বুদ্ধদেব বসুর কবিতা
*
শীতরাত্রির প্রার্থনা
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতা ( ১৯৪০ ) থেকে নেওয়া |


এসো,  ভুলে যাও তোমার সব ভাবনা, তোমার টাকার ভাবনা, স্বাস্থের ভাবনা,
.          এর পর কী হবে, এর পর,
ফেলে দাও ভবিষ্যতের ভয়, আর অতীতের জন্য মনস্তাপ |
আজ পৃথিবী মুছে গেছে, তোমার সব অভ্যস্থ নির্ভর
ভাঙলো একে-একে ;---রইলো হিম নিঃসঙ্গতা, আর অন্ধকার নিস্তাপ
.                        রাত্রি ; --- এসো, প্রস্তুত হও |

বাইরে বরফের রাত্রি |   ডাইনি-হাওয়ার কনকনে চাবুক
গালের মাংস ছিড়ে নেয়, চাঁদটাকে কাগজের মতো টুকরো ক’রে
ছিটিয়ে দেয় কুয়াশার মধ্যে, উপড়ে আনে আকাশ, হিংসুক
হাত ছড়িয়ে দেয় হিম ; শাদা, নরম, নাচের মতো অক্ষরে
.                          পৃথিবীতে মৃত্যুর ছবি এঁকে যায় |

তাহলে ডুবলো তোমার পৃথিবী, হারিয়ে গেলো চিরদিনের অভিজ্ঞান ;
ফুল নেই, পাখি ডাকে না, নাম ধ’রে ভরা গলায় ডাকে না কেউ ;
অচেনা দেশ, অস্থায়ী ঘর, শূন্য ঘরে নিঃসম্বল প্রাণ,
আর বাইরে উত্তরের শীত, অন্ধকার, মেরু-হাওয়ায় ঢেউয়ের পর ঢেউ |
.                            এই তো সময় ; ---সংহত হও |

সংহত হও, নিবিড় হও ; অতীত এখনো ফুরিয়ে যায়নি ভুলো না,
যে-অতীত অপেক্ষা করে আছে তোমার জন্য, তারই নাম ভবিষ্যৎ ;
যাবে, হবে, ফিরে পাবে |  মুহূর্তের পর মুহূর্তের ছলনা
কেবল চার বেঁধে রাখতে, লুকিয়ে রাখতে |  কিন্তু তোমার পথ
.                           চলে গেছে অনেক দূরে, দিগন্তে |

সেই প্রথম দিনে কে হাত রেখেছিলো তোমার হাতে, আজও তো
.     মনে পড়ে তোমার,
যাতে মনে পড়ে, ভুলতে না পারো, তাই অনেক ভুলতে হবে তোমাকে,
যাতে পথ চলতে ভয় না পাও, ফেলে দিতে হবে অনেক জঞ্জাল,
.     সাবধানের ভার,
হ’তে হবে রিক্ত, হারাতে হবে যা-কিছু তোমার চেনা, যাতে পথের বাঁকে বাঁকে
.                               পুরোনোকে চিনতেপারো, নতুন ক’রে |

এসো, আস্তে পা ফ্যালো, সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসো তোমার শূন্য ঘরে ;--
তুমি ভ’রে তুলবে, তাই শূন্যতা |  তুমি আনবে উষ্ণতা, তাই শীত |
এসো, ভুলে যাও তোমার টাকার ভাবনা, বাঁচার ভাবনা, হাজার ভাবনা---
.            আর এর পরে
তোমার দিকে এগিয়ে আসবে ভবিষ্যৎ, পিছন থেকে ধ’রে ফেলবে অতীত |
.                           এসো, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও আজ রাত্রে |

তা-ই চাও তুমি, তারই জন্য তোমার বুভুক্ষা, এই মৃত্যুর হাতেই
মুহূর্তের পর মুহূর্তের ছলনা হবে ছিন্ন ;
যেমন তোমার চোখের সামনে পৃথিবী মরে গেলো আজ ---ফুল নেই,
সব সবুজ নিবে গেছে, চারদিকে শুধু কঠিন শাদা স্তব্ধতার চিহ্ন---
.                           তেমনি তোমাকে ডুবতে হবে, তোমাকেও |

ডুবতে হবে মৃত্যুর তিমিরে, নয়তো কেমন ক’রে ফিরে আসবে আলোয় ?
লুপ্ত হ’তে হবে পাতালে, নয়তো কেমন ক’রে ফিরে আসবে আলোয় ?
তুমি কি জানো না, বার-বার মরতে হয় মানুষকে, বার-বার,
দুলতে হয় মৃত্যু আর নবজন্মের বিরামহীন দোলায়
.                          সত্যি যদি বাঁচতে হয় তাকে |

ডুবতে হবে মৃত্যুর তিমিরে, নয়তো কেমন ক’রে ফিরে আসবে আলোয় ?
লুপ্ত হ’তে হবে পাতালে, নয়তো কেমন ক’রে ফিরে আসবে আলোয় ?
তুমি কি জানো না, বার-বার মরতে হয় মানুষকে, বার-বার,
দুলতে হয় মৃত্যু আর নবজন্মের বিরামহীন দোলায়
.                           সত্যি যদি বাঁচতে হয় তাকে |

অন্ধকারকেই মৃত্যু নাম দিয়েছি আমরা |  বীজ ম’রে যায়,
যখন অদৃশ্য হয় মাটির তলায় সংগোপন গূঢ় গহ্বরে ;
শীত এলে ম’রে যায় পৃথিবী, ঝ’রে যায় পাতা, নেয় বিদায়
ঘাস, ফুল, ঘাস-ফড়িং ; নেকড়ে আসে বেরিয়ে ; কালো, কালো
.    নিষ্ঠুর কবরে
.                      হারিয়ে যায় প্রাণ---ধবধবে তুষারের তলায় |


তেমনি তুমি ; --- তোমারও রোদ মরে গেলো, ঘন হয়ে ঘিরলো কুয়াশা,
তোমার আলোর পৃথিবী ছেড়ে তুমি নেমে এলে পাতালে,
তোমার রঙিন সাজ ছিঁড়ে গেলো, মুছে গেলো নাম, ভুলে গেলে
.            তোমার ভাষা,
যত চোখ তোমাকে চিনেছিলো একদিন, সেই সব উত্সবের মতো
.          চোখের আড়ালে
.                   তুমি মিলিয়ে গেলে --- অন্ধকার থেকে অন্ধকারে |

কিন্তু মাটির বুক চিরে লুপ্ত বীজ ফিরে আসে একদিন,
আবার দেখা দেয়, অন্য নামে, নতুন জন্মে, রাশি রাশি ফসলের ঐশ্বর্যে ;
আর এই শীত --- তুমি তো জানো  প্রত্যেক ফোঁটা বরফের সঙ্গে
.      তারও শুধু জ’মে উঠছে ঋণ,
সব শোধ ক’রে দিতে হবে ; প্রচ্ছন্ন প্রাণ অবিচল ধৈর্যে
.                     জেগে আছে দীর্ঘ, দীর্ঘ রাত্রি |

শুধু জেগে আছে তাই নয়, কাজ ক’রে যাচ্ছে গোপনে-গোপনে,
সৃষ্টি ক’রে যাচ্ছে মৃত্যুর বুকে নতুন জন্ম, কবর ফেটে অবুঝ
অদ্ভুত উৎসারণ, পাথর ভেঙে স্রোত, বরফের নিথর আস্তরণে
স্পন্দন – যখন ঘোমটা ছিঁড়ে উঁকি দেবে ক্ষীণ, প্রবল, উজ্জ্বল, আশ্চর্য সবুজ
.                     বসন্তের প্রথম চুম্বনে |

আর তাই এই মৃত্যু তোমার প্রতীক্ষা --- তোমাকে তার যোগ্য হ’তে হবে,
ভুলতে হবে সাবধানের দীনতা, হাজার ভাবনার জঞ্জাল ;
সন্দেহ কোরো না, প্রতিবাদ কোরো না ;  নিহিত হও এই কঠিন হিম ধবধবে
আস্তরণের অন্তঃপুরে, বীজের মতো--- যেখানে অপেক্ষা ক’রে আছে
.     তোমার চিরকাল |
.                           উৎসর্জন করো, সমর্পণ করো নিজেকে |

নিবিড় হ’লো রাত্রি, পাত্লা চাঁদ ছিঁড়ে গেলো, নেকড়ের মতো অন্ধকার,
দলে-দলে ডাইনি বেরোলো হাওয়ায়., আততায়ীর ছুরির মতো শীত |
এরই মধ্যে তোমার যজ্ঞ ; উত্সর্গ হবে প্রাণ, আগুন জ্বালবে আত্মার,
ভস্ম হবে যাকে ভেবেছো তোমার ভবিষ্যৎ, আর যাকে জেনেছো তোমার অতীত |
.                            পবিত্র হও, প্রতীক্ষা করো |


ঐ শোনো, ঘন্টা বাজে গির্জেতে ; এদের উৎসবের ক্ষণ আসন্ন |
ঈশ্বরের একজাত, একমাত্র পুত্রের জন্মের স্মরণে ;---
কিন্তু তুমি---- তোমার শরীর ভিন্ন মাটিতে তৈরি, অন্য
গান বাজে তোমার রক্তে, অন্য এক আশ্বাসের উচ্চারণে
.                         ধ্বনিত তোমার ইতিহাসের আকাশ |

তুমি জেনেছো, মানুষমাত্রেই অমৃতের পুত্র--- শুধু একজন নয়, প্রত্যেকে,
তুমি বলেছো, অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যাও, মৃত্যু থেকে অমৃতে,
তুমি শুনেছো, জন্মের পর জন্মান্তর আবর্তের মতো এঁকে বেঁকে
অমৃতের দিকে নিয়ে যায় ; --- আর এই জীবন, সেও তার সময়ের
.    সীমায়, মাংসের গণ্ডিতে
.                          বন্দী হ’য়ে থাকবে না |

তাই তো জানো তুমি--- বার বার মরতে হয় মানুষকে, নতুন ক’রে
.    জন্ম নেবার জন্য
শুধু জন্ম-জন্মান্তর নয়, একই জন্মে তার এই মৃত্যু আর পুনরুথ্বান,
শুধু একজনের নয়, সকল মানুষের ---হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার অরণ্য
লুকিয়ে রেখেছে চিরকাল এই বুভুক্ষা---- তারই জন্য সব কান্না,
.            সব কান্না-ভরা গান,
.                          বুকে বুক রেখে তৃপ্তিহীন প্রেমিক |

তৃপ্তিহীন বিরহে তুমি জ্বলছো--- জ্বলতে দাও, পুড়ে যাক যা-কিছু
.    তোমার পুরোনো,
ডিমের খোলশের মতো ফেটে যাক তোমার পৃথিবী, বেরিয়ে আসুক
.    অন্য এক জগৎ
এই পাতাল বেয়ে নেমে যাও আরো, আরো অন্ধকারে ; যখন সব
.     হারাবে, কোনো
চিহ্ন আর থাকবে না, তখনই তোমাকে ধ’রে ফেলবে অতীত, এগিয়ে আসবে
.      তোমার দিকে ভবিষ্যৎ---
.                         সব নতুন ---- নতুন হ’য়ে |

সময় হ’লো, বাইরে অনাকার অন্ধকার, প্রেতের চীত্কারের মতো হাওয়া ;
অচেনা দেশ, অস্থায়ী ঘর, শূন্য ঘরে নিঃসম্বল প্রাণ ;
আজ আর কিছু নেই তোমার--- শুধু একফোঁটা রক্তে-লীন সংগোপন
.      ঝাপসা পথ-চাওয়া
এই ব্যাপ্ত কুয়াশার মধ্যে ক্ষীণ, ক্ষণিক, লুকিয়ে-থাকা তারার মতো
.      কম্পমান |
.                        প্রস্তুত হও, প্রতীক্ষা করো তোমার মৃত্যুর জন্য |

যে- মৃত্যুকে ভেদ করে লুপ্ত বীজ ফিরে আসে নির্ভুল,
রাশি-রাশি শস্যের উত্সাহে, ফসলের আশ্চর্য সফলতায়,
যে-মৃত্যুকে দীর্ণ ক’রে বরফের কবর ফেটে ফুল
জ্ব’লে ওঠে সবুজের উল্লাসে, বসন্তের অমর ক্ষমতায়---
.                        সেই মৃত্যুর--- নবজন্মের প্রতীক্ষা করো |

মৃত্যুর নাম অন্ধকার ; কিন্তু মাতৃগর্ভ --- তাও অন্ধকার, ভুলো না
তাই কাল অবগুন্ঠিত, যা হ’য়ে উঠছে তা-ই প্রচ্ছন্ন ;
এসো, শান্ত হও ;  এই হিম রাত্রে, যখন বাইরে-ভেতরে কোথাও
.      আলো নেই,
তোমার শূন্যতার অজ্ঞাত গহ্বর থেকে নবজন্মের জন্য
.                          প্রার্থনা করো, প্রতীক্ষা করো, প্রস্তুত হও |

.                                 *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
চিল্কায় সকাল
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতা ( ১৯৪০ ) থেকে নেওয়া |

কী ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায়
.        কেমন ক’রে বলি |
কী নির্মল নীল এই আকাশ, কী অসহ্য সুন্দর,
যেন গুণীর কন্ঠের অবাধ উন্মুক্ত তান
.        দিগন্ত থেকে দিগন্তে :

কী ভালো আমার লাগলো এই আকাশের দিকে তাকিয়ে ;
চারদিক সবুজ পাহাড়ে আঁকা বাঁকা, কুয়াশার ধোঁয়াটে,
.            মাঝখানে চিল্কা উঠছে ঝিলকিয়ে |

তুমি কাছে এলে, একটু বসলে, তারপর গেলে ওদিকে,
ইস্টেশনে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, তা-ই দেখতে |
গাড়ি চ’লে গেলো ! --- কি ভালো তোমাকে বাসি,
.            কেমন ক’রে বলি |

আকাশে সূর্যের বন্যা, তাকানো যায় না |
গোরুগুলো একমনে ঘাস ছিঁড়ছে, কী শান্ত !
--- তুমি কি কখনো ভেবেছিলে এই হ্রদের ধারে এসে আমরা পাবো
.            যা এতদিন পাইনি |

রুপোলি জল শুয়ে-শুয়ে স্বপ্ন দেখছে, সমস্ত আকাশ
নীলের স্রোতে ঝড়ে পড়ছে তার বুকের উপর
সূর্যের চুম্বনে | --- এখানে জলে উঠবে অপরূপ ইন্দ্রধনু
তোমার আর আমার রক্তের সমুদ্রকে ঘিরে
.              কখনো কি ভেবেছিলে ?

কাল চিল্কায় নৌকোয় যেতে যেতে আমরা দেখেছিলাম
দুটো প্রজাপতি কত দূর থেকে উড়ে আসছে
জলের উপর দিয়ে |----কী দুঃসাহস ! তুমি হেসেছিলে, আর আমার
.              কী ভালো লেগেছিলো

তোমার সেই উজ্জ্বল অপরূপ সুখ |  দ্যাখো, দ্যাখো
কেমন নীল এই আকাশ |--- আর তোমার চোখে
কাঁপছে কত আকাশ, কত মৃত্যু, কত নতুন জন্ম
.               কেমন ক’রে বলি |

.                              *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
অসম্ভবের গান
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতা ( ১৯৪০ ) থেকে নেওয়া |

বৃথাই জপিয়েছি তোমারে মন,
থামাও অস্থির চ্যাঁচামেচি |
কোথায় অর্জুন ! কোথায় কামরূপ !
এক বসন্তেই শূন্য তুণ |

এক বসন্তেই শূন্য তুণ ?
তাহ’লে আজো কেন শান্তি নেই ?
কেন বিচক্ষণ যুধিষ্ঠির
পাঞ্চালীরে রাখে পাশায় পণ ?

কোনো বিচক্ষণ যুধিষ্ঠির
জানে না কেন এই পরিশ্রম,
জানে না সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখা
হঠাৎ কাঁপে কোন আকাঙ্ক্ষায় |

হঠাৎ কাঁপি কোন আকাঙ্ক্ষায়---
বৃথাই জপালাম তোমারে, মন---
উন্মাদিনী পাশা বরং ভালো,
আজো কি চিত্রাঙ্গদার আশা ?

বরং প্রোজ্জল জুয়োর চোখে
দ্যাখো-না ডুব দিয়ে কোথায় তল,
কিংবা মদিরার উদার বুকে
পাবে তো অন্তত অন্ধকার |

এখানে কিছু নেই, অন্ধকার,
শূন্য তুণ এক বসন্তেই,
এ-বনে কেন তবে আবার খোঁজো
অনিশ্চয়তার অসম্ভবে !

অনিশ্চয়তার অন্বেষণে
পাঞ্চালীরে পেয়েছিলে সেবার,
সে আজ এতদূর বিখ্যাত যে
স্বয়ং কৃষ্ণের সে-ই মধুর |

ফসল অন্যের, তোমার শুধু
অন্য কোনো দূর অরণ্যের
পন্থহীনতার স্বপ্নে কেঁপে ওঠা
কোন অসম্ভব আকাঙ্ক্ষায় |

স্বপ্ন ওঠে রোল--- কোথায় কামরূপ
কাঁপছে চিত্রাঙ্গদার ঠোঁটে !
হে বীর, ভাঙো ভুল !  ব্রহ্মচারী তুমি ?
--- আবার বসন্তের হুলস্থূল

আবার বসন্তের হুলুস্থূল
ব্রহ্মচারী তুমি, সব্যসাচী !
থামে না চ্যাঁচামেচি !  যদি অসম্ভব
তবে এ-তৃষ্ণার কোথায় মূল ?

.                 *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
রাত তিনটের সনেট : ১
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতা ( ১৯৪০ ) থেকে নেওয়া |


শুধু তা-ই পবিত্র, যা ব্যক্তিগত | গভীর সন্ধ্যায়
নরম, আচ্ছন্ন আলো ; হলদে-ম্লান বইয়ের পাতার
লুকোনো নক্ষত্র ঘিরে আকাশের মতো অন্ধকার ;
অথবা অত্বর চিঠি, মধ্যরাতে লাজুক তন্দ্রায়
দূরের বন্ধুকে লেখা |  যীশু কি পরোপকারী
ছিলেন, তোমরা ভাবো  না কি বুদ্ধ কোনো সমিতির
মাননীয়,  বাচাল,  পরিশ্রমী,  অশীতির
মোহগ্রস্ত সভাপতি ? উদ্ধারের স্বত্বাধিকারী

ব্যতিব্যস্ত পাণ্ডাদের জগঝম্প, চামর, পাহারা
এড়িয়ে আছেন তাঁরা উদাসীন, শান্ত ছন্নছাড়া |
তাই বলি, জগতেরে ছেড়ে দাও, যাক সে যেখানে যাবে ;

হও ক্ষীণ, অলক্ষ্য, দুর্গম আর পুলকে বধির |
যে-সব খবর নিয়ে সেবকেরা উত্সাহে অধীর,
আঁধ ঘন্টা নারীর আলস্যে তার ঢের বেশি পাবে |

.                 *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
রাত তিনটের সনেট : ২
কবি বুদ্ধদেব বসু
কবি দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়কবি দীপক রায় সম্পাদিত  “বাংলা আধুনিক কবিতা ১”
(১৯৯২) থেকে নেওয়া |    


এ নয় তোমার জন্য |  শুধু বই আজও আছে খোলা |
যারা হাসে, মন্ত্র পড়ে, টুংটাং চায়ের টেবিলে,
তারাই, শোবার আগে, পরশির আলো নিবে গেলে
হয়ে যায় ভাঁড়ারঘরের ব্যস্ত ইঁদুর, আরশোলা ;
যুদ্ধ করে, খুঁটে খায় ; নিমন্ত্রণে অভ্যর্থনার
অস্তিত্ব না জেনে শুধু উচ্ছিষ্টেরে ভাবে ইতিহাস |
এ নয় তোমার জন্য | ফুল, ফল, ঋতু, বারো মাস
ঘুরে-ঘুরে যা বলে তা শিখে নাও | ঠিকানা রেখো না আর

কোনোখানে ---বাষ্পলীন, ধবল, সরল ডিসেম্বরে
বিস্মৃত, চক্রান্তকারী, নিরুদ্দেশ বসন্তের মতো
যাও দূরে, দেশান্তরে, সাগরের শেষ দ্বীপান্তরে ;

অনামী, অসাবধান, চেষ্টাহীন, অপ্রতিহত,
নতুন ভাষায়, শোনো, নক্ষত্রের দীপ্ত মদিরায়
চরাচর, চিরকাল নিস্বনিত তোমার শিরায় |

.                      *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
ঋতুর উত্তরে
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতা ( ১৯৪০ ) থেকে নেওয়া |


শীত, গ্রীষ্ম, বসন্ত, বর্ষার দিন, আমি এতদিনে
তোমাদের বিরাট খামখেয়াল জয় ক’রে, হৃদয়সন্ধ্যায়
নিয়েছি সুযোগমুক্ত, হতভাগ্য শূন্যতারে চিনে---

আমি, মৃত, নিশ্চিত, ভবিষ্যময়, প্রশ্নের অতীত
পউষে ফাল্গুনে গাঁথা কান্না-হাসি-দোলানো অন্যায়
আমাকে বেঁধে না আর ; বড়ো জোর বাত, পিত্ত, শ্লেষ্মার সংবিৎ

এঁকে যায় সামান্য গণিতচিহ্নে পঞ্জিকার পালা---
যেন এক পুরোনো প্রাসাদে শুধু অনুপস্থিতি
দেখায় আঙুল তুলে ঘরে-ঘরে মরচে-পড়া তালা |

আমার হৃদয় আজ চিরন্তন হেমন্তে বিলীন ;
কুয়াশা, চাঁদের প্রেত, রশ্মি-জ্বলা পশ্চিমের স্মৃতি—
সব মিশে অন্ধকারে ভ’রে দেয় আলোর পুলিন :

শুধু স্বপ্নে শুনে-শুনে এতকাল, ঋতুহীন সমুদ্রের স্বর—
নিঃসঙ্গতা ! জেনেছি তোমারই নাম শীত, গ্রীষ্ম, বসন্ত, বত্সর |

.                      *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
বিরহ
কবি বুদ্ধদেব বসু
কবি দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়কবি দীপক রায় সম্পাদিত  “বাংলা আধুনিক কবিতা ১”
(১৯৯২) থেকে নেওয়া |

ভ্রমর, ওরে ভ্রমর, কত করবি গুনগুন !
ঘরের মধ্যে জ্বালিয়ে দিলি সংগীতের আগুন |
গান যেন তোর ব্যর্থ না হয়, ঈশ্বর করুন |

ভ্রমর, ওরে ভ্রমর, তুই একটু চুপ কর,
বুকের মধ্যে শুনছি আমার আর-একজনের স্বর,
তোরই মতো দুপুর ভ’রে করত যে গুনগুন |

ভ্রমর, কালো ভ্রমর, ওরে ভ্রমর উতলা,
তোকে শুনে ব্যথা যে আর সইতে পারি না—
ব্যথা আমার ব্যর্থ না হয়, ঈশ্বর করুন |

আর-বছরে জ্বলেছি তার গানের আগুনে,
কোথায় গেল গানের রানী এবার ফাগুনে,
গান যেন তার ব্যর্থ না হয়, ঈশ্বর করুন |

ভ্রমর, ওরে ভ্রমর, আমি আজকে একেলা,
বুক ঠেলে যে কান্না ওঠে, সইতে পারি না |
আমার কাছে আর কত রে করবি গুনগুন !

ভ্রমর, কালো ভ্রমর, ফিরে আসিস আর-বছর,
চুপ ক’রে তুই শুনবি তখন আর-একজনের স্বর |
প্রার্থনা মোর ব্যর্থ না হয়, ঈশ্বর করুন |

.                      *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
মায়াবী টেবিল
কবি বুদ্ধদেব বসু
কবি দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়কবি দীপক রায় সম্পাদিত  “বাংলা আধুনিক কবিতা ১”
(১৯৯২) থেকে নেওয়া |


তা হ’লে উজ্জ্বলতর করো দীপ, মায়াবী টেবিলে
সংকীর্ণ আলোর চক্রে মগ্ন হও, যে-আলোর বীজ
জন্ম দেয় সুন্দরীর,  যার গান সমুদ্রের নীলে
কাঁপায়, জ্যোছনায় যার ঝিলিমিল-স্বপ্নের শেমিজ
দিগ্বিজয়ী জাহাজেরে ভাঙে এনে পুরোনো পাথরে |
তা হ’লে উজ্জ্বলতর করো দীপ, যে দীপের ছায়া
ঘাস, গাছ, রোদ্দুরের অন্তহীন আশ্চর্য কাপড়ে
পৃথিবীরে রূপ দেয়, যে রূপের লক্ষ হাতে হাওয়া
যদিও নিত্যই ছেঁড়ে, তবু পাতাঝরার চিত্কার
হার মানে, স্তব্ধ হয়, ছন্দ পায় যার প্রতিভায় |
তা হ’লে উজ্জ্বলতর করো দীপ, করো অঙ্গীকার
সেই আলো, যে দেয় জীবনে মুছে, যৌবনে নিবায় ;
রঙের তরঙ্গে বেঁধে তপ্ত ঘন খনির কোরকে---
ধাতুর প্রাণের পদ্মে, পাথরের রক্তের শিরায়
জ্বালায় অব্যর্থ, অফুরন্ত চোখের হীরকে |

.                      *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
রোদনরূপসী
কবি বুদ্ধদেব বসু
কবি দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়কবি দীপক রায় সম্পাদিত  “বাংলা আধুনিক কবিতা ১”
(১৯৯২) থেকে নেওয়া |


কে তুমি, সুন্দরী, যার বিন্দু-বিন্দু অশ্রু ঝ’রে ভেসে যায়
পদ্ম হ’য়ে নদীর সচ্ছল স্রোতে অবিরল ?
কোন প্লুত নীলিমায় লিপ্ত তুমি ? কোন পুণ্যজল
তোমার লাবণ্যসার আপনার তরঙ্গে মেশায় ?
রোদনরূপসী, তুমি কেন কাঁদো ? অশ্রু কেন পদ্ম হ’য়ে ফোটে ?
কেন তার হিরণ্ময়ী অভিমান দিগন্তেও হয় না বিলীন ?
কোন মন্ত্রে এই দিন অফুরান ? মহাকবি দেন নি উত্তর,
শুধু বলে গিয়েছেন দেবতারা তোমার অধীন |

দুঃসাহস –-তবু বলি | মনে হয় কোনো -এক দূর জন্মান্তরে
তুমি  ছিলে আমার একান্ত চেনা--- অন্তরঙ্গ, অবিস্মরণীয় |
সেদিন আমার কান্না তুমি কেঁদেছিলে ! আমিও জলের কলস্বরে
কান পেতে শুনেছি, কেমনে ধায় তোমার আজ্ঞায় মুগ্ধ পঞ্চভূত,
যুদ্ধ ভুলে , ছন্দের অঞ্জলি হটয়ে রূপ নেয় আকাশে আলোকে |
অগাধ ঐশ্বর্য ছিল --- তখন অমল এক বিশ্ব ছিল | সেদিন তোমার,

ছিল ঋতু, দ্যুলোক, সবিতা : তবু ছিল,  আমাকে তোমার প্রয়োজন |
মনে পড়ে সেই দূর স্বপ্নলোকে,  আদিম ঊষার লগ্নে
আমি তা-ই তোমাকে দিয়েছিলাম, যা তোমার তখন ছিল না জানা ---
যা ছিল না আলোর প্লাবনে কিংবা জলের হিল্লোলে ---
অভাব-বিচ্ছেদবোধ-স্বপ্ন-স্মৃতি-হৃদয়স্পন্দন !
সেই থেকে নিখিলের রাজ্ঞী তুমি, ইন্দ্র হল অকস্মাৎ অসহায়,
স্বর্গের ছলনাপ্রান্তে সে-অশ্রুপুলক চলে অন্তহীন ;----
শুধু আমি মাঝে-মাঝে ভুলে যাই, খ’সে পড়ি যন্ত্রণার অন্ধকূপে,
শূলবিদ্ধ শূকরের মতো নড়ি,  জীবনের অজ্ঞান চেষ্টায় |

.                      *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
বাহুকের স্বগতোক্তি
কবি বুদ্ধদেব বসু
কবি দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়কবি দীপক রায় সম্পাদিত  “বাংলা আধুনিক কবিতা ১”
(১৯৯২) থেকে নেওয়া |


এই হল আরম্ভ আমার |
আমি কে,  তা এখনও জানি না |
তবু এই ব্যাদিত আঁধার
আর তার বর্বর মন্ত্রণা –
আরণ্যক ঊর্ণার বিস্তার :
সব মনে হয় যথাযথ |

মাঝে মাঝে,  জোনাকির মতো,
কোনো-এক মুহূর্তের কণা
জ্ব’লে উঠে মিলায় চকিতে
পন্থহীন অনিশ্চয়তায় |

কারো কাছে চাই শিখে নিতে
কাকে বলে ভাবনা, বেদনা,
ক্রন্দনের কৈলাস কোথায় |
আর কার চোখের তাকানো---
অত শান্ত,  অত ধৈর্যশীল---
শূন্যতার অন্তরে উন্মীল |
স্মৃতি --- সে কি রয়েছে এখনও ?

কোনোদিন ছিল এক নারী |
কিন্তু বাহু যত হয় গাঢ়,
আকাঙ্ক্ষায় সক্ষম সে আরো,
তীব্রতর বেগে উচ্ছলিত |
তাই হল স্বতই স্খলিত
অনিপুণ আলিঙ্গনকারী |

মাঝে-মাঝে পাতার মর্মরে
জেগে ওঠে ক্ষণিক চেতনা :
যেন এই ভ্রান্তির কুহক,
যার মধ্যে আমি আছি প’ড়ে –
কীটদষ্ট, শূন্যসার ত্বক্—
এও নয় অবোধ্য বঞ্চনা,
এও তার পক্ষে আবশ্যক |

সব যেন তারই আয়োজন,
স্বাদ, শাঁস, ঘনত্বও তার |
কিন্তু চাই পর্যাপ্ত আধার |
আমি তার পক্ষে প্রয়োজন |

সে-ই কর্ত্রী, আমি শুধু ছুতেও |
আমি দত্ত, সে-ই প্রতিশ্রুত
তারই স্থির অপেক্ষার তলে
ক্রমান্বয়ে আমি জায়মান---
যেখানে সে,  পরিশ্রমে ম্লান,
অদৃষ্টকে সৃষ্টি ক’রে চলে |

মনে হয়, আমাকে এবার
মেনে নিয়ে সত্তার বিরতি,
সব ইচ্ছা থেকে অপসৃত,
হতে হবে তার দক্ষ হাতে
বিচূর্ণিত, রূপান্তরিত,
যাতে অমাবৃক্ষের শাখায়
রক্তবর্ণ বর্তুল রেখায়
দীপ্ত ফল পারে সে ফলাতে ---
তারই শেষ পূর্ণ পরিণিতি |

# বাহুক শাপগ্রস্ত বিকৃতরূপ নলের ছদ্মনাম |

.                      *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর