মুসলমান বৈষ্ণব কবি সম্বন্ধে যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্যর উদ্ধৃতি - পাতার উপরে . . .
১৯৪৫ সালে, যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্য তাঁর সম্পাদিত “বাঙ্গালার বৈষ্ণব-ভাবাপন্ন মুসলমান কবি” গ্রন্থে, কেন
কিছু মুসলমান কবি বৈষ্ণব-ভাবাপন্ন হলেন তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে, গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন . . .
“. . . রাম ও কৃষ্ণের উপর দেবত্ব আরোপিত হওয়ায় সেই-সকল কাহিনী (রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি) ইঁহারা
তাঁহাদের নবলব্ধ ধর্ম্মের আদর্শের সহিত সামঞ্জস্য করিয়া মানিতে পারিলেন না। তাই কালক্রমে এদেশীয়
মুসলমানদের নিকট বহুদেবতার পূজক হিন্দুদের ধর্ম্মকাহিনী পাঠের সম্পূর্ণ অনুপযোগী হইয়া উঠিল। চর্চ্চার
অভাবে এইজাতীয় অধিকাংশ কাহিনীই মুসলমানরা কালক্রমে ভুলিয়া গেলেন। কিন্তু চৈতন্যযুগে যখন প্রেমের
প্রবল বন্যায় বঙ্গদেশ প্লাবিত, তখন তাহা মুসলমানদের আঙ্গিনার মধ্যেও প্রবেশ করিল। প্রায় সেই সময়ই
প্রেমপূর্ণ বৈষ্ণব-হৃদয়ের উচ্ছ্বাস পদাবলীরূপে পরিস্ফুট হইয়া নৃত্যে ও সঙ্গীতে বাঙ্গালার গগন-পবন মুখরিত
করিয়া তুলিল। এই প্রেমসঙ্গীত-মন্দাকিনী শুধু হিন্দুর গৃহপাশেই প্রবাহিত হয় নাই, মুসলমানদের আঙ্গিনার
পাশ দিয়াও প্রবাহিত হইয়াছে। তাহার ফলে হিন্দুরা এই মন্দাকিনীর পূতবারি পানে যেরূপ কৃতার্থ হইয়াছেন,
মুসলমানরা সেইরূপ না হইলেও প্রেমতৃষ্ণা নিবারণের জন্য এই ধারা হইতে যে সময় সময় বারি গ্রহণ
করিয়াছেন, তাহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই। হিন্দু কবিরা এই ভাবগঙ্গায় স্নাত হইয়া জাহ্নবীর অশেষ
বীচিবিভঙ্গতুল্য অসংখ্য কবিতায় প্রেমিক-প্রেমিকার শাশ্বতমূর্ত্তি রাধাকৃষ্ণের লীলা বর্ণনা করিয়াছেন।
মুসলমানদের মধ্যে কেহ কেহ এই ভাবের প্রভাবে প্রভাবিত হইয়া রাধাকৃষ্ণ নাম উল্লেখ করিয়া প্রেমের কথা
গাহিয়াছেন।”
আমরা মিলনসাগরে কবি সাহ আকবরের কবিতা তুলে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে এই
প্রচেষ্টাকে সফল মনে করবো।
কবি সাহ আকবর-এর মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।
আমাদের ই-মেল - srimilansengupta@yahoo.co.in
এই পাতার প্রথম প্রকাশ - ২১.৬.২০১৪
পরিবর্ধিত সংস্করণ - ১৭.১১.২০১৭
অচ্যুত চরণ চৌধুরীর উদ্ধৃতির ও ২টি নতুন সংযোজন সহ পরবর্ধিত সংস্করণ - ১৭.১.২০১৮
...
অনেকে মনে করেন যে ইনি স্বয়ং সম্রাট আকবর! তাঁর বৈষ্ণব গীতির প্রীতি সম্বন্ধে অনেক কথা প্রচলিত
রয়েছে। অন্যদিকে অনেকে এই কবি সাহ আকবরকে, জনৈক ফকির বলে অনুমান করেন। তাঁর জীবনকাল
ইত্যাদি নিয়ে আর কোনো তথ্য জানা যায় নি।
যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্যর উদ্ধৃতি - পাতার উপরে . . .
যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্যর ১৯৪৫ সালে সম্পাদিত “বৈষ্ণব ভাবাপন্ন মুসলমান কবি” সংকলনে লিখেছেন . . .
“এই ভণিতা যুক্ত কবির একটি পদ গৌরপদতরঙ্গিণী গ্রন্থে উদ্ধৃত রয়েছে। এই পদটিই রমণীমোহন মল্লিক
সম্পাদিত মুসলমান বৈষ্ণব কবি, গ্রন্থে এবং ব্রজসুন্দর সান্যাল সম্পাদিত মুসলমান বৈষ্ণব কবি, চতুর্খ খণ্ডে
মুদ্রিত হয়েছে। কেউ কেউ অনুমান করেন যে ব্রজবুলি-ভাষায় চৈতন্যদেব সম্বন্ধে রচিত এই পদটি সম্রাট্
আকবরের রচনা। সম্রাট্ নাকি সভক্ত চৈতন্যের হরিসংকীর্ত্তন-চিত্র দেখিয়া বিহ্বল হইয়া এই পদটি রচনা
করিয়াছিলেন। অনেকে আলোচ্য কবিকে জনৈক ফকির বলিয়া অনুমান করেন।”
সম্রাট আকবরের বৈষ্ণব গীত প্রীতি - পাতার উপরে . . .
এই পদকর্তা যদি সত্যই সম্রাট আকবর হয়ে থাকেন, তাহলে আমাদের উচিত তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী এখানে
প্রকাশ করা। কিন্তু সম্রাট জালালউদ্দীন মহম্মদ আকবরের জীবনী যে কোনো ইতিহাসের বইতেই পাওয়া
যাবে। আমরা কেবল তাঁর বৈষ্ণব গীতি ও ভজন প্রীতি নিয়ে এখানে কিছু কথা বলবো।
সম্রাট আকবরের জন্মের মাত্র ৪বছর আগে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর (১৪৮৬ ~ ১৫৩৮) তিরোধান হয়। সম্রাট
আকবরের রাজত্বকাল শুরু হয় ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দে এবং শেষ হয় ১৬০৫ খৃষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যুতে। আকবরের
সময়কালে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কথা আসমুদ্র হিমাচলে ছড়িয়ে পড়েছিল একথা অসত্য নয়। বিভিন্ন সময়ে
আঁকা শ্রীচৈতন্যদেবের ছবিও যে আঁকা এবং প্রচারিত হয়েছিল তাতেও কারও সন্দেহ থাকা উচিত নয়।
সম্রাট আকবরের মতো উদার মনোভাবাপন্ন, প্রজার-নাড়ী-টিপে-চলা শাসকের পক্ষে চৈতন্যের ছবি
দেখা এবং তাঁর মহিমা অবগত হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়। তাছাড়া বিভিন্ন ধর্মের রীতি-নীতি নিয়ে
তিনি যে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন তা তাঁর নিজের প্রচলিত দীন-ই-ইলাহী প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে স্পষ্টরূপে
বোঝা যায়। দীন-ই-ইলাহীর উদযাপনের জন্য তিনি প্রয়াগ-এর নাম বদলে রাখেন ইলাহাবাদ, ১৫৮৩ খৃষ্টাব্দে।
সম্রাট আকবর ও মীরাবাঈ-এর রূপকথা - পাতার উপরে . . .
কথিত আছে যে, সম্রাট আকবর, মীরাবাঈয়ের রচিত ভজন প্রথমে শোনেন তাঁর সভার নবরত্নের অন্যতম
ওস্তাদ তানসেনের কণ্ঠে। এরপরই তাঁর প্রবল ইচ্ছা হয় মীরা বাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাত করার। সম্রাট আকবর
এরপর তানসেনকে সঙ্গে নিয়ে মীরাবাঈয়ের সঙ্গে দেখা করতে দ্বারকার রণছোড়জীর মন্দিরে যাত্রা করেন।
সেখানেই মীরাবাঈ তাঁদের আপ্যায়ণ করেন এবং তাঁর ভজন পরিবেশন করেন। তিনি নাকি সেদিন তাঁর
বিখ্যাত “যোগী মত জা . . .” ভজনটি আকবরকে গেয়ে শুনিয়েছিলেন।
খানিকটা প্রসঙ্গ বহির্ভূত হলেও একথা উল্লেখ করা হোলো এই কারণে যে, রূপকথার অংশ হলেও, এ থেকে
আমরা জানতে পারি যে সম্রাট আকবর বৈষ্ণব ভক্তিরসের গীত এতটাই ভালোবাসতেন যে, তা নিয়ে তাঁর
সঙ্গে মীরাবাঈ এর নাম জুড়ে একটি রূপকথার প্রচলন হতে পেরেছিল।
মিলনসাগরে মীরাবাঈয়ের ভজন হিন্দীতে পড়তে এখানে ক্লিক করুন . . .।
মীরাবাঈ (১৪৯৮ ~ ১৫৪৭) ও সম্রাট আকবরের সাক্ষাত্কারটি আদও ঘটেছিল কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট
সন্দেহ রয়েছে। মীরাবাঈ এর তিরোধান হয় আনুমানিক ১৫৪৭ খৃষ্টাব্দে। সে সময়ে আকবরের মাত্র ৫বছর
বয়স হওয়া কথা! ওস্তাদ তানসেন আকবরের দরবারে যোগদান করেন ১৫৬২ খৃষ্টাব্দে, মীরাবাঈ এর মৃত্যুর
প্রায় ১৫ বছর পরে! অন্যদিকে মীরাবাঈ এর জন্ম ও মৃত্যুর সময়কাল নিয়েও যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে! তাই
কোনটা ঠিক তা আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। বিশেষজ্ঞরা এই বিষয়ে আলোকপাত করবেন আশা করি।
এই পাতার কবিতার ভণিতা - সাহ আকবর, শাহ আকবর
|
বিভিন্ন সংকলনে কবির ভণিতা - পাতার উপরে . . .
জগবন্ধু ভদ্র সংকলিত ও মৃণালকান্তি ঘোষ সম্পাদিত, পদাবলী সংকলন “শ্রীগৌরপদ-তরঙ্গিণী”-তে কবির নাম
সাহ আকবর দেওয়া রয়েছে। হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত "বৈষ্ণব পদাবলী" তে কবির নাম
সাহ আকবর দেওয়া রয়েছে। যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্য সম্পাদিত বৈষ্ণব ভাবাপন্ন মুসলমান কবি সংকলন ও
আবদুল কাদির এবং রেজাউল করীম সম্পাদিত কাব্য মলঞ্চ সংকলনে কবির নাম রয়েছে শাহ আকবর
এবং সাহা আকবর।
মুসলমান বৈষ্ণব কবি সম্বন্ধে আবদুল করিমের উদ্ধৃতি - পাতার উপরে . . .
শিক্ষাবীদ, সাহিত্যিক, গবেষক ও প্রাচীন পুথির সংগ্রাহক, শ্রী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, জলধর সেন
সম্পাদিত “ভারতবর্ষ” পত্রিকার কার্তিক, ১৩২৩ সংখ্যায় (অক্টোবর ১৯১৬), তাঁর “বৈষ্ণব-কবিগণের
পদাবলী” প্রবন্ধে লিখেছেন . . .
“মুসলমান কবিগণ এক-সময়ে কবিতাকারে রাধাকৃষ্ণের প্রেম-বর্ণনায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন,---এখন এই
ভেদবুদ্ধির দিনে এ কথা নিতান্ত বিচিত্র বলিয়াই বোধ হইবে। কিন্তু বিচিত্র বোধ হইলেও, তাহা একান্ত সত্য
কথা,---তাহাতে বিস্মিত হইবার কিছুই নাই। মুসলমান কবিগণ সত্যসত্যই রাধাকৃষ্ণের প্রেমসুধা-পানে
বিভোর হইয়াছিলেন। সেই সুধাপানে কেহ-কেহ অমরতাও লাভ করিয়া গিয়াছেন। তাঁহাদের লীলারস
প্রকটনে অনেকে এমনই তন্ময়চিত্ত হইয়াছিলেন যে, ভণিতাটুকু উঠাইয়া দিলে---কবিতাটি হিন্দুর, কি
মুসলমানের রচনা, তাহা চিনিয়া লওয়া অসম্ভব বিবেচিত হইবে। জাতিধর্ম্মের ব্যবধানে থাকিয়া একজন
কবির এরূপ প্রসংশা-লাভ করা সামান্য গৌরবের কথা নহে। সৈয়দ মর্ত্তুজা, নাছির মহাম্মদ, মীর্জ্জা ফয়জুল্লা
প্রভৃতি কবিগণের পদাবলী কবিত্বে ও মাধুর্য্যে যে-কোন হিন্দু বৈষ্ণব-কবির পদাবলীর সহিত তুলনীয়।”
বৈষ্ণব পদাবলী সম্বন্ধে আবদুল করিমের উদ্ধৃতি - পাতার উপরে . . .
শিক্ষাবীদ, সাহিত্যিক, গবেষক ও প্রাচীন পুথির সংগ্রাহক, শ্রী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, সুরেশচন্দ্র
সমাজপতি সম্পাদিত “সাহিত্য” পত্রিকার পৌষ, ১৩২৫ সংখ্যায় (ডিসেম্বর ১৯১৮), তাঁর “সঙ্গীত শাস্ত্রের
একখানি প্রাচীন গ্রন্থ” প্রবন্ধে লিখেছেন . . .
“. . . বৈষ্ণব পদাবলীর মত সুন্দর জিনিস বঙ্গসাহিত্যে আর নাই। কাণের ভিতর দিয়া মরমে পশিয়া প্রাণ
আকুল করিয়া তুলিতে পারে, এমন সুধাস্রাবী ঝঙ্কার বৈষ্ণব পদাবলী ভিন্ন বাঙ্গালায় আর কিছুতে নাই।”
অচ্যুত চরণ চৌধুরীর উদ্ধৃতি - পাতার উপরে . . .
রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত, কলকাতার কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট থেকে প্রকাশিত “দাসী” পত্রিকার এপ্রিল
১৮৯৬ সংখ্যায় অচ্যুত চরণ চট্টোপাধ্যায় তাঁর মুসলমান বৈষ্ণব কবি প্রবন্ধে, সাহ আকবরের “জিউ জিউ
মোর মনচোরা গোরা” পদটির রচয়িতার সম্বন্ধে লিখেছেন . . .
“যথার্থ বটে, আকবর সাহা অতি উদার হৃদয় ছিলেন, কোন ধর্ম্ম বিশেষের উপর তাঁহার বিদ্বেষ ছিল না। এই
কারণে তাঁহার ধর্ম্মমত সম্বন্ধে নানাজনে নানা কথা বলিয়াছে ; কোন ঐতিহাসিক অর্দ্ধখৃষ্টিয়ান বলিতেও
কুণ্ঠিত হন নাই। এই কারণে গোঁড়া মুসলমানগণের কাছে তিনি “বিধর্ম্মী” বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকেন। সেই
গুণগ্রাহী সম্রাট, তাঁহার সমসাময়িক মহিমাময় সদুদার প্রচারক-প্রবরের গুণগ্রামে মুগ্ধ হইয়া থাকিবেন,
আশ্চর্য্য নহে। কিন্তু তিনি যে ঐ পদের রচয়িতা তাহার প্রমাণ কৈ ? ভণিতায় যে “সাহ আকবর” নাম
আছে, উনি ভিন্ন ব্যক্তি, না সেই স্বনামখ্যাত সম্রাট ? এ প্রশ্ন সহজেই মনে হইতে পারে।
এই মিমাংসা ইতিহাস করেন নাই। ইতিহাসে এ সম্বন্ধে কোন কথা না থাকিলেও একেবারে প্রমাণাভাব নহে।
আমরা একখানি চিত্রের কথা বলিতেছি।
এই চিত্রখানি চারিশত বর্ষের প্রাচীন। এখান নিতান্ত জীর্ণ হইয়া গিয়াছে, আর অধিককাল কালের সহিত
বিবাদ করিয়া থাকিতে পারিবে না। চিত্রখানি যিনি ইচ্ছা দেখিতে পারেন। বৃন্দাবনে---রাধাকুণ্ডে,
শ্রীজাহ্নবাজির কুঞ্জে তাহা অদ্যপি আছে।
বিদিত আছে যে, শ্রীমহাপ্রভুর গুণগ্রাম শ্রবণে গ্রণগ্রাহী আকবর সাহা একদা তাঁহাকে দেখিতে অভিলাষ করেন
। মহাপ্রভু তখন নীলাচলে। নীলাচলে তখন প্রতাপরুদ্র গজপতি স্বাধীন নৃপতি। মহাপ্রভুকে দিল্লী পাঠাইয়া
দিতে, সম্রাট প্রতাপরুদ্রকে অনুরোধ করেন। সম্রাটের আদেশলিপি পাইয়া গজপতি ভীত হইলেন। তিনি
জানেন, শ্রীমহাপ্রভু রাজদর্শন করিতে নিতান্ত পরাঙ্মুখ। (স্বয়ং প্রতাপরুদ্র কত কষ্টে মহাপ্রভুর দর্শন প্রাপ্ত হন,
চরিতামৃতের পাঠক তাহা জানেন)। সম্রাটের প্রস্তাব মহাপ্রভুকে বলিতেও তিনি সাহস করিলেন না ; তবে
সার্ব্বভৌমাদির পরামর্শ মতে প্রতাপরুদ্র শ্রীমহাপ্রভুর একখানি চিত্রপট, সম্রাটের নিকট পাঠাইয়া দিলেন। সেই
চিত্র খানির কথাই আমি বলিতেছি, বৃন্দাবনে জাহ্নবাজির কুঞ্জে তাহাই বিরাজিত।
প্রতাপরুদ্র প্রেরিত এই চিত্রখানি পাইয়া সম্রাট বিমুগ্ধ হন, এবং পরম যত্নে তাহা স্বীয় প্রাসাদ-প্রকোষ্ঠে রক্ষা
করেন। কালে মোগল সাম্রাজ্যের অধঃপতন ঘটিল, কিন্তু চিত্রখানি প্রাসাদেই রহিল। অবশেষে ভরতপুরের
রাজা বলদেব সিংহ দিল্লী লুণ্ঠন কালে চিত্রখানি প্রাপ্ত হন ; অন্যান্য রত্নের সহিত এখানিও তিনি আনায়ন
করেন, ও বৃন্দাবনের ভজনানন্দ সিদ্ধ কৃষ্ণজাস বাবাজিকে দান করেন। চিত্রখানি বাবাজির হৃদয়ের ধন ছিল,
এখানি দেখিলেও তাঁহার হৃদয়ে প্রেমের উত্স খুলিত। এইরূপে চিত্রখানি বৃন্দাবনে আইসে।
যদি কোন পাঠক বৃন্দাবনে যান, সে পুরাতন চিত্রখানি দেখিবেন। দেখিতে পাইবেন, তাহা একখানি
সংকীর্ত্তনের আলেখ্য। স্থান, সমুদ্রতীর, বৃক্ষাদি কিছু নাই, কেবল সাদা সাদা বালুকা। সেই বালুকা-প্রান্তরে
ছয়জনে মিলিয়া কীর্ত্তন গাইতেছেন। মধ্যস্থলে যিনি,---সুদীর্ঘ সুন্দর অথচ জীর্ণশীর্ণ, তিনিই শ্রীমহাপ্রভু।
মহাপ্রভু নৃত্যকারী, তিনজন ভক্ত করতাল ও দুইজন মৃঙ্গ বাজাইতেছেন। সকলেই মণ্ডলী বন্ধনে কীর্ত্তন
করিতেছেন। চিত্রে এ কি দেখা যাইতেছে ? তাঁহাদের পা কি বালুকাতে বসিয়া যাতেছে ? হাঁ, তাহাই বটে ;
তাহারই চিহ্ন দেখা যাইতেছে। মহাপ্রভুর পরিধান কৌপীন---বহির্ব্বাস, মস্তক মুণ্ডিত। তাঁহার প্রতিভা প্রদীপ্ত
দেহ হইতে যেন একটি অমানুষিক তেজ নির্গত হইতেছে।
এই সুচিত্রিত প্রকৃত চিত্রখানি দেখিয়া পাঠক, সাহ আকবরের ভণিতাযুক্ত পদটি স্মরণ করুণ, উভয় চিত্র,---
কবিতা ও আলেখ্য, কি এক---অভেদ বলিয়া বোধ হয় না। ছবিতে দেখিতে পাইবেন, সেই “মনচোরা গোরা,
আপহি নাচত আপন রসে ভোরা,” চিত্রিত। দেখিতে পাইবেন “খোল করতাল বাজে ঝিকি ঝিনিয়া, আনন্দে
ভকত নাকে লিকি লিকিয়া,” এ চিত্রও অঙ্কিত রহিয়াছে। তবে কি কবিতাটি যথার্থ আকবর বিরচিত, চিত্র
দর্শনে বিমুগ্ধ সম্রাট চিত্তে যথার্থই কি কবিতার পবিত্র উত্স উচ্ছাসিত হইয়াছিল ? সুধীগণ এ প্রশ্নের সিদ্ধান্ত
করিবেন।”
উপরোক্ত চিত্রটি দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। কুঞ্জঘাটার জমিদার বাড়ি থেকে প্রাপ্ত স-পার্ষদ শ্রীচৈতন্য
মহাপ্রভুর ছবি এটি নয়। কুঞ্জঘাটা থেকে প্রাপ্ত ছবিটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন।
উপরোক্ত বক্তব্য সম্বন্ধে আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে একটি কথা বলতে পারি যে, সম্রাট আকবরের, গজপতি
প্রতাপরুদ্রের কাছে শ্রীচৈতন্যকে দিল্লীতে প্রেরণ করার আদেশ পাঠানো সম্বভ নয়। কারণ শ্রীচৈতন্যেরদেবের
তিরোধান হয় সম্রাট আকবরের জন্মের ৪বছর পূর্বে। এ ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু বাকি বক্তব্য সত্য হতেও
পারে! সম্রাট আকবর তাঁর রাজত্বকালে ঐ ছবি আনিয়ে, দেখে, পদটি রচনা করতেই পারেন!
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পরে, ১৭৫৩সাল নাগাদ দিল্লী (জাটল্যাণ্ড) এবং ১৭৬৩সাল নাগাদ, ভরতপুরের
রাজাদের দ্বারা আগ্রার তাজমহলের রৌপ্য-সিংহদ্বার সহ বহু প্রাসাদের লুণ্ঠনকার্য সমাধা করা হয়েছিল
(উইকিপেডিয়া)। সেটাও ঐতিহাসিক সত্য। তবে সেই কাজে আমরা মহারাজা সুরজ মল-এর নাম পাই।
তাই ঐ ছবিটির মোগল প্রাসাদ থেকে বৃন্দাবনে পৌঁছানোর গল্পটিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
অন্যথা ঐ পদটি সাহ আকবর নামের অন্য কোনো ব্যক্তির রচিত পদও হতে পারে যেমনটি লিখেছেন
যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্য তাঁর নীচে দেওয়া প্রবন্ধের উদ্ধৃতিতে . . .
কবি সাহ আকবর - এই কবির একটি
মাত্র পদ পাওয়া গিয়েছে। তাঁর পদ "সাহ
আকবর", "সাহা আকবর" অথবা "শাহ
আকবর" ভণিতাতেও পাওয়া গিয়েছে।