নদীর বুকে বৃষ্টি পড়ে, . জোয়ার এল জলে ; লুকিয়ে-রাখা আশার মতো বাঁশের ফাঁকে ইতস্তত একটি-দুটি ম্লান জোনাক . ক্কচিৎ নেবে জ্বলে | আকাশ- ভরা মেঘের ভারে . বিদ্যুতের ব্যথা গুমরে উঠে জানায় শুধু . অবোধ আকুলতা | আকারহীন, হিংস্র, খল, অনিশ্চিত ফেনিল জল মিলিয়ে গেল অদৃষ্টের . মৌন ইশারাতে ;-- তোমায় আমি রেখে এলাম . ঈশ্বরের হাতে |
তাকিয়ে-থাকা একটি দীপ . জ্বলছে ছোটো ঘরে, একটি হাত এলিয়ে আছে কম্পমান বুকের কাছে ছিন্ন-স্মৃতি-শেলাই-করা . শীতল কাঁথার ‘পরে | মনে পড়ার ইন্দ্রজালে . ঝাপসা হল দ্বার, আমার হাতে লাফিয়ে ওঠে . তীক্ষ্ণ তলোয়ার | সুদূর কালে হারিয়ে-যাওয়া দেশান্তরী উঠল হাওয়া :-- ছেলেবেলার গন্ধ ভরা . অন্ধকার রাতে আমার প্রেম রেখে এলাম . ঈশ্বরের হাতে |
পালের ভাঁজে ভবিষ্যের . গর্ভ ওঠে ফুলে, অনাগতের রুদ্ধ চাপে পাটাতনের পাঁজর কাঁপে, ত্রস্ত মাছের অস্থিরতায় . গলুই ওঠে দুলে | কঠিন হাতে নাবিক ধরে . আকাঙ্ক্ষার হাল, কপট স্রোতে ভাসে আমার . মৃতদেহের ছাল | হৃদয়-তলে দাঁড়ের টানে অমর নাম প্রলয় আনে ঢেউয়ের আর দিগন্তের . মাতাল সংঘাতে ;--- আমার প্রাণ রেখে এলাম . ঈশ্বরের হাতে |
উল্টোদিকে ছুটল আমার . আঁধার আরাধনা ; অসীম নীল ঘুমের ‘পরে যন্ত্রণায় জড়িয়ে ধরে মুক্তিহীন জাগরণের . মূর্খ প্রতারণা | তবুও আছে একটি ঘর . কুঞ্জলতায় ঘেরা, দাওয়ায় বসে জটলা করে . পূর্বপুরুষেরা | তাঁদের মৃদু কানাকানি পড়ুক ঝরে সাবধানী হাজার ভয়, সংশয়ের . অন্ধ অজানাতে, আমি তোমায় রেখে এলাম . ঈশ্বরের হাতে |
সকাল থেকেই বৃষ্টির পালা শুরু, আকাশ-হারানো আঁধার-জড়ানো দিন | আজকেই, যেন শ্রাবণ করেছে পণ, শোধ করে দেবে বৈশাখী সব ঋণ | রিমঝিম ঝরে অঝোরে অন্ধ ধারা, ঘনবর্ষণে আপাত-আত্মহারা পৃথিবীতে যেন দিন নেই, রাত নেই ; স্তম্ভিত কাল মেঘ-মায়ালোকে লীন |
পথের পাথরে উঠছে জলের ধোঁয়া, উঁচু গাছগুলি মাথা নিচু ক’রে চুপ ; বস্তুগলিত তরলিত এই দিনে সেই ভালো হয়, সব যদি যায় খোয়া | তবু ন-টা বাজে, তবু ছাতা হাতে নিয়ে ট্রামে চ’ড়ে বসি আপিশের অভিসারে, কেরানিকীর্ণ খাঁচার রন্ধ্র দিয়ে থেকে-থেকে লাগে সিক্ত কোমল ছোঁয়া |
লুপ্ত, নিভৃত, অমর্ত্য এ-দিনেও মস্ত শহর ব্যস্ত মুখর কাজে, মানুষ-মূষিক বন্দী যে-পিঞ্জরে আজো খোলা আছে গোগ্রাসী তার হাঁ-যে | তারই অদম্য অনতিক্রম্য টানে অগণ্য ছাতা পথ করে আছে কালো, বিত্তশালীও মুক্ত-ইচ্ছা নয়, কর্মঠ মুখে চলেছে মোটরযানে |
আমি সেই ভিড়ে নিঃশেষে মিশে গিয়ে চলি একাগ্র নিরুপাধি, নামহীন | হাড় থেকে কেউ নিংড়ে নিয়েছে মজ্জা, পায়ে-পায়ে বাজে জীর্ণ জুতোর লজ্জা, ব্যর্থ জীবন মূর্ত করেছে যেন দু-দিনের দাড়ি, রজকরহিত সজ্জা | জীবন-ডোবানো বৃষ্টি যখন ঝরে সময়-হারানো স্বপ্ন-জড়ানো দিনে, শ্রাবণ-তাড়ানো উগ্র-বিজলি-জ্বলা শত নিশ্বাসে আবিল রুদ্ধ ঘরে আজ বাঁধা পড়ে আগামী কালের ঋণে |
দিন শেষ হয় ; বৃষ্টিশেষের নেশা নিষ্ক্রিয় মেঘে এখনও থমকি আছে, ক্ষণিক হলুদ-সবুজ-সোনার মেশা অলীক সন্ধ্যা পুন বর্ষণ যাচে | আহা, সুন্দর এ-পৃথিবী, এ-জীবন, বিনামূল্যেই অমূল্যতম দান, পণ্যরাশির জঘন্য অনটন দেহধারীটারে যত দুঃখই দিক অতল অগমে মুক্ত আমার প্রাণ | জীবিকা-যন্ত্র যখনই দিয়েছে ছাড়া তখনই শ্রাবণ পরালো আমার বুকে সোনায় শ্যামল গাঁথা তার মালাগাছি কত ভাগ্য যে বেঁচে আছি, বেঁচে আছি | ক্লান্ত, মুক্ত, বিক্ষত, উত্সুক, ক্ষুদ্র গৃহের দুর্গে চলেছি ফিরে, কখনও আবার পাব না যে দিনটিরে তারই শেষ স্মৃতি এখনও আকাশে আঁকা | গলিটা বিশ্রী, পিচ্ছিল, আঁকাবাঁকা, অসতর্কের বেঁধে কর্কশ খোয়া, পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে ওঠে তর্কের ধোঁয়া | বিষণ্ণতার নিঃসাড়তার নেশা আমার বুকের নিশ্বাস কেড়ে নিয়ে বিশ্বের ছবি মুছে দেয় মন থেকে | --- ভাঙল চমক বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে |
মৃদু ভঙ্গিতে আধেক দুয়ার ধ’রে দাঁড়িয়ে আছে সে রঙিন শাড়িটি প’রে, মাথার উপরে আধেক ঘোমটা টানা আধেক ফেরানো মুখটি আড়াল ক’রে | সব কেড়ে নিতে পারে নি দিনের ফাঁকি, তবু আছে রাত, তবু কিছু আছে বাকি, শূন্য মনের সুপ্তির গহ্বরে পূর্ণতা এনে স্বপ্নের রেখাপাতে সন্ধ্যাদীপের প্রতীক্ষা জ্বলে যেন একখানা ক্ষীণ, কনকরিক্ত হাতে |
মনে হ’ল তারে চিনি, তবু চিনি না যে, বুঝি না কী-কথা কেমন ছন্দে বলি, দরিদ্রতার লক্ষ ছিদ্র ভ’রে অবাধ, অগাধ, বিশাল শ্রাবণ ঝরে কদম্ববনে বিকশে অন্ধ গলি | হৃদয়-রূপক কিছু নেই, কিছু নেই, নেই বেলফুল, রজনীগন্ধা. জুঁই, চুপ ক’রে শুধু চেয়ে থাকি তার মুখে, চোখ দিয়ে শুধু কালো চোখদুটি ছুঁই | চিরন্তনীর অলক্ষ্য অভিসার পার হ’য়ে এসে তুচ্ছের বঞ্চনা বলে কানে-কানে, ‘আমার অঙ্গীকার ভুলব না আমি, কোনোদিন ভুলব না |’
বন্দীর বন্দনা কবি বুদ্ধদেব বসু সুকুমার সেন সম্পাদিত “বাংলা কবিতা সমুচ্চয়” ১খণ্ড (১৯৯১ )থেকে নেওয়া |
প্রবৃত্তির অবিচ্ছেদ্য কারাগারে চিরন্তন বন্দী করি রচেছ আমায় নির্মম নির্মাতা মম ! এ কেবল অকারণ আনন্দ তোমার ! মনে করি, মুক্ত হব ; মনে ভাবি, রহিতে দিব না মোর তরে এ-নিখিলে বন্ধনের চিহ্নমাত্র আর | রুক্ষ দস্যু বেশে তাই হাস্যমুখে ভেসে যাই উচ্ছ্বসিত স্বেচ্ছাচার-স্রোতে, উপেক্ষিয়া চলে যাই সংসার সমাজ গড়া লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র কন্টকের নিষ্ঠুর আঘাত ; দাসত্বের স্নেহের সন্তান সংস্কারের বুকে হানি তীব্র তীক্ষ্ম রূঢ় পরিহাস, অবজ্ঞার কঠোর ভর্ৎসনা | মনে ভাবি, মুক্তি বুঝি কাছে এল--- বিশ্বের আকাশে বহে লাবণ্যের মৃত্যুহীন স্রোত |
তারপরে একদিন অকস্মাৎ বিস্ময়ে নেহারি--- কোথা মুক্তি ? সহস্র অদৃশ্য বাধা নিশিদিন ঘিরে আছে মোরে, যতই এড়ায়ে চলি, ততই জড়ায়ে ধরে পায়ে, রোধ করে জীবনের গতি | সে-বন্ধন চলে মোর সাথে সাথে জীবনের নিত্য অভিসারে সুন্দরের মন্দিরের পানে | সে বন্ধন মগ্ন করি রেখেছে আমারে আকন্ঠ পঙ্কের মাঝে | সে-বন্ধন লক্ষ লক্ষ লাঞ্ছনার বীজাণুতে কুলষিত করিয়াছে নিশ্বাসের বাতাস আমার— লোহিত শোণিত মম নীল হয়ে গেছে সে-বন্ধনে | ক্ষণ তরে নহি মুক্ত; কর্ম মাঝে, মর্ম মাঝে মোর, প্রতি স্বপ্নে, প্রতি জাগরণে, প্রতি দিবসের লক্ষ বাসনা আশায় আমারে রেখেছ বেঁধে অভিশপ্ত, তপ্ত নাগ পাশে সৃজন ঊষার আদি হ’তে-- উদাসীন স্রষ্টা মোর ! মুক্তি শুধু মরীচিকা সুমধুর মিথ্যার স্বপন, আপনার কাছে মোরে করিয়াছ বন্দী চিরন্তন |
পথে-পথে পায়ে-হাঁটা লক্ষ-লক্ষ শব্দহীন শোক ; গঙ্গাতীরে নম্র, শান্ত সমতার সূর্যাস্ত-মমতা ; মুদ্রাযন্ত্রে আর্ত রোল ; রেডিওতে ধরে-আসা গলা--- থেমে যাবে, শেষ হবে, শেষ হল : তারপর ?
দুঃখ তার দয়ার সুন্দর হাতে ধরে আছে এই রাত্র্রির পবিত্র রক্ত ; যত ঝরে, তত ধরে হাতে | কিন্তু রক্ত ঝরে যাবে, কিন্তু এই কান্নার পরেও আবার অব্যর্থ ভোর ঘরে-ঘরে জাগাবে : --- তখন ?
জাগাবে আবার জ্বালা, বাঁচার ভীষণ জ্বালা, যার যন্ত্রণায় ঘরকন্না গুঁড়ো হয়, রাজত্ব ধুলোয় মেশে, কাঁপে মন্ত্রী, গৃহিণী, মজুর ক্ষমাহীন এই বাঁচা আবার পাঠাবে প্রশ্ন, যার উত্তর দিতেই হবে : তখন ? --- তখন ?
এলা-দি কবি বুদ্ধদেব বসু ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত “শুধু আবৃত্তির জন্য” থেকে নেওয়া |
পুরোনো পাড়া, ট্রাম থেকে দূরে ; ব্যস্ততা, ভিড়, খাটুনির বাইরে ; বড়ো-বড়ো গাছের ছায়ায় গম্ভীর---আমি সেখানে সময় পেলেই যাই, এলা-দিকে দেখতে | . ‘দেখতে’ কথাটাই ঠিক | কেননা আমি, ছেলেমানুষ, সবেমাত্র উনিশ আমার বয়স, কোন কথা আমি বলতে পারি এলা-দিকে, যা এর আগে অন্য অনেকে গুনগুন করেনি তাঁর কানে— সেই সব ভাগ্যবানের দল, কয়েক বছর আগে জন্মাবার সুযোগ পেয়ে আমার জন্যে কিছই আর বাকি রাখেনি যারা ! . মস্ত ঘর, ঘর পেরিয়ে বারান্দা | বাইরে চৈত্র মাসের দুপুর, তেতে উঠছে রোদ্দুর, ধুলোর ঘূর্ণি শিরশির ক’রে ব’য়ে যায় | কিন্তু এখানে ঠাণ্ডা, ঝাপসা আলোয় চোখের সুখ ছড়ানো, শব্দ নেই | সবুজে চিকে আব্রু-ঘেরা এই বারান্দা, ফাঁকে-ফাঁকে রোদের ফিতে কেঁপে ওঠে, আর তাতে গ’লে-গ’লে মিশে যায় পর্দার রং, দেয়ালের রং, দেয়ালে ঝোলানো ছবির আভা উজ্জ্বল, কোণে দাঁড়ানো শৌখিন গাছের হালকা-সবুজ | সবুজ আভা, হলদে আর সবুজ আর বেগনি আভা ; জলে ডুব দিলে যেমন দেখায়, তেমনি ; যেন বাতাস জুড়ে গুচ্ছ-গুচ্ছ আঙুর--- তেমনি ঠাণ্ডা, আর উষ্ণ, আর সম্ভোগের আভাসে ভরপুর | . কুশান-আঁটা শিঙাপুরি বেতের চেয়ারে এলিয়ে বসেন এলা-দি, শান্তিনিকেতনি চামড়া-বাঁধানো মোড়ায় পা রেখে | পাৎলা তাঁর পা দুটি, তাঁর মুখের চেয়েও ফর্শা, নীলচে সরু শিরায় আরো সুন্দর ; তাঁকে দেখার আগে আমি কখনো ভাবিনি মানুষের পায়েরও এত রূপ হ’তে পারে | আমি তাকিয়ে থাকি সেই পায়ের দিকে, যেখানে লুটিয়ে পড়ে তাঁর শাড়ির পাড় ময়ূরের বুকের মতো নীল ; তিনি সামনের দিকে একটু ঝুঁকে সিগারেট ধরান | যখন তাঁর মুখ থেকে ধোঁয়া বেরোয়, আমি বুক ভ’রে নিশ্বাস টানি, নিশ্বাসে তাঁর বিলেতি সিগারেটের সুবাস পাই, আর সেই সঙ্গে, ইঞ্জেকশনের ছুঁচের মতো, আমাকে বেঁধে জানি না কোন অদ্ভুত নামের সুগন্ধ | আমার মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করে উঠে---- নিজেকে এত হালকা মনে হয় যেন আমি পাখির মতো উড়ে যেতে পারি | . গাছ থেকে শুকনো পাতার মতো, তাঁর ঠোঁট থেকে একটি-দুটি কথা যখন খসে পড়ে, শুধু তখন আমি তাঁর মুখের দিকে তাকাই | চোখে চোখ পড়লে একটু হাসেন এলা-দি ; লিপস্টিকে রাঙানো ঠোঁটের ফাঁকে তাঁর দাঁতের সারি এত উজ্জ্বল যে আমি তখনই মাথা নিচু করি--- পাছে ভব্যতার সীমা পেরিয়ে যায় | তাছাড়া আমার অন্য কথাও মনে পড়ে | . মনে পড়ে আমার কাকিমাকে --- এঁদো গলির একতলায় যাঁর বাসা, যাঁর দিনের মধ্যে ছয় ঘন্টা কাটে রান্নাঘরে, যাঁর পাঁচটি ছেলেমেয়ে ছোটো-হয়ে-যাওয়া জামা পরে ঘুরে বেড়ায়, যিনি দিনে-দিনে ফ্যাকাশে আর রোগা হয়ে যাচ্ছেন, অথচ এখনো ডাক্তার ডাকা হচ্ছে না পাছে কোনো শক্ত অসুখ ধরা পড়ে | অথচ তাঁরও ছিলো রূপ--- সেই ভগবানের দান, মানুষের যত্ন ছাড়া যা বেশিদিন বাঁচে না | . মনে পড়ে আমাদের ঠিকে-ঝি হরিমতিকে--- সকাল থেকে সন্ধ্যা যে বাড়ি-বাড়ি ঘুরে বাসন মাজে, যার মুখের মধ্যে দুটো মাত্র দাঁত আছে এখন, আর সে-দুটো ঝুলে-পড়া প্রকাণ্ড আর নোংড়া হলুদ | তাকে দেখে এখন আর স্ত্রীলোক বলে মনে হয় না ; তার শরীর যেন এক ফালি তক্তা ; আর তার মুখ যেন মেয়েরও নয়, পুরুষেরও নয় | খুব কম কথা বলে সে, শুধু পিঠ বাঁকিয়ে কাজ করে যায় ; শুধু কাজ, শুধু বেঁচে থাকা, যে-কোনো রকমে নিছক বেঁচে থাকা শুধু-এ ছাড়া তার অন্য কিছুরই সময় নেই | তার দিকে তাকাতে আমার লজ্জা করে | . আর এলা-দি যখন বিছানা ছাড়েন, তখন তাঁর স্বামীর আপিশের গাড়ি তৈরি ; উঠে কফি খান, স্নানে ও প্রসাধনে বাজে এগারোটা, তারপর হয় গাড়ি নিয়ে সওদায় বেরোন, নয় গালগল্প করেন টেলিফোনে, আর নয়তো এই বারান্দায় বসে ছবিওলা বিদেশী পত্রিকার পাতা ওল্টান | বাড়ি সাজানো, শরীর সাজানো, বিকেলের দিকে ঘন্টাখানেক ঘুম, সপ্তাহে পাঁচটা-ছটা পার্টি, নানা দেশের ধনী মানী বন্ধু, মাঝে গ্যাংটকে বা কলম্বোতে বা বার্সেলোনায় বেড়াতে যাওয়া | সব শ্রম, সব কষ্ট, সব দম-আটকানো অন্ধকূপের উত্তরে এলা-দির আলস্য একটি সুন্দর গাছের মতো ছড়িয়ে আছে, পাতায়-পাতায় অজস্র আর সবুজ, রঙিন ফুল অনবরত ফুটে উঠছে, কিন্তু কখনো ফল ধরে না |
তবু বলি : এলা-দি, তুমি এমনি থেকো চিরকাল ; কখনো কোনো সমিতির নামে সমাজ-সেবা কোরো না, চাঁদা দিয়ো না উদ্ধারকারীদের, হঠাৎ কোনো বিবেকপীড়ায় রুক্ষ হয়ে যেয়ো না | এমনি থেকো---এমনি সুখী ও বিশ্রান্ত. সুন্দর ও সুগন্ধি, আর এমনি নিষ্প্রয়োজন |
সাগর--দোলা কবি বুদ্ধদেব বসু কবি মেঘ বসু সংকলিত ও সম্পাদিত “হে প্রেম” থেকে নেওয়া |
ছোটো ঘরখানি মনে কি পড়ে, সুরঙ্গমা ? মনে কি পড়ে ? মনে কি পড়ে ? জানালায় নীল আকাশ ঝরে, সারাদিনরাত হাওয়ার ঝড়ে সাগর-দোলা, সারাদিনরাত ঢেউয়ের তোড়ে নাগর-দোলা, আকাশ-মাতাল জানালা খোলা দিগন্ত থেকে দিগন্তরে, দিগন্ত-জোড়া সাগর ভ’রে ঢেউয়ের দোলা | সারাদিনরাত হাজার ঢেউয়ের উচ্চস্বরে অন্ধ অবোধ হাওয়ার ঝড়ে কী যে লুটোপুটি ছুটোছুটি ওই ছোট্ট ঘরে মনে কি পড়ে ? মনে কি পড়ে ? কত কালো রাতে করাতের মতো চিরে ভাঙাচোরা চাঁদ এসেছে ফিরে তীক্ষ্ণ তারার নিবিড় ভিরে ভাঙন এনে, কত কৃশ রাতে চুপে-চুপে চাঁদ এসেছে ফিরে সাগরের বুকে জোয়ার হেনে তোমাকে আমাকে অন্ধ অতল জোয়ারে টেনে মনে কি পড়ে ? কত উদ্ধত সূর্যের বাণে তুমি আর আমি গিয়েছি ছিঁড়ে, কত যে দিনের চুম্বন টেনে দিয়েছি মুছে, কত যে আলোর শিশুরে মেরেছি হেসে, সেই ছোটো ঘরে মনে কি পড়ে সুরঙ্গমা, মনে কি পড়ে ? জানালায় নীল আকাশ ঝরে সারাদিনরাত ঢেউয়ের দোলা, সমুদ্র-জোড়া দিগন্ত থেকে দিগন্তরে সারাদিনরাত জানালা খোলা দস্যু হাওয়ার উচ্চস্বরে তপ্ত ঢেউয়ের মত্ত জোয়ার-জ্বরে কী যে তোলপাড় দাপাদাপি ওই ছোট্ট ঘরে, মনে কি পড়ে, সুরঙ্গমা ? মনে কি পড়ে তোমার আমার রক্তে হাজার ঝড়ে কত সমুদ্র তপ্ত জোয়ার জ্বরে মনে কি পড়ে ? কত মৃত চাঁদে এনেছি ফিরায়ে রাত্রিশেষে কত বর্বর শিশু-সূর্যেরে মেরেছি হেসে ঘন-চুম্বন-বন্যায় কোন অন্ধ অতলে গিয়েছি ভেসে মনে কি পড়ে সুরঙ্গনা মনে কি পড়ে ?