এত, তবু তোমার আরম্ভ মাত্র | হেমন্তের যেন অন্ত নেই | গন্ধ, রস, স্নিগ্ধতা জড়িয়ে থাকে এমনকি উন্মুখ নিচোলে | তৃপ্তির পরেও দেখি আরও বাকি, এবং ফুরালে থামে না পুলক, পুষ্টি, উপকার | কিন্তু শুধু এই ?
তা-ই ভেবে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে | কিন্তু মাঝে মাঝে আসে ভারি-চোখের দু-এক জন কামাতুর, যারা থালা, ডালা, কাননের ছদ্মবেশ সব ভাঁজে-ভাঁজে
ছাঁড়ে ফেলে, নিজেরা তোমার মধ্যে অদ্ভুত আলোতে হ'য়ে ওঠে আকাশ, অরণ্য আর আকাশের তারা -- যা দেখে, হঠাত্ কেঁপে, আমাদেরও ইচ্ছে করে অন্য কিছু হ'তে
বিদ্যাসুন্দর কবি বুদ্ধদেব বসু এই ছড়াটি নেওয়া হয়েছে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও কবি এখলাসউদ্দিন আহ্ মদ সম্পাদিত "দুই বাংলার ছড়া" (১৯৯৩) সংকলন থেকে। এই ছড়াটিই কবি শ্যামলকান্তি দাশ সম্পাদিত “ছোটোদের আবৃত্তির ছড়া ও কবিতা” (২০০৮) সংকলনে প্রকাশিত হয় "সরস্বতী পুজোর পদ্য" নামে।
বলতে পারো, সরস্বতীর মস্ত কেন সম্মান ? বিদ্যে যদি বলো, তবে গণেশ কেন কম যান ? সরস্বতী কি করেছেন ? মহাভারত লেখেন নি। ভাব দেখে তো হচ্ছে মনে, তর্ক করাও শেখেন নি। তিন ভুবনে গণেশদাদার নেই জুড়ি পাণ্ডিত্যে অথচ তার বোনের দিকেই ভক্তি কেন চিত্তে ? সমস্ত রাত ভেবে ভেবে এই পেয়েছি উত্তর--- বিদ্যা যাকে বলি, তারই আর একটি নাম সুন্দর।
শুধু নয় সুন্দর অপ্সর-যৌবন কম্পিত অধরের চম্পক-চুম্বন। . শুধু নয় কঙ্কনে ক্ষণে ক্ষণে ঝংকার . আভরণ হীনতার, আবরণ ক্ষীণতার। . শুধু নয় তনিমার তন্ময় বন্ধন। . ---কিছু তার দ্বন্দ্ব, কিছু তার ছন্দ।
পুষ্পের নিঃশ্বাস, রেশমের শিহরণ, রক্তের রক্তিমা, কনকের নিক্কণ। . গন্ধের বাণী নিয়ে পরশের সুরকার . অঙ্গের অঙ্গণে আনলো যে-উপহার--- . সে-তো শুধু বর্ণের নহে গীত-গুঞ্জন। . ---কিছু তার স্বর্ণ, কিছু তার স্বপ্ন।
বিলসিত বলয়ের মত্ত আবর্তণ, মূর্ছিত রজনীর বিদ্যুৎ-নর্তন। . বিহ্বল বসনের চঞ্চল বীণাতার . উদ্বেল উল্লাসে আঁধারের ভাঙে দ্বার--- . সে কি শুধু উদ্দাম, উন্মাদ মন্থন। . ---কিছু তার সজ্জা, কিছু তার লজ্জা।
শুধু নয় দু’জনের হৃদয়ের রঞ্জন, নয়নের মন্ত্রণা, স্মরণের অঞ্জন। . রঙ্গিণী করবীর গরবিনী কবিতার . জাদুকর-তির্যক ইঙ্গিত আনে যার, . সে কি শুধু দেহতটে তরঙ্গ-তর্পণ। . ---কিছু তার দৃশ্য, কিছু বা রহস্য।
এসো শুভ লগ্নের উন্মীল সমীরণ করো সেই মন্ত্রের মগ্নতা বিকীরণ, . যার দান বিরহের অনিমেষ অভিসার, . মিলনের ক্ষণিকার কণ্ঠের মণিহার ;--- . সেথা বিজ্ঞানিকের বৃথা অণুবীক্ষণ। . ---কিছু তার জৈব, কিছু তার দৈব।
শীতরাত্রির প্রার্থনা কবি বুদ্ধদেব বসু বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতা ( ১৯৪০ ) থেকে নেওয়া |
এসো, ভুলে যাও তোমার সব ভাবনা, তোমার টাকার ভাবনা, স্বাস্থের ভাবনা, . এর পর কী হবে, এর পর, ফেলে দাও ভবিষ্যতের ভয়, আর অতীতের জন্য মনস্তাপ | আজ পৃথিবী মুছে গেছে, তোমার সব অভ্যস্থ নির্ভর ভাঙলো একে-একে ;---রইলো হিম নিঃসঙ্গতা, আর অন্ধকার নিস্তাপ . রাত্রি ; --- এসো, প্রস্তুত হও |
বাইরে বরফের রাত্রি | ডাইনি-হাওয়ার কনকনে চাবুক গালের মাংস ছিড়ে নেয়, চাঁদটাকে কাগজের মতো টুকরো ক’রে ছিটিয়ে দেয় কুয়াশার মধ্যে, উপড়ে আনে আকাশ, হিংসুক হাত ছড়িয়ে দেয় হিম ; শাদা, নরম, নাচের মতো অক্ষরে . পৃথিবীতে মৃত্যুর ছবি এঁকে যায় |
তাহলে ডুবলো তোমার পৃথিবী, হারিয়ে গেলো চিরদিনের অভিজ্ঞান ; ফুল নেই, পাখি ডাকে না, নাম ধ’রে ভরা গলায় ডাকে না কেউ ; অচেনা দেশ, অস্থায়ী ঘর, শূন্য ঘরে নিঃসম্বল প্রাণ, আর বাইরে উত্তরের শীত, অন্ধকার, মেরু-হাওয়ায় ঢেউয়ের পর ঢেউ | . এই তো সময় ; ---সংহত হও |
সংহত হও, নিবিড় হও ; অতীত এখনো ফুরিয়ে যায়নি ভুলো না, যে-অতীত অপেক্ষা করে আছে তোমার জন্য, তারই নাম ভবিষ্যৎ ; যাবে, হবে, ফিরে পাবে | মুহূর্তের পর মুহূর্তের ছলনা কেবল চার বেঁধে রাখতে, লুকিয়ে রাখতে | কিন্তু তোমার পথ . চলে গেছে অনেক দূরে, দিগন্তে |
সেই প্রথম দিনে কে হাত রেখেছিলো তোমার হাতে, আজও তো . মনে পড়ে তোমার, যাতে মনে পড়ে, ভুলতে না পারো, তাই অনেক ভুলতে হবে তোমাকে, যাতে পথ চলতে ভয় না পাও, ফেলে দিতে হবে অনেক জঞ্জাল, . সাবধানের ভার, হ’তে হবে রিক্ত, হারাতে হবে যা-কিছু তোমার চেনা, যাতে পথের বাঁকে বাঁকে . পুরোনোকে চিনতেপারো, নতুন ক’রে |
এসো, আস্তে পা ফ্যালো, সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসো তোমার শূন্য ঘরে ;-- তুমি ভ’রে তুলবে, তাই শূন্যতা | তুমি আনবে উষ্ণতা, তাই শীত | এসো, ভুলে যাও তোমার টাকার ভাবনা, বাঁচার ভাবনা, হাজার ভাবনা--- . আর এর পরে তোমার দিকে এগিয়ে আসবে ভবিষ্যৎ, পিছন থেকে ধ’রে ফেলবে অতীত | . এসো, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও আজ রাত্রে |
তা-ই চাও তুমি, তারই জন্য তোমার বুভুক্ষা, এই মৃত্যুর হাতেই মুহূর্তের পর মুহূর্তের ছলনা হবে ছিন্ন ; যেমন তোমার চোখের সামনে পৃথিবী মরে গেলো আজ ---ফুল নেই, সব সবুজ নিবে গেছে, চারদিকে শুধু কঠিন শাদা স্তব্ধতার চিহ্ন--- . তেমনি তোমাকে ডুবতে হবে, তোমাকেও |
ডুবতে হবে মৃত্যুর তিমিরে, নয়তো কেমন ক’রে ফিরে আসবে আলোয় ? লুপ্ত হ’তে হবে পাতালে, নয়তো কেমন ক’রে ফিরে আসবে আলোয় ? তুমি কি জানো না, বার-বার মরতে হয় মানুষকে, বার-বার, দুলতে হয় মৃত্যু আর নবজন্মের বিরামহীন দোলায় . সত্যি যদি বাঁচতে হয় তাকে |
ডুবতে হবে মৃত্যুর তিমিরে, নয়তো কেমন ক’রে ফিরে আসবে আলোয় ? লুপ্ত হ’তে হবে পাতালে, নয়তো কেমন ক’রে ফিরে আসবে আলোয় ? তুমি কি জানো না, বার-বার মরতে হয় মানুষকে, বার-বার, দুলতে হয় মৃত্যু আর নবজন্মের বিরামহীন দোলায় . সত্যি যদি বাঁচতে হয় তাকে |
অন্ধকারকেই মৃত্যু নাম দিয়েছি আমরা | বীজ ম’রে যায়, যখন অদৃশ্য হয় মাটির তলায় সংগোপন গূঢ় গহ্বরে ; শীত এলে ম’রে যায় পৃথিবী, ঝ’রে যায় পাতা, নেয় বিদায় ঘাস, ফুল, ঘাস-ফড়িং ; নেকড়ে আসে বেরিয়ে ; কালো, কালো . নিষ্ঠুর কবরে . হারিয়ে যায় প্রাণ---ধবধবে তুষারের তলায় |
তেমনি তুমি ; --- তোমারও রোদ মরে গেলো, ঘন হয়ে ঘিরলো কুয়াশা, তোমার আলোর পৃথিবী ছেড়ে তুমি নেমে এলে পাতালে, তোমার রঙিন সাজ ছিঁড়ে গেলো, মুছে গেলো নাম, ভুলে গেলে . তোমার ভাষা, যত চোখ তোমাকে চিনেছিলো একদিন, সেই সব উত্সবের মতো . চোখের আড়ালে . তুমি মিলিয়ে গেলে --- অন্ধকার থেকে অন্ধকারে |
কিন্তু মাটির বুক চিরে লুপ্ত বীজ ফিরে আসে একদিন, আবার দেখা দেয়, অন্য নামে, নতুন জন্মে, রাশি রাশি ফসলের ঐশ্বর্যে ; আর এই শীত --- তুমি তো জানো প্রত্যেক ফোঁটা বরফের সঙ্গে . তারও শুধু জ’মে উঠছে ঋণ, সব শোধ ক’রে দিতে হবে ; প্রচ্ছন্ন প্রাণ অবিচল ধৈর্যে . জেগে আছে দীর্ঘ, দীর্ঘ রাত্রি |
শুধু জেগে আছে তাই নয়, কাজ ক’রে যাচ্ছে গোপনে-গোপনে, সৃষ্টি ক’রে যাচ্ছে মৃত্যুর বুকে নতুন জন্ম, কবর ফেটে অবুঝ অদ্ভুত উৎসারণ, পাথর ভেঙে স্রোত, বরফের নিথর আস্তরণে স্পন্দন – যখন ঘোমটা ছিঁড়ে উঁকি দেবে ক্ষীণ, প্রবল, উজ্জ্বল, আশ্চর্য সবুজ . বসন্তের প্রথম চুম্বনে |
আর তাই এই মৃত্যু তোমার প্রতীক্ষা --- তোমাকে তার যোগ্য হ’তে হবে, ভুলতে হবে সাবধানের দীনতা, হাজার ভাবনার জঞ্জাল ; সন্দেহ কোরো না, প্রতিবাদ কোরো না ; নিহিত হও এই কঠিন হিম ধবধবে আস্তরণের অন্তঃপুরে, বীজের মতো--- যেখানে অপেক্ষা ক’রে আছে . তোমার চিরকাল | . উৎসর্জন করো, সমর্পণ করো নিজেকে |
নিবিড় হ’লো রাত্রি, পাত্লা চাঁদ ছিঁড়ে গেলো, নেকড়ের মতো অন্ধকার, দলে-দলে ডাইনি বেরোলো হাওয়ায়., আততায়ীর ছুরির মতো শীত | এরই মধ্যে তোমার যজ্ঞ ; উত্সর্গ হবে প্রাণ, আগুন জ্বালবে আত্মার, ভস্ম হবে যাকে ভেবেছো তোমার ভবিষ্যৎ, আর যাকে জেনেছো তোমার অতীত | . পবিত্র হও, প্রতীক্ষা করো |
ঐ শোনো, ঘন্টা বাজে গির্জেতে ; এদের উৎসবের ক্ষণ আসন্ন | ঈশ্বরের একজাত, একমাত্র পুত্রের জন্মের স্মরণে ;--- কিন্তু তুমি---- তোমার শরীর ভিন্ন মাটিতে তৈরি, অন্য গান বাজে তোমার রক্তে, অন্য এক আশ্বাসের উচ্চারণে . ধ্বনিত তোমার ইতিহাসের আকাশ |
তুমি জেনেছো, মানুষমাত্রেই অমৃতের পুত্র--- শুধু একজন নয়, প্রত্যেকে, তুমি বলেছো, অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যাও, মৃত্যু থেকে অমৃতে, তুমি শুনেছো, জন্মের পর জন্মান্তর আবর্তের মতো এঁকে বেঁকে অমৃতের দিকে নিয়ে যায় ; --- আর এই জীবন, সেও তার সময়ের . সীমায়, মাংসের গণ্ডিতে . বন্দী হ’য়ে থাকবে না |
তাই তো জানো তুমি--- বার বার মরতে হয় মানুষকে, নতুন ক’রে . জন্ম নেবার জন্য শুধু জন্ম-জন্মান্তর নয়, একই জন্মে তার এই মৃত্যু আর পুনরুথ্বান, শুধু একজনের নয়, সকল মানুষের ---হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার অরণ্য লুকিয়ে রেখেছে চিরকাল এই বুভুক্ষা---- তারই জন্য সব কান্না, . সব কান্না-ভরা গান, . বুকে বুক রেখে তৃপ্তিহীন প্রেমিক |
তৃপ্তিহীন বিরহে তুমি জ্বলছো--- জ্বলতে দাও, পুড়ে যাক যা-কিছু . তোমার পুরোনো, ডিমের খোলশের মতো ফেটে যাক তোমার পৃথিবী, বেরিয়ে আসুক . অন্য এক জগৎ এই পাতাল বেয়ে নেমে যাও আরো, আরো অন্ধকারে ; যখন সব . হারাবে, কোনো চিহ্ন আর থাকবে না, তখনই তোমাকে ধ’রে ফেলবে অতীত, এগিয়ে আসবে . তোমার দিকে ভবিষ্যৎ--- . সব নতুন ---- নতুন হ’য়ে |
সময় হ’লো, বাইরে অনাকার অন্ধকার, প্রেতের চীত্কারের মতো হাওয়া ; অচেনা দেশ, অস্থায়ী ঘর, শূন্য ঘরে নিঃসম্বল প্রাণ ; আজ আর কিছু নেই তোমার--- শুধু একফোঁটা রক্তে-লীন সংগোপন . ঝাপসা পথ-চাওয়া এই ব্যাপ্ত কুয়াশার মধ্যে ক্ষীণ, ক্ষণিক, লুকিয়ে-থাকা তারার মতো . কম্পমান | . প্রস্তুত হও, প্রতীক্ষা করো তোমার মৃত্যুর জন্য |
যে- মৃত্যুকে ভেদ করে লুপ্ত বীজ ফিরে আসে নির্ভুল, রাশি-রাশি শস্যের উত্সাহে, ফসলের আশ্চর্য সফলতায়, যে-মৃত্যুকে দীর্ণ ক’রে বরফের কবর ফেটে ফুল জ্ব’লে ওঠে সবুজের উল্লাসে, বসন্তের অমর ক্ষমতায়--- . সেই মৃত্যুর--- নবজন্মের প্রতীক্ষা করো |
মৃত্যুর নাম অন্ধকার ; কিন্তু মাতৃগর্ভ --- তাও অন্ধকার, ভুলো না তাই কাল অবগুন্ঠিত, যা হ’য়ে উঠছে তা-ই প্রচ্ছন্ন ; এসো, শান্ত হও ; এই হিম রাত্রে, যখন বাইরে-ভেতরে কোথাও . আলো নেই, তোমার শূন্যতার অজ্ঞাত গহ্বর থেকে নবজন্মের জন্য . প্রার্থনা করো, প্রতীক্ষা করো, প্রস্তুত হও |