শীতরাত্রির প্রার্থনা কবি বুদ্ধদেব বসু বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতা ( ১৯৪০ ) থেকে নেওয়া |
এসো, ভুলে যাও তোমার সব ভাবনা, তোমার টাকার ভাবনা, স্বাস্থের ভাবনা, . এর পর কী হবে, এর পর, ফেলে দাও ভবিষ্যতের ভয়, আর অতীতের জন্য মনস্তাপ | আজ পৃথিবী মুছে গেছে, তোমার সব অভ্যস্থ নির্ভর ভাঙলো একে-একে ;---রইলো হিম নিঃসঙ্গতা, আর অন্ধকার নিস্তাপ . রাত্রি ; --- এসো, প্রস্তুত হও |
বাইরে বরফের রাত্রি | ডাইনি-হাওয়ার কনকনে চাবুক গালের মাংস ছিড়ে নেয়, চাঁদটাকে কাগজের মতো টুকরো ক’রে ছিটিয়ে দেয় কুয়াশার মধ্যে, উপড়ে আনে আকাশ, হিংসুক হাত ছড়িয়ে দেয় হিম ; শাদা, নরম, নাচের মতো অক্ষরে . পৃথিবীতে মৃত্যুর ছবি এঁকে যায় |
তাহলে ডুবলো তোমার পৃথিবী, হারিয়ে গেলো চিরদিনের অভিজ্ঞান ; ফুল নেই, পাখি ডাকে না, নাম ধ’রে ভরা গলায় ডাকে না কেউ ; অচেনা দেশ, অস্থায়ী ঘর, শূন্য ঘরে নিঃসম্বল প্রাণ, আর বাইরে উত্তরের শীত, অন্ধকার, মেরু-হাওয়ায় ঢেউয়ের পর ঢেউ | . এই তো সময় ; ---সংহত হও |
সংহত হও, নিবিড় হও ; অতীত এখনো ফুরিয়ে যায়নি ভুলো না, যে-অতীত অপেক্ষা করে আছে তোমার জন্য, তারই নাম ভবিষ্যৎ ; যাবে, হবে, ফিরে পাবে | মুহূর্তের পর মুহূর্তের ছলনা কেবল চার বেঁধে রাখতে, লুকিয়ে রাখতে | কিন্তু তোমার পথ . চলে গেছে অনেক দূরে, দিগন্তে |
সেই প্রথম দিনে কে হাত রেখেছিলো তোমার হাতে, আজও তো . মনে পড়ে তোমার, যাতে মনে পড়ে, ভুলতে না পারো, তাই অনেক ভুলতে হবে তোমাকে, যাতে পথ চলতে ভয় না পাও, ফেলে দিতে হবে অনেক জঞ্জাল, . সাবধানের ভার, হ’তে হবে রিক্ত, হারাতে হবে যা-কিছু তোমার চেনা, যাতে পথের বাঁকে বাঁকে . পুরোনোকে চিনতেপারো, নতুন ক’রে |
এসো, আস্তে পা ফ্যালো, সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসো তোমার শূন্য ঘরে ;-- তুমি ভ’রে তুলবে, তাই শূন্যতা | তুমি আনবে উষ্ণতা, তাই শীত | এসো, ভুলে যাও তোমার টাকার ভাবনা, বাঁচার ভাবনা, হাজার ভাবনা--- . আর এর পরে তোমার দিকে এগিয়ে আসবে ভবিষ্যৎ, পিছন থেকে ধ’রে ফেলবে অতীত | . এসো, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও আজ রাত্রে |
তা-ই চাও তুমি, তারই জন্য তোমার বুভুক্ষা, এই মৃত্যুর হাতেই মুহূর্তের পর মুহূর্তের ছলনা হবে ছিন্ন ; যেমন তোমার চোখের সামনে পৃথিবী মরে গেলো আজ ---ফুল নেই, সব সবুজ নিবে গেছে, চারদিকে শুধু কঠিন শাদা স্তব্ধতার চিহ্ন--- . তেমনি তোমাকে ডুবতে হবে, তোমাকেও |
ডুবতে হবে মৃত্যুর তিমিরে, নয়তো কেমন ক’রে ফিরে আসবে আলোয় ? লুপ্ত হ’তে হবে পাতালে, নয়তো কেমন ক’রে ফিরে আসবে আলোয় ? তুমি কি জানো না, বার-বার মরতে হয় মানুষকে, বার-বার, দুলতে হয় মৃত্যু আর নবজন্মের বিরামহীন দোলায় . সত্যি যদি বাঁচতে হয় তাকে |
ডুবতে হবে মৃত্যুর তিমিরে, নয়তো কেমন ক’রে ফিরে আসবে আলোয় ? লুপ্ত হ’তে হবে পাতালে, নয়তো কেমন ক’রে ফিরে আসবে আলোয় ? তুমি কি জানো না, বার-বার মরতে হয় মানুষকে, বার-বার, দুলতে হয় মৃত্যু আর নবজন্মের বিরামহীন দোলায় . সত্যি যদি বাঁচতে হয় তাকে |
অন্ধকারকেই মৃত্যু নাম দিয়েছি আমরা | বীজ ম’রে যায়, যখন অদৃশ্য হয় মাটির তলায় সংগোপন গূঢ় গহ্বরে ; শীত এলে ম’রে যায় পৃথিবী, ঝ’রে যায় পাতা, নেয় বিদায় ঘাস, ফুল, ঘাস-ফড়িং ; নেকড়ে আসে বেরিয়ে ; কালো, কালো . নিষ্ঠুর কবরে . হারিয়ে যায় প্রাণ---ধবধবে তুষারের তলায় |
তেমনি তুমি ; --- তোমারও রোদ মরে গেলো, ঘন হয়ে ঘিরলো কুয়াশা, তোমার আলোর পৃথিবী ছেড়ে তুমি নেমে এলে পাতালে, তোমার রঙিন সাজ ছিঁড়ে গেলো, মুছে গেলো নাম, ভুলে গেলে . তোমার ভাষা, যত চোখ তোমাকে চিনেছিলো একদিন, সেই সব উত্সবের মতো . চোখের আড়ালে . তুমি মিলিয়ে গেলে --- অন্ধকার থেকে অন্ধকারে |
কিন্তু মাটির বুক চিরে লুপ্ত বীজ ফিরে আসে একদিন, আবার দেখা দেয়, অন্য নামে, নতুন জন্মে, রাশি রাশি ফসলের ঐশ্বর্যে ; আর এই শীত --- তুমি তো জানো প্রত্যেক ফোঁটা বরফের সঙ্গে . তারও শুধু জ’মে উঠছে ঋণ, সব শোধ ক’রে দিতে হবে ; প্রচ্ছন্ন প্রাণ অবিচল ধৈর্যে . জেগে আছে দীর্ঘ, দীর্ঘ রাত্রি |
শুধু জেগে আছে তাই নয়, কাজ ক’রে যাচ্ছে গোপনে-গোপনে, সৃষ্টি ক’রে যাচ্ছে মৃত্যুর বুকে নতুন জন্ম, কবর ফেটে অবুঝ অদ্ভুত উৎসারণ, পাথর ভেঙে স্রোত, বরফের নিথর আস্তরণে স্পন্দন – যখন ঘোমটা ছিঁড়ে উঁকি দেবে ক্ষীণ, প্রবল, উজ্জ্বল, আশ্চর্য সবুজ . বসন্তের প্রথম চুম্বনে |
আর তাই এই মৃত্যু তোমার প্রতীক্ষা --- তোমাকে তার যোগ্য হ’তে হবে, ভুলতে হবে সাবধানের দীনতা, হাজার ভাবনার জঞ্জাল ; সন্দেহ কোরো না, প্রতিবাদ কোরো না ; নিহিত হও এই কঠিন হিম ধবধবে আস্তরণের অন্তঃপুরে, বীজের মতো--- যেখানে অপেক্ষা ক’রে আছে . তোমার চিরকাল | . উৎসর্জন করো, সমর্পণ করো নিজেকে |
নিবিড় হ’লো রাত্রি, পাত্লা চাঁদ ছিঁড়ে গেলো, নেকড়ের মতো অন্ধকার, দলে-দলে ডাইনি বেরোলো হাওয়ায়., আততায়ীর ছুরির মতো শীত | এরই মধ্যে তোমার যজ্ঞ ; উত্সর্গ হবে প্রাণ, আগুন জ্বালবে আত্মার, ভস্ম হবে যাকে ভেবেছো তোমার ভবিষ্যৎ, আর যাকে জেনেছো তোমার অতীত | . পবিত্র হও, প্রতীক্ষা করো |
ঐ শোনো, ঘন্টা বাজে গির্জেতে ; এদের উৎসবের ক্ষণ আসন্ন | ঈশ্বরের একজাত, একমাত্র পুত্রের জন্মের স্মরণে ;--- কিন্তু তুমি---- তোমার শরীর ভিন্ন মাটিতে তৈরি, অন্য গান বাজে তোমার রক্তে, অন্য এক আশ্বাসের উচ্চারণে . ধ্বনিত তোমার ইতিহাসের আকাশ |
তুমি জেনেছো, মানুষমাত্রেই অমৃতের পুত্র--- শুধু একজন নয়, প্রত্যেকে, তুমি বলেছো, অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যাও, মৃত্যু থেকে অমৃতে, তুমি শুনেছো, জন্মের পর জন্মান্তর আবর্তের মতো এঁকে বেঁকে অমৃতের দিকে নিয়ে যায় ; --- আর এই জীবন, সেও তার সময়ের . সীমায়, মাংসের গণ্ডিতে . বন্দী হ’য়ে থাকবে না |
তাই তো জানো তুমি--- বার বার মরতে হয় মানুষকে, নতুন ক’রে . জন্ম নেবার জন্য শুধু জন্ম-জন্মান্তর নয়, একই জন্মে তার এই মৃত্যু আর পুনরুথ্বান, শুধু একজনের নয়, সকল মানুষের ---হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার অরণ্য লুকিয়ে রেখেছে চিরকাল এই বুভুক্ষা---- তারই জন্য সব কান্না, . সব কান্না-ভরা গান, . বুকে বুক রেখে তৃপ্তিহীন প্রেমিক |
তৃপ্তিহীন বিরহে তুমি জ্বলছো--- জ্বলতে দাও, পুড়ে যাক যা-কিছু . তোমার পুরোনো, ডিমের খোলশের মতো ফেটে যাক তোমার পৃথিবী, বেরিয়ে আসুক . অন্য এক জগৎ এই পাতাল বেয়ে নেমে যাও আরো, আরো অন্ধকারে ; যখন সব . হারাবে, কোনো চিহ্ন আর থাকবে না, তখনই তোমাকে ধ’রে ফেলবে অতীত, এগিয়ে আসবে . তোমার দিকে ভবিষ্যৎ--- . সব নতুন ---- নতুন হ’য়ে |
সময় হ’লো, বাইরে অনাকার অন্ধকার, প্রেতের চীত্কারের মতো হাওয়া ; অচেনা দেশ, অস্থায়ী ঘর, শূন্য ঘরে নিঃসম্বল প্রাণ ; আজ আর কিছু নেই তোমার--- শুধু একফোঁটা রক্তে-লীন সংগোপন . ঝাপসা পথ-চাওয়া এই ব্যাপ্ত কুয়াশার মধ্যে ক্ষীণ, ক্ষণিক, লুকিয়ে-থাকা তারার মতো . কম্পমান | . প্রস্তুত হও, প্রতীক্ষা করো তোমার মৃত্যুর জন্য |
যে- মৃত্যুকে ভেদ করে লুপ্ত বীজ ফিরে আসে নির্ভুল, রাশি-রাশি শস্যের উত্সাহে, ফসলের আশ্চর্য সফলতায়, যে-মৃত্যুকে দীর্ণ ক’রে বরফের কবর ফেটে ফুল জ্ব’লে ওঠে সবুজের উল্লাসে, বসন্তের অমর ক্ষমতায়--- . সেই মৃত্যুর--- নবজন্মের প্রতীক্ষা করো |
মৃত্যুর নাম অন্ধকার ; কিন্তু মাতৃগর্ভ --- তাও অন্ধকার, ভুলো না তাই কাল অবগুন্ঠিত, যা হ’য়ে উঠছে তা-ই প্রচ্ছন্ন ; এসো, শান্ত হও ; এই হিম রাত্রে, যখন বাইরে-ভেতরে কোথাও . আলো নেই, তোমার শূন্যতার অজ্ঞাত গহ্বর থেকে নবজন্মের জন্য . প্রার্থনা করো, প্রতীক্ষা করো, প্রস্তুত হও |
চিল্কায় সকাল কবি বুদ্ধদেব বসু বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতা ( ১৯৪০ ) থেকে নেওয়া |
কী ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায় . কেমন ক’রে বলি | কী নির্মল নীল এই আকাশ, কী অসহ্য সুন্দর, যেন গুণীর কন্ঠের অবাধ উন্মুক্ত তান . দিগন্ত থেকে দিগন্তে :
কী ভালো আমার লাগলো এই আকাশের দিকে তাকিয়ে ; চারদিক সবুজ পাহাড়ে আঁকা বাঁকা, কুয়াশার ধোঁয়াটে, . মাঝখানে চিল্কা উঠছে ঝিলকিয়ে |
তুমি কাছে এলে, একটু বসলে, তারপর গেলে ওদিকে, ইস্টেশনে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, তা-ই দেখতে | গাড়ি চ’লে গেলো ! --- কি ভালো তোমাকে বাসি, . কেমন ক’রে বলি |
আকাশে সূর্যের বন্যা, তাকানো যায় না | গোরুগুলো একমনে ঘাস ছিঁড়ছে, কী শান্ত ! --- তুমি কি কখনো ভেবেছিলে এই হ্রদের ধারে এসে আমরা পাবো . যা এতদিন পাইনি |
রুপোলি জল শুয়ে-শুয়ে স্বপ্ন দেখছে, সমস্ত আকাশ নীলের স্রোতে ঝড়ে পড়ছে তার বুকের উপর সূর্যের চুম্বনে | --- এখানে জলে উঠবে অপরূপ ইন্দ্রধনু তোমার আর আমার রক্তের সমুদ্রকে ঘিরে . কখনো কি ভেবেছিলে ?
কাল চিল্কায় নৌকোয় যেতে যেতে আমরা দেখেছিলাম দুটো প্রজাপতি কত দূর থেকে উড়ে আসছে জলের উপর দিয়ে |----কী দুঃসাহস ! তুমি হেসেছিলে, আর আমার . কী ভালো লেগেছিলো
তোমার সেই উজ্জ্বল অপরূপ সুখ | দ্যাখো, দ্যাখো কেমন নীল এই আকাশ |--- আর তোমার চোখে কাঁপছে কত আকাশ, কত মৃত্যু, কত নতুন জন্ম . কেমন ক’রে বলি |
রাত তিনটের সনেট : ১ কবি বুদ্ধদেব বসু বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতা ( ১৯৪০ ) থেকে নেওয়া |
শুধু তা-ই পবিত্র, যা ব্যক্তিগত | গভীর সন্ধ্যায় নরম, আচ্ছন্ন আলো ; হলদে-ম্লান বইয়ের পাতার লুকোনো নক্ষত্র ঘিরে আকাশের মতো অন্ধকার ; অথবা অত্বর চিঠি, মধ্যরাতে লাজুক তন্দ্রায় দূরের বন্ধুকে লেখা | যীশু কি পরোপকারী ছিলেন, তোমরা ভাবো না কি বুদ্ধ কোনো সমিতির মাননীয়, বাচাল, পরিশ্রমী, অশীতির মোহগ্রস্ত সভাপতি ? উদ্ধারের স্বত্বাধিকারী
ব্যতিব্যস্ত পাণ্ডাদের জগঝম্প, চামর, পাহারা এড়িয়ে আছেন তাঁরা উদাসীন, শান্ত ছন্নছাড়া | তাই বলি, জগতেরে ছেড়ে দাও, যাক সে যেখানে যাবে ;
হও ক্ষীণ, অলক্ষ্য, দুর্গম আর পুলকে বধির | যে-সব খবর নিয়ে সেবকেরা উত্সাহে অধীর, আঁধ ঘন্টা নারীর আলস্যে তার ঢের বেশি পাবে |
এ নয় তোমার জন্য | শুধু বই আজও আছে খোলা | যারা হাসে, মন্ত্র পড়ে, টুংটাং চায়ের টেবিলে, তারাই, শোবার আগে, পরশির আলো নিবে গেলে হয়ে যায় ভাঁড়ারঘরের ব্যস্ত ইঁদুর, আরশোলা ; যুদ্ধ করে, খুঁটে খায় ; নিমন্ত্রণে অভ্যর্থনার অস্তিত্ব না জেনে শুধু উচ্ছিষ্টেরে ভাবে ইতিহাস | এ নয় তোমার জন্য | ফুল, ফল, ঋতু, বারো মাস ঘুরে-ঘুরে যা বলে তা শিখে নাও | ঠিকানা রেখো না আর
কোনোখানে ---বাষ্পলীন, ধবল, সরল ডিসেম্বরে বিস্মৃত, চক্রান্তকারী, নিরুদ্দেশ বসন্তের মতো যাও দূরে, দেশান্তরে, সাগরের শেষ দ্বীপান্তরে ;
কে তুমি, সুন্দরী, যার বিন্দু-বিন্দু অশ্রু ঝ’রে ভেসে যায় পদ্ম হ’য়ে নদীর সচ্ছল স্রোতে অবিরল ? কোন প্লুত নীলিমায় লিপ্ত তুমি ? কোন পুণ্যজল তোমার লাবণ্যসার আপনার তরঙ্গে মেশায় ? রোদনরূপসী, তুমি কেন কাঁদো ? অশ্রু কেন পদ্ম হ’য়ে ফোটে ? কেন তার হিরণ্ময়ী অভিমান দিগন্তেও হয় না বিলীন ? কোন মন্ত্রে এই দিন অফুরান ? মহাকবি দেন নি উত্তর, শুধু বলে গিয়েছেন দেবতারা তোমার অধীন |
দুঃসাহস –-তবু বলি | মনে হয় কোনো -এক দূর জন্মান্তরে তুমি ছিলে আমার একান্ত চেনা--- অন্তরঙ্গ, অবিস্মরণীয় | সেদিন আমার কান্না তুমি কেঁদেছিলে ! আমিও জলের কলস্বরে কান পেতে শুনেছি, কেমনে ধায় তোমার আজ্ঞায় মুগ্ধ পঞ্চভূত, যুদ্ধ ভুলে , ছন্দের অঞ্জলি হটয়ে রূপ নেয় আকাশে আলোকে | অগাধ ঐশ্বর্য ছিল --- তখন অমল এক বিশ্ব ছিল | সেদিন তোমার,
ছিল ঋতু, দ্যুলোক, সবিতা : তবু ছিল, আমাকে তোমার প্রয়োজন | মনে পড়ে সেই দূর স্বপ্নলোকে, আদিম ঊষার লগ্নে আমি তা-ই তোমাকে দিয়েছিলাম, যা তোমার তখন ছিল না জানা --- যা ছিল না আলোর প্লাবনে কিংবা জলের হিল্লোলে --- অভাব-বিচ্ছেদবোধ-স্বপ্ন-স্মৃতি-হৃদয়স্পন্দন ! সেই থেকে নিখিলের রাজ্ঞী তুমি, ইন্দ্র হল অকস্মাৎ অসহায়, স্বর্গের ছলনাপ্রান্তে সে-অশ্রুপুলক চলে অন্তহীন ;---- শুধু আমি মাঝে-মাঝে ভুলে যাই, খ’সে পড়ি যন্ত্রণার অন্ধকূপে, শূলবিদ্ধ শূকরের মতো নড়ি, জীবনের অজ্ঞান চেষ্টায় |
কারো কাছে চাই শিখে নিতে কাকে বলে ভাবনা, বেদনা, ক্রন্দনের কৈলাস কোথায় | আর কার চোখের তাকানো--- অত শান্ত, অত ধৈর্যশীল--- শূন্যতার অন্তরে উন্মীল | স্মৃতি --- সে কি রয়েছে এখনও ?
কোনোদিন ছিল এক নারী | কিন্তু বাহু যত হয় গাঢ়, আকাঙ্ক্ষায় সক্ষম সে আরো, তীব্রতর বেগে উচ্ছলিত | তাই হল স্বতই স্খলিত অনিপুণ আলিঙ্গনকারী |
মাঝে-মাঝে পাতার মর্মরে জেগে ওঠে ক্ষণিক চেতনা : যেন এই ভ্রান্তির কুহক, যার মধ্যে আমি আছি প’ড়ে – কীটদষ্ট, শূন্যসার ত্বক্— এও নয় অবোধ্য বঞ্চনা, এও তার পক্ষে আবশ্যক |
সব যেন তারই আয়োজন, স্বাদ, শাঁস, ঘনত্বও তার | কিন্তু চাই পর্যাপ্ত আধার | আমি তার পক্ষে প্রয়োজন |
সে-ই কর্ত্রী, আমি শুধু ছুতেও | আমি দত্ত, সে-ই প্রতিশ্রুত তারই স্থির অপেক্ষার তলে ক্রমান্বয়ে আমি জায়মান--- যেখানে সে, পরিশ্রমে ম্লান, অদৃষ্টকে সৃষ্টি ক’রে চলে |
মনে হয়, আমাকে এবার মেনে নিয়ে সত্তার বিরতি, সব ইচ্ছা থেকে অপসৃত, হতে হবে তার দক্ষ হাতে বিচূর্ণিত, রূপান্তরিত, যাতে অমাবৃক্ষের শাখায় রক্তবর্ণ বর্তুল রেখায় দীপ্ত ফল পারে সে ফলাতে --- তারই শেষ পূর্ণ পরিণিতি |