কবি বীথি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
শকুন্তলা উপাখ্যান
কবি বীথি চট্টোপাধ্যায়

চারিদিকে খুব নিবিড় গাছপাতা
হরিণ শিশু ঘুমোতে আসে কোলে,
ঘাসের মেঝে শিশির দিয়ে ধোয়া
আমার শিশুবয়েস গেছে চলে।

মাকে আমি চোখে দেখিনি শুধু
শুনেছি তিনি ত্রিলোকে রূপবতী,
আমায় ফেলে চুপটি করে সয়ে
লুকিয়েছিলেন বাবার দুর্মতি।

এ সব আমায় ভাবায় না খুব বেশি
পালক ত্রাতা ভাবতে শেখাননি তো,
ভাবনা ছাড়াই জীবন কত নরম
বান্ধবীরা ঘুম পাড়িয়ে দিতো।

শরীর বাড়ে যুবতী হয় দেহ
সখীরা বলে শ্রেষ্ঠ আমাকেই।
পিতৃসম বৃদ্ধ ঋষি ছাড়া
চারদিকে আর পুরুষ চোখ নেই।

আমার চোখ গভীর টলটলে
চোখের পাতা পাপড়ি মেলে আছে,
চোখের মধ্যে বোকা দৃষ্টি ভাসে
স্পষ্ট লেখা কেউ আসেনি কাছে।

.           *****************

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
শরীর বিষয়ক
কবি বীথি চট্টোপাধ্যায়

সেদিন নিবিড় প্রাকৃতিক পটভূমি।
সকালভ্রমণ, মাঝে মাঝে এই হয়
নাঙি-কম্পনে একাকার প্রশ্বাস,
রতিময় কুচে যেই চুমু খেলে তুমি।

দেহঘনিষ্ঠ বর্ণনা শুধু নয়,
প্রচেষ্টা নয় কাব্যিক আদিরসে
লৌকিক এক দেহগত অধ্যায়
শরীর শিল্পে বাড়ায় আয়ুক্ষয়

আমার শরীর আমার আয়ুকে খায়।
আমার জিহ্বা তোমার সোহাগস্থল
বুক, নিতম্ব, বাহুমূল, মনোভূমি
ত্রিকাল স্পর্শে ইতিহাস হয়ে যায়।

বড় সাধারণ এমন পংক্তিগুলো
তাতে পৃথিবীর কারো কোনো ক্ষতি নেই
নিবিড় জড়িয়ে প্রকৃত আদিম স্নানে
অপেক্ষা করে স্বচ্ছ ঝরনাগুলো।

.           *****************

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
লুকোনো কবিতা
কবি বীথি চট্টোপাধ্যায়

সাগর জলের গোপন নালে পদ্যমাখা চোখ
ঠোঁট ছোঁয়াতেই গভীর বাণী
নানা রঙের রঙিন কুসুম
পড়ল ঝরে দু-এক ছত্র ভালোবাসার শ্লোক।

দু’চোখ থেকে পদ্য পড়ি না-জানা কোন ভয়
সমস্ত গায়ে পদ্য আমার
পদ্য আমায় স্বপ্ন দেখায়
উষ্ণতা পাই ভালোবাসার শরীর পদ্যময়।

ও চোখ কখন গল্প শোনায় কখন বাসায় ভালো
কখন দেখায় সূর্য ওঠা
কখন শুধু কান্নাহাসি
কখন ফোটায় বকুল শিমুল রামধনু রঙ আলো।

পদ্য আমার সব প্রসাধন অঙ্গবসন কাজল চন্দনে
পদ্য আমায় বাঁচতে শেখায়
পদ্য আমার বুকের মধ্যে
আকাশপথে গাজনমেলায় আলস্য কম্পনে।

.           *****************

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
ভারতবর্ষ ২০০২
কবি বীথি চট্টোপাধ্যায়

তারপর থেকে আমি চুপ ক’রে গেছি
এতদিন আমি গভীর আত্মরতি,
থেমে গেছে সব মধুর কলস্বর
ছোট নদী আমি বলছি সবরমতী।

পশ্চিম দেশ ধূসর চতুর্দিক
আমার শরীরে মৈথুনকামী ঢেউ,
একটি কিশোর নৌকা ভাসাতো রোজ
তার রক্তেই আজকে আমার ঢেই।

উছলে পড়ছে আমি রাগে ফেটে পড়ছি
তবুও আমার চারিদিকে কত গ্রাম,
ঝলসে যাচ্ছে চকচকে তরবারি
তৃপ্তি পাচ্ছে মিটিয়ে মনস্কাম।

আমার দুপাশে ক্ষুধার তৃতীয় বিশ্ব
তবু মাঝে মাঝে জ্যোত্স্নালোকিত রাত,
আদিম জগতে যুবক ও যুবতীরা
ক্ষুধাতুর বুকে শরীরের গিরিখাত।

শরীর ছাড়া তো
আমাদের কিছু নেই
আমরা আদিম নিঃস্ব শরীর বিশ্ব,
সেটুকুও আজ ছিঁড়ে নিয়ে যেতে চায়
ধর্ম নামক আবহমানের দৃশ্য।

যে মেয়েটি রোজ ছুঁচের ডগায় নকশা
বুনে যেত প্রিয় ঘাঘরাচোলিকে ঘিরে,
সেই মেয়েটির নূপুরটি পড়ে আছে
এইখানে এই সবরমতীর তীরে।

সেই মেয়েটির জীবন ও বারোমাস
হাতের লাগানো ছোট্ট শিউলি চারা,
ছেলেবেলাকার সঙ্গী ধবলীটিও
তছনছ ক’রে আনন্দ পায় কারা ?

মনে পড়ে যায় এই তো কদিন আগে
যে রোগা রাখাল সরল চক্ষে হাসতো,
তার মৃতদেহ শনাক্ত করা যায়নি
তাকে যে মেয়েটি চুপি চুপি ভালোবাসতো . . .

সেও তো নিখোঁজ কয়েক সপ্তা ধরে
তার ঘরে আজ বাতাস খেলছে ধু ধু,
শেষবার তাকে দাঙ্গার প্রান্তরে
কয়েক ঝলক দেখা গিয়েছিল শুধু।

জনহীন খাঁ খাঁ চকচকে রাজপথে
প্রহরী শুধুই সাম্প্রদায়িক চোখ,
হিংস্র চক্ষু হা হা ক’রে তেড়ে আসে
ফাঁকা রাস্তার নিরস্ত্র এক লোক।

ফাঁকা রাস্তায় পোট্রোল পোড়া গন্ধ
আগুনের শিখা দ্রুতগতি লকলক,
ব্যাকুল গলায় আমাকে মেরো না ভাই
পুড়ে যাচ্ছেন নিরস্ত্র শিক্ষক।

অববাহিকার কত না চিত্রপট
সুখদুঃখের রেখাময় কিছু রূপ,
সাম্প্রদায়িক ভারতবর্ষে আজ
পশ্চিমদেশ নিখুঁত ধ্বংসস্তূপ।

.           *****************

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর