নবদ্বীপের চাঁদকাজী এবং শ্রীচৈতন্যের একটি সফল নাগরিক আন্দোলন - পাতার উপরে . . .
বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে বিবাহের পরে ১৫০৮ খৃষ্টাব্দে বিশ্বম্ভর (শ্রীচৈতন্যের পূর্বাশ্রমের নাম) গয়া গেলেন
পিতৃশ্রাদ্ধ ও পিণ্ডদানের জন্য। সেখানে অঞ্জলি দেওয়ার সময় আত্মহারা হয় গেলেন। ঈশ্বরীপুরীর কাছে
গোপাল মন্ত্র নিলেন।
গয়া থেকে ফিরে সবাই দেখলো যে কৃষ্ণপ্রেমে নিমাইয়ের হৃদয় উদ্বেল হয়ে উঠেছে। তাঁর চরিত্রের পরিবর্তন
লক্ষ্য করলেন সবাই। তাঁর হাস্য-কৌতুক, বিদ্যার দম্ভ, সব যেন কোথায় হারিয়ে গেল। তাঁর অন্তরে দেখা
দিল সংসার বৈরাগ্য। ছাত্র পড়াতে আর মন নেই বলে তাঁর টোল বন্ধ হয়ে গেল। তিনি কৃষ্ণ নাম-কীর্তনে
মেতে উঠলেন। তিনি নিত্যানন্দ, অদ্বৈত্যাচার্য প্রমুখ বৈষ্ণবগণ, যাঁরা শাক্ত ও নৈয়ায়িকদের ভয়ে ভয়ে
ছিলেন, তাঁদের উদ্বুদ্ধ করলেন।
বৈষ্ণব বিরোধী হিন্দুদের এবং যবন ( অহিন্দু, এক্ষেত্রে মুসলমান ) নাগরিকদের অভিযোগের ভিত্তিতে কাজী
নগরে কীর্তন বন্ধের আদেশ দিলেন . . .
এইমত পাষণ্ডীরা বল্গয়ে সদায়।
প্রতিদিন নগরিয়াগণ ‘কৃষ্ণ’ গায়॥
একদিন দৈবে কাজি সেই পথে যায়।
মৃদঙ্গ মন্দিরা শঙ্খ শুনিবারে পায়॥
হরিনাম-কোলাহল চতুর্দ্দিগে মাত্র।
শুনিয়া স্মঙরে কাজি আপনার শাস্ত্র॥
কাজি বোলে “ধর ধর আজি করোঁ কার্য্য।
আজি বা কি করে তোর নিমাঞি আচার্য্য॥”
এথেব্যথে পলাইল নগরিয়াগণ।
মহাত্রাসে কেশ কেহো না করে বন্ধন॥
যাহারে পাইল কাজি, মারিল তাহারে।
ভাঙ্গিল মৃদঙ্গ, অনাচার কৈল দ্বারে॥
কাজি বোলে হিন্দুয়ানি হইল নদীয়া।
করিমু ইহার শাস্তি নাগালি পাইয়া॥
ক্ষমা করি যাঙ আজি, দৈবে হৈল রাতি।
আরদিন লাগি পাইলেই লৈব জাতি॥ ---বৃন্দাবন দাস, চৈতন্যভাগবত, মধ্যখণ্ড, ২৩শ অধ্যায়॥
শুনিয়া যে ক্রুদ্ধ হইল সকল যবন ;
কাজী পাশে আসি সবে কৈল নিবেদন।
ক্রোধে সন্ধ্যাকালে কাজী একঘরে আইলা ;
মৃদঙ্গ ভাঙ্গিয়া লোকে কহিতে লাগিলা :---
‘এতকাল প্রকটে কেহ না কৈল হিন্দুয়ানী ;
এবে উদ্যম চালাও কার বল জানি ?
কেহ কীর্ত্তন না করিহ সকল নগরে ;
আজি মুই ক্ষমা করি যাইতেছি ঘরে।
আর যদি কীর্ত্তন করিতে লাগ পাইমু ;
সর্ব্বস্ব দণ্ডিয়া তার জাতি যে লইমু’। ---কৃষ্ণদাস কবিরাজ, চৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, সপ্তদশ পরিচ্ছেদ॥
কাজীর আদেশ শুনে যখন সবাই ভয়েভীত, তখন বিশ্বম্ভরের মুখে ভয়ের বদলে শোনা গেল হুংকার! . . .
তা’ সবার অন্তরে ভয় প্রভু মনে জানি
কহিতে লাগিলা লোকে শীঘ্র ডাকি আনি :---
‘নগরে নগরে আজি করিব কীর্ত্তন ;
সন্ধ্যাকালে কর সবে নগর মণ্ডন।
সন্ধ্যাতে দেউটি সবে জ্বাল ঘরে ঘরে।
দেখি কোন্ কাজি আসি মোরে মানা করে’? ---কৃষ্ণদাস কবিরাজ, চৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, সপ্তদশ
পরিচ্ছেদ॥
কাজীর এই কীর্তন বন্ধের আদেশের বিরুদ্ধে বিশ্বম্ভর অনুষ্ঠিত করেন একটি সফল, অহিংস, প্রচণ্ড, নাগরিক
আন্দোলন! তিনি তাঁর ভক্ত-সমর্থকদের তিনটি দলে ভাগ করে দেন। প্রথম দলটি চলে যবন হরিদাসের
নেতৃত্বে, দ্বিতীয় দল চলে অদ্বৈত আচার্যের নেতৃত্বে এবং তৃতীয় দল চলে নিত্যানন্দ এবং তাঁর নেতৃত্বে। সকল
জাতপাতের সাধারণ মানুষকে নিয়ে, হরি নাম করতে করতে, কাজীর বাড়ী পর্যন্ত চলে এই অভিযান।
বিশাল জন সমর্থন দেখে কাজী ভয় পেয়ে যান। বিশ্বম্ভরের সঙ্গে মামা-ভাগ্নের সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলেন এবং
নতিস্বীকার করেন! অথবা বিশ্বম্ভরের নানা প্রশ্ন ও শাস্ত্রবচন শুনে, সত্যিই অনুশোচনাগ্রস্থ হয়ে বিশ্বম্ভরের
দাবী মেনে নেন এবং কৃপাপ্রার্থী হন। . . .
তবে মহাপ্রভু তার দ্বারেতে বসিলা ;
ভব্য লোক পাঠাইয়া কাজী বোলাইলা।
দূর হৈতে আইলা কাজী মাথা নোঙাইয়া ;
কাজীরে বসাইলা প্রভু সম্মান করিয়া।
প্রভু বলেন ‘আমি তোমার আইলাম অভ্যাগত ;
আমা দেখি লুকাইলা ; এ ধর্ম্ম কেমত’?
কাজী কহে ‘তুমি আইস ক্রুদ্ধ হইয়া ;
তোমা শান্ত করিবারে রহিনু লুকাইয়া।
এবে তুমি শান্ত হৈলা, আসি মিলিলাঙ ;
ভাগ্য মোর তোমা হেন অতিথি পাইলাঙ।
গ্রাম সম্বন্ধে চক্রবর্ত্তী হয় আমার চাচা ;
দেহ সম্বন্ধ হৈতে গ্রাম সম্বন্ধ সাচা।
নীলাম্বর চক্রবর্ত্তী হয় মোর নানা ;
সে সম্বন্ধে হও তুমি আমার ভাগিনা।
ভাগিনার ক্রোধ মামা অবশ্য সহয় ;
মাতুলের অপরাধ ভাগিনা না লয়’।
এই মতে দুঁহার কথা হয় ঠারে ঠোরে ;
ভিতরের তত্ত্ব কেহ বুঝিতে না পারে।
* * * * *
প্রভু কহে ‘এক দান মাগিয়ে তোমায় ;
সংকীর্ত্তন বাদ যেন নহে নদীয়ায়’।
কাজী কহে ‘মোর বংশে যত উপজিবে ;
তাহাকে তালাক দিব কীর্ত্তন না বাধিবে।’
শুনি প্রভু হরি বলি উঠিলা আপনি ;
উঠিল বৈষ্ণব সব করি হরিধ্বনি।
---কৃষ্ণদাস কবিরাজ, চৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, সপ্তদশ পরিচ্ছেদ॥
কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃতের এই ঘটনার বর্ণনার সঙ্গে বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবতের বর্ণনার
অনেক তফাত রয়েছে। চৈতন্যভাগবতে (মধ্য খণ্ড, ২৩শ অধ্যায়) এই আন্দোলনকে মোটেই অহিংস দেখানো
হয়নি। সেখানে কাজীর বাড়ী ও বাগান লণ্ডভণ্ড করে দেওয়া হয় এবং কাজী তাঁর লোকজন নিয়ে ভয়ে
পালিয়ে যান। এরপর নিমাই, বাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দিতে বলেন। বিশ্বম্ভরের এই ক্রোধ দেখে শেষে
ভক্তরাই গলবস্ত্র হয়ে তাঁকে শান্ত হতে অনুরোধ করলে তিনি ফিরে যান। দুটির মধ্যে কোনো বর্ণনাতেই নেই
কোনো হতাহতের বা লুণ্ঠনের বা নারীর শ্লীলতাহানীর ঘটনার উল্লেখ। অর্থাৎ একটি অহিংস এবং অপরটি
নির্ভেজাল অহিংস না হলেও খুনাখুনি পর্যন্ত গড়ায়নি।
কোটিকোটি হরিধ্বনি মহাকোলাহল।
স্বর্গ-মর্ত্ত্য-পাতালাদি পূরিল সকল॥
শুনিয়া কম্পিত কাজি গণ-সহে ধায়।
সর্প-ভয়ে যেন ভেক ইন্দুর পলায়॥
* * * * *
আসিয়া প্রভুর দ্বারে প্রভু বিশ্বম্ভর।
ক্রোধাবেশে হুঙ্কার করয়ে বহুতর॥
ক্রোধে বোলে প্রভু “আরে কাজি বেটা কোথা।
ঝাট আন ধরিয়া কাটিয়া ফেলোঁ মাথা॥
নির্যবন করোঁ আজি সকল ভুবন।
পূর্ব্বে যেন বধ কৈলুঁ সে কালযবন॥
প্রাণ লঞা কোথা কাজি গেল দিয়া দ্বার।
ঘর ভাঙ্গ ভাঙ্গ” প্রভু বোলে বারেবার॥---বৃন্দাবন দাস, চৈতন্যভাগবত, মধ্য খণ্ড, ২৩শ অধ্যায়॥
. . . এর পর ঘর-দোর গাছ-পালা লণ্ডভণ্ডের বর্ণনার পর ভক্তগণের গলবস্ত্র হয়ে ক্রোধ সম্বরণের অনুরোধ . . .
“ . . .অগ্নি দেহ ঘরে তোরা না করিহ ভয়।
আজি সব যবনের করিমু প্রলয়॥”
দেখিয়া প্রভুর ক্রোধ সর্ব্বভক্তগণ।
গলায় বান্ধিয়া বস্ত্র পড়িলা তখন॥
ঊর্দ্ধবাহু করিয়া সকল ভক্তগণ।
প্রভুর চরণানবিন্দে করে নিবেদন॥
“তোমার প্রধান অংশ প্রভু সঙ্কর্ষণ।
তাঁহার অকালে ক্রোধ না হয় কখন॥
যে-কালে হইব সর্ব্বসৃষ্টির সংহার।
সঙ্কর্ষণ ক্রোধে হন রুদ্র-অবতার॥
যে রুদ্র সকল সৃষ্টি ক্ষণেকে সংহরে।
শেষে তিঁহো আসি মিলে তোমার শরীরে॥
* * * * *
ব্রহ্মাদিও তোমার ক্রোধের নহে পাত্র।
সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় তোমার লীলা-মাত্র॥
করিলা ত কাজির অনেক অপমান।
আর যদি ঘটে তবে সংহারিহ প্রাণ॥”
এখানে ক্রোধের মধ্যে দিয়ে একদিকে শ্রীচৈতন্যকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবতাররূপে তুলে ধরার একটি চেষ্টা।
অপরদিকে ভক্তগণ ক্রোধ সম্বরণ করতে বলার মধ্যে সঙ্কর্ষণের বা হলধর বা প্রভু নিত্যানন্দের কথা তুলে
বলছেন যে অকালে তাঁর এমন ক্রোধ হয় না। জগাই-মাধাই কাণ্ডের সময়ও নিমাই প্রচণ্ড ক্রোধিত হয়ে
সংহার করার কথা বলে ছিলেন এবং নিত্যানন্দ প্রভুর মাথা ফাটলেও তিনি জগাই-মাধাইকে ক্ষমা করার
কথা বলে বাঁচিয়েছিলেন। এখানে নিত্যানন্দ, হলধর অর্থাৎ বলরামের অবতার।
প্রশ্ন ওঠে কোন বর্ণনাটি সত্য, চৈতন্যচরিতামৃতের না চৈতন্যভাগবতের? অনেকেই বৃন্দাবন দাসের কথাই
ঠিক বলে মনে করেন কারণ তিনি তাঁর গুরু প্রভু নিত্যানন্দের থেকেই সব বিবরণ শুনে লিখেছিলেন। অর্থাৎ
প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য! আমার মনে হয় যে প্রভু নিত্যানন্দের ব্যক্তিত্বকে আরও উজ্জ্বল বা আরও বড় করে
দেখানোর জন্যও এমনভাবে লিখে থাকতে পারেন বৃন্দাবন দাস। বৃন্দাবন দাস প্রভু নিত্যানন্দের মন্ত্রশিষ্য
ছিলেন। তাঁর আজ্ঞাতেই তিনি চৈতন্যভাগবত রচনা করেন। এখানে বৃন্দাবন দাসের রচনা যেন কিছুটা
অতিরঞ্জিত। কৃষ্ণদাস কবিরাজের পরিণত-বৃদ্ধবয়সের লেখা অনেক সংযত। কৃষ্ণদাস কবিরাজ
চৈতন্যজীবনী, বৃন্দাবন দাসের থেকে প্রায় ২০বছর পরে লিখলেও তিনি ২০-২২বছরের বয়োজ্যেষ্ঠ।
নবদ্বীপের এই নাগরিক আন্দোলনের সময় তিনি কিশোর বয়সের আর বৃন্দাবন দাসের তখন জন্মই হয় নি।
তাই কৃষ্ণদাস কবিরাজও লোক মুখে সেই ঘটনার তাজা বিবরণ শুনেছিলেন তা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া
যায় না। যদিও তিনি তাঁর গ্রন্থে একাধিকবার বৃন্দাবন দাসের লেখাকে অনুসরণ করছেন বলে লিখেছেন।
তবুও মনে হয় পরস্পর বিরোধী তথ্যের, যায়গায় তাঁর নিজের জানা তথ্যের উপর ভিত্তি করে
চৈতন্যচরিতামৃত রচনা করেছিলেন।
চাঁদ কাজী ছিলেন বাংলার নবাবের দৌহিত্র। নদীয়ার বামনপুকুরে চাঁজকাজীর সমাধি রয়েছে। অভিষেক
নস্কর লিখেছেন যে সেখানকার মানুষজনের মতে, চাঁদকাজীর আসল নাম ছিল মৌলানা সিরাজউদ্দীন। তিনি
ছিলেন এই অঞ্চলের শাসক এবং গৌড়েশ্বর হুসেন শাহের শিক্ষক (অভিষেক নস্কর, বঙ্গদর্শন )। যাই হোন না
কেন, তিনি নবাবের আত্মীয় অথবা অতি কাছের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই।
তাঁর বাড়ী-ঘর ভাঙচুর করলে, ফল কত খারাপ হতে পারে, সে কথা নিমাইপণ্ডিতের মত বিচক্ষণ নেতা
নিশ্চয়ই চিন্তা করেছিলেন। কোনো বিবেচক নেতার কি তেমন কোনো হঠকারী কাজে উত্সাহ দেওয়া উচিত
হোতো? নবদ্বীপের মানুষের উপর বাংলার বাদশাহের কাছ থেকে, এই ঘটনার বদলা হিসেবে অবধারিত
দমন-পীড়ন ঘটনাবলীর উল্লেখ আমরা পাই না। তাই এরকম ঘটনার সত্যতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ
থেকেই যায়।
তাই মনে হয় কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃতের ঘটনাই সত্যের কাছাকাছি। সেখানে দেখতে পাই যে
কাজীর সঙ্গে নিমাই পণ্ডিতের সামনাসামনি কথা হচ্ছে এবং কাজী, গ্রাম সূত্রে নিমাই-এর সঙ্গে মামা-ভাগ্নের
আত্মীয়তার কথা বলছেন। তিনি নাকি শ্রীচৈতন্যের ভক্তও হয়ে যান। নদীয়ার বামনপুকুরে, কাজীর সমাধির
উপর, মহাপ্রভু নাকি একটি চাপাফুলের গাছ পুতেছিলেন (কথিত)। সেই গাছটি এখনও জীবিত আছে।
নবদ্বীপের কাজী ও বিশ্বম্ভরের ঘটনাটি যে কোনো আধুনিক যুগের নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করা
যায়, চোখ বুজে! প্রশাসন দ্বারা নাগরিকের উপর কোনো বিষয়ে উত্পীড়ন-নিপীড়ন, কোন জননেতার দ্বারা,
নাগরিকদের সংগঠিত করে স্লোগান দিতে দিতে, এ ক্ষেত্রে হরিনাম সঙ্কীর্তন করতে করতে, প্রশাসকের
কর্মক্ষেত্রের দিকে এদিয়ে গিয়ে অবরোধ তৈরী করা, প্রশাসনকে বাধ্য করা সামনাসামনি বসে কথা বলার
এবং শেষে প্রশাসককে বুঝিয়ে রাজি করানো, তাঁদের দাবী সম্পূর্ণভাবে মেনে নিতে! যে যুগে লড়াই-যুদ্ধ-
বিগ্রহই ছিল যে কোনো বিরোধের মিমাংসার একমাত্র উপায়, সেখানে বিশ্বম্ভর, পরে শ্রীচৈতন্য চমত্কারভাবে
সংগঠিত করছেন একটি অহিংস নাগরিক আন্দোলন! কে বলে ইনি শুধু ধর্মনেতা!?
যুধিষ্ঠির জানা ওরফে মালীবুড়োর উদ্ধৃতি - পাতার উপরে . . .
শ্রীচৈতন্যের সন্ন্যাসগ্রহণের পূর্বে নদীয়া নগরের কাজীর নামও চাঁদকাজী, যিনি সেখানে কীর্তন বন্ধের আদেশ
দেন। ইনি কবি চাঁদকাজী কিনা তাও বলা যাচ্ছে না। যুধিষ্ঠির জানা (মালীবুড়ো) দ্বারা ১৯৮৫ এর পরে
প্রকাশিত, “শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য” গ্রন্থের শেষে সংক্ষিপ্ত পরিচিতিতে তিনি চাঁজকাজীর উল্লেখ করে
লিখেছেন . . .
“হুসেন শাহের (গৌড়ের নবাব) আঠারোজন পুত্র কন্যা ছিল। চাঁদকাজী, হুসেন শাহের একজন দৌহিত্র।
চৈতন্যদেব যখন চাঁদকাজীর বাগান বাড়ী ভেঙে লণ্ডভণ্ড করেন, তখন হুসেন শাহ গৌড়ে ছিলেন না। তিনি
গিয়েছিলেন উড়িষ্যায় যুদ্ধ করতে। খুব সম্ভবত ১৫১০ খ্রীষ্টাব্দে মহাপ্রভু চাঁদকাজীর বাড়ী ভগ্ন করেছিলেন। এই
ঘটনার অব্যবহিত পরেই শ্রীচৈতন্যদেব সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। মৌলানা সিরাজুদ্দিন চাঁদকাজীর সমাধি
মায়াপুরে বামনপুকুর নামক স্থানে আজিও বিদ্যমান। এই স্থানের প্রাচীন নাম সিমূলিয়া।”
কবি চাঁদ কাজী - হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়
সম্পাদিত "বৈষ্ণব পদাবলী" তে কবির
ভণিতা সহ একটি বৈষ্ণব পদ রয়েছে। তাঁর
জীবনকাল ইত্যাদি নিয়ে আর কোনো তথ্য
আমাদের কাছে নেই।
শ্রীচৈতন্যের সন্ন্যাস নেবার পূর্বে নবদ্বীপের কাজী, কীর্তন গীত গাওয়া নিষিদ্ধ করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে
বিশ্বম্ভর মিশ্র (শ্রীচৈতন্যের পূর্বাশ্রমের নাম) এক সফল নাগরিক আন্দোলন সংঘটিত করে কীর্তন গাইবার
অধিকার নিয়ে ছাড়েন। সেই নবদ্বীপের কাজীর নাম অনেকের মতে চাঁদকাজী। কেউ কেউ মনে করেন তাঁর
আসল নাম ছিল মৌলানা সিরাজউদ্দীন। তিনি ছিলেন এই অঞ্চলের শাসক এবং গৌড়েশ্বর হুসেন শাহের
শিক্ষক। নদীয়ার বামনপুকুরে চাঁজকাজীর সমাধি রয়েছে।
ডঃ শিশির কুমার দাশের ২০০৩ সালে প্রকাশিত, "সংসদ বাংলা সাহিত্য সঙ্গী" বইটিতে এক
ত্রিপুরাবাসী কবি শেখ চাঁদ-এর উল্লেখ পাই, যাঁর জীবনকাল ছিল সম্ভবত ১৫৬০ ~ ১৬২৫ খৃষ্টাব্দ। শেখ চাঁদের
রচনার মধ্যে রয়েছে "রসুলবিজয়", "কিয়ামৎনামা", "হরগৌরী সংবাদ" প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ। তিনি ধর্মশাস্ত্রে
সুপণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু এই শেখ চাঁদই কবি চাঁদ কাজী কি না তা আমরা জানি না।
মুসলমান বৈষ্ণব কবি সম্বন্ধে যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্যর উদ্ধৃতি - পাতার উপরে . . .
১৯৪৫ সালে, যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্য তাঁর সম্পাদিত “বাঙ্গালার বৈষ্ণব-ভাবাপন্ন মুসলমান কবি” গ্রন্থে, কেন
কিছু মুসলমান কবি বৈষ্ণব-ভাবাপন্ন হলেন তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে, গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন . . .
“. . . রাম ও কৃষ্ণের উপর দেবত্ব আরোপিত হওয়ায় সেই-সকল কাহিনী (রামায়ণ, মহাভারত
ইত্যাদি) ইঁহারা তাঁহাদের নবলব্ধ ধর্ম্মের আদর্শের সহিত সামঞ্জস্য করিয়া মানিতে পারিলেন না। তাই
কালক্রমে এদেশীয় মুসলমানদের নিকট বহুদেবতার পূজক হিন্দুদের ধর্ম্মকাহিনী পাঠের সম্পূর্ণ অনুপযোগী
হইয়া উঠিল। চর্চ্চার অভাবে এইজাতীয় অধিকাংশ কাহিনীই মুসলমানরা কালক্রমে ভুলিয়া গেলেন। কিন্তু
চৈতন্যযুগে যখন প্রেমের প্রবল বন্যায় বঙ্গদেশ প্লাবিত, তখন তাহা মুসলমানদের আঙ্গিনার মধ্যেও প্রবেশ
করিল। প্রায় সেই সময়ই প্রেমপূর্ণ বৈষ্ণব-হৃদয়ের উচ্ছ্বাস পদাবলীরূপে পরিস্ফুট হইয়া নৃত্যে ও সঙ্গীতে
বাঙ্গালার গগন-পবন মুখরিত করিয়া তুলিল। এই প্রেমসঙ্গীত-মন্দাকিনী শুধু হিন্দুর গৃহপাশেই প্রবাহিত হয়
নাই, মুসলমানদের আঙ্গিনার পাশ দিয়াও প্রবাহিত হইয়াছে। তাহার ফলে হিন্দুরা এই মন্দাকিনীর পূতবারি
পানে যেরূপ কৃতার্থ হইয়াছেন, মুসলমানরা সেইরূপ না হইলেও প্রেমতৃষ্ণা নিবারণের জন্য এই ধারা হইতে যে
সময় সময় বারি গ্রহণ করিয়াছেন, তাহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই। হিন্দু কবিরা এই ভাবগঙ্গায় স্নাত হইয়া
জাহ্নবীর অশেষ বীচিবিভঙ্গতুল্য অসংখ্য কবিতায় প্রেমিক-প্রেমিকার শাশ্বতমূর্ত্তি রাধাকৃষ্ণের লীলা বর্ণনা
করিয়াছেন। মুসলমানদের মধ্যে কেহ কেহ এই ভাবের প্রভাবে প্রভাবিত হইয়া রাধাকৃষ্ণ নাম উল্লেখ করিয়া
প্রেমের কথা গাহিয়াছেন।”
মুসলমান বৈষ্ণব কবি সম্বন্ধে আবদুল করিমের উদ্ধৃতি - পাতার উপরে . . .
শিক্ষাবীদ, সাহিত্যিক, গবেষক ও প্রাচীন পুথির সংগ্রাহক, শ্রী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, জলধর সেন
সম্পাদিত “ভারতবর্ষ” পত্রিকার কার্তিক, ১৩২৩ সংখ্যায় (অক্টোবর ১৯১৬), তাঁর “বৈষ্ণব-কবিগণের
পদাবলী” প্রবন্ধে লিখেছেন . . .
“মুসলমান কবিগণ এক-সময়ে কবিতাকারে রাধাকৃষ্ণের প্রেম-বর্ণনায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন,---এখন এই
ভেদবুদ্ধির দিনে এ কথা নিতান্ত বিচিত্র বলিয়াই বোধ হইবে। কিন্তু বিচিত্র বোধ হইলেও, তাহা একান্ত সত্য
কথা,---তাহাতে বিস্মিত হইবার কিছুই নাই। মুসলমান কবিগণ সত্যসত্যই রাধাকৃষ্ণের প্রেমসুধা-পানে
বিভোর হইয়াছিলেন। সেই সুধাপানে কেহ-কেহ অমরতাও লাভ করিয়া গিয়াছেন। তাঁহাদের লীলারস
প্রকটনে অনেকে এমনই তন্ময়চিত্ত হইয়াছিলেন যে, ভণিতাটুকু উঠাইয়া দিলে---কবিতাটি হিন্দুর, কি
মুসলমানের রচনা, তাহা চিনিয়া লওয়া অসম্ভব বিবেচিত হইবে। জাতিধর্ম্মের ব্যবধানে থাকিয়া একজন
কবির এরূপ প্রসংশা-লাভ করা সামান্য গৌরবের কথা নহে। সৈয়দ মর্ত্তুজা, নাছির মহাম্মদ, মীর্জ্জা ফয়জুল্লা
প্রভৃতি কবিগণের পদাবলী কবিত্বে ও মাধুর্য্যে যে-কোন হিন্দু বৈষ্ণব-কবির পদাবলীর সহিত তুলনীয়।”
বৈষ্ণব পদাবলী সম্বন্ধে আবদুল করিমের উদ্ধৃতি - পাতার উপরে . . .
শিক্ষাবীদ, সাহিত্যিক, গবেষক ও প্রাচীন পুথির সংগ্রাহক, শ্রী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, সুরেশচন্দ্র
সমাজপতি সম্পাদিত “সাহিত্য” পত্রিকার পৌষ, ১৩২৫ সংখ্যায় (ডিসেম্বর ১৯১৮), তাঁর “সঙ্গীত শাস্ত্রের
একখানি প্রাচীন গ্রন্থ” প্রবন্ধে লিখেছেন . . .
“. . . বৈষ্ণব পদাবলীর মত সুন্দর জিনিস বঙ্গসাহিত্যে আর নাই। কাণের ভিতর দিয়া মরমে পশিয়া প্রাণ
আকুল করিয়া তুলিতে পারে, এমন সুধাস্রাবী ঝঙ্কার বৈষ্ণব পদাবলী ভিন্ন বাঙ্গালায় আর কিছুতে নাই।”
এই কবিদের পরিচয় নিয়ে ব্রজসুন্দর সান্যালের উদ্ধৃতি - পাতার উপরে . . .
ব্রজসুন্দর সান্যাল তাঁর “মুসলমান বৈষ্ণব কবি, ৩য় খণ্ড”-এর “জীবনী আলোচনা”-তে লিখেছেন . . .
“ . . . ‘মুসলমান বৈষ্ণব কবির’ বর্ত্তমান খণ্ডে সৈয়দ আলাওল, মীর্জা ফয়জুল্লা, মীর্জা কাঙ্গালী, সৈয়দ
আইনদ্দিন, নাছির মহম্মদ, সৈয়দ নাছিরদ্দিন, সেরচান্দ বা সেরবাজ, এবাদোল্লা, আবাল ফকির, মোছন আলী,
মহম্মদ হানিফ এবং আলিমদ্দিন,---এই দ্বাদশ জন কবির পদাবলী প্রকাশিত হইল। ইহাঁদের মধ্যে মহাকবি
আলাওলের বৃত্তান্ত পৃথকভাবে লিপিবদ্ধ হইল। অবশিষ্ট কবিগণের সম্বন্ধে আমাদের গবেষণার হুল কিছুমাত্র
প্রবেশ করিতে পারে নাই। প্রাচীন কবিগণ সাহিত্য-সংসারে একান্ত কুহেলিকাচ্ছন্ন। তাঁহাদের জীবনী
জানিবার অভিলাষ করা আর অন্ধকারে ঢিল ছোড়া প্রায় সমানই বটে!”
এই পাতার কবিতার ভণিতা - চাঁদকাজী
|
যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্যের উদ্ধৃতি - পাতার উপরে . . .
যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্য তাঁর সম্পাদিত “বাঙ্গালার বৈষ্ণব-ভাবাপন্ন মুসলমান কবি” সংকলনে এই কবি সম্বন্ধে
লিখেছেন . . .
“চাঁদকাজী - পরিচয় অজ্ঞাত। ইঁহার রচিত মাত্র একটি পদ পাওয়া গিয়াছে। কাহারও কাহারও মতে, যে
কাজী শ্রীচৈতন্যদেবের কীর্ত্তন নিবারণ করিয়াছিলেন, তাঁহার নাম ছিল চাঁদকাজী। কিন্তু ডাঃ দীনেশচন্দ্র সেন
মহাশয় ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁহার মতে কীর্ত্তন-নিবারক কাজীর নাম গোরাই কাজী।”