কবি রামমণী বা রামী জকিনীর বৈষ্ণব পদাবলী
*
কি কহিব বঁধু হে বলিতে না জুয়ায়
ভণিতা রামী
কবি রামী রজকিনী
এই পদটি ১৩০৩ (১৮৯৬) সালে প্রকাশিত, রমণীমোহন মল্লিক সম্পাদিত, চণ্ডীদাস  গ্রন্থের
জীবনী ও সমালোচনায় এই রূপে দেওয়া রয়েছে। তিনি পদটি পদসমুদ্র গ্রন্থ থেকে সংগ্রহ
করেছিলেন।

কি কহিব বঁধু হে বলিতে না জুয়ায়।
কাঁদিয়া কহিতে পোড়া মুখে হাসি পায়॥
অনামুখ মিন্ সে গুলার কিবা বুকের পাটা।
দেবী পূজা বন্দ করে কুলে দেয় বাটা॥
দুঃখের কথা কৈতে গেলে প্রাণ কাঁদি উঠে।
মুখ ফুটে না বলতে পারি মরি বুক ফেটে॥
ঢাক পিটিয়ে সহজবাদ গ্রামে গ্রামে দেয় হে ?
চক্ষে না দেখে মিছে কলঙ্ক রটায় হে ?
ঢাক ঢোলে যে জন সুজন নিন্দা করে।
ঝঞ্ঝনা পড়ুক তার মস্তক উপরে॥
অবিচার পুরী দেশে আর না রহিব।
যে দেশে পাষণ্ড নাই সে দেশে যাব॥
বাসুলী দেবীর যদি কৃপা দৃষ্টি হয়।
মিছে কথা সেঁচা জল কত ক্ষণ রয়॥
আপনার নাক কাটি পরে বলে বোঁচা।
সে ভয় করে না রামী নিজে আছে সাঁচা॥

ই পদটি ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে (১৯৩০খৃ) যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত রচিত বঙ্গের মহিলা কবি গ্রন্থের
৩-পৃষ্ঠায় প্রকাশিত। “পদসমুদ্র” পদসংকলনের পদ।

কি কহিব বঁধু হে বলিতে না জুয়ায়।
কাঁদিয়া কহিতে পোড়ামুখে হাসি পায়॥
অনুমুখ মিন্ সে গুলোয় কিবা বুকের পাটা।
দেবীপূজা বন্দ করে কুলে দেয় বাটা॥
দুঃখের কথা কইতে গেলে প্রাণ কেঁদে উঠে।
মুখ ফুটে না বলতে পারি মরি বুক ফেটে॥
ঢাক পিটিয়ে সহজবাদ গ্রামে গ্রামে দেয় হে ?
চক্ষে না দেখে মিছে কলঙ্ক রটায় হে ?
ঢাক ঢোলে যে সুজন নিন্দা করে।
ঝঞ্ঝনা পড়ুক তার মস্তক উপরে॥
অবিচার পুরী দেশে আর না রহিব।
যে দেশে পাষণ্ড নাই সে দেশে যাব॥
বাশুলী দেবীর যদি কৃপাদৃষ্টি হয়।
মিছে কথা সেঁচা জল কতক্ষণ রয়॥
আপনার নাক কাটি পরে বলে বোঁচা।
সে ভয় করে না রামী নিজে আছে সাঁচা॥

.           *************************    
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
কোথা যাও ওহে প্রাণ বঁধু মোর
ভণিতা রামী
কবি রামী
এই পদটি ১৩০৩ (১৮৯৬) সালে প্রকাশিত, রমণীমোহন মল্লিক সম্পাদিত, চণ্ডীদাস গ্রন্থের জীবনী ও
সমালোচনায় এই রূপে দেওয়া রয়েছে। তিনি পদটি পদসমুদ্র গ্রন্থ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন।

কোথা যাও ওহে,                        প্রাণবঁধু মোর,
দাসীরে উপেখা করি।
না দেখিয়া মুখ,                        ফাটে মোর বুক,
ধৈরজ ধরিতে নারি॥
বাল্যকাল হতে,                          এ দেহ সঁপিনু,
মনে আন নাহি জানি।
কি দোষ পাইয়া,                          মথুরা যাইবে,
বল হে সে কথা শুনি॥
তোমার এ সারথী,                        ক্রুর অতিশয়,
বোধ বিচার নাই।
বোধ থাকিলে,                          দুঃখ সিন্ধু নিরে,
অবলা ভাসাতে নাই॥
পিরীতি জ্বালিয়া,                        যদি বা যাইবা,
কবে বা আসিবে নাথ।
রামীর বচন,                                 করহ পালন,
দাসীরে করহ সাথ॥

ই পদটি ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে (১৯৩০খৃ) যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত রচিত বঙ্গের মহিলা কবি গ্রন্থের ৫-পৃষ্ঠায় প্রকাশিত
। “পদসমুদ্র” পদসংকলনের পদ।

কোথা যাও ওহে, প্রাণ বঁধু মোর, দাসীরে উপেক্ষা করি।
না দেখিয়া মুখ, ফাটে মোর বুক, ধৈরয ধরিতে নারি॥
বাল্যকাল হতে, এ দেহ সঁপিনু, মনে আন নাহি জানি।
কি দোষ পাইয়া, মথুরা যাইবে, বল হে সে কথা শুনি॥
তোমার এ সারথী, ক্রুর অতিশয়, বোধ বিচার নাই।
বোধ থাকলে, দুঃখ-সিন্ধু-নীরে, অবলা ভাসাইতে নাই॥
পিরীতি জ্বালিয়া, যদি বা যাইবা, কবে বা আসিবে নাথ।
রামীর বচন, করহ শ্রবণ, দাসীরে করহ সাথ॥

.           *************************    
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
তুমি দিবাভাগে লীলা অনুরারাগে
ভণিতা রামী
কবি রামী
এই পদটি ১৩০৩ (১৮৯৬) সালে প্রকাশিত, রমণীমোহন মল্লিক সম্পাদিত, চণ্ডীদাস গ্রন্থের জীবনী ও
সমালোচনায় এই রূপে দেওয়া রয়েছে। তিনি পদটি পদসমুদ্র গ্রন্থ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন।

তুমি দিবাভাগে,                        লীলা অনুরাগে
ভ্রম সদা বনে বনে।
তাহে তব মুখ,                        না দেখিয়া দুঃখ,
পাই বহু ক্ষণে ক্ষণে॥
ত্রুটী সমকাল,                           মানি সুজঞ্জাল,
যুগ তুল্য হয় জ্ঞান।
তোমার বিরহে,                           মনস্থির নহে,
ব্যাকুলিত হয় প্রাণ॥
কুটিল কুন্তল,                              কত সুনির্ম্মল,
শ্রীমুখ মণ্ডল শোভা।
হেরি হয় মনে,                              এ দুই নয়নে,
নিষেধ দিয়াছে কেবা॥
যাহে সর্ব্বক্ষণ,                                 তবদরশন,
নিবারণ সেহ করে।
ওহে প্রাণাধিক,                          কি কব অধিক,
দোষ দিয়ে বিধাতারে॥
তুমি সে আমার,                     আমি সো তোমার,
সুহৃৎ কে আছে আর।
খেদে রামী কয়,                            চণ্ডীদাস বিনা,
জগৎ দেখি আঁধার॥

ই পদটি ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে (১৯৩০খৃ) যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত রচিত বঙ্গের মহিলা কবি গ্রন্থের ৬-পৃষ্ঠায়
প্রকাশিত। “পদসমুদ্র” পদসংকলনের পদ।

তুমি দিবাভাগে, লীলা অনুরাগে, ভ্রম সদা বনে বনে।
তাহে তব মুখ, না দেখিয়া দুঃখ, পাই বহু ক্ষণে ক্ষণে॥
ত্রুটী সমকাল, মানি সুজঞ্জাল, যুগ তুল্য হয় জ্ঞান।
তোমার বিরহে, মন স্থির নহে, ব্যাকুলিত হয় প্রাণ॥
কুটিল কুন্তল, কত সুনির্ম্মল, শ্রীমুখ-মণ্ডল-শোভা।
হেরি হয় মনে, এ দুই নয়নে, নিষেধ দিয়াছে কেবা॥
যাহে সর্ব্বক্ষণ, হয় দরশন, নিবারণ সেহ করে।
ওহে প্রাণাধিক, কি কব অধিক, দোষ দিয়ে বিধাতারে॥
তুমি সে আমার, আমি সো তোমার, সুহৃৎ কে আছে আর।
খেদে রামী কয়, চণ্ডীদাস বিনা, জগৎ দেখি আঁধার॥

.           *************************    
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
কাঁহা গেয়ো বন্ধু চণ্ডীদাস
চণ্ডীদাসের মৃত্যু
ভণিতা রামী
কবি রামী
এই পদটি ১৮৯৬ সালে, স্বাধীন ত্রিপুরার মহারাজ বীরচন্দ্রমাণিক্য দেব-বর্ম্মণ বাহাদুরের
অর্থানুকুল্যে মুদ্রিত, দীনেশচন্দ্র সেনের “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য (ইংরেজ প্রভাবের পূর্ব্ব পর্য্যন্ত)”, ২১৭-পৃষ্ঠায়
এইরূপে দেওয়া রয়েছে। ২২০-পৃষ্ঠায় এই পদটির প্রাপ্তি সম্বন্ধে দীনেশচন্দ্র লিখেছেন, “একখানি পাতা।
উপকরণ---তুলোট কাগজ। আকার, ১৫ ১/৪ x ৫ ইঞ্চি। প্রতি পৃষ্ঠায় ১১ পংক্তি, অক্ষর প্রাচীন। সাহিত্য-
পরিষৎ পুস্তকাগারে রক্ষিত।”



কাঁহা গেয়ো বন্ধু চণ্ডীদাস।
চাতকি পিয়াসীগণ         
             না পাইআ বরিসণ
নআনের নাগরে নিয়াস॥
কি করিল রাজা গৌড়েশ্বর।
না জানিঞা প্রেম লেহ   
                ব্রেথাই ধরিস দেহ
বধ কৈলে প্রাণের দোসর॥
কেনে বা সভাতে কৈলে গান।
স্বর্গ মঞ্চ(১) পাতালপুর      
            আবির্ভূত পশু নর
মানিনীর না রহিল মান॥
গান শুনি পার্চ্ছার(২) বেগম
রাজারে কহে জানিঞা মরম॥
রাণি মনঃ কথা রাখিতে নারিল।
চণ্ডিদাস সমে প্রিত        
              করিতে হইল চিত
তার প্রিতে আপন খুয়াল্যা॥
রাজা কহে মন্ত্রিরে ডাকিয়া।
তরার্ণিত হস্থি আনি             পিষ্ঠে পেলি(৩) বান্ধ টানি
পিষ্ঠ খুদে বৈরী ছাড় গিয়া।(৪)
আমি অনাথিনী নারী     
              মাধবির ডালে ধরি
উর্চ্চস্বরে ডাকি প্রাণনাথ।
হস্তি চলে অতি জোরে
        ভালস্তে(৫) না দেখি তোরে
মাথা এ পড়িল বজ্রাঘাত।
রাণি কহে ছাড়িয়া না যায়(৬)।
কহিতে কহিতে প্রাণ       
             আর দেহ সমাধান
দুঁহু প্রাণ একত্রে মিলায়॥ ১॥
সুন প্রিয় রজকিনি       
           আসকে হারালঙ প্রাণী
এবার তরাবে তুমি মোরে।
বেগম সহিত লেহ    
                  হা নাথ খুয়ালে দেহ
প্রাণে মাল্য(৭) এ রাজা গুঁয়ারে(৮)।
আসকে লভিত প্রাণ     
                তখনি করিলে গান
কেমনে জানিব হেন হবে।
বৈরি শত ডংসে(৯) গায়  
              চেতন পাইএ তায়
তোমারে ডাকিএ আত্মাভাবে।
এই করি আস মনে      
         উর্ধ্বারিবে পতিত জনে
তবে সে দুর্ল্লভ মানি প্রীত।
নতুবা ফুরাল্য দায়       
          বৈরী চোটে প্রাণ জায়
কে য়ার করিবে মোর হীত।
কান্দি কহে চণ্ডিদাস        
               দশ দসার আস
পুনু কর রজক কুমারি।
নহিলে একলা জাই          
          সঙ্গে মোর কেহ নাই
কাছে য়াস্য তবে প্রাণে মরি॥ ২॥

সুন বন্ধু চণ্ডীদাস দুখিনিরে সঙ্গে করি লেহ॥ ধ্রু॥
চঞ্চল স্বভাব তোর চিত
সভাতে গাইলে গীত
মনের মরম করি সার।
অনুরাগে কি না করিলে ফুত্কার।
পাতি হাট বসাত্যে না দিলে।
আসক আনলে পড়াইলে॥
বৈরি কাটে তোমার গায়।
তুমি সে আনন্দ বাস তায়॥
মোর অঙ্গ সব ক্ষেতি হৈল।
রুধিরে বসন ভিজ্যা গেল॥
পরসিত এ জনার মন।
কতেক করাছ কদর্থন(১০)॥
রামি কহে যদি সঙ্গে নিবে
তুরিতে পরাণ তেজ তবে॥ ৩॥

সুন প্রাণনাথ চণ্ডদাস তার নির্ব্বন্ধন।
দৈবের কর্ম্মফাঁস না যায় খণ্ডন॥
ছাড়ি পরিবার     
               মোর সঙ্গ কর
সভারে কহিলে সত্য।
বাসুলি বচন     
               না কৈলে সঙরণ
তাহাতে মজাল্যে চিত্ত॥
আমা মুখ চাঞা       
          গজপিষ্টে সুঞ্যা
রয়্যাছ বন্ধন পাকে।
রাজা গৌড়েশ্বর     
               দুষ্ট কলেবর
কেহনা বুঝাল তাকে॥
নাথ আমি সে রজকবালা।
আমার বচন       
             না সুনে রাজন
বুঝিল কৃষ্ণের লীলা॥
সুদ্ধ কলেবর       
               হইল জর্জ্জর
দারুণ সঞ্জান ঘাতে।
এ দুঙ্ঘ দেখিয়া   
                বিদরএ হিয়া
অভাগিরে লেহ সাথে॥
কহেন রামিনী    
                  সুন গুণমণি
জানিলাঙ তোমার রীতি।
বাশুলি বচন     
               করিলে লংঘন
সুনহ রসিক পতি॥ ৪॥

পার্চ্ছার বেগম কয়।
সুন মহিনাথ মহাশয়॥
তুমি অবলা বচন রাখ।
রসিক মণ্ডল দেখ॥
আমি সে অবলা নারি।
তোমারে কহিএ বিনয় করি॥
যোড় করে কহে রামি।
সুন নৃপ চূড়ামণি।
সুন রসের স্বরূপ সে
কেন বিনাস করহ তাহার দে।
সে সামান্য মানুষ নহে।
রতি স্থিতি তার দেহে।
জাহার সুস্বর গানে।
বিন্ধিল আমার প্রাণে॥
ভূবনে রাখিলে লাজ
রাজা হে যবন জাতি।
কি জানে রসের গতি।
চণ্ডিদাস করি ধ্যান।
বেগম তেজিল প্রাণ।
সুনি শ্রস্তা(১১) ধবিনি(১২) ধায়
পড়িল বেগম পায়॥ ৫॥

১। মঞ্চ = মর্ত্ত্য, ২। পার্চ্ছার = পাত্সাহের, ৩। পেলি = ফেলি,
৪। পিষ্ঠ খুদে বৈরী ছাড় গিয়া = পৃষ্টদেশ বিদীর্ণ করিয়া শত্রুকে বধ কর,
৫। ভালস্তে = ভাল করিয়া, ৬। জায় = যেও, ৭। মাল্য = মরিল, ৮। গুঁয়ারে = নিষ্ঠুর,
৯। ডংসে = দংশে, ১০। কদর্থন = কষ্ট, ১১। শ্রস্তা = ত্রস্তভাবে, ১২। ধবিনি = ধুবসী, রজক কন্যা।

.     *************************    
.                                                                                              
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর