বিপিনচন্দ্র পাল - জন্মগ্রহণ করেন অবিভক্ত বাংলার শ্রীহট্ট জেলার পৈল গ্রামে।  পিতা রামচন্দ্র পাল
এবং মাতা নারায়ণী দেবী।  রামচন্দ্র বরিশাল জেলা কোর্টে প্রথমে পেশকার ও পরে মুনসেফ হন। বিপিনের
আট বছর বয়সে রামচন্দ্র সরকারী চাকরি ছেড়ে, শ্রীহট্ট শহের গিয়ে জেলা আদালতে ওকালতী শুরু করেন।

বিপিনচন্দ্রের স্কুল শুরু হয় শ্রীহট্টে। প্রথমে “নয়া সড়ক” ও পরে “শেখহাট”-এর উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে তাঁর
পড়াশোনা চলতে থাকে।

১৮৭১ সালের একটি ঘটনা তাঁর মনকে প্রভাবিত করে।
I.C.S. সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (পরে ইনি রাষ্ট্রগুরু
নামে খ্যাত হন ) শ্রীহট্টে সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে আসেন। তাঁর স্ত্রী সাহেব স্ত্রীদের সমমর্যাদার দাবী করলে,
সাহেবরা ভীষণ অসন্তুষ্ট হন তাঁর উপর এবং মিখ্যে মামলায় জড়িয়ে পদচ্যুতির চেষ্টা করেন। দুর্ভাগ্যবশত
সেই  মামলায় সুরেন্দ্রনাথ হেরে যান এবং বিলাতে গিয়ে অ্যাপিল করেও সুবিচার না পেয়ে ফিরে আসতে
হয়। ফলে সুরেন্দ্রনাথকে মিথ্যে অপবাদ মাথায় নিয়ে চাকরি থেকে সরে আসতে হয়। বিদ্যালয়ের দশম
শ্রেণীর ছাত্র বিপিনচন্দ্রের এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করে এই ধারণা জন্মালো যে ইংরেজ রাজত্বে  ইংরেজ যদি
বাঙালীর পেছনে লাগে তাহলে ইংরেজের কাছ থেকে সুবিচার পাওয়া অসম্ভব।

১৮৭৩ সালে তিনি এনট্রান্স পরীক্ষা পাশ করেন। পরের বছর ১৭৭৪ সালে আসাম প্রদেশকে বাংলা থেকে
আলাদা করা হলো এবং বাঙালী অধ্যুষিত শ্রীহট্ট জেলাও আসামের সঙ্গে যুক্ত হলো।

উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি কলকাতায় এলেন। তাঁর কলকাতার শিক্ষা জীবন ১৮৭৫ থেকে ১৮৭৮ পর্যন্ত। ১৯৭৫
সালে মায়ের মৃত্যুর পর, ১৮৭৭ সালে তিনি হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে
শিবনাথ শাস্ত্রীর “সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ”-এর
“বিশিষ্ট সাধক দল”-এর দীক্ষা নিয়ে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। এই কাজের ফলে পিতা তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ
করেন। যদিও পিতার শেষ সময়ে পিতাপুত্রের পুনর্মিলন ঘটেছিল।

অসুস্থতার  জন্য তাঁর  এফ.এ. পরীক্ষা  দেওয়া সম্ভব হয়নি এবং তিনি আর পড়াশোনা করে উঠতে পারেন
নি। এরপর কটক, শ্রীহট্ট, ব্যাঙ্গালোর, কলকাতা, লাহোর সহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে স্কুল শিক্ষক ও
সাংবাদিকতার কাজ করে কিছুকাল কাটান। সম্মানের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে মতবিরোধের ফলে বেশিদিন
কোনোখানেই কাজ করতে পারেন নি।                                                    

১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম হয়। ১৮৮৬ সালে দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশনে বিপিনচন্দ্র
শ্রীহট্টের প্রতিনিধি রূপে যোগদান করেন। ১৮৮৭ সালে তৃতীয় বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হয় মাদ্রাজে। সেখানে
“তন্ত্র আইন রদ” এর  সমর্থনে জোরালো ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে সর্বভারতীয় স্তরে খ্যাতি এ পরিচিতি লাভ
করেন।

প্রথম পত্নি,
শিবনাথ শাস্ত্রীর পৌষ্যকন্যা নৃত্যকালী দেবীর মৃত্যুর পর, ১৯৯০ সালে তিনি বছর দেড়েকের জন্য
কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরীর (বর্তমানে জাতীয় গ্রন্থাগার) গ্রন্থাগারিক-সম্পাদকের পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন।
নানা বিষয়ে গ্রন্থ পাঠ করার অফুরন্ত সুযোগ তাঁর অস্থির চিত্তকে শান্ত করার পথে সাহায্য করেছিল। দেড়
বছরের মাথায় তিনি আবার বিবাহ করেন। এর পর বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর কাছে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষাগ্রহণ
করেন।  

ব্রিটিশ ব়্যাণ্ড ফরেন ইউনেটারিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, ব্রাহ্ম সমাজের প্রচারকর্মীদের একেশ্বরবাদী ঈশ্বরতত্ত্বে
(Unitarian Theology) শিক্ষাদানের জন্য প্রতিবছর একটি বৃত্তিদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে,
বিপিনচন্দ্র সেই বৃত্তিলাভ করে বিলেত যাত্রা করেন। সেখানে গিয়ে আমেরিকার মাদক নিবারণী সমিতির
কাছ থেকে একটি বৃত্তি পেয়ে তিনি চলে যান আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরে। সেখানে চার মাস কাল এবধি
বক্তৃতাদানের জন্য এই বৃত্তি পেয়েছিলেন।

নিউ ইয়র্ক শহরে এসে তাঁর আরেকটি সুদূরপ্রসারী চিন্তার পরিবর্তন ঘটলো, একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
তাঁর বৃক্তৃতার এক শ্রোতা একদিন তাঁকে বললেন যে তিনি যতই ভাল কথা বলুন না কেন, একজন পরাধীন
দেশের মানুষের কাছ থেকে কোনো কথাই তিনি শুনতে আগ্রহী নন। এই ঘটনাটি তাঁকে তাঁর জীবনের
পরবর্তী পথ ঠিক করতে সাহায্য করে। আমেরিকা থেকে ভারতে ফিরে এসে তিনি সর্ব শক্তি দিয়ে ভারত-
মাতার মুক্তি-সংগ্রামে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন।

১৯০১ সালে তাঁর নিজের সম্পাদনায় প্রকাশিক ইংরেজী সাপ্তাহিক পত্রিকা “নিউইণ্ডিয়া”-তে তাঁর নতুন
রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার করা শুরু করলেন। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস তখন শুধু বিদেশী সরকারের
বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিয়ে চেলেছে। বিপিনচন্দ্র আন্দোলনের চেয়ে যোগ্য মানুষ তৈরী করার উপর
গুরুত্ব দিয়ে সর্বপ্রথম ঘোষণা করলেন যে জনসংখ্যার বেশীরভাগ হিন্দু হলেও, ভারতবর্ষ শুধুমাত্র হিন্দুর দেশ
নয়। হিন্দু, মুসলমান, পার্সী, খ্রীষ্টান, আদিবাসী-সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির মিলনে গড়ে উঠবে স্বাধীন নবীন
ভারত। সবার মধ্যে সমন্বয়ের সূত্র হবে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহিষ্ণুতা। তিনি এই মতবাদের নাম দিলেন
“কম্পোজিট প্যাট্রিয়াটিজম্” বা যৌগিক স্বাদেশিকতা।

বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ও ঐক্য খর্ব করবার জন্য ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বঙ্গ-ভঙ্গ করার চেষ্টা করেন।
সারা রাজ্যবাসী এর বিরোধে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। ৭ই আগস্ট ১৯০৫ তারিখে কলকাতার টাউন হলের এক
বিশাল প্রতিবাদী জনসভায় বঙ্গভঙ্গ রোধের সংকল্প ঘোষণা করা হয়। ইংরেজ সরকার সে সব প্রতিবাদ
অগ্রাহ্য করে ১৬ অক্টোবর ১৯০৫ তারিখে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করেন। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন নিজ
যোগ্যতাবলে,  বিপিনচন্দ্র পাল। গড়ে উঠল নব্য জাতীয়তাবাদী দল।

১৯০৬ সালের আগস্ট মাসে, সর্বভারতীয় স্তরে প্রচারের জন্য শুরু করলেন ইংরেজী দৈনিক পত্রিকা
“বন্দেমাতরম”। কিছুদিন পর বরোদা থেকে
অরবিন্দ ঘোষ (পরে শ্রীঅরবিন্দ) এসে যোগ দিলেন তাতে,
বিপিনচন্দ্রের অনুরোধে। এই “বন্দেমাতরম” পত্রিকাতেই ১৯০৭ সালের অগাস্ট মাসে সর্বপ্রথম ভারতবর্ষের
জন্য ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ মুক্ত  পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য দাবি  ঘোষণা করেন বিপিনচন্দ্র। স্বদেশী যুগে বাংলার
আন্দোলন যখন  ধীরে ধীরে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়লো, তখন এই আন্দোলনে সামিল হলেন পাঞ্জাব-কেশরী
লালা লাজপত রায় এবং মহারাষ্ট্র-গৌরব লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক। লালাজী, তিলকজী ও বিপিনচন্দ্রের
নামের অংশবিশেষ  লোকের মুখে মুখে একত্র হয়ে গড়ে উঠলো জপমন্ত্রের মতো এক সাংকেতিক নাম “লাল-
বাল-পাল”। এই নাম কণ্ঠে নিয়ে সেদিন যুব ভারত দেশজননীর মুক্তি-সংগ্রামে আত্মদানে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল।

এই সময়েই কটকে এক ঐতিহাসিক জনসভায় বক্তৃতায় তিনি ভাবী স্বাধীন ভারতের সম্ভাব্য জাতীয়
সংবিধানের এক রূপরেখা উপহার দেন। তা ছিল অনেকটা আমেরিকার মতো। এর আগে আর কোনো
ভারতীয় নেতা এ বিষয়ে চিন্তা করেন নি। তাঁর সংগ্রামের হাতিয়ার ছিল “প্যাসিভ রেসিস্ট্যান্স”।

অল্পদিনের মধ্যেই শুরু হয় “বন্দেমাতরম”-মামলা যার মুখ্য অভিযুক্ত ছিলেন
অরবিন্দ ঘোষ। বিপিনচন্দ্রকে
সাক্ষী হিসেবে  কাঠগড়ায়  দাঁড় করালে তিনি সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করেন। এজন্য তাঁর ছয় মাস কারাবাস
হয়। এই ঘটনায় জনমানসে তাঁর ভাবমূর্তি  আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলো।
অরবিন্দ ঘোষ বেকসুর খালাস
পেয়ে গেলেন।

১৯২১ সালের মার্চ মাস। গান্ধীজির ভাবধারা ততদিনে কংগ্রেসে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছে।
বরিশালে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করলেন বিপিনচন্দ্রই। কিন্তু তাঁর সঙ্গে মতবিরোধ
বাঁধলো গান্ধীজির মতাদর্শী তরুণ নেতা
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের। সংখ্যাগরিষ্ঠ সভ্যরা দেশবন্ধুর দেওয়া
স্বরাজের ব্যাখ্যাতে সন্তুষ্ট হলেন এবং সোল্লাসে গ্রহণ করলেন।

এরপরই বিপিনচন্দ্র জাতীয় আন্দোলনের  মূল প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। এরপর তিনি আরও
এগারো বছর জীবিত ছিলেন কিন্তু ভারতবর্ষের রাজনৈতিক আন্দোলনে আর কোনো অবদান রেখে যেতে
পারেন নি।

গান্ধী-যুগে
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ-ই হয়ে উঠেছিলেন বাংলার অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা।

বিপিনচন্দ্র পাল বাংলা সাহিত্যে প্রবন্ধকার হিসেবেই বিশিষ্ট আসন দাবি করেন। তাঁর অনেক প্রবন্ধ
গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলেও বহু প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তাঁর প্রবন্ধের বিষয়ের
মধ্যে রয়েছে ধর্ম ও দর্শন, সমাজতত্ত্ব ও সমাজনীতি, রাষ্ট্র দর্শন ও রাজনীতি, সাহিত্যতত্ত্ব ও
সাহিত্যসমালোচনা, চরিত-সাহিত্য, আত্মজীবনী ও বিবিধ। বঙ্কিম-সাহিত্য ও বৈষ্ণব-সাহিত্য তাঁর
সমালোচনার প্রিয় বিষয় ছিল। তাঁর ইংরেজীতে লেখা “বেঙ্গল বৈষ্ণভিজম্” একটি উপাদেয় গ্রন্থ। তিনি
রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি কবিতা ও গানেরও অপূর্ব ব্যাখ্যান রেখে গেছেন।

আমরা বিপিনচন্দ্র পালের একটি ছড়া পেয়েছি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও এখলাসউদ্দিন আহমদ সম্পাদিত “দুই
বাংলার ছড়া” বইটি থেকে। তা-ই   
মিলনসাগরে পাতায় তুলে এই মহান মানুষটিকে মিলনসাগরের শ্রদ্ধার্ঘ্য
প্রদান করতে পেরে আমরা নিজেদের ধন্য মনে করছি।  



উত্স – শিবদাস চক্রবর্তী, বাঙলার মনীষা, ১ম খণ্ড, ১৯৮৬।   


মিলনসাগরে কবি বিপিনচন্দ্র পালের কবিতার পাতায় যেতে হলে এখানে ক্লিক্ করুন...    


আমাদের যোগাযোগের ঠিকানা :-                                                         উপরে ফেরত   
মিলনসাগর       
srimilansengupta@yahoo.co.in      



এই পাতার প্রথম প্রকাশ একটি ছড়া নিয়ে - ৮.২০১৩
পাতার পরিবর্ধিত সংস্করণ - ২৬.৭.২০১৮

.