কবি বিপিনচন্দ্র পালের ছড়া ও কবিতা
*
খোকাবাবু
কবি বিপিনচন্দ্র পাল
শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও এখলাসউদ্দিন আহমদ সম্পাদিত “দুই বাংলার ছড়া” থেকে নেওয়া।

পড়াশুনা হলে সারা কাজকর্ম নাই---
জয়ঢাকটা নিয়ে একটু খেলা করি ভাই।
কাঠি দিয়া দিচ্ছি টোকা একি চমত্কার
ঢ্যাং ঢ্যাং ঢ্যাং ন্যাটাং ন্যাটাং বেজে ওঠে আর!

সাদাসিদে চারিদিকে কল কৌশল নাই---
কোথা হতে শব্দ আসে ভাবছি বসে তাই!
নিশ্চয় এর মধ্যে আছে সন্দেহ কি তার---
ঢ্যাং ঢ্যাং ঢ্যাং ন্যাটাং ন্যাটাং কোথায় থাকে আর!

.           *****************

.                                                                              
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
পিরীত
কবি বিপিনচন্দ্র পাল
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ সম্পাদিত “নারায়ণ” পত্রিকার আষাঢ় ১৩২৩ (জুন ১৯১৬) সংখ্যায় প্রকাশিত।

১।

পিরীতি পিরীতি,                কি তার প্রকৃতি,                কেমন মূরতি ধরে ?
পিরীতের কথা                কহে যথা তথা,                কেহ কি দেখেছে তারে ?
এ অঙ্গে অনঙ্গে,                সদা এক সঙ্গে,                রঙ্গে বসতি করে।
এরূপে অরূপে,                মিলায়ে স্বরূপে,                রসের মূরতি ধরে॥
নিজ রসে মজি,                এ মূরতি ভজি,                সহজে পিরীতি পায়।
রসতনুখানি,                রসের পরাণি,                রসেতে ভাসিয়া যায়॥

২।

কি বলিব সখি,                বলিবার এ কি,                বলিলে বুঝিবে কে ?
গুণ বিপরীত,                মিলায়ে বিধাত,                গড়েছে পিরীতি দে’॥
এই ত বয়ান                জুড়ায় পরাণ,                তবু যেন এই নয়।
এ রুচির দেহ                বাড়াইছে লেহ,                এ নহে মরমে কয়॥
এ রূপ দরশে                আঁখি অনিমেষ,                নারি তবু দেখিবারে।
এ তনু পরশে                হইনু অবশ,                ছুঁতে নারি তবু তারে॥
এই অঙ্গ গন্ধ,                নাসা করে অন্ধ,                মিটে না পিয়াসা কভু।
এই কণ্ঠধ্বনি                শ্রুতি রসায়নী,                শ্রবণ পূরে না তবু॥
এ মানুষই হয়,                এ মানুষ নয়,                হেঁয়ালি ভাঙ্গিবে কে ?
অঙ্গেরে ধরিয়া,                অনঙ্গে পাইয়া,                পিরীতি জানয়ে সে।

.           *****************
             

.                                                                              
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
রূপ
কবি বিপিনচন্দ্র পাল
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ সম্পাদিত “নারায়ণ” পত্রিকার আষাঢ় ১৩২৩ (জুন ১৯১৬) সংখ্যায় প্রকাশিত।


পুছিও না মোরে,               সে কেমন জন,                বলিতে নারিব আমি।
নয়ন দেখেছে,                নয়ন না জানে,                কেমন সে রূপখানি॥
সে রূপ পরশে,                আঁধোয়া এ আঁখি,        কে কারে দেখিবে বল ?
কিবা সে বরণ,                কিবা সে গঠন,                (কেবল) মরম ছুঁইয়া গেল!
মরম ছুঁইয়া,                পরাণে পশিয়া,                সৃজিল আপন কায়।
পরাণ চিরিয়া,                বাহির করিলে,                দেখিতে পাইবে তায়॥
মিছা কহিলাম,                চিরিলে পরাণ,                দেখা নাহি পাবে তার।
পিঞ্জর ভাঙ্গিবে,                পাখী পালাইবে,                ভাঙ্গা সুধু হবে সার॥

.           *****************              

.                                                                              
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
পূর্ব্ব রাগ
কবি বিপিনচন্দ্র পাল
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ সম্পাদিত “নারায়ণ” পত্রিকার শ্রাবণ ১৩২৩ (জুলাই ১৯১৬) সংখ্যায় প্রকাশিত।

১।

[ নায়িকা পক্ষে ]

সখি! কি আর কহিব তোরে!
আপনি না বুঝি                          আপন বেদন
পরাণ কেন যে এমন করে॥

(আমি) জানি না এ হিয়া               কিসের লাগিয়া
সদাই অধীর হইয়া ছুটে।
চিনে না যাহারে                        সুমরিয়া তারে
কেনে গো গুমরি গুমরি উঠে॥

শুধাইলি যদি                           শোন তবে বলি
কেন যে আমার এমন ভেল।
দুটি আঁখি দিয়া,                        জড়াইয়া মোরে
কেমনে মরমে বিঁধিল শেল॥

*        *        *        *        *        *

(একদিন) বসন্ত দুপুরে                  আঙ্গিনার ধারে
বসিয়া বকুল-ছায়।
অপরূপ রূপ                            লাগিনু আঁকিতে
যেমন পরাণে ভায়॥

মাথার উপরে                             দুলিল মাধবী,
আকুল ভোমরাকুল ;
সমুখেতে নীল                             স্বচ্ছ সরোবরে
ফুটিল কতই ফুল॥

শ্যামল তৃণের                            কোমল আসনে
আবেশে বসিল সে।
ডাহিনে হেলিয়া,                          পড়িছে ঢলিয়া
পুলকে পূড়িছে দে’॥

আঁকিতে আঁকিতে                      শোভন সে-রূপ
নিঁদ আঁখিতে ছায়।
শ্রীমুখ তাহার,                           নারিনু তুলিতে
ঘুমা’য়ে পড়িনু হায়॥

*        *        *        *        *        *

জাগিয়া দেখিনু                           বেলা অবসান
একেলা চলিনু জলে।
আমাতে গো যেন,                      আমি আর নাই
(যেন) চলেছি স্বপন বলে॥

সে মধুর রূপে                            ভরল এ দিঠি
(শুনি) কি মধুর গীতি কাণে।
সে রূপে সে গীতে,                        মন্ত্রমুগ্ধ যেন
ডুবিনু তাহারি ধ্যানে॥

*        *        *        *        *        *

জানি না কেমনে                        জাগিনু সহসা
চকিতে মেলিনু আঁখি।
যেই মুখ-খানি                        নারিনু আঁকিতে
তাই কি সমুখে দেখি!
(অমনি) মুদিল নয়ান,                    কাঁপিল হৃদয়
মোহে ঝাঁপিল চিত।
জীবনে মরণে                      করে কোলাকোলি
বুঝি না একি এ রীত॥

.         
    *****************              

.                                                                              
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
পূর্ব্বরাগ
লালসা
কবি বিপিনচন্দ্র পাল
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ সম্পাদিত “নারায়ণ” পত্রিকার আষাঢ় ১৩২৩ (জুন ১৯১৬) সংখ্যায় প্রকাশিত।

১।
[ নায়িকা পক্ষে ]

যে দিন হইতে,                        দেখেছি তাহারে,
পড়েছি বিষম ফাঁদে।
আর কোন কিছু,                    দেখে না কি আঁখি,
(সুধু) “ওই, ওই,” বলি কাঁদে॥
জাগিয়া দিবসে,                          দেখি ওই রূপ
দেখি যে স্বপন মাঝে।
পরাণ ভিতরে,                        কিবা সে বাহিরে,
বুঝি না কোথা বা রাজে॥

কণ্ঠের সে বাণী                           শ্রবণে পশিয়া
মরমে বিন্ধিয়া গেছে।
তবধরি কাণ,                          নাহি শোনে আন
(কেবল) ছুটিছে তাহারি পিছে॥
মলয়নিঃস্বনে,                              মধুপ-গুঞ্জনে,
তটিনীর কলনাদে।
বিহগের গানে,                               ঘন-বরষণে
কেবলি সে বাণী বাজে॥

অনুকূল বাতে,                         একটি নিঃস্বাশে
পাইনু অঙ্গের গন্ধ।
সে বাসে বিভোর,                     জানে না এ নাসা,
আর কোন ভালমন্দ॥
সারাবিশেব মাঝে,                     তাই সুধু খোঁজে
যেমন পাগল-পারা।
কোন্ ফুলবাসে,                          মজাইছে তারে,
ঢুঁড়িয়া হইছে সারা॥
প্রতি অঙ্গ মোর,                          দারুণ তিয়াসে
পুড়িছে তাহারি লাগি।
মিলিবে কি তারে,                      মিটিবে এ সাধ,
হবে কি এমন ভাগি॥



[ নায়ক পক্ষে ]

মিছে কেন পুছ মোরে রূপের বাখান।
আমি সুধু এই জানি, হেরি তার মুখখানি,
ছুটে ভাব, টুটে ভাষা, স্তবধ পরাণ॥

যখনি দেখিতে তারে পেয়েছে এ আঁখি
একই অঙ্গে বান্ধা পড়ি, করিয়াছে জড়াজড়ি,
গতিহীন, শক্তিহীন, তারেই নিরখি॥

যখনি বরণ দেখি, ভুলি কি গড়ন ?
গড়নে নয়ন দিলে, ভুলি যে বরণ॥
ভুলে যাই মুখশশি চরণ-কমল দেখি।
ভুলি পয়োধর-শোভা, গ্রীবার বলনী লখি॥
প্রতি অঙ্গে ডেকে বলে, চেয়ে দেখ মোরে!
কত শোভা, কি বলিব, প্রতি অঙ্গে ঝরে॥

কুসুম-কোমল দেহে আঁখি পড়ে যবে,
অনন্ত পরশ কি গো, কেঁপে উঠে তবে১!
অমিয়-সিঞ্চিনী বাণী পশিলে এ শ্রবণে,
শ্রুতি বিনা কিছু আর নাহি রহে ভুবনে!
দাঁড়াইলে, কহে বিশ্ব---স্থিরা ভব ধরণী।
চলে যবে, উঠে নৃত্য বিশ্বমাঝে অমনি।
প্রতি অঙ্গ, প্রতি ভঙ্গী, প্রতি ভাব তার,
পূর্ণ করে ব্রহ্মাণ্ডের অমিয়া ভাণ্ডার॥


১ - “তবে”- এই শব্দটি “ভবে” হতেও পারে। মুদ্রণ-প্রমাদ।

.             *****************              

.                                                                              
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর