বুদ্ধদেব বসুর কবিতা
*
রুপান্তর
বুদ্ধদেব বসু

দিন মোর কর্মের প্রহারে পাংশু,
রাত্রি মোর জ্বলন্ত জাগ্রত স্বপ্নে |
ধাতুর সংঘর্ষে জাগো, হে সুন্দর, শুভ্র অগ্নিশিখা,
বস্তুপুঞ্জ বায়ু হোক, চাঁদ হোক নারী,
    মৃত্তিকার ফুল হোক আকাশের তারা |
জাগো, হে পবিত্র পদ্ম, জাগো তুমি প্রাণের মৃণালে,
চিরন্তনে মুক্তি দাও ক্ষণিকার অম্লান ক্ষমায়,
    ক্ষণিকেরে কর চিরন্তন |
দেহ হোক মন, মন হোক প্রাণ, প্রাণে হোক মৃত্যুর সঙ্গম,
মৃত্যু হোক দেহ প্রাণ, মন |

.                 *************                
.                                                                         
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
দায়িত্বের ভার
কবি বুদ্ধদেব বসু

কিছুই সহজ নয়, কিছুই সহজ নয় আর |
লেখা, পড়া, প্রুফ পড়া, চিঠি লেখা, কথোপকথন,
যা-কিছু ভুলিয়ে রাখে, আপাতত, প্রত্যহের ভার --
সব যেন, বৃহদরণ্যের মতো তর্কপরায়ণ
হ'য়ে আছে বিকল্পকুটিল এক চতুর পাহাড় |
সেই যুদ্ধে বার-বার হেরে গিয়ে, ম'রে গিয়ে, মন
যখন বলছে ; শুধু দেহ নিয়ে বেঁচে থাকা তার
সবচেয়ে নির্বাচিত, প্রার্থনীয়, কেননা তা ছাড়া আর
কিছু নেই শান্ত, স্নিগ্ধ, অবিচল প্রীতিপরায়ণ --
আমি তাকে তখন বিশ্বস্ত ভেবে, কোনো-এক দীপ্ত প্রেমিকার
আলিঙ্গনে সত্তার সারাত্সার ক'রে সমর্পন --
দেখেছি দাঁড়িয়ে দূরে, যদিও সে উদার উদ্ধার
লুপ্ত ক'রে দিলো ভাবা, লেখা, পড়া, কথোপকথন,
তবু প্রেম, প্রেমিকেরে ঈর্ষা ক'রে, নিয়ে এলো ক্রূর বরপণ --
দুরহ, নূতনতর, ক্ষমাহীন দায়িত্বের ভার |
কিছুই সহজ নয়, কিছুই সহজ নয় আর |

.                 *************                
.                                                                                  
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
স্টিল্ লাইফ

সোনালি আপেল, তুমি কেন আছ ? চুমো খাওয়া হাসির কৌটোয়
দাঁতের আভায় জ্বলা লাল ঠোঁটে বাতাস রাঙাবে ?
ঠাণ্ডা, আঁটো, কঠিন কোনারকের বৈকুণ্ঠ জাগাবে
অপ্সরীর স্তনে ভরা অন্ধকার হাতের মুঠোয় ?

এত, তবু তোমার আরম্ভ মাত্র | হেমন্তের যেন অন্ত নেই |
গন্ধ, রস, স্নিগ্ধতা জড়িয়ে থাকে এমনকি উন্মুখ নিচোলে |
তৃপ্তির পরেও দেখি আরও বাকি, এবং ফুরালে
থামে না পুলক, পুষ্টি, উপকার | কিন্তু শুধু এই ?

তা-ই ভেবে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে | কিন্তু মাঝে মাঝে
আসে ভারি-চোখের দু-এক জন কামাতুর, যারা
থালা, ডালা, কাননের ছদ্মবেশ সব ভাঁজে-ভাঁজে

ছাঁড়ে ফেলে, নিজেরা তোমার মধ্যে অদ্ভুত আলোতে
হ'য়ে ওঠে আকাশ, অরণ্য আর আকাশের তারা --
যা দেখে, হঠাত্ কেঁপে, আমাদেরও ইচ্ছে করে অন্য কিছু হ'তে

.                 *************                
.                                                                                    
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর        
*
কোনো মৃতার প্রতি

