এ-পারের এই বুনো ঝাউ আর ও পারের বুড়ো বট মাঝখানে তার আগাছায় ভরা শুকনো গাঙের তট ; এরি উঁচু পারে নিত্য বিহানে লাঙল দিয়েছে চাষী, কুমীরেরা সেথা পোহাইছে রোদ শুয়ে শুয়ে পাশাপাশি | কূলে কূলে চলে খরমূলা মাছ, দাঁড়িকানা পালে পালে ছোঁ দিয়ে তার একটারে ধরি' গাঙ চিল বসে ডালে ঠোঁটে চেপে ধরি' আছাড়ি আছাড়ি নিস্তেজ করি তায় মুড়ো পেটি লেজ ছিঁড়ি একে একে গিলিয়া গিলিয়া খায় | এরি কিছু দূরে একপাল গোরু বিচরিছে হেথা সেথা শিঙে মাটি মাখা দড়ি ছিঁড়ি ষাঁড় চলে সে স্বাধীনচেতা | মাথা নিচু করি কেহ বা ঝিমায় কেহ বা খেতেছে ঘাস, শুয়ে শুয়ে কেহ জাবর কাটিয়া ছাড়িতেছে নিঃশ্বাস ; গোচর পাখিরা ইহাদের গায়ে নির্ভয়ে চলে ফেরে উকুন আঠালু ঠোকরিয়া খায় লেজের পালক নেড়ে ; বক পাখিগুলো গোচরকীয়ার হয়েছে অংশীদার শালিক কেবলই করিছে ঝগড়া কাজ কিছু নাই তার | নতুন চরের পলি জমিটাতে কলাই বুনেছে যারা আখের খামারে দিতেছে তারাই রাতভর পাহারা ; খেতে কোণায় বাঁশ পুঁতে পুঁতে শূণ্যে বেঁধেছে ঘর বিচালী বিছায়ে রচেছে শয্যা বাঁশের বাখারি 'পর | এমন শীতেও মাঝ মাঠে তারা থড়ের মশাল জ্বালি ঠকঠকি নেড়ে করিছে শব্দ হাতে বাজাইছে তালি | ওপার হইতে পদ্মা সাঁতারি বন্য বরাহ পাল এ-পারে আসিয়া আখ খায় রোজ ভেঙে করে পয়মাল | তাই বেচারিরা দারুণ শীতেও এসেছে নতুন চরে টোঙে বসি বসি জাগিতেছে রাত পাহারা দেবার তরে ; কুয়াশা যেন কে বুলায়ে দিয়েছে মশারির মত করি মাঠের ওপারে ডাকিতেছে "ফেউ" কাঁপাইয়া বিভাবরী | ঘুমেল শিশুরা এই ডাক শুনি জড়ায়ে ধরিছে মায়, কৃষাণ যুবতী ঝাপটি তাহারে মনে মনে ভয় পায় ; "ফেউ" নাকি চলে বাঘের পেছনে গাঁয়ের লোকেরা বলে টোঙের মানুষ ভাবিতেছে ঘর, ঘর ভেজে আঁখি জলে |
এই চরে ওই হালটার কোণে বিঘে দুই ক্ষেত ভরি বট ও পাকুড়ে দোঁহে ঘিরে ঘিরে করি আছে জড়াজড়ি | গাঁয়ের লোকেরা নতুন কাপড় তেল ও সিঁদুর দিয়া ঢাক ঢোল পিটি গাছ দুইটির দিয়ে গেছে নাকি বায়া | নতুন চালুনি ভেঙে গেছে তার, মুছি আর কড়িগুলা রাখাল ছেলেরা নিয়ে গেছে সব ভরি গামছায় ঝুলা | চড়কের মেলা এই গাছতলে হয় বছরের শেষে সে দিন যেন গো সারা চরখানি উত্সবে ওঠে হেসে | বটের পাতায় নৌকা গড়িয়া ছেড়ে দেয় জলে কেউ, এই চর হতে ওই গাঁ'র পানে নিয়ে যায় তারে ঢেউ | ছোট ছেলেপুলে বাঁশি কিনে কিনে বেদম বাজায়ে চলে, বুড়োদের হাতে ঠোঙায় খাবার, কাশে আর কথা বলে | ছেঁড়া কলাপাতা টুকড়ো বাতাসা চারিদিকে পড়ে রয় পরদিনে তার রাখাল ছেলেরা সবে মিলে ঘুঁটে লয় ; উত্সব শেষে খাঁ খাঁ করে হায় শূণ্য বালির চর--- এ পারের পানে চাহিয়া ও পার কাঁদে শুধু রাত ভর |
ঝড়ের সাথে এলায়ে কেশ . এসেছ বিরহিনী তোমারে দেখে জেগেছে মনে . চিনি গো যেন চিনি ; বরষা রাতে চোখের জলে . হেসেছ' পলাতকা চখিরে দেখে যেমন করি . হেসেছে ভীরু চখা | . পেয়েছি তোমা জীবন ভরে . নানান রূপে পলক তরে কখনো হারি খেলার ছলে . কখনো যেন জিনি |
. খোকার বাড়ি কমলডাঙার গাঁয় শালিক ঘুঘু ডাকে সেথায় সবুজ পাতার ছায়। সেইখানেতে ফোটে শালুক চলনবিলের জলে পানকৌড়ি ডুব ভাঙিয়া সাঁতার দিয়া চলে, সেই বিলেতে দাম বেঁধেছে কলমীকাজল লতা সেথায় বসে ডাহুক বক জানায় মনের কথা। পাল তুলিয়া ওই গাঁ পানে নৌকা ভেসে যায় মাঝিরা সব বৈঠা ফেলে সারির গান গায়। সে গান শুনি খোকনমণি রইতে নারে ঘরে বেরিয়ে আসে আগড় খুলি চলনবিলের চরে। চেয়ে থাকে চোখ তুলে সে দূরের সীমানায় যখন বড়ো হবে খোকন যাবে সে ওই গাঁয়। খোকন যাবে বাণিজ্যেতে দশখান যাবে না’ লোকজন যে কত যাবে নাই তার ঠিকানা। নিদ্রাবতী কন্যা আছে কোন বা অচিন দেশে নৌকা নিয়ে ঘুরে ফিরে সেথায় যাবে শেষে। সোনার কাঠি ছুঁইয়ে তার ভাঙিয়ে দেবে ঘুম তাহারে নিয়ে ঘরেতে আসি লাগিয়ে দেবে ধুম।
. খোকন থাকে কমলডাঙার গাঁয় ফুলের বনে প্রজাপতির সাথে সে বেড়ায়। তালিপাতার আবডালেতে চাঁদ যে ওঠে রাতে বাঁশের বনের দীঘল ছায়া পড়ে আঙিনাতে। জোনাকিরা হীরার মতো জ্বলে কেবল জ্বলে ঘুমপরীরা দল বাঁধিয়া নাচে গাছের তলে। খোকার গায়ে কাতুকুতু দেয় সে স্বপনবুড়ি ঘুমের ঘোরে হাসে সে তাই আঙুলে দেয় তুড়ি। পঙ্খীরাজে চড়ে খোকন মায়ার দেশে যায় পিছন হতে দত্যিদানা ধরতে পিছু ধায়। বার সিপাহী খোকন দাঁড়ায় খুলে তরোয়াল বাঁ হাতে তার ঝল্ কে ওঠে মকরমুখী ঢাল। সড়কি হাতে বাগিয়ে ধরে খোকন যায় তেড়ে পালিয়ে বাঁচে দৈত্যরা সব---পালায় দেশ ছেড়ে। ঘোড়ায় চড়ে হাওয়ার বেগে এগিয়ে আরো যায় সোনার গাছে মাণিক ফলে দেখতে সে দেশ পায়। হীরার ফল জ্বলে সেথায় মুক্তা পাহাড় ঘিরে কোঁচড় ভরে নিয়ে খোকা আসবে দেশে ফিরে। মা দেখে খুব হবেন খুশি---চুমো খাবেন মুখে গর্ব ভরে খোকন বসে হাসবে মনের সুখে।