দেড়শো বছর বাদে তোমার ছবির সামনে নতজানু হবো এমন যোগ্যতা নেই | তুমি নত হতে শেখাও নি, সবল স্পর্ধায় মাথা উঁচু ক’রে অন্যায়ের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে বুকটান ক’রে হাঁটতে শিখিয়েছিলে |
মানুষ গাছ থেকে বনস্পতি হয়ে ওঠে যদি থাকে মনুষ্যত্ব ; নালা থেকে ক্রমশ নদী হতে পারে যদি রক্তের ভিতরে জেগে ওঠে করুণা নির্ঝর | তুমি বাংলাদেশ গড়ার জন্য মনুষ্যত্বের উদ্ধোধনে বর্ণপরিচয়ের মোমবাতিগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছিলে ; অথচ দেড়শো বছর বাদে আমরা ভীষণ এক ভাঙা বাংলায় বাস করছি, গঙ্গার এপার থেকে মেঘনার ওপার চোখের অস্পষ্টতার জন্য এখন আর দেখা যায় না | দেড়শো বছর বাদে তোমার ছবির সামনে নতজানু হবো এমন যোগ্যতা নেই : চতুর্দিকে সুবিধাবাদী ঠোঁট বামনের দল তোমার পাহাড় প্রতিম মূর্তির পাশে পিঁপড়ের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে | আমরা এখন বুকভাঙা রক্তমাখা এক দুঃখী বাংলায় ঝড়ের নৌকায় বাস করছি |
ঘরের সমস্ত ছবি ভেঙে চায় ঘরটি সাজাতে সাগ্রহ নতুন দিয়ে, দেয়াল রঙিলা করে তোলে | চমত্কার পরদা ঝোলে দুয়ারে-জানালায়., কদাচিৎ এমন দেখেছি আমি, এপারের বাংলায় বাজাতে দুরূহ রবীন্দ্রনাথ মিশে থাকা সাঁওতাল বাঁশির সুরে যে গৃহটান, তার চেয়ে সাফল্যে কবির জটিল মননে আনে ক্ষুরধার সাঁতার সন্ধ্যার সকালের দুপুরের ---অপকৃত পক্ষে প্রাকৃতিকী!
কিন্তু তুমি! সারবান, রবীন্দ্র অগ্রজ, ঐশ্বরিক--- পশ্চিমাসংকুল এই বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছিলে সেদিন, বাহ্যত রূঢ়-গাঢ়, তবু বিজ্ঞানসম্মত বাংলাভাষা দিয়ে তুমি বাঙালীর ভিত্তি গড়েছিলে--- আচার্য, তোমার সার্ধশতবর্ষে বাংলার প্রণাম ||
শব্দ যিনি শিখিয়েছিলেন তাকে আমি শব্দ লিখে কি করে বোঝাবো ! বর্ণপরিচয় থেকে যে অচঞ্চল চলা আজ এনেছে সাগরতীরে বুঝিয়াছে মাথায় আকাশ এলে ধ্রুবতারকার কাছে নতজানু হতে হয় খুঁজতে হয় পদচিহ্ন, ধুলোর এই তো পরম সফলতা ! আমারও উপমা সেই চিহ্ন শিখে খুশি হয় মরমানুষের কাছে এটুকুই যা কিছু অমরতা |
এখন তো ঘরেও অবাক ধুলো, ধুলো আজ জাতীয় জীবনে কোনো পদচিহ্ন তাই আর অনুসরণযোগ্য হয়ে উঠেছে না | আর আমি, শব্দের কুহক মাখা এক আশিরপদনখের বাঙালী যে নাকি অনেক আগেই ভেবেছে ঈশ্বর গুজব মাত্র অস্ট্রিক স্মৃতির পাশে আর্য বেদ বেড়াতে এসেও সপ্রমাণ করতে পারেনি ঈশ্বর সত্যিই এক পরলোকপ্রিয় লিপ্সা কিনা ! শুধু একবার, একবার দ্রবণের মতো এই পরম বাঙলায় স্পষ্ট বলীর্বদ এক ঈশ্বরের জন্ম হয়েছিল
উড়নি ধুতি পরা ছিল বলে আমরা তখন তাকে ঠিকমত চিনতেই পারিনি !
এখনো পূর্ণিমা-রাত্রে আলো হয় | আলোর স্বভাবে স্খলিত তরঙ্গধ্বনি বুনো ঝোপে কিংবা চূর্ণ পাথরের দেশে ছিন্নভিন্ন জনপদে ; বস্তিতে আসল অন্ধকারে ধনুষ্টঙ্কারের বীজ বেড়ে ওঠে, কারণ শতাব্দী জুড়ে বাঘা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কয়েকটি কুটিল অশ্ব রেখে গিয়েছিল , ব্যক্তি কিংবা শ্রেণীগতভাবে আজ, মনে হয়, তথ্যগুলি ধরা পড়ে গেছে | আর ঠিক সেই ক্ষণে চোষ কাগজের মত স্তরে স্তরে জমাট বনিকী অন্ধকারে কলকাতার আংশিক উথ্বান ; যেন সমগ্রের প্রতিভাস নিয়ে,--- কেবল পড়ে না ধরা অপুষ্ট শিশুর চোখে ধীরে ধীরে পোহালে শর্বরী |
বণিকের মানদন্ড দেখা দিল রাজদন্ডরূপে : তুমি, মানসযাত্রায় উত্কন্ঠার প্রতিনিধি : কর্মঠ কব্ জির নীচে ঘাম জমে, অশ্রু ও স্বপ্নের সমুদ্রে উথ্বিত এক কঠিন প্রবালদ্বীপ : চতুর্দিকে জাগরণ স্রোতে ভাসমান বাণিজ্যতরণী, সংঘ কিংবা প্রতিষ্ঠানহীন সেই জ্যোত্স্নার গঠনে নির্মিত মানুষ আর মানুষের প্রাণের জাহ্নবী --- তুমি সেই প্রাণপুরুষের নেতা, কিংবা নেতা নয়, নবীন প্রণেতা--- আপন স্বভাব ঘিরে জেগে ওঠো , স্তব্ধ হয় স্বভাবের সীমা--- তখনই পর্বতমালা অতিক্রম ক’রে দূর অবণ্যসীমার শতাব্দী শশাঙ্ক হয়ে ঢ’লে পড়ে, যদিও তা অষ্টমীর চাঁদ--- তবু তারই অবসানে ঊষার সঞ্চার, সম আয়তনে সেই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের চতুর্দিকে জনস্রোত, দিনযাপনের শক্তি, প্রকাশ্যে বীরত্বহীন বিরক্ত, বীরের রক্তধারা --- ইতস্তত অপসৃত অন্ধকারে মুর্গীচোর শেয়ালের পদধ্বনি--- আর কেবল পূর্ণিমা শেষে স্যাঁতস্যেঁতে লোকালয়ে তোমার ক্ষমতা, ঘরে ঘরে স্বপ্নায়ু শিশুর হাতে বর্ণ পরিচয়, মলাটে অস্পষ্ট চিত্র, আলেখ্যদর্শন |
গভীর জ্যোত্স্নায় ব’সে আজ ঈশ্বরচন্দ্র অক্ষর সাজাচ্ছেন----- বর্ণমালা--কি ক’রে সমূহ বাঙালিকে ভাষা শেখাবেন, তাই | এদিকে একটি পাখি ভয়ঙ্কর ডেকে উঠে বহু রম্যতা ছাড়িয়ে বহু ভব্যতা ছাড়িয়ে বহু সভ্যতা ছাড়িয়ে
এমন সুন্দর এক তেজঃপুঞ্জ যার কোলে মাথা রেখে চুপ চুপটি ক’রে ব’সে আছে রক্ত মেদ মেধা বুদ্ধি সেই অনুষ্টুপ |
সাগরেরও শেষ আছে, আছে কূল, তল অতলান্ত শুধু তাঁর হৃদয়ের জল শতবট গেল তাঁর প্রয়াণেরও পর অ--মৃত তথাপি তিনি : স্মৃতি কোজাগর ; কথকতা কৃতিগুলি কৌমুদি উজ্জ্বল ঈশ্বরে নিষ্পৃহ যিনি নিজেই ঈশ্বর
বিদ্যার দয়ায় যাঁর মেলে না তুলনা মানুষের জন্য যাঁর অপার করুণা অবিনাশী কন্ঠ তাঁর কখনো ভুলো না
‘মাতৃজাতি দুহিতারা গৃহের গরু না ! সুন্দরের শুশ্রুষার অন্য নাম,------ নারী ! পুরুষের সাথে তারা সম অধিকারী ;
নিরন্নকে অন্ন দাও, অন্ধজনে আলো নারী, শিশু, অসহায়ে বাসো আরো ভালো মানুষ্যত্বে মানুষের করে উত্তরণ উচ্চশির, প্রতিবাদী থাক আমরণ ;
মানুষ শক্তির উত্স ; তার অপচয় রোধ কর দিয়ে তারে বর্ণ পরিচয় মানুষ যখন হয় শিক্ষিত, সাক্ষর তখনই সে খুঁজে পায় নিজস্ব ঈশ্বর ;
কোথাও তখন জ্বলত না দীপ, পথের বুকে ভীষণ আঁধার শ্মশান থেকে আসত খবর জ্বলছে মেয়ে অগ্নি-জ্বালে, বালক যুবক পায় না হাতে মনের মত পড়ার বই সেসব দিনে স্বদেশ বাঁধা ফিরিঙ্গিদের লোহার জালে |
বুকের ভেতর ব্যথার সাগর : একটা মানুষ ঘুমোচ্ছে না একটা মানুষ ভাবছে দেশের মানুষনিয়ে রাত্রিদিন সেই মানুষের রক্তে ছিল দয়ার জোয়ার জন্মাবধি বজ্রকঠোর বুকের ভেতর ফুটত কুসুম অন্তহীন---
ভেঙে দিলেন হাজার বাধা ; ধর্ম নিয়ে জচ্চুরি গুঁড়িয়ে দিয়ে মানবতার জয়ধ্বজা উড়িয়ে তখন অন্ধকারে আলোর নেশা ছড়িয়ে দিলেন অকুতোভয় হঠাৎ যেন ঝড়ের রাতে ভাঙল জাতির সন্মোহন |
আজও মানষ তাকিয়ে আছে তাঁর ছবিতে, পায়ের ছাপে--- চাইছে অশেষ আশীর্বাণী শহর-গাঁয়ের নিরক্ষর, হাসবে সবাই পড়বে সবাই তবেই না তাঁর স্মরণ-বরণ আজকে নিশান ওড়াও তাতে থাকুক লেখা “বিদ্যাসাগর” |