'ভুলিবো না' - এত বড় স্পর্ধিত শপথে
জীবন করে না ক্ষমা | তাই মিথ্যা অঙ্গিকার থাক |
তোমার চরম মুক্তি, হে ক্ষণিকা, অকল্পিত পথে
ব্যপ্ত হোক | তোমার মুখশ্রী-মায়া মিলাক, মিলাক
তৃণে-পত্রে, ঋতুরঙ্গে, জলে-স্থলে, আকাশের নীলে |
শুধু এই কথাটুকু হৃদয়ের নিভৃত আলোতে
জ্বেলে রাখি এই রাত্রে -- তুমি ছিলে, তবু তুমি ছিলে |

.                 *************                
.                                                                                    
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
প্রত্যহের ভার

যে-বাণীবিহঙ্গে আমি আনন্দে করেছি অভ্যর্থনা
ছন্দের সুন্দর নীড়ে বার-বার, কখনো ব্যর্থ না
হোক তার বেগচ্যুত, পক্ষমুক্ত বায়ুর কম্পন
জীবনের জটীল গ্রন্থিল বৃক্ষে ; যে-ছন্দোবন্ধন
দিয়েছি ভাষারে, তার অন্তত আভাস যেন থাকে
বত্সরের আবর্তনে, অদৃষ্টের ক্রূর বাঁকে-বাঁকে,
কুটিল ক্রান্তিতে ; যদি ক্লান্তি আসে, যদি শান্তি যায়,
যদি হৃত্পিণ্ড শুধু হতাশার ডম্বরু বাজায়,
রক্ত শোনে মৃত্যুর মৃদঙ্গ শুধু ;--- তবুও মনের
চরম চুড়ায় থাক সে-অমর্ত্য অতিথি-ক্ষণের
চিহ্ন, যে-মূহূর্তে বাণীর আত্মারে জেনেছি আপন
সত্তা ব'লে, স্তব্ ধ  মেনেছি কালেরে, মূঢ় প্রবচন
মরত্বে ; খন মন অনিচ্ছার অবশ্য বাঁচার
ভুলেছে ভিষণ ভার, ভুলে গেছে প্রত্যহের ভার |

.                 *************                
.                                                                         
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
ব্যাং

বর্ষায় ব্যাঙের ফুর্তি | বৃষ্টি শেষ, আকাশ নির্বাক ;
উচ্চকিত ঐকতানে শোনা গেল ব্যাঙেদের ডাক |

আদিম উল্লাসে বাজে উন্মুক্ত কণ্ঠের উচ্চ সুর |
আজ কোনো ভয় নেই-- বিচ্ছেদের, ক্ষুধার মৃত্যুর |

ঘাস হ'ল ঘন মেঘ ; স্বচ্ছ জল জ'মে আছে মাঠে
উদ্ধত আনন্দগানে উত্সবের দ্বিপ্রহর কাটে |

স্পর্ষময় বর্ষা এল ; কী মসৃণ তরুণ কর্দম !
স্ফীতকণ্ঠ, বীতস্কন্ধ-- সংগীতের শরীরী সপ্তম |

আহা কী চিক্কণ কান্তি মেঘস্নিগ্ধ হলুদে-সবুজে !
কাচ-স্বচ্ছ উর্ধ্ব দৃষ্টি চক্ষু যেন ঈশ্বরের খোঁজে

ধ্যানমগ্ন ঋষি-সম | বৃষ্টি শেষ, বেলা প'ড়ে আসে ;
গম্ভীর বন্দনাগান বেজে ওঠে স্তম্ভিত আকাশে |

উচ্চকিত উচ্চ সুর ক্ষীণ হ'লো ; দিন মরে ধুঁকে ;
অন্ধকার শতচ্ছিদ্র একচ্ছন্দা তন্দ্রা-আনা ডাকে |

মধ্যরাত্রে রুদ্ধদ্বার আমরা আরামে শয্যাশায়ী,
স্তব্ ধ  পৃথিবীতে শুধু শোনা যায় একাকী উত্সাহী

একটি অক্লান্ত সুর ; নিগূড় মন্ত্রের শেষ শ্লোক --
নিঃসঙ্গ ব্যাঙের কণ্ঠে উত্সারিত -- ক্রোক, ক্রোক, ক্রোক |

.                 *************                
.                                                                         
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
বিদ্যাসুন্দর
কবি বুদ্ধদেব বসু
এই ছড়াটি নেওয়া হয়েছে
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কবি এখলাসউদ্দিন আহ্ মদ
সম্পাদিত "দুই বাংলার ছড়া" (১৯৯৩) সংকলন থেকে। এই ছড়াটিই
কবি শ্যামলকান্তি
দাশ সম্পাদিত “ছোটোদের আবৃত্তির ছড়া ও কবিতা” (২০০৮) সংকলনে প্রকাশিত হয়
"সরস্বতী পুজোর পদ্য" নামে।


বলতে পারো, সরস্বতীর
মস্ত কেন সম্মান ?
বিদ্যে যদি বলো, তবে
গণেশ কেন কম যান ?
সরস্বতী কি করেছেন ?
মহাভারত লেখেন নি।
ভাব দেখে তো হচ্ছে মনে,
তর্ক করাও শেখেন নি।
তিন ভুবনে গণেশদাদার
নেই জুড়ি পাণ্ডিত্যে
অথচ তার বোনের দিকেই
ভক্তি কেন চিত্তে ?
সমস্ত রাত ভেবে ভেবে
এই পেয়েছি উত্তর---
বিদ্যা যাকে বলি, তারই
আর একটি নাম সুন্দর।

.        *************                
.                                                                         
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
প্রেমের কবিতা
কবি বুদ্ধদেব বসু

শুধু নয় সুন্দর অপ্সর-যৌবন
কম্পিত অধরের চম্পক-চুম্বন।
.        শুধু নয় কঙ্কনে ক্ষণে ক্ষণে ঝংকার
.        আভরণ হীনতার, আবরণ ক্ষীণতার।
.        শুধু নয় তনিমার তন্ময় বন্ধন।
.                ---কিছু তার দ্বন্দ্ব, কিছু তার ছন্দ।


পুষ্পের নিঃশ্বাস, রেশমের শিহরণ,
রক্তের রক্তিমা, কনকের নিক্কণ।
.        গন্ধের বাণী নিয়ে পরশের সুরকার
.        অঙ্গের অঙ্গণে আনলো যে-উপহার---
.        সে-তো শুধু বর্ণের নহে গীত-গুঞ্জন।
.                ---কিছু তার স্বর্ণ, কিছু তার স্বপ্ন।


বিলসিত বলয়ের মত্ত আবর্তণ,
মূর্ছিত রজনীর বিদ্যুৎ-নর্তন।
.        বিহ্বল বসনের চঞ্চল বীণাতার
.        উদ্বেল উল্লাসে আঁধারের ভাঙে দ্বার---
.        সে কি শুধু উদ্দাম, উন্মাদ মন্থন।
.                ---কিছু তার সজ্জা, কিছু তার লজ্জা।


শুধু নয় দু’জনের হৃদয়ের রঞ্জন,
নয়নের মন্ত্রণা, স্মরণের অঞ্জন।
.        রঙ্গিণী করবীর গরবিনী কবিতার
.        জাদুকর-তির্যক ইঙ্গিত আনে যার,
.        সে কি শুধু দেহতটে তরঙ্গ-তর্পণ।
.                ---কিছু তার দৃশ্য, কিছু বা রহস্য।


এসো শুভ লগ্নের উন্মীল সমীরণ
করো সেই মন্ত্রের মগ্নতা বিকীরণ,
.        যার দান বিরহের অনিমেষ অভিসার,
.        মিলনের ক্ষণিকার কণ্ঠের মণিহার ;---
.        সেথা বিজ্ঞানিকের বৃথা অণুবীক্ষণ।
.                ---কিছু তার জৈব, কিছু তার দৈব।

.                     *************                
.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
শেষের রাত্রি
কবি বুদ্ধদেব বসু

পৃথিবীর শেষ সীমা যেইখানে, চারিদিকে খালি আকাশ ফাঁকা,
আকাশের মুখে ঘুরে-ঘুরে যায় হাজার-হাজার তারার চাকা,
যোজনের পর হাজার যোজন বিশাল আঁধারে পৃথিবী ঢাকা।
.        (তোমার চুলের মতো ঘন কালো অন্ধকার,
.        তোমারি আঁখির তারকার মতো অন্ধকার ;
.        তবু চ’লে এসো ; মোর হাতে হাত দাও তোমার---
.                কঙ্কা শঙ্কা কোরো না। )

বিশাল আকাশ বাসনার মতো পৃথিবীর মুখে এসেছে নেমে,
ক্লান্ত শিশুর মতন ঘুমায় ক্লান্ত সময় সগসা থেমে ;
দিগন্ত থেকে দূর দিগন্তে ধূসর পৃথিবী করিছে খাঁ-খাঁ।
.        (আমারি প্রেমের মতন গহন অন্ধকার,
.        প্রেমের অসীম বাসনার মতো অন্ধকার ;
.        তবু চ’লে এসো ; মোর হাতে হাত দাও তোমার---
.                কঙ্কা শঙ্কা কোরো না। )

নেমেছে হাজার আঁধার রজনী, তিমির-তোরণে চাঁদের চূড়া,
হাজার চাঁদের চূড়া ভেঙে-ভেঙে হয়েছে ধূসর স্মৃতির গুঁড়া।
চলো চিরকাল জ্বলে যেথা চাঁদ, চির-আঁধারের আড়ালে বাঁকা
.        (তোমারি চুলের বন্যার মতো অন্ধকার,
.        তোমারি চোখের বাসনার মতো অন্ধকার ;
.        তবু চ’লে এসো ; মোর হাতে হাত দাও তোমার---
.                কঙ্কা শঙ্কা কোরো না। )

এসেছিল যত রূপকথা-রাত ঝরেছে হলদে পাতার মতো,
পাতার মতন পীত স্মৃতিগুলি যেন এলোমেলো প্রেতের মতো।
---রাতের আঁধারে সাপের মতন আঁকাবাঁকা কত কুটিল শাখা
.        (এসো, চ’লে এসো ; সেখানে সময় সীমাহীন
.        হঠাৎ ব্যথায় নয় দ্বিখণ্ড রাত্রিদিন ;
.        সেখানে মোদের প্রেমের সময় সীমাহীন,
.                কঙ্কা শঙ্কা কোরো না। )

অনের ধূসর স্মপণের ভারে এখানে জীবন ধূসরতম,
ঢালো উজ্জ্বল বিশাল বন্যা তীব্র তোমার কেশের তম,
আদিম রাতের বেণীতে জড়ানো মরণের মতো এ-আঁকাবাঁকা।
.        (ঝড় তুলে দাও, জাগাও হাওয়ার ভরা জোয়ার,
.        পৃথিবী ছাড়ায়ে সময় মাড়ায়ে যাবো এবার,
.        তোমার চুলের ঝড়ের আমরা ঘোড়সাওয়ার---
.                কঙ্কা শঙ্কা কোরো না। )

যেখানে জ্বলিছে আঁধার-জোয়ারে জোনাকির মতো তারকা-কণা,
হাজার চাঁদের পরিক্রমণে দিগন্ত ভ’রে উন্মাদনা।
কোটি সূর্যের জ্যোতির নৃত্যে আহত সময় ঝাপটে মাথা।
.        (কোটি-কোটি মৃত সূর্যের মতো অন্ধকার
.        তোমার আমার সময়-ছিন্ন বিরহ-ভার ;
.        তবু চ’লে এসো ; মোর হাতে হাত দাও তোমার---
.                কঙ্কা শঙ্কা কোরো না। )

তোমার চুলের মনোহীন তমো আকাশে-আকাশে চলেচে উড়ে
আদিম রাতের আঁধার-বেণীতে জড়ানো মরণ পঞ্জে ফুঁড়ে,---
সময় ছাড়ায়ে, মরণ মাড়ায়ে---বিদ্যুৎময় দীপ্ত ফাঁকা।
.        (এসো চলে এসো যেকানে সময় সীমানাহীন,
.        সময়-ছিন্ন বিরহে কাঁপে না রাত্রিদিন।
.        যেখানে মোদের প্রেমের সময় সময়হীন
.                কঙ্কা শঙ্কা কোরো না। )

.                     *************                
.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
শীতরাত্রির প্রার্থনা
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতা ( ১৯৪০ ) থেকে নেওয়া |


এসো,  ভুলে যাও তোমার সব ভাবনা, তোমার টাকার ভাবনা, স্বাস্থের ভাবনা,
.          এর পর কী হবে, এর পর,
ফেলে দাও ভবিষ্যতের ভয়, আর অতীতের জন্য মনস্তাপ |
আজ পৃথিবী মুছে গেছে, তোমার সব অভ্যস্থ নির্ভর
ভাঙলো একে-একে ;---রইলো হিম নিঃসঙ্গতা, আর অন্ধকার নিস্তাপ
.                        রাত্রি ; --- এসো, প্রস্তুত হও |

বাইরে বরফের রাত্রি |   ডাইনি-হাওয়ার কনকনে চাবুক
গালের মাংস ছিড়ে নেয়, চাঁদটাকে কাগজের মতো টুকরো ক’রে
ছিটিয়ে দেয় কুয়াশার মধ্যে, উপড়ে আনে আকাশ, হিংসুক
হাত ছড়িয়ে দেয় হিম ; শাদা, নরম, নাচের মতো অক্ষরে
.                          পৃথিবীতে মৃত্যুর ছবি এঁকে যায় |

তাহলে ডুবলো তোমার পৃথিবী, হারিয়ে গেলো চিরদিনের অভিজ্ঞান ;
ফুল নেই, পাখি ডাকে না, নাম ধ’রে ভরা গলায় ডাকে না কেউ ;
অচেনা দেশ, অস্থায়ী ঘর, শূন্য ঘরে নিঃসম্বল প্রাণ,
আর বাইরে উত্তরের শীত, অন্ধকার, মেরু-হাওয়ায় ঢেউয়ের পর ঢেউ |
.                            এই তো সময় ; ---সংহত হও |

সংহত হও, নিবিড় হও ; অতীত এখনো ফুরিয়ে যায়নি ভুলো না,
যে-অতীত অপেক্ষা করে আছে তোমার জন্য, তারই নাম ভবিষ্যৎ ;
যাবে, হবে, ফিরে পাবে |  মুহূর্তের পর মুহূর্তের ছলনা
কেবল চার বেঁধে রাখতে, লুকিয়ে রাখতে |  কিন্তু তোমার পথ
.                           চলে গেছে অনেক দূরে, দিগন্তে |

সেই প্রথম দিনে কে হাত রেখেছিলো তোমার হাতে, আজও তো
.     মনে পড়ে তোমার,
যাতে মনে পড়ে, ভুলতে না পারো, তাই অনেক ভুলতে হবে তোমাকে,
যাতে পথ চলতে ভয় না পাও, ফেলে দিতে হবে অনেক জঞ্জাল,
.     সাবধানের ভার,
হ’তে হবে রিক্ত, হারাতে হবে যা-কিছু তোমার চেনা, যাতে পথের বাঁকে বাঁকে
.                               পুরোনোকে চিনতেপারো, নতুন ক’রে |

এসো, আস্তে পা ফ্যালো, সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসো তোমার শূন্য ঘরে ;--
তুমি ভ’রে তুলবে, তাই শূন্যতা |  তুমি আনবে উষ্ণতা, তাই শীত |
এসো, ভুলে যাও তোমার টাকার ভাবনা, বাঁচার ভাবনা, হাজার ভাবনা---
.            আর এর পরে
তোমার দিকে এগিয়ে আসবে ভবিষ্যৎ, পিছন থেকে ধ’রে ফেলবে অতীত |
.                           এসো, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও আজ রাত্রে |

তা-ই চাও তুমি, তারই জন্য তোমার বুভুক্ষা, এই মৃত্যুর হাতেই
মুহূর্তের পর মুহূর্তের ছলনা হবে ছিন্ন ;
যেমন তোমার চোখের সামনে পৃথিবী মরে গেলো আজ ---ফুল নেই,
সব সবুজ নিবে গেছে, চারদিকে শুধু কঠিন শাদা স্তব্ধতার চিহ্ন---
.                           তেমনি তোমাকে ডুবতে হবে, তোমাকেও |

ডুবতে হবে মৃত্যুর তিমিরে, নয়তো কেমন ক’রে ফিরে আসবে আলোয় ?
লুপ্ত হ’তে হবে পাতালে, নয়তো কেমন ক’রে ফিরে আসবে আলোয় ?
তুমি কি জানো না, বার-বার মরতে হয় মানুষকে, বার-বার,
দুলতে হয় মৃত্যু আর নবজন্মের বিরামহীন দোলায়
.                          সত্যি যদি বাঁচতে হয় তাকে |

ডুবতে হবে মৃত্যুর তিমিরে, নয়তো কেমন ক’রে ফিরে আসবে আলোয় ?
লুপ্ত হ’তে হবে পাতালে, নয়তো কেমন ক’রে ফিরে আসবে আলোয় ?
তুমি কি জানো না, বার-বার মরতে হয় মানুষকে, বার-বার,
দুলতে হয় মৃত্যু আর নবজন্মের বিরামহীন দোলায়
.                           সত্যি যদি বাঁচতে হয় তাকে |

অন্ধকারকেই মৃত্যু নাম দিয়েছি আমরা |  বীজ ম’রে যায়,
যখন অদৃশ্য হয় মাটির তলায় সংগোপন গূঢ় গহ্বরে ;
শীত এলে ম’রে যায় পৃথিবী, ঝ’রে যায় পাতা, নেয় বিদায়
ঘাস, ফুল, ঘাস-ফড়িং ; নেকড়ে আসে বেরিয়ে ; কালো, কালো
.    নিষ্ঠুর কবরে
.                      হারিয়ে যায় প্রাণ---ধবধবে তুষারের তলায় |


তেমনি তুমি ; --- তোমারও রোদ মরে গেলো, ঘন হয়ে ঘিরলো কুয়াশা,
তোমার আলোর পৃথিবী ছেড়ে তুমি নেমে এলে পাতালে,
তোমার রঙিন সাজ ছিঁড়ে গেলো, মুছে গেলো নাম, ভুলে গেলে
.            তোমার ভাষা,
যত চোখ তোমাকে চিনেছিলো একদিন, সেই সব উত্সবের মতো
.          চোখের আড়ালে
.                   তুমি মিলিয়ে গেলে --- অন্ধকার থেকে অন্ধকারে |

কিন্তু মাটির বুক চিরে লুপ্ত বীজ ফিরে আসে একদিন,
আবার দেখা দেয়, অন্য নামে, নতুন জন্মে, রাশি রাশি ফসলের ঐশ্বর্যে ;
আর এই শীত --- তুমি তো জানো  প্রত্যেক ফোঁটা বরফের সঙ্গে
.      তারও শুধু জ’মে উঠছে ঋণ,
সব শোধ ক’রে দিতে হবে ; প্রচ্ছন্ন প্রাণ অবিচল ধৈর্যে
.                     জেগে আছে দীর্ঘ, দীর্ঘ রাত্রি |

শুধু জেগে আছে তাই নয়, কাজ ক’রে যাচ্ছে গোপনে-গোপনে,
সৃষ্টি ক’রে যাচ্ছে মৃত্যুর বুকে নতুন জন্ম, কবর ফেটে অবুঝ
অদ্ভুত উৎসারণ, পাথর ভেঙে স্রোত, বরফের নিথর আস্তরণে
স্পন্দন – যখন ঘোমটা ছিঁড়ে উঁকি দেবে ক্ষীণ, প্রবল, উজ্জ্বল, আশ্চর্য সবুজ
.                     বসন্তের প্রথম চুম্বনে |

আর তাই এই মৃত্যু তোমার প্রতীক্ষা --- তোমাকে তার যোগ্য হ’তে হবে,
ভুলতে হবে সাবধানের দীনতা, হাজার ভাবনার জঞ্জাল ;
সন্দেহ কোরো না, প্রতিবাদ কোরো না ;  নিহিত হও এই কঠিন হিম ধবধবে
আস্তরণের অন্তঃপুরে, বীজের মতো--- যেখানে অপেক্ষা ক’রে আছে
.     তোমার চিরকাল |
.                           উৎসর্জন করো, সমর্পণ করো নিজেকে |

নিবিড় হ’লো রাত্রি, পাত্লা চাঁদ ছিঁড়ে গেলো, নেকড়ের মতো অন্ধকার,
দলে-দলে ডাইনি বেরোলো হাওয়ায়., আততায়ীর ছুরির মতো শীত |
এরই মধ্যে তোমার যজ্ঞ ; উত্সর্গ হবে প্রাণ, আগুন জ্বালবে আত্মার,
ভস্ম হবে যাকে ভেবেছো তোমার ভবিষ্যৎ, আর যাকে জেনেছো তোমার অতীত |
.                            পবিত্র হও, প্রতীক্ষা করো |


ঐ শোনো, ঘন্টা বাজে গির্জেতে ; এদের উৎসবের ক্ষণ আসন্ন |
ঈশ্বরের একজাত, একমাত্র পুত্রের জন্মের স্মরণে ;---
কিন্তু তুমি---- তোমার শরীর ভিন্ন মাটিতে তৈরি, অন্য
গান বাজে তোমার রক্তে, অন্য এক আশ্বাসের উচ্চারণে
.                         ধ্বনিত তোমার ইতিহাসের আকাশ |

তুমি জেনেছো, মানুষমাত্রেই অমৃতের পুত্র--- শুধু একজন নয়, প্রত্যেকে,
তুমি বলেছো, অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যাও, মৃত্যু থেকে অমৃতে,
তুমি শুনেছো, জন্মের পর জন্মান্তর আবর্তের মতো এঁকে বেঁকে
অমৃতের দিকে নিয়ে যায় ; --- আর এই জীবন, সেও তার সময়ের
.    সীমায়, মাংসের গণ্ডিতে
.                          বন্দী হ’য়ে থাকবে না |

তাই তো জানো তুমি--- বার বার মরতে হয় মানুষকে, নতুন ক’রে
.    জন্ম নেবার জন্য
শুধু জন্ম-জন্মান্তর নয়, একই জন্মে তার এই মৃত্যু আর পুনরুথ্বান,
শুধু একজনের নয়, সকল মানুষের ---হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার অরণ্য
লুকিয়ে রেখেছে চিরকাল এই বুভুক্ষা---- তারই জন্য সব কান্না,
.            সব কান্না-ভরা গান,
.                          বুকে বুক রেখে তৃপ্তিহীন প্রেমিক |

তৃপ্তিহীন বিরহে তুমি জ্বলছো--- জ্বলতে দাও, পুড়ে যাক যা-কিছু
.    তোমার পুরোনো,
ডিমের খোলশের মতো ফেটে যাক তোমার পৃথিবী, বেরিয়ে আসুক
.    অন্য এক জগৎ
এই পাতাল বেয়ে নেমে যাও আরো, আরো অন্ধকারে ; যখন সব
.     হারাবে, কোনো
চিহ্ন আর থাকবে না, তখনই তোমাকে ধ’রে ফেলবে অতীত, এগিয়ে আসবে
.      তোমার দিকে ভবিষ্যৎ---
.                         সব নতুন ---- নতুন হ’য়ে |

সময় হ’লো, বাইরে অনাকার অন্ধকার, প্রেতের চীত্কারের মতো হাওয়া ;
অচেনা দেশ, অস্থায়ী ঘর, শূন্য ঘরে নিঃসম্বল প্রাণ ;
আজ আর কিছু নেই তোমার--- শুধু একফোঁটা রক্তে-লীন সংগোপন
.      ঝাপসা পথ-চাওয়া
এই ব্যাপ্ত কুয়াশার মধ্যে ক্ষীণ, ক্ষণিক, লুকিয়ে-থাকা তারার মতো
.      কম্পমান |
.                        প্রস্তুত হও, প্রতীক্ষা করো তোমার মৃত্যুর জন্য |

যে- মৃত্যুকে ভেদ করে লুপ্ত বীজ ফিরে আসে নির্ভুল,
রাশি-রাশি শস্যের উত্সাহে, ফসলের আশ্চর্য সফলতায়,
যে-মৃত্যুকে দীর্ণ ক’রে বরফের কবর ফেটে ফুল
জ্ব’লে ওঠে সবুজের উল্লাসে, বসন্তের অমর ক্ষমতায়---
.                        সেই মৃত্যুর--- নবজন্মের প্রতীক্ষা করো |

মৃত্যুর নাম অন্ধকার ; কিন্তু মাতৃগর্ভ --- তাও অন্ধকার, ভুলো না
তাই কাল অবগুন্ঠিত, যা হ’য়ে উঠছে তা-ই প্রচ্ছন্ন ;
এসো, শান্ত হও ;  এই হিম রাত্রে, যখন বাইরে-ভেতরে কোথাও
.      আলো নেই,
তোমার শূন্যতার অজ্ঞাত গহ্বর থেকে নবজন্মের জন্য
.                          প্রার্থনা করো, প্রতীক্ষা করো, প্রস্তুত হও |

.                                 *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর