর | বিজয় গুপ্তে বলে সার মোর গতি নাহি আর দেবী পদ্মাবতী দয়া কর ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
|
ব্রহ্মা বলে শুন ঊষা আমার বচন |
তোমারে বর দিব আমি তাহে দেও মন ||
শুনিয়া ব্রহ্মার বাক্য ঊষা হরষিত |
প্রণাম করিয়া ঊষা পড়িল ভূমিত ||
ঊষা বলে ব্রহ্মা তুমি দেবের প্রধান |
আমার যত পাপপূণ্য তোমার বিদ্যমান ||
সংসারের সার তুমি জগত গোসাঞি |
লুকাইয়া পাপ করলে তোমার অবিদিত নাই ||
মোর যত পাপপূণ্য কহি তোমার ঠাঁই |
মহাদেবের শাপে আমি নরলোকে যাই ||
স্বরূপে গোসাঞি তুমি মোরে দিবা বর |
তোমার প্রসাদে যেন হই জাতিস্মর ||
ঊষার বচনে ব্রহ্মা দুঃখিত অন্তর |
এবমস্তু বলিয়া ঊষারে দিল বর ||
ব্রহ্মা বলে ঊষা তুমি করিলে বড় কর্ম |
সবুষ জাতি হইয়া স্মরিলা পূর্ব ধর্ম ||
মোর বরে হবে তোমার সুন্দর আকৃতি |
সংসারের স্ত্রী হইতে হবা তুমি সতী ||
সুবর্ণ রজত লৌহ তামা পিতল |
তোমার অগ্নি জ্বালে হইবে কোমল ||
সঙ্গীতজ্ঞানে গৌরব করিবে সর্বজন |
মরিলে মরা জীয়াইবা হারাইলে পাইবা ধন ||
অনিরুদ্ধ পতি তোমার হইবে অবশ্য |
নরলোকে ইহার না করিও রহস্য ||
সাত পাঁচ দুঃখ কিছু না ভাবিও মনে |
দুই কুল উদ্ধারিয়া আসিবা কত দিনে ||
অন্তর্ধান অগ্নিদেব হইল তখন |
স্বরূপে অগ্নিতে প্রবেশ করিল দুইজন ||
চন্দন কাষ্ঠের অগ্নি জ্বলিছে প্রচুর |
এক দৃষ্টে চাহে সব মন্দাকিনীর কূল ||
যখনে অগ্নিতে প্রবেশ করিলা দুইজন |
চিত্রগুপ্ত করে যমপুরে লিখন ||
আয়ুশেষে পরমায়ু দিনে দিনে টাকি |
পাতায় পাতায় লিখে ওয়াসিল বাকী ||
টুটিল কাল তাহার আয়ু হইল শেষ |
কোন দূত পাঠাইয়া করহ আদেশ ||
চিত্রগুপ্তের মুখে যম শুনিয়া বচন |
দোহারে আনিতে দূত পাঠায় তিনজন ||
ত্রিদশ ত্রিশিরা আর শূকর বদন |
লোহার দড়ি পরিধান রক্ত লোচন ||
লোহার দড়ি লইয়া চলে মুষল লোহার |
বায়ুগতি যায় দূত শূন্যে করি ভর ||
তাড়াতাড়ি যায় দূত জাহ্নবীর তটে |
বেড়িয়া রহিল গিয়া কুন্ডের নিকটে ||
লোহার মুদগর মারে কুন্ড চাপিয়া |
অনিরুদ্ধ ঊষার প্রাণ লইল কাড়িয়া ||
অনিরুদ্ধ ঊষার প্রাণ দূতে লইয়া যায় |
পাকল আঁখি করিয়া বিষহরি চায় ||
কোথা হইতে আসিয়াছ তুই বেটা কে |
প্রাণে যদি না মরিব পরিচয় দে ||
পাপীজন নিতে তোর যমের অধিকার |
পূণ্যজন নিতে যম কোথাকার ছার ||
দ্বারকার লোক নিতে না পার একগোটা |
হরিশচন্দ্র রাজা হইতে মোর দেখ টুটা ||
কোন কর্ম করিতে যম হইল উপযোগ |
সর্বক্ষণ পাপ ভুঞ্জে শরীরে বাড়ে রোগ ||
দূত বলে পদ্মাবতী বৃথা হও কুপিত |
আমার যমের অধিকার সংসার বিদিত ||
স্থল জল হুতাশন ভাস্কর আদি যত |
লম্বোদর লম্ব অষ্ট দেখিতে অদ্ভুত ||
হেন যমের পদ্মা যে হয় তাপি |
যমের দোষ নাই সেই সব পাপী ||
ত্রিদশ ভুবনে মোর যম মহাশয় |
তাহার প্রসাদে মোর কারে নাহি ভয় ||
যাহার নুন খাই তাহার কর্ম করি |
অকারণে পাকল আঁখি কর বিষহরি ||
যমের প্রসাদে নাই কাহার কুপ্পরি |
অকারণে লজ্জা পাইবা জয় বিষহরি ||
দূতের মুখে পদ্মাবতী পাইয়া অনুত্তর |
নাগগণের তরে দেবী বলে ধর ধর |
ধর ধর বলিয়া দেবী জ্বলিয়া গেল কোপ |
হরিণ দেখিয়া হেন বাঘে মারে ছোপ ||
পদ্মার আদেশে নাগ মারিলেক ছোপ |
শুকনা কাষ্ঠেতে যেন কুড়ালের কোপ ||
বিস্তর দুর্গতি কৈলা কেহ নাহি কাছে |
ঝড়ে উড়াইল যেন দুই তাল গাছে ||
বিষের আজরে লোটায় ভূমিতলে |
অনিরুদ্ধ ঊষার জীব পদ্মা বাঁধিল আঁচলে ||
এতেক শুনিয়া দূত পদ্মার বচন |
দুই জনের জীব লইয়া করিল গমন ||
এতেক দেখিয়া তবে দেবী বিষহরি |
ধামু ধামু বলি পদ্মা ডাকে শীঘ্র করি ||
পদ্মাবতী বলে নাগ শুনরে বচন |
দুই দূতে ফল দেও যেন লয় মন ||
চারি নাগ লইয়া ধামু চলিলা আপনি |
বায়ুগতি চলে যেন হেন অনুমানি ||
দেখিতে না দেখি যেন বায় উড়ে রেখা |
ধামুর সঙ্গে যমদূতের পথে হৈল দেখা ||
ধামু নাগের সহিত দূতের পথে হইল দ্বন্দ্ব |
এই কালে বল ভাই লাচারির ছন্দ ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর মনসা মঙ্গল
যমযুদ্ধ পালা
৬
চল চল আরে দূত জড়িয়া বাণের সুতা উহার মাতা মনসার দাসী | যে জন পদ্মার দায় তারে নারে যমরায় আর যেবা জন মরে কাশী || অনুচর তুই ছার পদ্মারে না বলে আর, সকল সংসারে যারে পূজে | যেজন গঙ্গায় মরে যম নিতে নাহি পারে সে জন বৈকুন্ঠে সুখ ভুঞ্জে || তার প্রভু ধর্মরাজ সেই কিবা বোঝে কাজ কেবা তারে হেন বুদ্ধি দেও | বিচারিয়া চাহ পাছে কোন কালে হেন আছে পদ্মার সেবক জনে নেও || অহঙ্কারে ধামু রোষে কোপে যত দূত হাসে ঘনঘন মোচরায় দাড়ি | কোপ মুখে যম দূতে লোহার মুদগর হাতে ধামুরে মারিতে মারে বাড়ি || পঞ্চনাগ একভিত রুষিল দূতের চিত সংগ্রাম বাধিল অদ্ভুত | বিজয় গুপ্ত কবি কয় রসিকের মনে লয় নাগ মুখে দাঁড়ান যমদূত ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
|
শুনিয়া দূতের কথা ধর্মের নন্দন |
জ্বলিয়া উঠিল যেন জলন্ত হুতাশন ||
যম বলে আরে দূত শুন মোর বাণী |
মোর দূত মরিয়াছে কানি বড় প্রাণী ||
নর বেটা চান্দ তারে জিনিতে না পারে |
আজি সে কানি কি আমার দূত মারে ||
আমার সঙ্গে বাদ করে এত বড় পদ |
আজি রণে আসিলে হইবে স্ত্রী বধ ||
এত বড় দর্প কানির কিছু নারে বোঝে |
শৃগাল হইয়া সে সিংহের সঙ্গে যোঝে ||
সিংহের সনে যুঝিতে আসে হইয়া শৃগাল |
আজি রণে করিব তার বংশের পাখাল ||
সাজ সাজ আরে দূত পর তাড়াতাড়ি |
ঝাটে করি মার গিয়া জয় বিষহরি ||
শুনিয়া যমের বাক্য যত সৈন্যগণ |
রণমুখে ধাইয়া চলে হরষিত মন ||
বিজয় গুপ্ত বলে গাইন কৌতুক হইল বড়ি |
এই কালে বল ভাই সরস লাচারি ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর মনসা মঙ্গল
যমযুদ্ধ পালা
৮
সাজ সাজ বলে দূত লোহার মুদগর হাতে ঝাটে সাজ উষা আনিবার | যমে হাহাকার করে পাঁচশত দূতে লড়ে জয় জয় করে আনিবার || সাজিয়া যমরায় যুদ্ধ করিতে যায় সাজ সাজ বলে দূতগণে | বীর দর্পে লড়ালড়ি সবে করে হুড়াহুড়ি সাজিয়া চলিলা সর্বজনে | | জয়ধর্ম জয়মঙ্গলা যমরাজার দুই শালা আগুয়ান চলে দুই জন | ধর্ম ধর্মক্ষ দূত আর চলে যায় ভূত চলে সবে হরষিত মন || কালা চোরা নিশা খোঁড়া নিলজ্জিত দন্ত মুড়া বিষমুখা বিকট দশন | জয়মঙ্গলা কালা যমরাজের দুই শালা ভাটির রাজ্যে যাহার আসন || এক দূত নামে লোদ হাতে পায় চারি গোদ তাহার ভাই শূকরবদন | এক দূত নীলাই এই আছে এই নাই তারা যেন সঞ্চরে গগন || এক দূত ব্রজকাল যাহার কান্ধে লোহার শাল মূলাদাঁতী খিচরীর ভূত | দেখিয়া তাহার সাজন চলে যত দূতগণ সমরে চলিলা রবির সুত || ত্রিপদ ত্রিশিরা লড়ে যমের হুঙ্কার পড়ে সাজ সাজ বলে দূতগণে || দেখিয়া কটকের সাজন কৌতুক ধর্মরাজন চলে যম যুদ্ধের কারণে || সাজিল যে ধর্মরায় যুদ্ধ করিবারে ধায় রণভূণি করিল পয়ান | ধূমধুমী বাদ্য বাজে যুদ্ধ করিবারে সাজে যত দূত ধরিল যোগান || নারদ কহে বিবরণ শুনে যত দেবগণ দেখিতে আসিল পুরন্দর | সকল দেবতা সাজে রণজয়ী বাদ্য বাজে যম হইল বৈতরণী পার || যে সকল হইল পার নাহি কাহার নিস্তার আপনি হরিবা যমরায় | যদি নিজে ভাল চাহ পদ্মার শরণ লহ বৈদ্য বিজয় গুপ্তে গীত গায় ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
|
তোমার সহিত যম করিবেক রণ |
তে কারণে আমা সব পাঠাইছে শমন ||
আমা সবার কথা দেবী শুন গো বচন |
অনিরুদ্ধ উষার জীব দেও এইক্ষণ ||
নহে আসি যুদ্ধ কর যদি লয় মন |
আজুকার যুদ্ধে হইবে তোমার নিধন ||
আমার যমের সনে বাদ করে হেন জন নাই |
আজুকার যুদ্ধে হইবে তোমার নিধন ||
আমার যমের সনে বাদ করে হেন জন নাই |
আজুকার যুদ্ধে তোমার ভাঙ্গিবে বড়াই ||
দূত মুখে পদ্মাবতী শুনিয়া বচন |
জ্বলিয়া উঠিল যেন জ্বলন্ত হুতাশন ||
কোপে রাঙ্গা আঁখি পদ্মা চাহে চারি ধারে |
মোর আগে বেটা এত অহঙ্কার করে ||
স্ত্রী জাতি দেখিয়া মোরে নাহি ভাবে সম |
আজি রণে পশিলে হইবে যমের যম ||
এতেক শুনিয়া দূত চলিল সত্বর |
কহিল সকল কথা যমের গোচর ||
শুনিয়া দূতের কথা যমের পরিপাটী |
সংবাদ দিয়া আনে পদ্মা নাগ উনকোটি ||
বিজয় গুপ্ত বলে গাইন কৌতুক হইল বড়ি |
এই কালে বল ভাই সরস লাচারি ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কি বুদ্ধি করিব নেতা বল এইক্ষণ ||
নেতা বলে পদ্মাবতী শুন গো বচন |
আমি বিদ্যমানে চিন্তা কর কি কারণ ||
এক যুক্তি বলি দেবী তাহে দেও মন |
সংবাদে উনকোটী নাগ আন এইক্ষণ ||
তাহার চতুর্দশ যম মোর নাগ উনকোটী |
বিষ জ্বালে পুড়িয়া মারিব না রাখিব একগোটি ||
নেতার বচনে পদ্মার আনন্দিত মন |
নাগ নাগ বলিয়া দেবী করিল স্মরণ ||
আসিল উনকোটী নাগ দেবীর দরশন |
দেবী বলে নাগ তোমরা শুনরে বচন ||
কিরূপে জিনিব যম রবির নন্দন |
নাগগণে বলে মাতা চিন্তা নাহি মন ||
আমরা জিনিব যম রবির নন্দন |
নাগগণে বলে মাতা চিন্তা নাহি মন ||
নাগের কথায় পদ্মাবতী আনন্দিত মন |
নাগ আভরণ পরি চলিল তখন ||
কামরাজ নাগ পরে সিঁথিতে সিন্দুর |
কর্ণফুলিয়া নাগে দেবী পরে কর্ণফুল ||
পায় পাশুলি শোভিয়াছে ধোড়া |
পায়ের মল খাড়ু বিঘতিয়া বোড়া ||
তেসারিয়া সাপে দেবীর হৃদয়ের কাঁচুলি |
পিঙ্গলিয়া নাগে পরে পলার হাঁসলী ||
মণিনাগ দিয়া দেবীর মাথায় মণি জ্বলে |
নাগ আভরণ দেবী সাজিল শরীরে ||
নাগরথে চড়িয়া দেবী আনন্দিত মন |
নেতার সংহতি করি চলিল তখন ||
সমুদ্রের কূলে করিলা রণভূমের স্থান |
কোটী কোটী নাগে গিয়া ধরিল যোগান ||
বৈদ্য বিজয় গুপ্ত মনসার দাস |
যাহার কবিতায় হইল গীতের প্রকাশ ||
তোমার চরণে মাগো রহুক ভকতি |
বলিব লাচারির গীত পয়ারের গতি ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর মনসা মঙ্গল
যমযুদ্ধ পালা
১১
ছোট বড় নাগ সাজে চলিল পদ্মার কাজে রণসাজে সাজায় ব্রাহ্মণী | প্রথমে অনন্ত চলে শিরে হাজার মণি জ্বলে গর্জনেতে কাঁপে মেদিনী || জয় জয় দিয়া হাঁক চলিল তক্ষক নাগ বিষজ্বালে দহে রবি শশী || যত বৃক্ষ আশপাশ সকল হইল নাশ আকাশে উঠিল ভস্মরাশি || জয় জয় বাদ্য বাজে উনকোটী নাগ সাজে মনসা সাজিল নাগরথে | বিজয় গুপ্ত সুরচিত রচিল পাঁচালী গীত মনসার চরণ ধরি মাথে || পদ্ম মহাপদ্ম চলে গর্জনে ধরণী টলে যাহার বিষে মোহ দেবরাজে | ফুলি কর্কট নাগে চলিল সবার আগে আপনি চলিলা নাগরাজে || ফণী নাগ চলে ধাইয়া বিষের ভান্ডার লইয়া যাহার ঘায় নাহিক নিস্তার | নাগগণ সঙ্গে করি বিচিত্র রথে চড়ি নেতা হইলা আবাসের বাহির || আর নাগ মহাকাল মুখ যাহার পাতাল পদ্মারে প্রণাম করি বলে | যদি আজ্ঞা কর তুমি যমেরে গিলিব আমি কোন কার্যে আর নাগ চলে || এইরূপ নাগ সবে প্রণাম করিল তবে রণস্থলে মিলিল তখন বিজয় গুপ্তের প্রবন্ধ রচিল লাচারির ছন্দ দেখিয়া হরিষ সর্বজন ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
|
অর্ধচন্দ্র বাণ যম লইল তখন ||
জীবন্যাস করিয়া বাণ এড়ে শীঘ্রগতি |
পবনবাণে নিবারিল দেবী পদ্মাবতী ||
শিলামুখ বাণ দেবী করিল সন্ধান |
ইন্দ্রবাণে যমরাজ করে দুইখান ||
ঐশিক বাণ যম এড়িলা ধনুকে |
বজ্রঘাত শব্দে পড়ে মনসার বুকে ||
বাণ খেয়ে মোহ গেলা পদ্মাবতী |
গরুর বাণ যমরাজ এড়ে শীঘ্রগতি ||
গরুর দেখিয়া যত সর্প পলায় |
রহ রহ বলিয়া ডাকে দেবী মনসায় ||
অর্ধচন্দ্র বাণ এড়ে দেবী পদ্মাবতী |
সেই বাণে কাটিলেন যমের সারথি ||
নেতা বলে পদ্মাবতী হও স্থির কায়া |
এড়হ অনন্ত বাণ চুর হইবে মায়া ||
নেতার বচনে আনন্দিত মন |
যত মহেন্দ্র অস্ত্র এড়িল তখন ||
যত যত ব্রহ্মঅস্ত্র মনসার শিক্ষা |
যম রাজার উপর করিল পরীক্ষা ||
বাণ ঘায়ে ব্যথা পাইয়া ধর্মরায়ে |
কাল মুদগর তুলিয়া লইল বাহে ||
মুদগর লইয়া যম থর থর কাঁপে |
ডাক দিয়া মনসারে বলে মহাকোপে ||
যম বলে কানি সাহস বুঝি থাক |
এড়িলাম মুদ্গর আপনারে রাখ ||
এই বলিয়া যমরায় এড়িল তখন |
মুদ্গর দেখিয়া পদ্মা ভয় পাইল মন ||
নেতা নেতা বলে ডাকে ঘনে ঘন |
নেতা আসি হেন কালে দিল দরশন ||
মুদ্গর ফুটিয়া পদ্মা ভয় পাইল ব্রাহ্মণী |
নেতা বলে দেবী তুমি দুষ্ট-সংহারিণী ||
যাবৎ নহে য়মরায় করে উপহাস |
অনন্ত ঘিরিয়া তুলি এড় নাগপাশ ||
নেতার বচনে মনসা পাইল সন্ধি |
এড়িলেক নাগপাশ যম হইল বন্দী ||
হাসিয়া মনসা দেবী চলিল তখন |
সত্বরে চলিয়া গেল যমের সদন ||
হরিষে মনসা দেবী ধরে তাহার হাতে |
গলায় কাপড় দিয়া তুলিলেক রথে ||
বিজয় গুপ্ত বলে ভাই কৌতুক হইল বড়ি |
সংবাদ পড়িল গাইন বলরে লাচারি ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর মনসা মঙ্গল
যমযুদ্ধ পালা
১৩
বাপের স্ত্রী সতাই গেলাম তাঁহার ঠাঁই বাদ করিলাম তাঁহার সনে | অনেক কাকুতি তায় কার্তিকে ধরিয়া পায় তবে গৌরী জিয়াইলাম আমি || আমার বিষের তেজে নীলকন্ঠ দেবরাজে আপনে হইল অচেতন || কিসেরে বা মা কর রাও মাথায় তুলিয়া চাও যুদ্ধ হারিলা রবির নন্দন || এত তিন ভুবনমাঝে মোরে জিনে কেবা আছে ইহা তুমি না শুনিও কানে || আমার বিষের ঘায় ইন্দ্রাদি দেব স্থির নয় তাতে কিরূপে জিনিবা সকলে || পদ্মার অভক্ত যে অবিলম্বে তার ক্ষে ভক্তজনে সর্বত্র কল্যাণ || বিজয় গুপ্ত কহে সার মোর গতি নাহি আর সভাসদে কহে সম্মান ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
|
নাগপাশে মনসা করিল দেখ বন্দি ||
নারদ বলেন যম না কান্দিও আর |
অনিরুদ্ধ ঊষা পদ্মা পাইল শিবের দ্বার ||
( নারদ বলিল দেবী শুন গো বচন |
বিদায় দেও যাউক যম আপন ভবন ||
নারদের বচনে পদ্মা করিলা আদেশ |
যম ছাড়িয়া নাগ সব গেল নিজ দেশ ||
পদ্মা বলে যম কেন করিলা বিবাদ |
মিছা মিছা পাইলা দুঃখ ক্ষম অপরাধ ||
যম বিদায় দিল জয় বিষহরি |
আনন্দে চলিয়া গেল আপনার পুরী ||
নারদ চলিয়া গেল ব্রহ্মার গোচরে |
যাহার যে নিজালয়ে চলিল সত্বরে || )
বিজয় গুপ্ত রচে পুঁথি মনসার বর |
যম যুদ্ধ পালা গাইলাম এখানে সোসর ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর মনসা মঙ্গল
যমযুদ্ধ পালা
১ ( শুন শুন আর লোক হয়ে একমন | সরস প্রসঙ্গ যত গীত বিবরণ || সেই সব কথা শুন কর্ণপুট ভরি | যেই রূপে অনিরুদ্ধ হরিল বিষহরি || এক দিন অনিরুদ্ধ ঊষা দুইজন | পর্বত শিখরে দোহে করিছে ভ্রমণ || ছয় পুত্র শোকে সোনা করিছে ক্রন্দন | তাহা দেখি ঊষারাণীর বিষাদিত মন || ঊষা বলে শুন প্রভু আমার বচন | কিরূপে সোনেকার হবে শোক নিবারণ ||
|
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
যমযুদ্ধ পালা
৫
তুমি জগন্নাথ সংসারের সার |
বিনা অপরাধে শাপ হইল ঊষার ||
শিশুকাল হইতে থাকি তোমার পাশে |
কামদেব তনয় প্রভু তোমার দাসে ||
তোমাতে ভক্তি না হইল মুই ছার পাপী |
নিজ অনুগত গোসাঞি কোন দোষে শাপি ||
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
যমযুদ্ধ পালা
৭
বিষের জ্বালায় দূত করে ছটফট |
অনেক শান্তিতে গেলা যমের নিকট ||
সর্বাঙ্গে নাগের গা রক্ত পড়ে বাহিয়া |
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
যমযুদ্ধ পালা
৯
পদ্মাবতী আই সবারে দেও বর |
বৈতরণী পার যম হইল সত্বর ||
একে একে পার হইল বৈতরণী জল |
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
যমযুদ্ধ পালা
১০
শুন শুন আরে দূত শুন রে বচন |
কি করিতে পারে মোরে ধর্মের নন্দন ||
এত বড় দর্প বেটার বলিয়া পাঠায় সে |
সে তো নরের যম চার যম কে ||
এই কথা কহিও দূত তোর ধর্মরাজের আগে |
সুখে থাকিতে তারে বিধি বিধি বাদে লাগে
আমারে নারী লোক দেখে পুরুষ সেই জন |
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
যমযুদ্ধ পালা
১২
রণস্থলে পদ্মাবতী আসিয়া তখন |
নেতা নেতা বলি দেবী ডাকে ঘন ঘন ||
পদ্মার আদেশে নেতা আসিল তখন |
পদ্মাবতী বলে নেতা শুন গো বচন ||
যত নাগ আসিয়াছে যুদ্দ করিবারে |
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
যমযুদ্ধ পালা
১৪
( সেই পদ্মাবতী সবারে দেও বর |
বন্ধন সহিত যম রহিল সত্বর || )
এই পাতায় কোনো ভুল-ত্রুটি চোখে পড়লে অথবা যদি কোথাও ভুল বলে মনে হয়, তাহলে আমাদের এই ইমেলে জানাবেন। আমরা শুধরে নেবার চেষ্টা করবো। srimilansengupta@yahoo.co.in
|
|
|