বিদ্যাসাগরকে উত্সর্গিত কবিতা ও ছড়া
*
বিধবা-বিবাহ আইন উপলক্ষে ঘোর আন্দোলন
দাশরথী রায়
(জানুয়ারী / ফেব্রুয়ারী ১৮০৬ ~ ১৭ অক্টোবর ১৮৫৭)
দাশরথী রায়ের কবিতার পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন . . .

বিধবার বিবাহ-কথা            কলির প্রধান কলিকাতা,---
নগরে উঠিছে এই রব |
কাটাকাটি হচ্ছে বাণ                 ক্রমে দেখছি বলবান
হবার কথা হয়ে উঠছে সব || ১
ক্ষীরপাই নগরে ধাম,                      ধন্যগন্য গুণধাম,
ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামক |
তিনি কর্ত্তা বাঙ্গালীর,         তাতে আবার কোম্পানীর,---
হিন্দু-কলেজের অধ্যাপক || ২
বিবাহ দিতে ত্বরায়,                হাকিমের হয়েছে রায়,
আগে কেউ টের পায় নি সেটা |
তারা ক’রলে অর্ডার,                  জেতে করে অর্ডার,
চটুকে বুদ্ধি আটকে রাখিবে কেটা ? ৩
হাকিমের এই বুদ্ধি,                    ধর্ম্ম-বৃদ্ধি প্রজা-বৃদ্ধি,
এ বিবাহ সিদ্ধি হ’লে পরে |
বিধবা করে গর্ভ-পাত,                     অমঙ্গল উৎপাত,
এতে রাজার রাজ্য হ’তে পারে? ৪
হিন্দু ধর্ম্মে যারা রত,                  প্রমাণ দিয়ে নানা মত,
হবে না ব’লে করিতেছেন উক্ত ||
ইহাদের যে উত্তর,                     টিকিবে নাকো উত্তর,
ঊত্তীর্ণ হওয়া অতি শক্ত || ৫

.     *************************  
.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর
অজ্ঞাত কবি

.    বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হ’য়ে
সদরে করেছ রিপোর্ট বিধবাদের হবে বিয়ে  |
.   কবে হবে এমন দিন প্রচার হবে এ আইন,
.  দেশে দেশে জেলায় জেলায় বেরোবে হুকুম
.   বিধবা রমণীর বিয়ের লেগে যাবে ধূম
সধবাদের সঙ্গে যাবো বরণডালা মাথায় লয়ে  |
আর কেন ভাবিস লো সই, ঈশ্বর দিয়াছেন সই
.   এবারে বুঝি ঈশ্বরেচ্ছায় পতিপ্রাপ্ত হই
.   রাধাকান্ত মনোভ্রান্ত দিলেন না কই সই,
লোক মুখে শুনে আমরা আছি লোক লাজ ভয়ে  |

.    এমন দিন কবে হবে বৈধব্য যন্ত্রণা যাবে
.    আভরণ পরিব সবে লোকে দেখবে তাই
.      আলোচাল কাঁচকলার মুখে দিয়ে ছাই
. এয়ো হ’য়ে যাব সবে বরণ ডালা মাথায় লয়ে  |

.                   *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
মহামুনিবর
অজ্ঞাত কবি

একদিন এই মহামুনিবর, ভ্রমিতে গভীর বিজন বনে,
কি জানি সহসা, কেমন করিয়া মিলন হইল বালার সনে |
পরম যতনে আনিঘরে তারে, স্বীয় তপোবলে সৃজন করি,
বিমল বসনে, সাজাল বালায়, অহো কি মাধুরী হয়েছে মরি !
মৃত প্রাণ তার, নবীন জীবন, করেছ প্রদান এ মহা ঋষি,
বালিকার স্নেহে মগন তাপস, বালিকা তাপসে রয়েছে মিশি  |
কত ভালবাসা, কত কথা কয়, চাহে কত কিছু বালিকা তায়,
একে একে দিয়ে নানা অলঙ্কার, সাজায়েছে ঋষি বালার কায় |
আখ্যানমঞ্জরী, তুলি সযতনে, পরাল গলায় চিকন মালা  |
বালবিধবার, অশ্রুবিন্দু দিয়ে, দিল সাজাইয়ে বরণ ডালা |
মহাপুরুষের জীবনচরিতে, দিল করে নব কঙ্কন তার |
মস্তকের মণি, করে সাজাইল, সীতাবনবাস-স্নেহোপহার |
এইরূপে কত, বসন ভূষণে, সাজাল বালার নবীন দেহ |
নব বেশ পরি, নব আশা তার, আগে এত শোভা দেখিনি কেহ  |

.                   *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
বিদ্যাসাগর
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
কবি ঈশ্রচন্দ্র গুপ্তর কবিতায় পাতায় যেতে এখানে ক্লিক্ করুন . . .

“বাধিয়াছে দলাদলি, লাগিয়াছে গোল |
বিধবার বিয়ে হবে, বাজিয়াছে ঢোল  ||
কত বাদী,   প্রতিবাদী ,  করে কত রব |
ছেলে বুড়ী আদি কবি, মাতিয়াছে সব ||
কেহ উঠে শাখাপরে, কেহ থাকে মূলে |
করিছে প্রমাণ জড়ো, পাঁজি পুঁথি খুলে ||

                  
.                       এক দলে যত বুড়ো, আর দলে ছোঁড়া |
.                       গোঁড়া হয়ে মাতে সব, দেখেনাকো গোড়া ||
.                       লাফালাফি,  দাপাদাপি, করিতেছে যত |
.                       দুই দলে খাপা-খাপি, ছাপাছাপি কত ||
.                       বচন রচন করি, কত কথা বলে |
.                       ধর্মের বিচার পথে, কেহ নাহি চলে ||
.                       “পরাশর”  প্রমাণেতে বিধি বলে কেউ |
.                       কেহ বলে এযে দেখি, সাগরের ঢেউ ||
.                       কোথা বা করিছে লোক, শুধু হেউ হেউ |
.                       কোথা বা বাঘের পিছে,  লাগিয়েছে ফেউ ||

.                   *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
পন্ডিতবর শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তর কবিতার পাতায় যেতে এখানে ক্লিক্ করুন . . .

.                        ১
শুনেছি লোকের মুখে পীড়িত আপনি
. হে ঈশ্বরচন্দ্র ! বঙ্গে বিধাতার বরে
. বিদ্যার সাগর তুমি ;  তব সম মণি,
মলিনতা কেন কহ ঢাকে তার করে ?
বিধির কি বিধি সুরি, বুঝিতে না পারি,
হেন ফুলে কীট কেন পশিবারে পারে ?
.   করমনাশার স্রোত অপবিত্র বারি
ঢালি জাহ্নবীর গুণ কি হেতু নিবারে ?
. বলের সুচূড়ামণি করে হে তোমারে
সৃজিলা বিধাতা, তোমা জানে বঙ্গজনে ;
. কোন পীড়ারূপ অরি বাণাঘাতে পারে
বিঁধিতে, হে বঙ্গরত্ন |  এ হেন রতনে ?
.  যে পীড়া ধনুক ধরি হেন বাণ হানে
( রাক্ষসের রূপ ধরি ), বুঝিতে কি পার,
.  বিদীর্ণ বঙ্গের হিয়া সে নিষ্ঠুর বাণে  ?
.    কবিপুত্র সহ মাতা কাঁদে বারম্বার |


.                        ২
“বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে  |
করুণার সিন্ধু তুমি,  সেই জানে মনে ,
দীন যে,  দীনের বন্ধু  ! উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেম-কান্তি অম্লান কিরণে  |
কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহাপর্বতে,
.     যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
. সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
গিরিশ ! কি সেবা তার সে সুখ -সদনে !
.     দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী ;
.   যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
.   দীর্ঘ-শির তরুদল, দাসরূপ ধরি’ ;
.   পরিমল ফুল -কুল দশ দিশ ভরে,
. দিবসে শীতলশ্বাসা ছায়া,  বনেশ্বরী
নিশায় সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে |”

.          *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
বিদ্যাসিন্ধু
দীনবন্ধু মিত্র      
কবি দীনবন্ধু মিত্রর কবিতার পাতায় যেতে এখানে ক্লিক্ করুন . . .     

