কবি বিজয় গুপ্ত-র মনসামঙ্গল কাব্য যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
|
বেহুলারে কোলে করি জুড়িল ক্রন্দন || শ্রাবণের ধারা যেন ঝরিছে নয়ানী | চরণে পড়িয়া বেহুলা মাগিল মেলানি || পতির চরণ ধরি বসিল মাজুষে | দেবগণ ধন্য ধন্য করয়ে আকাশে|| সাধু সাধু বলি সর্বলোকে ঘোষে | মনসার চরণ ভাবি চড়িল মাজুষে || স্বামী বিনে বেহুলার গতি নাহি আর | এ সময়ে পদ্মা মোরে করিও উদ্ধার || প্রচন্ড বাতাসে ভুরা মাঝে লইয়া যায় | নেহারিয়া সদাগর শানে আছাড় খায় || পুত্র পুত্র বলি চান্দ ভূমে যায় গড়াগড়ি | সংবাদ পড়িল গাইন বলরে লাচারি ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
|
যোড় হাত করি বলে শুন দেবী মাও ||
ভক্তিভাবে পূজিলাম আমি শিশুকাল হইতে |
তাহার উচিত ফল দিলা হাতে হাতে ||
কাল বিবাহের উত্সবে গেলাম চম্পক নগরী |
অদ্য মরা স্বামী কোলে লইয়া ভাসি গাঙ্গরি ||
তোমার সেবা করি আমি হারাইলাম সকল |
তোমার কিছু দোষ নাহি আমার কর্মফল ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
. **************** সূচি...
পুরুষোত্তম ঘোষ বিজয় গুপ্তের গায়েন ছিলেন।
মিলনসাগর
|
শ্বেতকাক দেখি সুমিত্রা বলেন গোপাল |
আচম্বিতে শ্বেতকাক কার্য নহে ভাল ||
দক্ষিণ পড়িলে কাক কার্যে দেখি আউল |
সুমিত্রা কাকের সম্মুখে আনি দিল চাউল ||
অন্দরে দাঁড়াইয়া দেখে যত নারীগণ |
খলখলি করিয়া কাক ডাকে ঘন ঘন ||
তাহার নিকটে কাক ঘন ঘন ডাকি |
কাকের মুখেতে পত্র সুমিত্রায় দেখি ||
সুমিত্রা বলেন কাক ধর্ম অধিষ্ঠান |
সত্য কহিও কাক না করিও আন ||
লক্ষ্মীন্দর বেহুলার কুশল বার্তা পুছি |
এত বলি সাক্ষাতে রাখিলেন কুচি ||
পূর্বে আর দক্ষিণেতে দিল নিয়া চাউল |
দক্ষিণে পড়িও যদি কার্যে থাকে আউল ||
সত্য কথা কহ কাকে কিছু নহে লড়ে |
ঠোঁটে পত্র লইয়া কাক দক্ষিণ ভাগে পড়ে ||
কাকের জিজ্ঞাসিতে দুঃখ লাগে বড়ি |
এইকালে বল ভাই করুণ লাচারি ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
৬
কাঁদিয়া কহিলা বধূ শাশুড়ীর আগে |
বিয়ার রাত্রে বেহুলার স্বামী দংশিয়াছে নাগে ||
বধূর মুখেতে শুনি বেহুলার সমাচার |
ভূমে পড়ি সুমিত্রা করে হাহাকার ||
সুমিত্রা বলে বিধি কি হইল মোরে |
আছাড় খাইয়া পড়ে ভূমির উপরে ||
ভূমিতে পড়িয়া কান্দে করে গড়াগড়ি |
বিলাপ করিয়া কান্দে দুঃখ লাগে বড়ি ||
এইকালে বল ভাই করুণ লাচারি ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
৭
কোথা গেলে আরে অবাধ সদাগর |
সংসার খুঁজিয়া তুমি না পাইলে বর ||
কোথা হইতে আনিলা নাগের বাদুয়া |
নাগের বাদুয়ার ঠাঁই বেহুলা দিলা বিয়া ||
কোথা গেলে আরে পুত্র হরি সদাগর |
বেহুলারে আনি মোর প্রাণ রক্ষা কর ||
মায়ের আবাসে শুনি ক্রন্দনের রোল |
হরি সাধু ধাইয়া আইল হইয়া ব্যাকুল ||
সুমিত্রা বলেন শুন পুত্র সাধু হরি |
মরা লইয়া যায় বেহুলা মনসার পুরী ||
সুমিত্রা বলেন যাও শীঘ্র করিয়া |
যত দূর পাও বেহুলারে আন গিয়া ||
হরি সাধু বলে মাতঃ শিরে কর দিয়া |
কতদূর গেল বেহুলা দেখিয়া আসি গিয়া ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
৮
মায়ের চরণ বন্দি হরি সাধু লড়ে |
তরাসে বাহিরে গিয়া অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে ||
যেই বাঁকে ভাসে বেহুলা সাহের কুমারী |
সেই বাঁকে মেলে গিয়া মহাসাধু হরি ||
কলার মাজুষে ভাসে মরা স্বামী কোলে |
উচ্চৈঃস্বরে হরি সাধু বেহুলা বেহুলা বলে ||
হরি সাধু বলে বেহুলা যাও কোন ঠাঁই |
আসিয়াছে অভাগিয়া তব জ্যেষ্ঠ ভাই ||
আসিয়াছি তোমায় নিতে মায়ের আজ্ঞা পাইয়া |
মাজুষ চাপাও ঘাটে কথা কও রইয়া ||
হরি সাধু দেখিয়া বেহুলা দুঃখিত অপার |
মাজুষে থাকিয়া বেহুলা করে নমস্কার ||
বাপ ভাই ত্যজি বেহুলা কোন দেশে যাও |
বাপ মায়ের ঘরে বসি ঘৃত অন্ন খাও ||
কেবা দিবে ঘৃত চাউল কেবা দিবে হাড়ি |
মুখ চেয়ে গালি দিবে বেহুলা কাঁচা রাঁড়ি ||
নেউট নেউট বেহুলা মোর বোল ধর |
গাঙ্গরির কূলে পোড় মরা লক্ষ্মীন্দর ||
পথের দোসর নাই তুমি রূপবতী |
দারুণ বণিক কূলে রাখিবে অখ্যাতি ||
বেহুলা বলে ভাই মোর না বলা উচিত |
স্বামী না থাকিলে নারীর জীবন কুৎসিত ||
ঘরে যাও ভাই মোর না বলিও আর |
বাপ মায়ের চরণে জানাইও নমস্কার ||
কান্দিতে কান্দিতে হরি করিল গমন |
সুমিত্রারে জানাইল যত বিবরণ ||
সুমিত্রা বলে লখাই নাগের বাদুয়া |
তার ঠাঁই বেহুলা সুন্দরী দিল বিয়া ||
কপাল ভাঙ্গিয়া দেখিতেছি আর কি |
কোন পাপে হারাইলাম বেহুলা হেন ঝি ||
শিশুকাল হইতে পুজি শঙ্কর পার্বতী |
উদরে ধরিলাম তাই বেহুলা হেন সতী ||
বিজয় গুপ্ত কবি কহে না কর হুতাশ |
পাইবা বেহুলার লাগ থাক ছয় মাস ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
ভুরাখানি ভাসিয়া যায় গাঙ্গরির জলে ||
বিধাতা বিড়ম্বিল গোদার কর্ম ফলে |
কাপড় কাচিয়া গোদা ঝাঁপ দিল জলে ||
হাত বাড়াইল গোদা ধরিতে মাজুষ |
বেহুলা সাক্ষী করে ধর্ম পুরুষ ||
কোপে শাল দিল বেহুলা গাঙ্গরির মাঝে |
স্রোতে বড়শী গিয়া আপন পায় বাজে ||
তাবৎ থাকিও গোদে ফুটিয়া বড়শী |
যাবৎ হেথায় আমি ফিরিয়া না আসি ||
বিজয় গুপ্তে বলে বেউলা বিলম্ব না কর |
মনসুখে বাইয়া যাও গোদার নাহি ডর ||
ধর্মের প্রভাবে বেহুলা নিরাহারে যায় |
ভাসিতে ভাসিতে গেল আর বাঁক ছয় ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
অচেতন হইয়া সে নদী তীরে রয় ||
কোপেতে বেহুলা যদি তারে পাশ দিল |
অচেতন হইয়া বেটা ভূমেতে পড়িল ||
সতী নারী ধন্য ধন্য সর্বলোকে বলে |
ভুরাখানি ভাসিয়া যায় গাঙ্গরির জলে ||
ধর্মের প্রভাবে বেহুলা নিরাহারে রয় |
ভাসিতে ভাসিতে যায় আরো বাঁক ছয় ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
আজু হইতে হও তুমি মোর ধর্ম মাতা ||
না জানিয়া দোষ করি ফল পাইলাম আই |
এক বার প্রাণ রক্ষা কর দুই ভাই ||
বেহুলা বলে পদ্মাবতী হও প্রসন্ন |
জলমধ্যে দুই ভাইর রাখহ জীবন ||
ধর্ম উদ্দেশে যাইতে হইলাম বধের ভাগী |
দুই বেটা জল মধ্যে মরে মোর লাগি ||
বেহুলার বচনে পদ্মা হাসে কুতূহলে |
জল হইতে দুই ভাইরে কূলে নিয়া তোলে ||
তল পাইয়া দুই ভাই স্মরিল গোসাঞি |
কুঁথিতে কুঁথিতে গেল ঘরে দুই ভাই ||
ধর্মের প্রভাবে বেহুলা নিরাহারে যায় |
খেয়ানী ঘাট ছাড়ি গেল বাঁক ছয় ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
১২
এক দুই করিয়া দিবস কত লিখে |
তথা হইতে গিয়া টেটনের ঘাটে ঠেকে ||
পরম সুন্দর এক প্রথম বয়স |
জলমধ্যে মরে গলে বান্ধিয়া কলস ||
তাহাকে দেখিয়া বেহূলার উপজিল তাপ |
মাজুষে থাকিয়া বলে না মরিও বাপ ||
টেটনা বলিল মাতা না বলিও আর |
অবশ্য মরিব চিত্তে করিয়াছি সার ||
খাইতে নাহিক ভাত পরিতে বসন |
জাতি মালাকার আমি স্বভাবে টেটন ||
শিশুকাল হইতে মোর খলের সঙ্গে খেলা |
বাপের ধন হারাইলাম করি জুয়াখেলা ||
কর্মফলে হারাইলাম সব ধন জন |
যেই দেখে সেই বলে দূরে যা টোটন ||
এমন দারুণ খেলা এড়িতে না পারি |
কল্যকার খেলায় হারাইলাম নিজ নারী ||
বেহুলা বলে বাপ ঘরে ফিরে যাও তুমি |
আজি হইতে তোমার দুঃখ দূর করিব আমি ||
বেহুলা আগে গিয়া ছিঁড়ে গলায় দড়ি |
টেটনের হাতে দিল মাণিক্য দোহারি ||
টেটনা বলে আমি কি করিতে পারি |
কোন কার্যে ধন নেব ঘরে নাই নারী ||
বেহুলা বলে বাছা তুমি ঘরে যাও |
মাণিক্য দোহারি বেচি কতকাল খাও ||
যাইবার কালে যদি পাই দরশন |
মনসুখে যত চাহ তত দিব ধন ||
এতেক বলিয়া বেহুলা খুলিল মাজুষ |
প্রণাম করি ঘরে চলে টেটন পুরুষ ||
সতী সাধ্বী ধন্য ধন্য সর্বলোকে বলে |
ভুরাখানি ভাসিয়া যায় গাঙ্গরির জলে ||
মাসেকর মরা হৈল গায়ে লাগে বাতাস |
স্রোতে পুঁজ পড়ে কিছু নাহি রক্তমাংস ||
মরা স্বামী লইয়া বেহুলা চলে একেশ্বরী |
নাগরথে চিন্তিয়া বিকল বিষহরি ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
১৩
পদ্মাবতী বলে নেতা সমুদ্র কূলে যাও |
ব্যঘ্ররূপ ধরিয়া লখাইর অস্থি খাও ||
অস্থি মাংস সব খাইও না থুইও শেষ |
পাছে যেন খুঁজিয়া তার না পায় উদ্দেশ ||
গাঙ্গরির মধ্যে বেহুলা চিন্তা মনে মন |
একখান চর দেখে অতি রম্য বন ||
বিপরীত শালবন ব্যঘ্র শোভে তাতে |
মানুষের গতি নাই সাত দিনের পথে ||
শালবন দেখি বেহুলার স্থির নহে হিয়া |
বিক্রম করিয়া বাঘিনী উপস্থিত গিয়া ||
অপূর্ব সুন্দর গাও বড়ই সুঠাম |
উভা লেজ করিয়া সারিল দুই কান ||
খাম খাম করিয়া ডাকে বিপরীত বায় |
দুই আঁখি পাকাইয়া লখাই খাইতে চায় ||
সাহের কুমারী বেহুলা বড় বুদ্ধি সতী |
হস্তযোড় করিয়া বাঘের করে স্তুতি ||
বেহুলা বলে বাঘ তুমি দেব অধিষ্ঠান |
বনচর কিন্তু মধ্যে তুমি হও সে প্রধান ||
অভাগিনী নারী আমি লোকে করে ঘৃণা |
বিয়ার রাত্রে মৈল পতি অযশ ঘোষণা ||
অনেক দিনের মরা গায়ে আছে পোক |
পচা মাংস খাইলে তোমার না যাইবে ভোক ||
অভাগিনী বেহুলার সহায় কেবা আছে |
আগেতে আমারে খাও প্রভুরে খাইবে পাছে ||
বেহুলার কথা শুনি দুঃখিত হৃদয় |
ততক্ষণে নেতা বেহুলারে দিল পরিচয় ||
আশষ বিশেষ দেখি বেহুলার ব্যগ্রতা |
বাঘিনী না হই আমি ধোপাঝি নেতা ||
মনসার অনুরোধ না পারি এড়াতে |
অকারণে আসিলাম তোমার স্বামী খাইতে ||
সাহস করিয়া বেহুলা সাধিছ সকল ||
আমি বর দিলাম কার্যে হইবে কুশল |
কিছু ভয় নাই তোমার যাও শীঘ্র করি ||
চারিদিন পরে পাইবা মনসার পুরী |
মাজুষ উপরে তুমি হইয়া দেখ খাড়া ||
হেথা হইতে যায় দেখা পদ্মার ঘরের চূড়া |
এতেক বলিয়া নেতা হইল ঊর্দ্ধ দৃষ্টি ||
বেহুলার উপর দেবে করে পুষ্পবৃষ্টি |
আর এক কথা কহি শুন উপদেশ ||
অষ্টনাগ বন্দী করি কেন দেও ক্লেশ |
না খায় আহার পানি পবন পিয়া থাকে ||
অষ্টনাগ ছাড়িয়া বেহুলা দাও একে একে |
এতেক বলিয়া নেতা কামরূপে চলে ||
স্রোতে মাজুষ দিয়া বেহুলা যায় জলে |
সমুদ্র দেখিয়া বেহুলা ভাবে মনে মন ||
পদ্মাবতী বলে নেতা শুনহ বচন ||
এইক্ষণে চল নেতা শীঘ্র করি যাও |
চিলরূপ ধরিয়া লখাইর মাংস খাও ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
১৪
উড়িয়া চলিল নেতা সমুদ্র ভিতর |
ছোপ দিয়া নিতে চাহে লখাইর পাঁজর ||
অঞ্চলে চাপিয়া তবে লখাইর পাঁজর |
চিলনীর স্তুতি করে হাত করি যোড় ||
বেহুলা বলে লক্ষ্মীন্দর তোমার জামাই |
কেমনে তাহার অঙ্গেছোপ দিবে আই ||
বেহুলা কাকুতি করে করিয়া ব্যগ্রতা |
লজ্জা পাইয়া নিজ ঘরে চলে গেল নেতা ||
নেতা যদি ঘরে গেল ভাবে মনে মন |
নেতার বচন তবে পড়িল স্মরণ ||
সাহের কুমারী বেহুলা নানা বুদ্ধি রাখে |
অষ্টনাগ ছাড়িয়া দিল একে একে ||
নাগ ছাড়িয়া দিল যদি মনে লাগে তাপ |
চিত্তের দুঃখেতে বেহুলা নাগে দিল শাপ ||
নাগজাতি হইয়া যার দন্তে বিষ বসে |
মনুষ্য দংশিলে যেন তার লেজ খসে ||
ভাসিতে ভাসিতে ভুরা চলিল তখন |
ধোপাঝির ঘাট গিয়া দিল দরশন ||
মাংস পচিয়া লখাইর পুজ ভাসে স্রোতে |
তবু বেহুলা লখাইরে না ছাড়ে কোনমতে ||
বেহুলা করুণা করে দুঃখ লাগে বড়ি |
সংবাদ পড়িল গাইন বল রে লাচারি ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
১৫
গন্ধেতে বিকট করে নিকটে ঘনাইতে নারে কেমনে লইব আমি ধুইয়া | আঙ্গুলে দিলাম টান মাংস হইল খান খান খাবলে খাবলে লইল ধুইয়া || সোনার হড়পা ভরি রাখে অস্থি যত্ন করি কাতর নয়নে চাহি দেখি | হড়পায় রাখে অস্থি চাঁপাতলায় রাখে পুতি বেহুলা কান্দে উচ্চৈঃস্বরে | বিজয় গুপ্ত বসে সার বেহুলা হইয়া পার হাঁটি যায় নেতার মন্দিরে ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
|
রাত্রি প্রভাতে যাব যথায় গোসাঞি ||
বেহুলার বচনে নেতা বলে হয় হয় |
দুই জনে কথা কহিতে রাত্রি হইল ক্ষয় ||
পোহায়া আইল রাত্রি আছে দন্ড দুই |
নেতার তরে বলিল বেহুলা বাহিরে যাই মুই ||
ধনপতি মৃদঙ্গ তুলিয়া লইল কান্ধে |
নেতার আবাস ছাড়ি চলিল সানন্দে ||
রাত্রি শেষ হইল বেহুলা চল তাড়াতাড়ি |
নেতার আবাস ছাড়ি গেল শিবপুরী
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
মধুর মৃদঙ্গ বাজে শুনিতে রসাল ||
নৃত্য গীতে শূলপাণি হইল মোহিত |
অনিমেষ নয়নে শিব চাহে কন্যার ভিত ||
মহাদেব বলে নন্দী জিজ্ঞাস কন্যায় |
আসিয়াছে মোর হেথা কিবা বর চায় ||
বেহুলা বলে গোসাঞি তুমি সংসারের সার |
আপনি সকল জান কি বলিব আর ||
বিজয় গুপ্ত বলে গাইন সানন্দ হৃদয় |
লাচারি প্রবন্ধে বল বেহুলার পরিচয় ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
নাগরথ সাজাইয়া বাপের ঘরে চল ||
ব্যাকুল মহাদেব বেহুলার নৃত্য গীতে |
আশ্বাসিলেন বেহুলারে স্বামীদান দিতে ||
সকল দেবের আগে বেহুলা যে বাদী |
প্রবোধ না দিলে তারে ছাড়িবে না দিদি ||
নাহি যদি যাও দিদি শিবের আদেশে |
লখাই জীয়াইয়া ঈশ্বর পাঠাবেন দেশে ||
হরগৌরী ভক্ত প্রধান চান্দ সদাগর |
লখাই জীয়াইলে তোমা পূজিবে না আর ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
বিরস বদন দেখি পদ্মা অধোমুখী ||
বেহুলারে দেখিয়া পদ্মার বিরস বদন |
মুখোমুখি হইয়া হাসে যত দেবগণ ||
বেহুলা বলেন শিব তুমি জ্ঞানের নিদান |
আঁচল পাতিয়া মাগি দাও স্বামী দান ||
স্বামীদান মাগো বেহুলা আনন্দিত চিত |
এইকালে বল ভাই লাচারির গীত ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
এত মায়া জান তুমি কপট রাক্ষসী ||
যেন সেবা করিলাম তেন পাইলাম ফল |
সর্বনাশ করিলা মোর আরো বল খল ||
দেবকন্যা হইয়া তুমি এত মায়া জান |
কল্য খাইয়া স্বামী আজ নাহি মান ||
বিজয় গুপ্ত স্তুতি করে মনসার পায় |
লাচারি করিতে ভাই এই ত সময় ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
করযোড় করিয়া বেহুলা শিবেরে করে স্তুতি ||
নির্মল শরীর তোমার পূজে সর্ব দেশে |
অনুচিত বাক্য কেন তোমার মুখে আইসে ||
গোসাঞিরে ভর্ৎসিতে বেহুলার মনে নাহি ভয় |
লাচারি বলিতে ভাই এইতো সময় ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
স্বরূপে ভান্ডিতে নারিলাম সাহে বানিয়ার ঝী ||
বামে বসে বেহুলা ডাইনে বসে নেতা |
ধ্যান করিয়া বসে তক্ষকের মাতা ||
বেহুলার মুখ দেখি পদ্মার লাগে ব্যথা |
বেহুলারে লক্ষ করি কহে আপন কথা ||
পদ্মা বলে বেহুলা তুমি প্রাণের দোসর |
মোর যত দুঃখ সকল তোমার গোচর ||
যত দুঃখ দিল চান্দ কহন না যায় |
বিজয় গুপ্ত স্তুতি করে মনসার পায় ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
হাটিতে বসিতে বলে ধামনা ভাতারী ||
বার মাসের তের পদ লইল লিখিয়া |
এই বেহুলা হইতে হবে বাদের উদ্ধার ||
মনসার কথা যদি হইল অবসান |
বেহুলা বলে মোর দুঃখ কর অবধান ||
বেহুলা বলে দুঃখের কথা পদ্মা দিল চিত |
এই কালে বল ভাই ছয় মাসের গীত ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
২৭
প্রথম বৈশাখ মাসে শ্বশুর মোর আইল |
মাসের ঊনত্রিসে বিবাহ মোর হইল ||
মুখচন্দ্রিকার কালে স্বামী ঢলিল পাটে |
অপযশ করে লোকে শুনি প্রাণ ফাটে ||
জ্যৈষ্ঠ মাসেতে আমি ভাসিলাম সাগরে |
সমুদ্রের ঢেউ দেখি প্রাণ কাঁপে ডরে ||
মহাসুখে বাস করে সবে পতি সঙ্গে |
আমি অভাগিনী ভাসি সাগর তরঙ্গে ||
আষাঢ় মাসেতে পড়িলাম দায় |
ঘাটের খেয়ানি বেটা মোরে নিতে চায় ||
শ্রাবণ মাসেতে পুন ঠেকিলাম দায় |
বন হইতে ব্যাঘ্র আসি প্রভুরে খাইতে চায় ||
অরণ্য দেখিয়া মোর ভয়ে প্রাণ ফাটে |
স্তুতি করি বাঘিনীরে এড়াইলাম সঙ্কটে ||
ভাদ্র মাসেতে বয় উতরালি বাও |
গলিল প্রভুর মাংস খসিল হাত পাও ||
আশ্বিন মাসেতে আমি ছিলাম একেশ্বর |
শরীর শুকাইয়া আমার হইল জর জর ||
ছয় মাস ছিলাম মাগো স্বামী নিয়া কোলে |
তোমার প্রাসাদে আমি আসিলাম কূলে ||
বিজয় গুপ্ত বলে বেহুলা না কর ক্রন্দন |
আজি হইতে দুঃখ তব হইবে মোচন ||
পদ্মাবতী বলে বেহুলা না কান্দিও আর |
এখনই জীয়াইয়া দিব বীর লক্ষ্মীন্দর ||
ডাইনে পদ্মাবতী বসে বাম ধারে নেতা |
ধ্যান জুড়িয়া বৈসে তক্ষকের মাতা ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
২৮
বাছিয়া বাছিয়া অস্থি থুইল এক ভিতে |
সংযোগে সংযোগে জোড়াও পুরুষের রীতে ||
নেতার সহিত পদ্মাবতী করিয়া কানাকানি |
খন্ড বিয়নী আনে অমৃত কুন্ডের পানি ||
নানা পুষ্পের ডালি আনি থুইল একঠাঁই |
ধ্যান করিয়া বসিলেন বিষহরি আই ||
লক্ষ্মীন্দর জীয়াইতে পদ্মা আগুসার |
চারিদিকে দেবগণে দিল পাটয়ার ||
গুরু উপদেশ পদ্মা মন্ত্র পাইল তপে |
লখাইর গায় হাত দিয়া মূল মন্ত্র জপে ||
বামে বৈসে ধোপাঝি ডাহিনে বিষহরি |
গুরুর পাও স্মরিয়া স্মরিল ধন্বন্তরি ||
দুই হস্তে আগুসারি পদ্মা জপে ধ্যান |
বুকে হাত দিয়া পদ্মা জপে মহাজ্ঞান ||
ধোপাঝির মহাজ্ঞান চারিযুগে জাগে |
খসিছিল লখাইর অস্থি সঞ্চে লাগে ||
তিন অক্ষর মন্ত্র পদ্মা জপে ধীর ধীর |
অমৃত কুন্ডের জল দিয়া সিঞ্চিল শরীর ||
( উকি দিয়া কেহ কেহ চাহে পদ্মার পানে |
ধ্যান যুড়িল পদ্মা দেবতা বিদ্যমানে ||
শব্দ করি মন্ত্র পড়ে দেবতাগণে শুনে |
বাম পাশে ধোপা ঝী মনসা দক্ষিণে || )
ক্ষীর নদীর সাগরে পড়িয়া গেল ভাটা |
বাপের সঙ্গে ঝী যায় আকাশে ছোঁয় জটা ||
কূলে থাকি ডোমনী হাসিয়া গড়ি যায় |
মনসার স্মরণে বিষ ঘা মুখে আয় ||
লখাইর গায় হাত দিয়া মূলমন্ত্র জপে |
বজ্র চাপড় মারে লক্ষ্মীন্দরের বুকে ||
চাপড় ছাড়িয়া পদ্মা বলে হরি হরি |
গুরু গুরু স্মরিয়া স্মরিল ধন্বন্তরি ||
বিজয় গুপ্ত বলে পদ্মা মানি পরিহার |
মন্ত্রছলে বলি কিছু সরস পয়ার ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
দেখিয়া লজ্জিত বেহুলা বস্ত্র নাহি গায় ||
সভামধ্যে লক্ষ্মীন্দর নাহিক বসন |
হেট মাথা করিয়া রহিল লজ্জিত হইয়া মন ||
বিজয় গুপ্তে বলে তবে কার্যে দেও চিত্ত |
হেন সময় বস্ত্র দেওয়া গাইনের উচিত ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
৩০
ভাল ভাল বলে সবে চান্দর কোঙর |
লখাইরে পরিতে দাও উত্তম কাপড় ||
যম ঘর হইতে আইল আরবার |
আইওগণ সবে দিল জয় জোকার ||
জয় জয় সবে করে হয়ে আনন্দিত |
লখাইর অঙ্গে বস্ত্র নাই বেহুলা লজ্জিত ||
স্বামী দেখিয়া বেহুলা হইল কুতূহল |
আথেব্যথে ছিড়ি নিল নেতের আঁচল ||
সেই বস্ত্র লক্ষ্মীন্দর পরে শীঘ্র করি |
বিস্মিত হইয়া তবে নেহালে দেবপুরী ||
লখাইর মুখ দেখিয়া সবে করে হায় হায় |
পাষাণে রাখিছে হিয়া লখাইর বাপ মায় ||
সর্বলোকে বলে চান্দর অমৃত হৃদয়|
সাত পুত্র মরিল তবু প্রাণ রয় ||
ধন্য সোনেকা তোমার সফল জীবন |
তোমার ঘরে জন্মিয়াছিল এই চন্দ্রবদন ||
সত্য অব্যাহতি পাইল নাচে শূলপাণি |
চতুর্দিকে বিদ্যাধরী দিল জয়ধ্বনি ||
চারিদিকে চাহে লখাই স্থির নহে মন |
বেহুলারে চিনে মাত্র না চিনে অন্যজন ||
লক্ষ্মীন্দর বলে বেহুলা বুঝিতে নারি কার্য |
কোথায় আসিয়াছি এ দেশ কোন রাজ্য ||
তুমি আমি ছিলাম লোহার বাসর |
তথা হইতে কেমনে আসিলাম এতদূর ||
লখাইর বচনে বেহুলার মনে লাগে ব্যথা |
যোড় হাত করি কহে যত ইতিকথা ||
লোহার বাসরে তোমা দংশিল নাগিনী |
তোমা লইয়া আসিলাম সমুদ্রের পানি ||
কলার মাজুষে চড়ি হইলাম দেশান্তরী |
তোমারে জীয়াইলাম আমি দেব সহায় করি ||
বেহুলার বচনে লখাইর হরষিত মন |
দুইজনে নৃত্যগীত করয়ে তখন ||
ধনপতি মৃদঙ্গ তুলিয়া লইল কান্ধে |
হাতে তালি দিয়া বেহুলা নাচয়ে আনন্দে ||
সাতপাঁচ মহাদেব মনে মনে আচে |
হাসিয়া বলিল শিব বেহুলা কেন নাচে ||
বেহুলা বলে গোসাঞি তোমার দায় নাই |
স্বামী লইয়া নাচি মুই মনসার ঠাঁই ||
বেহুলার বচনে শিব হাসে আড় আঁখি |
ঘনপাকে নাচে বেহুলা যেন মযুর পাখি ||
কাহার শক্তি বুঝিতে পারে দেবতার মায়া |
বেহুলার মুখ দেখি পদ্মার বাড়ে দয়া ||
তোমার তরে আইলাম মুই দেবের সমাজ |
লক্ষ্মীন্দর জীয়াইয়া সাধিলাম তোমার কাজ ||
শিশুকাল হইতে আমা পূজ নিরন্তর |
মনসুখে যেই চাহ সেই দিব বর ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
একে একে প্রণাম করে ভাই ছয়জন ||
একে একে সবে হইল কোলাকুলি |
লখাইর মাথায় দিল ভাইর পদধূলি ||
নায়কেরে বর দেও বিষহরি আই |
একঠাঁই মিলন হইল লখাইর সাতভাই ||
বিজয় গুপ্ত রচে পুঁথি মনসার পাঁচালি |
সাথে গীত গাহে নাচে বেহুলা বালি ||
সাতভাই সুন্দর কিছু উনা নাই |
একে একে সাতজনে গড়িছে গোসাঞি ||
হেনমতে দেবগণ করয়ে প্রশংসা |
বেহুলার নৃত্যে মোহিত হইল কুমারী মনসা ||
স্বামী জীয়াইলাম তব ভাসুর ছয়জন |
আবার বেহুলা তুমি নাচ কি কারণ ||
সকলে তুষ্ট হইলাম নৃত্যে কাজ কি |
মনসুখে যাহা চাহ তাহা আমি দি ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
সকল বেহুলার স্থানে বুঝাইয়া দিল ||
একে একে উঠিল চান্দর ডিঙ্গা চৌদ্দগোটা |
বিদায় লইয়া চলে পবনের বেটা ||
দেখিয়া কৌতুক অতি বেহুলা সুন্দরী |
আরবার নাচে বেহুলা সাহের কুমারী ||
পদ্মাবতী বলে বেহুলা আর নাচ মিছা |
বেহুলা বলে বাকি আছে ধন্বন্তরি ওঝা ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
৩৩
বেহুলার বচনে পদ্মা ঈষৎ হাসিয়া |
ধন্বন্তরি ওঝা দেবী দিলেন আনিয়া ||
পদ্মা বলে বেহুলা করহ গমন |
বিলম্ব না কর ঝাটে চল এইক্ষণ ||
পদ্মার বচনে বেহুলা উঠে হরষিত |
মনসার পদধূলি লইলেক মাথে ||
ভক্তিভাবে শিবদূর্গা করিল বন্দন |
একে একে প্রণমিল যত দেবগণ ||
লখাই বেহুলারে দেখি সবের আনন্দিত হিয়া |
সেইখানে লখাইর করাইল বাসি বিয়া ||
পদ্মা বলে বেহুলা শুনহ বচন |
অপযশ খন্ডে যেন তোমার কারণ ||
বেহুলা বলে পদ্মাবতী তুমি মোর মাতা |
এবে সে জানিলাম তোমা মোর লাগে ব্যথা ||
সত্য করি বলিলাম তোমার দুই পায় |
তোমার ঘট লইয়া যাব এই নায় ||
শিব দুর্গা দুই জন আনন্দে বন্দিয়া |
নেতার চরণ বন্দে হরষিত হইয়া ||
নৌকায় চড়িয়া সবে হইল আনন্দিত |
তের চামরের বাও পড়ে চারিভিত ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
৩৪
সবারে বন্দিয়া লখাই ডিঙ্গায় চড়ে গিয়া |
সকলে লইয়া ডিঙ্গা দিলেক খুলিয়া ||
বেহুলা বলে শুন দেবী নিবেদি আই |
তব ঘট দেও মোরে মাথায় করি যাই ||
বেহুলারে ঘট দিতে পদ্মা স্থির নয় |
আদি অন্ত যত কথা বেহুলার ঠাঁই কয় ||
মহাদেব বলে শুন বেহুলা গুণবতী |
চান্দরে কহিও যেন পূজে পদ্মাবতী ||
প্রণাম করিয়া বেহুলা পড়িল ভূমিতে |
শিরে মনসার ঘট লইল ত্বরিত ||
সকল দেবের পদ বন্দে একে একে |
পদ্মার চরণ বন্দি চলিল কৌতুকে ||
ছল ছল করে দেবের নয়নের পানি |
থাকুক অন্যের কাজ কান্দে শূলপাণি ||
সকলে নিমেষ ত্যজি একদৃষ্টে চায় |
মন কুতূহলে চড়ে মধুকর নায় ||
ডিঙ্গা বাওয়াইয়া যায় সাধুর কুমার |
সাতভাই কোলাকুলি আনন্দ অপার ||
মাঝিগণ সারি গায় শুনিতে সুললিত |
এই ভাবে বল ভাই লাচারির গীত ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
৩৬
ডিঙ্গা বাওয়াইয়া চলে লক্ষ্মীন্দর |
নেতা ধোপাঝীর ঘাটে নৌকা মিলিল সত্বর ||
বেহুলা বলে প্রাণনাথ নিবেদি চরণে |
অস্থি থুইলাম অভাগিনী এই স্থানে ||
এই চম্পাতলে অস্থি করিলাম পোতন |
পশ্চাতে নেতার সঙ্গে হইল দরশন ||
বেহুলার বচনে লখাই কূলে তোলে বাট |
সুবর্ণের বান্ধিয়া দিল ধোপাঝির ঘাট ||
বেহুলা বলে দুঃখের কথা নিবেদি রাঙ্গা পায় |
যাবার কালে বাঘিনী খাইতে আসিল তোমায় ||
বাঘের স্তব করিলাম যোড় করি কর |
নিজরূপ ধরিয়া তবে নেতা গেল ঘর ||
এতেক শুনিয়া লখাই বেহুলার হাতে ধরি |
বড় ভাগ্যে পাইলাম তোমা হেন নারী ||
এত শুনি লক্ষ্মীন্দরের ক্রোধ হইল মনে |
শালবন এড়িয়া বাঘ মারিল তখনে ||
চম্পকের রাজা সাধু ধনে অকাতর |
বাঘপুরী নামে তথায় স্থাপয়ে নগর ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
৩৭
এ বাঁক হইতে বেহুলা আর বাঁকে যায় |
টেটনের ঘাটে গিয়া পৌঁছিল নায় ||
চৌদ্দ ডিঙ্গা দেখি টেটনা করে পরিহার |
পূর্বে সত্য করিয়াছে মা সত্যে হও পার ||
শুনিয়া লখাইর মনে চমত্কার লাগে |
কোন সত্য করিয়াছ প্রিয়া মনুষ্যের আগে ||
লখাইর বচনে বেহুলার মনে লাগে ব্যথা |
যোড়হাতে কহে পূর্ব টেটনের কথা ||
টেটনের যত দুঃখ কহিতে না পারি |
জুয়া খেলা খেলিয়া হারাইল উহার নারী ||
ভিক্ষা মাগিয়া খায় ঘরে নাহি বসে |
সাগরে নামিয়া মরে গলায় কলসে ||
এতেক দেখিয়া মোর দুঃখে পোড়ে হিয়া |
সত্য করি উহারে করাব পঞ্চ বিয়া ||
বেহুলার বচন লখাই না করিল আন |
চৌদ্দ ডিঙ্গা সেইখানে করিল চাপান ||
সমুদ্রের কূলে তবে নগর বিরচিয়া |
পাঁচ গৃহস্থের কন্যা আনিল মূল্য দিয়া ||
বন হইতে ফল মূল আনিল তুলিয়া |
সমুদ্রের কূলে টেটনা করে পাঁচ বিয়া ||
টেটন বিয়া করাইয়া লখাই কৌতুকে |
আর কিছু দিল বিয়ার যৌতুকে ||
বিয়া করিয়া টেটন গেল আপনার ঘর |
চৌদ্দ ডিঙ্গা বাহিয়া চলিল লক্ষ্মীন্দর ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
৩৮
টেটনের ঘাট এড়ি বীর লক্ষ্মীন্দর |
ধোনা মোনার ঘাটে গিয়া মিলিল সত্বর ||
বেহুলা বলে প্রাণনাথ নিবেদি চরণে |
ধোনা মোনা পাটনী আছে এই স্থানে ||
তোমারে লইয়া যখন দেবপুরী যাই |
আমারে ধরিতে হেথা আইল দুই ভাই ||
চর পাঠাইয়া দিল নগর ভিতর |
দুইজনে ধরি আনে লখাইর গোচর ||
ততক্ষণে দুইজনে শালে তুলি দিল |
খেওয়ানিপুর বলি তথা গ্রাম বসাইল ||
এ বাঁক হইতে বেহুলা আর বাঁকে যায় |
গোদার থানায় গিয়া ডিঙ্গা চাপায় ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
৩৯
একেশ্বর আছে গোদা থরহরি কাঁপে |
অচল হইয়াছে দুষ্ট বেহুলার শাপে ||
গেদারে দেখিয়া বেহুলা বলে থাক থাক |
যত বিরূপে বলিয়াছ ভুঞ্জ তাহার তাপ ||
গোদাকে দেখিয়া বেহুলার মনে লাগে ব্যথা |
লখাইর স্থানে কহে গোদার যত কথা ||
শুনিয়া লক্ষ্মীন্দরের ক্রোধ হইল চিতে |
পাইক পাঠইল গোদারে কাটিতে ||
কপাল লিখন কভু না যায় খাওন |
গোদারে কাটিয়া ডিঙ্গা করাইল স্নান ||
সুবর্ণের মূর্তি স্থাপিল রূপে অনুপম |
আজু হইতে হইল গোদাবরী নাম ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
৪০
এ বাঁক হইতে সাধু আর বাঁকে যায় |
হরিসাধুর ঘাটে গিয়া দরশন পায় ||
ডিঙ্গা চলিয়া যায় গাঙ্গে লড়ে পাণি |
ডাইনে বামে দেখিলেন নগর উজানী ||
বেহুলা বলে প্রাণনাথ নিবেদি তব পায় |
যাবার কালে না দেখিলাম মোর বাপমায় ||
কলার মাজুষে প্রভু তোমারে লইয়া যাই |
এইখানে মিলিল মোর হরিসাধু ভাই ||
এতেক কহিল যদি সাহের কুমারী |
হরষিতে গেল সবে বানিয়ার বাড়ি ||
বেহুলারে দেখি রাণীর আনন্দ অপার |
বাপ মায়ের চরণে বেহুলা করে নমস্কার ||
একে একে বন্দে ছয় ভাইয়ের চরণ |
তার পাছে বন্দে বেহুলা বধূ ছয়জন ||
কুলপুরোহিত বেহুলা করে নমস্কার |
শ্বশুর শ্বাশুড়ী বন্দে চান্দর কুমার ||
বিজয় গুপ্ত রচে পূথি মনসার বর |
উজানী সংবাদ হইল এইখানে সোসর ||
. **************** সূচি...
মিলনসাগর
কবি বিজয় গুপ্তর মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
১ সকল বান্ধব হাহাকার করে | চারিজনে ধরিয়া লখাইরে বাহির করে || দীর্ঘভুজ লক্ষ্মীন্দর দীঘল মাথার চুল |
|
কবি বিজয় গুপ্তর মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
২
ক্ষীরোদ জলে চান্দ লখাইরে ভাসাইয়া বিস্তর করিছে বিষাদ | পুত্র পুত্রবধূ জলেতে ভাসাইয়া
|
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
৩
তোমারে বিদায় দিয়া খাড়া হইয়া চাই |
মা বলিয়া কে ডাকিবে হেন লক্ষ নাই ||
ভূমিতে পড়িয়া চান্দ যায় গড়াগড়ি |
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
৪
বেহুলা বলে শিশুকাল হইতে সেবিলাম চরণ |
মোর যত অপরাধ ক্ষমিবা সকল ||
ভাল মন্দ যত করি তুমি যে সহায় |
কবি বিজয় গুপ্তর মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
৫
কাক স্বরূপে কহিও সার | প্রাণের দোসর বেহুলা কাইল স্বামীর ঘরে গেলা ভালমন্দ কি তুমি জানহ তাহার || ধর্মের দ্বারে থাক যেই সত্য সেই দেখ ভালমন্দ তোমার গোচর | নাগের বাদুয়া যে তার সাতে বিয়া দে কুশলে নি আছে লক্ষ্ণীন্দর |
|
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
৯
বল নাহি টোটে বেহুলা রূপে নহে হীন |
মনসার চরণ বেহুলা ভাবে রাত্রি দিন ||
এক দুই করিয়া দিবস কত লিখে |
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
১০
ভাসিতে ভাসিতে ভুরা গেল নন্দীপুর |
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
১১
শুভদশা হইল তার দুই তিন মাসে |
মালিয়ার মালঞ্চ মধ্যে ভুরাখানা ভাসে ||
শুকনা মালঞ্চখানি দ্বাদশ বত্সর |
না জানি মালঞ্চে আজ আসিছে ঈশ্বর ||
এক খানি বস্ত্র তার গলায় বান্ধিয়া |
মালিনী পড়িল পায় বেহুলা ভজিয়া ||
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
১৬
দেবের বস্ত্র কাচে নেতা আর নাহি মতি |
কূলে বস্ত্র মেলে তার পুত্র ধনপতি ||
পুকুরেতে বস্ত্র ধোয় ধোপার কুমারী |
সেই পুকুরেতে নামে সাহের কুমারী ||
বস্ত্র ধৌত করে নেতা হরিষ অন্তরে |
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
১৭
রত্নময় সিংহাসনে বসেছেন গোসাঞি |
বামপাশে বসিয়াছেন জগত গৌরী মাই ||
থরে থরে বসিয়াছে যতেক দেবতা |
কবি বিজয় গুপ্তর মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
১৮
ছাড়িয়া যে লাজ ভয় করযোড়ে বেহুলা কয় তুমি শিব অনাদির ধন | উত্পত্তি প্রলয় স্থান সকলি আপনি জান জানিয়া জিজ্ঞাস কি কারণ || তুমি কিনা জান সাচে উত্তর রাজ্যে চান্দ আছে চম্পক নগরে তার বাস |
|
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
১৯
আপন আবাসে আছেন দেবী পদ্মাবতী |
শিবের আজ্ঞায় নন্দী বলে শীঘ্রপতি ||
নন্দীরে দেখিয়া পদ্মার আনন্দিত মন |
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
২০
কার্তিকের অনুরোধ এড়াইতে না পারি |
নাগ আভরণ করে দেবী বিষহরি ||
পরিধানে পাটের শাড়ি কোমরে তক্ষক |
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
২১
কোথায় উত্তর রাজ্য কোথায় দেবপুর |
তোমার যশ শুনিয়া আসিলাম এত দূর ||
অনাথের নাথ তুমি দেব অধিকারী |
হেন না বলিও মরা জীয়াতে না পারি ||
সৃষ্টির প্রধান তুনি অনাথের গতি |
বেহুলার স্বামী জীয়াইতে চাহ পদ্মাবতী ||
পরম কারণে তুমি দেবের দেবতা |
চারি যুগে তোমার বাক্য নাহিক অন্যথা ||
কবি বিজয় গুপ্তর মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
২২
পদ্মা তোমার কপটের নাহি ওর |
|
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
২৩
পদ্মার কথা শুনিয়া কুপিত মহাকালী |
কোপ মনে চন্ডিকা শিবেরে পাড়ে গালি ||
শ্মশানে শ্মশানে বেড়াও উম্মত্তের বেশে |
কোন কাজে আইল বেহুলা তোমার উদ্দেশে ||
সর্বলোকে বলে তুমি জগতের ঈশ্বর |
কবি বিজয় গুপ্তর মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
২৪
সপটে যুড়িয়া কর বেহুলা বলে মহেশ্বর
|
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
২৫
মহাদেবের বচনে বেহুলার বাড়ে তেজ |
সভার মধ্যে রাখিলেন কালিনাগের লেজ ||
এই কালনাগিনী দংশিল প্রাণপতি |
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
২৬
শুন গো বেহুলা সাহের কুমারী |
লঘুর যন্ত্রণা আমি কত সইতে পারি ||
প্রথম বৈশাখ মাসে সোসর রাত্রি দিবা |
আপন মন্দিরে সোনা আমারে করে সেবা ||
পাতিয়া বিচিত্র ঘট গাইনে গীত গায় |
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
২৯
ধ্যানেতে বসিল পদ্মা তক্ষকের মাতা |
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
৩২
দয়াভাবে বচন শুনিয়া মনসার |
প্রণাম করিয়া বেহুলা বলে আরবার ||
পথে যাইতে মাগো সাগর গহন |
কবি বিজয় গুপ্তর মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
৩৫
প্রতি নায়ে পরে সাড়া ঢাক ঢোল বাজে কাড়া
|
কবি বিজয় গুপ্তর
মনসা মঙ্গল
ভাসান পালা
৩১
বেহুলা বলে কি কব তব পায় |
ঘরে বাড়ি আছে মোর জায় জন ছয় ||
সর্ব নষ্ট হইল দুষ্ট শ্বশুরের বাদে |
মৈল স্বামী জীয়াইলাম তোমার প্রসাদে ||
স্বামী লইয়া দেশে যাব মনে বড় সুখ |
এই পাতায় কোনো ভুল-ত্রুটি চোখে পড়লে অথবা যদি কোথাও ভুল বলে মনে হয়, তাহলে আমাদের এই ইমেলে জানাবেন। আমরা শুধরে নেবার চেষ্টা করবো। srimilansengupta@yahoo.co.in
|
|
|