“বিদ্যার সাগর বিদ্যাসাগর প্রবর,
দীনজন-লালন -পালন - তত্পর ,
মাতৃভক্তি ভরা চিত্ত, কাছে গিয়ে মার,
অদ্যাপি শিশুর মত করে আবদার ;
বিধবা-বিবাহ বিধি যুক্তির বিচার,


.                      খন্ডাতে পারে নি কেহ শাস্ত্রমত তার ;
.                      অমিয়া - লহরী -যুত রচনা - নিয়ে,
.                      ললিত - মালতী মালা - কোমলতাময়,
.                      সাহিত্য - সহজ - পথ উপক্রমণিকা,
.                      পড়িয়া পন্ডিত কত বালক বালিকা ;
.                      সংস্কৃতি কলেজ যাঁর যতন কৌশলে,
.                      লভিয়াছে এত যশঃ মানবমন্ডলে ;
.                      দেশ-অনুরাগ-স্রোতঃ বহিছে হৃদয়ে,
.                      ‘বেঁচে থাক বিদ্যাসিন্ধু চিরজীবী হয়ে  |’……”

.                      *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
বিদ্যাসাগর
হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়       
কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কবিতার পাতায় যেতে এখানে ক্লিক্ করুন . . .     

আসছে দেখো সবার আগে বুদ্ধি সুগভীর,
বিদ্যের সাগর খ্যাতি, জ্ঞানের মিহির |
বঙ্গের সাহিত্যগুরু শিষ্ট সদালাপী
দীক্ষাপথে বুদ্ধ ঠাকুর স্নেহে জ্ঞানবাপি |
উত্সাহে গ্যাসের শিখা, দার্ঢ্যে শালকড়ি
কাঙাল বিধবা বন্ধু অনাথের নড়ি |


.                     প্রতিজ্ঞায় পরশুরাম, দাতাকর্ণ দানে
.                     স্বাতন্ত্র্যে শেঁকুল কাঁটা----- পারিজাত ঘ্রাণে |
.                     ইংরিজির ঘিয়ে ভাজা সংস্কৃত “ডিস”    
.                     টোল স্কুলী অধ্যাপক দুয়েরই   “ফিনিস” |
.                     এসো হে দ্বিজের চূড়া, বঙ্গ অলঙ্কার,
.                     দিকপাল তোমার মত দেশে নাই আর |

.                      *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
ঈশ্বর বৈকুন্ঠে
রাজকৃষ্ণ রায়
কবি রাজকৃষ্ণ রায়ের কবিতার পাতায় যেতে এখানে ক্লিক্ করুন . . .     

আমার ঈশ্বর প্রভু ,
আমার প্রাণের প্রাণ,
আমার গুরুর গুরু, জ্ঞানের জ্ঞেয়ান ;
অপার দয়ার সিন্ধু,
অসংখ্য দীনের বন্ধু,
ভাষার ভাস্কর - ইন্দু, দেবতা মহান্  |
বিধবার কাতরতা,
অনাথের প্রাণব্যথা,
ছাত্রের জীবন গুরু ঈশ্বর আমার ;
বিদ্যার সাগর ধীর,
সত্যের তেজস্বী বীর,
অন্যায়ের মহাবৈর ন্যায়-অবতার |
গাম্ভীর্যের মহা মূর্তি,
রহস্যের মহাস্ফূর্তি,
শিষ্টের পালন প্রভু দুষ্টের দমন
অমর ঈশ্বর মোর,
অমরগণের সনে
হৃদয়-বৈকুন্ঠে মোর বিরাজে কেমন
মোর মত শত শত
লক্ষ লক্ষ হৃদয়েতে
এতদিনে পূর্ণরূপে ঈশ্বর-বিকাশ ;
একটি বৈকুন্ঠে নয়,
লক্ষ লক্ষ --- ততোহধিক
হৃদয়-বৈকুন্ঠে এবে ঈশ্বর-নিবাস  |

পৃথিবীর যে যেথায়,
শুনুক সে উচ্চ সুর,
কোটি কোটি চক্ষু মেলি দেখুক চাহিয়া,
বাঙালীর ঘরে ঘরে,
লক্ষ লক্ষ ছয় কোটি
হৃদয়-বৈকুন্ঠ মাঝে দয়ার সাগর
ঈশ্বর---ঈশ্বর---গুরু অমর ঈশ্বর |
কেন তবে কাঁদ সবে,
‘জয়েশ্বর’ উচ্চ রবে
তোল সব বহু দূর আকাশ ভেদিয়া  |

.     *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
বাঙ্গালীর মাতামহ
গোবিন্দচন্দ্র দাস
কবি গোবিন্দচন্দ্র দাসের কবিতার পাতায় যেতে এখানে ক্লিক্ করুন . . .     

বাঙ্গালীর মাতামহ, বিদ্যার সাগর,
বিশাল বাঙ্গালী জাতি, সমস্ত তোমার নাতি
করিবে তোমার শ্রাদ্ধ স্নেহার্দ্র অন্তর |
জমাইয়া হাহুতাশ, জমাইয়া দীর্ঘশ্বাস
স্মৃতির সমাধি স্তম্ভ রচিবে সুন্দর |
অভ্রভেদি সে মন্দির, উপরে তুলিবে শির
শিখরে জ্বলিবে ভক্তি মণি মনোহর |
বঙ্গের বিধবা নারী পাদ্যদিবে অশ্রুবারি
দিবে কৃতজ্ঞতা অর্ঘ্য দীন দুঃখী নর |
করি দিবে পুষ্পহার, আনন্দচন্দনে তার
গন্ধামোদে মাতিবেক বিশ্ব চরাচর !
হাতে লয়ে বর্ণশিক্ষা
তব মন্ত্রে হবে দীক্ষা
বোধোদয়ে নিরাকার জপিবে ঈশ্বর,
বঙ্গের ভবিষ্য বংশ----- শিশু নারী নর !

.     *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কবিতার রচনাকাল ২৪ ভাদ্র ১৩৪৫ (সেপ্টেম্বর ১৯৩৮)। প্রকাশিত হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্র সেন সম্পাদিত
"দেশ" পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১৩৪৬ (ডিসেম্বর ১৯৩৯) সংখ্যায়।
গুরুদেববীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার পাতায় যেতে এখানে ক্লিক্ করুন . . .     


বঙ্গ সাহিত্যের রাত্রি স্তব্ধ ছিল তন্দ্রার আবেশে
অখ্যাত জড়ত্বভারে অভিভূত | কী পুণ্য নিমেষে
তব শুভ অভ্যুদয়ে বিকীরিল প্রদীপ্ত প্রতিভা,
প্রথম আশার রশ্মি নিয়ে এল প্রত্যুষের বিভা,
বঙ্গ ভারতীর ভালে পরাল প্রথম জয়টিকা |

রুদ্ধ ভাষা আঁধারের খুলিলে নিবিড় যবনিকা,
হে বিদ্যাসাগর, পূর্ব দিগন্তের বনে উপবনে
নব উদ্বোধন গাথা উচ্ছ্বসিল বিস্মিত গগনে  |
যে বাণী আনিলে বহি নিষ্কলুষ তাহা শুভ্ররুচি,
সকরুণ মাহাত্ম্যের পুণ্যগঙ্গাস্নানে তাহা শুচি !
ভাষার প্রঙ্গনে তব আমি কবি তোমারি অতিথি ;
ভারতীর পূজাতরে চয়ন করেছি আমি গীতি
সেই তরুতল হতে যা তোমার প্রসাদ সিঞ্চনে
মরুর পাষাণ ভেদি প্রকাশ পেয়েছে শুভক্ষণে ||

.     *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর