বুদ্ধদেব বসুর কবিতা
*
সমর্পণ
কবি বুদ্ধদেব বসু
কবি দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়কবি দীপক রায় সম্পাদিত  “বাংলা আধুনিক কবিতা ১”
(১৯৯২) থেকে নেওয়া |    


নদীর বুকে বৃষ্টি পড়ে,
.        জোয়ার এল জলে ;
লুকিয়ে-রাখা আশার মতো
বাঁশের ফাঁকে ইতস্তত
একটি-দুটি ম্লান জোনাক
.        ক্কচিৎ নেবে জ্বলে |
আকাশ- ভরা মেঘের ভারে
.        বিদ্যুতের ব্যথা
গুমরে উঠে জানায় শুধু
.        অবোধ আকুলতা |
আকারহীন, হিংস্র, খল,
অনিশ্চিত ফেনিল জল
মিলিয়ে গেল অদৃষ্টের
.        মৌন ইশারাতে ;--
তোমায় আমি রেখে এলাম
.        ঈশ্বরের হাতে |

তাকিয়ে-থাকা একটি দীপ
.        জ্বলছে ছোটো ঘরে,
একটি হাত এলিয়ে আছে
কম্পমান বুকের কাছে
ছিন্ন-স্মৃতি-শেলাই-করা
.        শীতল কাঁথার ‘পরে |
মনে পড়ার ইন্দ্রজালে
.        ঝাপসা হল দ্বার,
আমার হাতে লাফিয়ে ওঠে
.        তীক্ষ্ণ তলোয়ার |
সুদূর কালে হারিয়ে-যাওয়া
দেশান্তরী উঠল হাওয়া :--        
ছেলেবেলার গন্ধ ভরা
.        অন্ধকার রাতে
আমার প্রেম রেখে এলাম
.        ঈশ্বরের হাতে |

পালের ভাঁজে ভবিষ্যের
.        গর্ভ ওঠে ফুলে,
অনাগতের রুদ্ধ চাপে
পাটাতনের পাঁজর কাঁপে,
ত্রস্ত মাছের অস্থিরতায়
.        গলুই ওঠে দুলে |       
কঠিন হাতে নাবিক ধরে
.        আকাঙ্ক্ষার হাল,
কপট স্রোতে ভাসে আমার
.        মৃতদেহের ছাল |
হৃদয়-তলে দাঁড়ের টানে
অমর নাম প্রলয় আনে
ঢেউয়ের আর দিগন্তের
.        মাতাল সংঘাতে ;---
আমার প্রাণ রেখে এলাম
.        ঈশ্বরের হাতে |

উল্টোদিকে ছুটল আমার
.        আঁধার আরাধনা ;
অসীম নীল ঘুমের ‘পরে
যন্ত্রণায় জড়িয়ে ধরে
মুক্তিহীন জাগরণের
.        মূর্খ প্রতারণা |
তবুও আছে একটি ঘর
.        কুঞ্জলতায় ঘেরা,
দাওয়ায় বসে জটলা করে
.        পূর্বপুরুষেরা |
তাঁদের মৃদু কানাকানি
পড়ুক ঝরে সাবধানী
হাজার ভয়, সংশয়ের
.        অন্ধ অজানাতে,
আমি তোমায় রেখে এলাম
.        ঈশ্বরের হাতে |

.            *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
বর্ষার দিন
কবি বুদ্ধদেব বসু
কবি দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়কবি দীপক রায় সম্পাদিত  “বাংলা আধুনিক কবিতা ১”
(১৯৯২) থেকে নেওয়া |    


সকাল থেকেই বৃষ্টির পালা শুরু,
আকাশ-হারানো আঁধার-জড়ানো দিন |
আজকেই, যেন শ্রাবণ করেছে পণ,
শোধ করে দেবে বৈশাখী সব ঋণ |
রিমঝিম ঝরে অঝোরে অন্ধ ধারা,
ঘনবর্ষণে আপাত-আত্মহারা
পৃথিবীতে যেন দিন নেই, রাত নেই ;
স্তম্ভিত কাল মেঘ-মায়ালোকে লীন |

পথের পাথরে উঠছে জলের ধোঁয়া,
উঁচু গাছগুলি মাথা নিচু ক’রে চুপ ;
বস্তুগলিত তরলিত এই দিনে
সেই ভালো হয়, সব যদি যায় খোয়া |
তবু ন-টা বাজে, তবু ছাতা হাতে নিয়ে
ট্রামে চ’ড়ে বসি আপিশের অভিসারে,
কেরানিকীর্ণ খাঁচার রন্ধ্র দিয়ে
থেকে-থেকে লাগে সিক্ত কোমল ছোঁয়া |

লুপ্ত, নিভৃত, অমর্ত্য এ-দিনেও
মস্ত শহর ব্যস্ত মুখর কাজে,
মানুষ-মূষিক বন্দী যে-পিঞ্জরে
আজো খোলা আছে গোগ্রাসী তার হাঁ-যে |
তারই অদম্য অনতিক্রম্য টানে
অগণ্য ছাতা পথ করে আছে কালো,
বিত্তশালীও মুক্ত-ইচ্ছা নয়,
কর্মঠ মুখে চলেছে মোটরযানে |

আমি সেই ভিড়ে নিঃশেষে মিশে গিয়ে
চলি একাগ্র নিরুপাধি, নামহীন |
হাড় থেকে কেউ নিংড়ে নিয়েছে মজ্জা,
পায়ে-পায়ে বাজে জীর্ণ জুতোর লজ্জা,
ব্যর্থ জীবন মূর্ত করেছে যেন
দু-দিনের দাড়ি, রজকরহিত সজ্জা |
জীবন-ডোবানো বৃষ্টি যখন ঝরে
সময়-হারানো স্বপ্ন-জড়ানো দিনে,
শ্রাবণ-তাড়ানো উগ্র-বিজলি-জ্বলা
শত নিশ্বাসে আবিল রুদ্ধ ঘরে
আজ বাঁধা পড়ে আগামী কালের ঋণে |

দিন শেষ হয় ; বৃষ্টিশেষের নেশা
নিষ্ক্রিয় মেঘে এখনও থমকি আছে,
ক্ষণিক হলুদ-সবুজ-সোনার মেশা
অলীক সন্ধ্যা পুন বর্ষণ যাচে |
আহা, সুন্দর এ-পৃথিবী, এ-জীবন,
বিনামূল্যেই অমূল্যতম দান,
পণ্যরাশির জঘন্য অনটন
দেহধারীটারে যত দুঃখই দিক
অতল অগমে মুক্ত আমার প্রাণ |
জীবিকা-যন্ত্র যখনই দিয়েছে ছাড়া
তখনই শ্রাবণ পরালো আমার বুকে
সোনায় শ্যামল গাঁথা তার মালাগাছি
কত ভাগ্য যে বেঁচে আছি, বেঁচে আছি |
ক্লান্ত, মুক্ত, বিক্ষত, উত্সুক,
ক্ষুদ্র গৃহের দুর্গে চলেছি ফিরে,
কখনও আবার পাব না যে দিনটিরে
তারই শেষ স্মৃতি এখনও আকাশে আঁকা |
গলিটা বিশ্রী, পিচ্ছিল, আঁকাবাঁকা,
অসতর্কের বেঁধে কর্কশ খোয়া,
পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে ওঠে তর্কের ধোঁয়া |
বিষণ্ণতার নিঃসাড়তার নেশা
আমার বুকের নিশ্বাস কেড়ে নিয়ে
বিশ্বের ছবি মুছে দেয় মন থেকে |
--- ভাঙল চমক বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে |

মৃদু ভঙ্গিতে আধেক দুয়ার ধ’রে
দাঁড়িয়ে আছে সে রঙিন শাড়িটি প’রে,
মাথার উপরে আধেক ঘোমটা টানা
আধেক ফেরানো মুখটি আড়াল ক’রে |
সব কেড়ে নিতে পারে নি দিনের ফাঁকি,
তবু আছে রাত, তবু কিছু আছে বাকি,
শূন্য মনের সুপ্তির গহ্বরে
পূর্ণতা এনে স্বপ্নের রেখাপাতে
সন্ধ্যাদীপের প্রতীক্ষা জ্বলে যেন
একখানা ক্ষীণ, কনকরিক্ত হাতে |

মনে হ’ল তারে চিনি, তবু চিনি না যে,
বুঝি না কী-কথা কেমন ছন্দে বলি,
দরিদ্রতার লক্ষ ছিদ্র ভ’রে
অবাধ,  অগাধ, বিশাল  শ্রাবণ ঝরে
কদম্ববনে বিকশে অন্ধ গলি |
হৃদয়-রূপক কিছু নেই, কিছু নেই,
নেই বেলফুল, রজনীগন্ধা. জুঁই,
চুপ ক’রে শুধু চেয়ে থাকি তার মুখে,
চোখ দিয়ে শুধু কালো চোখদুটি ছুঁই  |
চিরন্তনীর অলক্ষ্য অভিসার
পার হ’য়ে এসে তুচ্ছের বঞ্চনা
বলে কানে-কানে,  ‘আমার অঙ্গীকার
ভুলব না আমি, কোনোদিন ভুলব না |’

.               *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
শাপভ্রষ্ট
কবি বুদ্ধদেব বসু
কবি প্রমথনাথ বিশী ও ডঃ তারাপদ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত “কাব্যবিতান” কাব্যসংকলন
থেকে নেওয়া |

যৌবনের উচ্ছ্বসিত সিন্ধুতটভূমে
বসে আছি আমি |
দগ্ধ স্বর্ণ-রেণু-সম বালুকণারাশি
লুটায় চরণ-প্রান্তে অকৃপণ বিপুল বৈভবে |
ঊর্দ্ধে মম রক্তিম আকাশ—
প্রভাত-সূর্যের লজ্জা রঞ্জিত করিছে অরণ্যানী |
সদ্য-নিদ্রা-জাগরিত গগনের পাণ্ডুভাল-’ পরে
বহ্নি-শিখা করিছে অর্পণ :
কামনার বহ্নি সে যে, স্বপনের সলজ্জ বিকাশ |
গোলাপের বর্ণে-বর্ণে স্বপ্ন-সুধা মাখা,
আরক্তিম কামনায় আঁকা |
আমার অন্তর নিয়ে একাকী বসিয়া আছি আমি
উচ্ছ্বসিত যৌবনের সিন্ধুতীরে |

সম্মুখে গরজে সিন্ধু বেদনার দুঃসহ পীড়নে |
লক্ষ-লক্ষ লুব্ধ ওষ্ঠ মেলি’
চুম্বিয়া মুছিতে চাহে গগনের তরুণ রক্তিমা,
রিক্ত করি’ দিতে চাহে ধরিত্রীর তীর্থযাত্রীদলে
সহসা-বন্যায় |
নিষ্ফল আক্রোশে তার ক্রূর জিহ্বা উদ্ গারিছে বিষ,
তরঙ্গ-মথিত ফেনা রেখে যায় সৈকত-শিয়রে |
গাঢ়কৃষ্ণ জলরাশি অস্বচ্ছ অতল
নিত্য-নব অমঙ্গলে করে জন্মদান
গোপন গভীর গর্ভে ;
অকল্যাণ বায়ু বহি’ প্রাণের মন্দিরে
নির্বাপিত করি’ দেয় পূজার প্রদীপ ;
ম্লানমুখে ঝরি’ পড়ে কাননে অষ্ফুট শেফালিকা
হিমস্পর্শে  তার |
আমি শুষ্ক, নিশাচর, অন্ধকারে মোর সিংহাসন |
আমি হিংস্র, দুরন্ত, পাশব |
সুন্দর ফিরিয়া যায় অপমানে, অসহ্য লজ্জায়
হেরি মোর রুদ্ধদ্বার, অন্ধকার মন্দির-প্রাঙ্গণ |
সুদূর কুসুম-গন্ধে তার যাত্রা-বাঁশি বেজে ওঠে ;
দৈন্য-ভরা গৃহ মোর শূন্যতায় করে হাহাকার |
----যৌবন আমার অভিশাপ |
ক্ষণে ক্ষণে তরঙ্গের ‘পরে
গগনের স্নিগ্ধ শান্ত আলোখানি বিচ্ছুরিত হয়ে যেন লাগে ;
ফুটে ওঠে সোনার কমল
ক্ষণিক সৌরভে তার নিখিলের করিয়া বিহ্বল |
সেই পদ্মগব্ধখানি এনে দেয় মোর পরিচয়
পল্লব-সম্পুটে |
বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে পড়ি আমি লিখন তাহার :
‘হে তরুণ, দস্যু নহ, পশু নহ, নহ তুচ্ছ কাট---
শাপভ্রষ্ট দেব তুমি |’

শাপভ্রষ্ট দেব আমি !
আমার নয়ন তাই বন্দী যুগ-বিহঙ্গের মতো
দেহের বন্ধন ছিঁড়ি শূন্যতায় উড়ি’ যেতে চায়
আকন্ঠ করিতে পান আকাশের উদার নীলিমা |
তাই মোর দুই কর্ণে অরণ্যের পল্লবমর্মর
প্রেম-গুঞ্জনের মত কী অমৃত ঢালে মর্ম-মাঝে |
রবির গভীর স্নেহে, শিশিরের শীতল প্রণয়ে
শুষ্ক শাখে তাই ফোটে ফুল,
দক্ষিণ-পবন তারে মৃদুহাস্যে আন্দোলিয়া যায় |
রাত্রির রাজ্ঞীর বেশে পূর্ণচন্দ্র কভু দেয় দেখা,
আঁধারের অশ্রুকণা তারার মণিকা হয়ে জ্বলে
ত্রিযামার জাগরণ-তলে |
স্তব্ধচিত্তে চেয়ে থাকি ; অন্তরের নিরুদ্ধ বেদনা
সযত্নে সাজাই নিত্য উত্সবের প্রদীপের মতো
আনন্দের মন্দির-সোপানে |
সুধায় নির্মিত মোর দেহ-সৌধখানি,
ইন্দ্রিয় তাহার বাতায়ন---
মুক্ত করি’ রাখি’ তারে আকাশের অকূল আলোকে
অন্ধকার-অন্তরালে অন্তরের মাঝে
বিনিঃশেষে করি যে গ্রহণ !

অক্ষম, দুর্বল আমি নিঃসম্বল নীলাম্বর-তলে,
ভঙ্গুর হৃদয়ে মম বিজড়িত সহস্র পঙ্গুতা---
জীবনের দীর্ঘ পথে করেছিনু কোন্
.                        স্বর্ণরেখাদীপ্ত ঊষাকালে---
আজ তার নাহিকো আভাস |
আজ আমি ক্লান্ত হয়ে পথ-প্রান্তে পড়ে আছি
.                        নীরব ব্যথায় শান্তমুখে
ঝ’রে-পড়া বকুলের গন্ধস্নিগ্ধ বিজন বিপিনে |
সেই মোর গোধূলির সুরভি আঁধারে
যার সাথে দেখা,
যার সাথে সঙ্গোপনে প্রণয়-গুঞ্জন,
যার স্পর্শে ক্ষণে-ক্ষণে হৃদয়ের বেদনার মেঘে
চমকিয়া থেলি’ যায় হর্ষের বিজলী ;----
নেত্রের মুকুরে তার দেখেছি আপন প্রতিচ্ছবি,
দেখিয়াছি দিনে দিনে, ক্ষণে-ক্ষণে আপনার ছায়া,
দেখিয়াছি কান্তি মম দেবতার মতো অপরূপ,
ভাস্করের মতো জ্যোতির্ময় ;----
তখন বিষণ্ণ বায়ু নিঃশ্বসি’ কহিয়া গেছে কানে :
‘শাপভ্রষ্ট দেব তুমি !’
নিকুঞ্জের সঙ্গী মোর হাসিয়া কয়েছে যবে কথা
তুচ্ছতম বাণী তার রূপান্তর করেছে গ্রহণ,
বিহঙ্গের উদাসীন কলকন্ঠ-সাথে মিশি’ আসি’
বেজেছে আমার বক্ষে দুরাশার মতো---
‘শাপভ্রষ্ট দেব তুমি !’
তাই আজ ভাবি মনে মনে---
পঙ্কের-কলঙ্ক-বারি উত্তরিয়া আছে মোর স্থান
পঙ্কজের শুভ্র অঙ্কে |
শেফালি সৌরভ আমি, রাত্রির নিঃশ্বাস,
ভোরের ভৈরবী |
সংসারের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কন্টকের তুচ্ছ উত্পীড়ণ
হাস্যমুখে উপেক্ষিয়া চলি |
যেথা যত বিপুল বেদনা,
যেথা যত আনন্দের মহান্ মহিমা---
আমার হৃদয়ে তার নব-নব হয়েছে প্রকাশ |
বকুল-বীথির ছায়ে গোধূলির অস্পষ্ট মায়ায়
অমাবস্যা-পূর্ণিমার পরিণয়ে আমি পুরোহিত |--
শাপভ্রষ্ট দেবশিশু আমি !

.                     *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
সুদূরিকা
কবি বুদ্ধদেব বসু
কবি প্রমথনাথ বিশী ও ডঃ তারাপদ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত “কাব্যবিতান” কাব্যসংকলন
থেকে নেওয়া |


চক্ষে যার বহ্নিরাগ, বক্ষে যার সুমধুর কুসুম-সুষমা,
অন্তরে লুকায়ে রেখো সংগোপনে সেই অন্তঃপুরচারিণীরে ;
সৃষ্টির আনন্দ-মোহে রচিয়াছ অন্ধকারে নব তিলোত্তমা---
সূর্যের দুর্জয় দাহে এনো না টানিয়া তারে নির্লজ্জ বাহিরে |

থাক সে নিশীথরাত্রে পত্রের মর্মর-মাঝে চিরবিরহিণী,
সুদূরিকা হয়ে থাক্ আকাশের নীহারিকা উদার, উদাস,
প্রভাতের তারা হয়ে জলুক রূপের রেখা স্বপ্নের সঙ্গিনী,
সুরভির সুরা ঢালি’ তুলুক মদির করি’ উতল নিশ্বাস |

হারায়ে ফেলো না তারে বাহিরের হর্ম্যভরা হিরণ-আলোতে,
মিলায়ে যাবে না সে, হায়, ছায়াসম, বাসনার প্রখর কিরণে ;
ফেনিল মত্ততা যত সঞ্চরিছে বিষদগ্ধ নীল রক্তস্রোতে,
উদ্বেল উচ্ছ্বাসে তার ভাসায়ে দিয়ো না তব সুন্দর স্বপনে |
লেলিহান লালসারে নিবাইয়ো অশ্রু আনি’ তার আঁখি হতে,
জ্যৈষ্ঠের নিষ্ঠুর তপ ভাঙিয়ো তাহার স্নিগ্ধ ব্যথার বর্ষণে ||

.                        *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
বন্দীর বন্দনা
কবি বুদ্ধদেব বসু
সুকুমার সেন  সম্পাদিত “বাংলা কবিতা সমুচ্চয়” ১খণ্ড (১৯৯১ )থেকে নেওয়া |


প্রবৃত্তির অবিচ্ছেদ্য কারাগারে চিরন্তন বন্দী করি রচেছ আমায়
নির্মম নির্মাতা মম ! এ কেবল অকারণ আনন্দ তোমার !
মনে করি, মুক্ত হব ; মনে ভাবি, রহিতে দিব না    
মোর তরে এ-নিখিলে বন্ধনের চিহ্নমাত্র আর |
রুক্ষ দস্যু বেশে তাই হাস্যমুখে ভেসে যাই উচ্ছ্বসিত স্বেচ্ছাচার-স্রোতে,
উপেক্ষিয়া চলে যাই সংসার সমাজ গড়া লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র কন্টকের          
নিষ্ঠুর আঘাত ;  দাসত্বের স্নেহের সন্তান
সংস্কারের বুকে হানি তীব্র তীক্ষ্ম রূঢ় পরিহাস,
অবজ্ঞার কঠোর ভর্ৎসনা |           
মনে ভাবি, মুক্তি বুঝি কাছে এল---
বিশ্বের আকাশে বহে লাবণ্যের মৃত্যুহীন স্রোত |

তারপরে একদিন অকস্মাৎ বিস্ময়ে নেহারি---
কোথা মুক্তি ?
সহস্র অদৃশ্য বাধা নিশিদিন ঘিরে আছে মোরে,
যতই এড়ায়ে চলি, ততই জড়ায়ে ধরে পায়ে,
রোধ করে জীবনের গতি |       
সে-বন্ধন চলে মোর সাথে সাথে জীবনের নিত্য অভিসারে
সুন্দরের মন্দিরের পানে |
সে বন্ধন মগ্ন করি রেখেছে আমারে
আকন্ঠ পঙ্কের মাঝে |
সে-বন্ধন লক্ষ লক্ষ লাঞ্ছনার বীজাণুতে
কুলষিত করিয়াছে নিশ্বাসের বাতাস আমার—
লোহিত শোণিত মম নীল হয়ে গেছে সে-বন্ধনে |
ক্ষণ তরে নহি মুক্ত; কর্ম মাঝে, মর্ম মাঝে মোর,
প্রতি স্বপ্নে, প্রতি জাগরণে,
প্রতি দিবসের লক্ষ বাসনা আশায়
আমারে রেখেছ বেঁধে অভিশপ্ত, তপ্ত নাগ পাশে    
সৃজন ঊষার আদি হ’তে--         
উদাসীন স্রষ্টা মোর !
মুক্তি শুধু মরীচিকা সুমধুর মিথ্যার স্বপন,
আপনার কাছে মোরে করিয়াছ বন্দী চিরন্তন |         

বাসনার বক্ষোমাঝে কেঁদে মরে ক্ষুধিত যৌবন,
দুর্দম বেদনা তার স্ফুটনের আগ্রহে অধীর |
রক্তের আরক্ত লাজে লক্ষবর্ষ-উপবাসী শৃঙ্গার কামনা
রমণী-রমণ-রণে পরাজয় ভিক্ষা মাগে নিতি ;        
তাদের মেটাতে হয় আত্ম বঞ্চনার নিত্য ক্ষোভ |
আছে ক্রুর স্বার্থদৃষ্টি, আছে মূঢ় স্বার্থপর লোভ,
হিরণ্ময় প্রেমপাত্রে হীন হিংসা-সর্প তপ্ত আছে |
আনন্দ নন্দিত দেহে কামনার কুৎসিত দংশন |
জিঘাংসার কুটীল কুশ্রীতা |
সুন্দরের ধ্যান মোর এরা সব ক্ষণে-ক্ষণে ভেঙে দিয়ে যায়,
কাঁদায় আমারে সদা অপমানে ব্যথায়, লজ্জায় |
ভুলিয়া থাকিতে চাই ; -- ক্ষণ তরে ভুলে যাই ডুবে গিয়ে লাবণ্য উচ্ছাসে
তবু, হায়, পারিনে ভুলিতে |
নিমেষে-নিমেষে ত্রুটি, পদে পদে স্খলন পতন,
আপনারে ভুলে যাওয়া সুন্দরের নিত্য অসম্মান |
বিশ্বস্রষ্টা, তুমি মোরে গড়েছ অক্ষম করি যদি,
মোরে ক্ষমা করি তব অপরাধ করিও ক্ষালন |

জ্যোতির্ময়, আজি মম জ্যোতিহীন বন্দীশালা হতে
বন্দনা-সংগীত গাহি তব |
স্বর্গলোভ নাহি মোর, নাহি মোর পুণ্যের সঞ্চয়                   
লাঞ্ছিত বাসনা দিয়া অর্ঘ্য তব রচি আমি আজি
শাশ্বত সংগ্রামে মোর আহত বক্ষের যত রক্তাক্ত ক্ষতের বীভৎসতা,
হে চিরসুন্দর, মোর নমস্কার-সহ লহো আজি |

বিধাতা, জানো না তুমি কি অপার পিপাসা আমার
অমৃতের তরে |
না হয় ডুবিয়া আছি কৃষিঘন পঙ্কের সাগরে,
গোপন অন্তর মম নিরন্তর সুখার তৃষ্ণায়
শুষ্ক হয়ে আছে তবু |
না-হয় রেখেছ বেঁধে  তবু জেনো, শৃঙ্খলিত ক্ষুদ্র হস্ত মোর
উধাও আগ্রহভরে ঊর্ধ্বনভে উঠিবারে চায়
অসীমের নীলিমারে জড়াইতে ব্যগ্র আলিঙ্গনে |
মোর আঁখি রহে জাগি নিস্তব্ধ নিশীথে,
আপন আসন পাতে নিদ্রাহীন নক্ষত্র সভায়,
স্বচ্ছ শুক্ল ছায়াপথে মায়ারথে ভ্রমি ফেরে কভু
আবেশ-বিভ্রমে |
তুমি মোরে দিয়েছ কামনা, অন্ধকার অমা-রাত্রি সম,
তাহে আমি গড়িয়াছি প্রেম, মিলাইয়া স্বপ্নসুধা মম |
তাই মোর দেহ যবে ভিক্ষুকের মতো ঘুরে মরে
ক্ষুধা জীর্ণ, বিশীর্ণ কঙ্কাল—
সমস্ত অন্তর মম যে মুহূর্তে গেয়ে উঠে গান |
অনন্তের চির-বার্তা নিয়া ;
সে কেবল বারবার অসীমের কানে কানে একটি গোপন বাণী কহে—
‘তবু আমি ভালোবাসি, তবু আমি ভালোবাসি আজি !’
রক্ত মাঝে মদ্যফেনা, সেথা মীনকেতনের উড়িছে কেতন,
শিরায় শিরায় শত সরীসৃপ তোলে শিহরণ,
লোলুপ লালসা করে অন্য মনে রসনা লেহন |
তবু আমি অমৃতাভিলাষী ?
অমৃতের অন্বেষণে ভালোবাসি, শুধু ভালোবাসি,
ভালোবাসি আর কিছু নয় |
তুমি যারে সৃজিয়াছ, ওগো শিল্পী, সে তো নহি আমি,
সে তোমার দুঃস্বপ্ন দারুণ |
বিশ্বের মাধুর্য রস তিলে তিলে করিয়া চয়ন
আমারে রচেছি আমি,---তুমি কোথা ছিলে অচেতন
সে মহাসৃজন কালে তুমি শুধু জানো সেই কথা |

মোর আপনারে আমি নবজন্ম করিয়াছি দান |
নিখিলের স্রষ্টা তুমি, তোমার উদ্দেশে আজি তাই,
মোর এ সৃষ্টিকার্য উত্সৃষ্ট করিনু সন্তর্পণে |
মোর এই নব সৃষ্টি এ যে মূর্ত বন্দনা তোমার,
অনাদির মিলিত সংগীত |
আমি কবি, এ সংগীত রচিয়াছি উদ্দীপ্ত উল্লাসে,
এই গর্ব মোর—
তোমার ত্রুটিরে আমি আপন সাধনা দিয়া করেছি শোধন,
এই গর্ব মোর |
লাঞ্ছিত এই বন্দী তাই বন্ধহীন আনন্দ উচ্ছ্বাসে
বন্দনার ছদ্মনামে নিষ্ঠুর বিদ্রূপ গেলো হানি’
.             তোমার সকাশে |

.                        *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
৩০ জানুয়ারী, ১৯৪৮
কবি বুদ্ধদেব বসু
অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত “বাংলা কবিতা সমুচ্চয়” ২য় খণ্ড (১৯৯৩ ) থেকে
নেওয়া |


অসম্ভব আজীবন শোক করা |  স্তম্ভিত পাথর
কান্নার তৃষ্ণায় ভাঙে ; পাথরের প্রচ্ছন্ন, অথচ
স্ফীত, তীব্র অসহ্য শিরায় নামে খরস্রোত;  হৃদয়ের আরক্ত অধরে
ক্লান্তির করুণা নামে, কান্না থামে | --- তারপর ?

পথে-পথে পায়ে-হাঁটা লক্ষ-লক্ষ শব্দহীন শোক ;
গঙ্গাতীরে নম্র, শান্ত সমতার সূর্যাস্ত-মমতা ;
মুদ্রাযন্ত্রে আর্ত রোল ; রেডিওতে ধরে-আসা গলা---
থেমে যাবে, শেষ হবে, শেষ হল : তারপর ?     

দুঃখ তার দয়ার সুন্দর হাতে ধরে আছে এই
রাত্র্রির পবিত্র রক্ত ; যত ঝরে, তত ধরে হাতে |
কিন্তু রক্ত ঝরে যাবে, কিন্তু এই কান্নার পরেও
আবার অব্যর্থ ভোর ঘরে-ঘরে জাগাবে : --- তখন ?

জাগাবে আবার জ্বালা, বাঁচার ভীষণ জ্বালা, যার
যন্ত্রণায় ঘরকন্না গুঁড়ো হয়, রাজত্ব ধুলোয় মেশে, কাঁপে মন্ত্রী, গৃহিণী, মজুর
ক্ষমাহীন এই বাঁচা আবার পাঠাবে প্রশ্ন, যার
উত্তর দিতেই হবে : তখন ?  --- তখন ?

.                        *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
আমন্ত্রণ---রমাকে
কবি বুদ্ধদেব বসু
ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত “শুধু আবৃত্তির জন্য” থেকে নেওয়া |


তুমি             এখানে কখনো যদি আসবে, মেয়ে
.             শোনো,    আসবে কখন :
যবে          আঁধার নামবে শাদা আকাশ ছেয়ে
কালো          আঁধার নামবে লাল আকাশ ছেয়ে,
যবে          সন্ধ্যাতারার মুখ থাকবে চেয়ে
.                মোর              মুখের পানে
.                নির্--              নিমেষ নয়ন---
যবে           জাগবে রাতের হাওয়া উতল গানে---
.                তুমি              আসবে তখন |

মানে---     আসবে এখানে তুমি সন্ধ্যা হলে---
.                তুমি          লক্ষ্মী মেয়ে !
মেশা            উষ্ণ তুষার তব লাল কপোলে,
মাখা            শুর্মা তোমার কালো চোখের কোলে,
শাদা            গলায় তোমার শাদা মুক্তা দোলে ;
.                ঘন             নীলাম্বরী
.                শাদা           শরীর ছেয়ে |
এনো             স্বপ্ন তোমার কালো নয়ন ভরি’,
.                এসো,                লক্ষ্মী মেয়ে |

আমি              ধরবো দু-হাত তব নিমেষ-তরে
.                তুমি            আসবে যখন ;
তব               নাম ধ’রে ডেকে তোমা আনবো ঘরে,
যাবে          চুলের সুবাসে তব বাতাস ম’রে ;
শাদা          আলোক প’ড়ে নীল শাড়ির ‘পরে
.                কেঁপে           উঠবে সুখে---
.                তুমি            আসবে যখন |
হেসে               তাকাবো গোলাপ-ফোটা তোমার মুখে
.                শাদা                 তুষার-বরণ |

আমি                বসাবো তোমাকে মোর ইজি-চেয়ারে,
.                আমি            বসবো পাশে |
ঘরে           জ্বলবে মোমের আলো এক কিনারে,
আর           জ্বলবে সন্ধ্যাতারা আকাশ-পারে,
আর           জ্বলবে স্বপ্ন তব আঁখির ঠারে,---
.                  কালো          আঁখির কোলে
.                     শাদা           আলোক ভাসে ;
মোর           হৃদয়ের তোলপাড় শান্ত হলে
.                     আমি           বসবো পাশে |

ঢের           গল্পগুজব হবে তেমায়-আমায়
.                  শুধু             আমরা দু-জন ;
নয়া           চুলের ফ্যাশন থেকে সাহিত্য মায়
হাসি          ফুটবে ফুলের মতো চোখের কোনায়,
হাসি          কাঁপবে আলোর মতো অধর-সীমায়—
.                  লাল            ঠোঁটের পরে—
.                     কালো         নয়ন-মগন !
শত           গহন স্বপনে ঘন নয়ন ভরে
.                  হাসি           ফুলের মতন |

আমি         বলবো তোমাকে ঢের মিথ্যে কথা---
.                  তুমি            শুনবে, মেয়ে ;
তব           শরীর-অন্ধকারে বিজলি-লতা,
নীল          শাড়িতে মেঘের ঘন তমিস্রতা ;
দুই          বাহুতে জলের মতো উচ্ছলতা,
.                   শত           কবির স্বপন
.                  তব           নয়ন ছেয়ে |
তব          নয়নে মরণ, তব চরণে মরণ !---
.                    তুমি         শুনবে মেয়ে |
.     তুমি           বলবে আমাকে ঢের মিথ্যে কথা,
.                   আমি        শুনবো,  মেয়ে |
তব          স্বর্গের অর্ঘ্যের আমি দেবতা,
তব          হৃদয়-গগনে আমি তপন-যথা,
তব          হৃদয়-সাগরে চির-চঞ্চলতা---
.                   চোখে       ফুটলো আলো
.                      মোর        নয়নে চেয়ে,---
ম্লান         মোমের আলোয় মোরে বাসবে ভালো---
.                     তুমি         লক্ষ্মী মেয়ে |

তুমি        মোমের আলোয় ভালোবাসবে মোরে---
.                     মোরা         পড়বো প্রেমে,
ভালো-      বাসবো তোমায় আমি হৃদয় ভ’রে
এক          তারকা-ফোটা ঘন সন্ধ্যা ধ’রে,
মোরা       বাসবো, বাসবো ভালো পরস্পরে ;
.                  দূর            আকাশ থেকে
.                  প্রেম          আসবে নেমে |
প্রেমে        নাম ধ’রে ঘরে মোরা আনবো ডেকে,
.                  মোরা         পড়বো প্রেমে |

.                        *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
কবিমশাই
কবি বুদ্ধদেব বসু
ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত “শুধু আবৃত্তির জন্য” থেকে নেওয়া |


কবিমশাই, অনেক তো ধান ভানলেন ;
বলুন এবার, বলুন দেখি সত্যি ক’রে,
ব্যাপারটা কী ? আপনি – হ্যাঁ, আপনি নিজে
দেখেছেন তো প্রেমে প’ড়ে?

ঠিক না ? তা বলুন না সে কেমনতর ?
সোজা কথায় বুঝিয়ে বলুন ;
লোকেরা যার তাড়ায় ছোটে নানান পাড়ায়
সেইখানে কি প্রেমের আগুন ?

তা--- হ’লে তো শরীরটাতেই সব মিটে যায় |
কিন্তু, দেখুন, মনও আছে ;
মুশকিলটা এই যে মনের আরজি যত
পেশ করা চাই ওরই কাছে |

যেমন ধরুন, কাউকে দেখামাত্র যদি
ঠিক চিনলেন মনের মানুষ,
কেমন করে পাবেন তাকে ? কোন ফিকিরে
এক জোড়া মন, দামাল, বেহুঁশ,

মিলতে পারে ? না গো মশাই, কবুল করুন,
ছটফটানি সবই খাঁচায়;
উড়তে হ’লে একলা যাবেন ; মিলতে হ’লে---
মিলতে হ’লে শরীরটা চাই |

কেমন মজা,----শরীরটাকে নিংড়ে ছিঁড়ে
কিছুতেই কি ইচ্ছে পোরে !
আবার, মনের সঙ্গে মনের মোকাবিলায়
শরীর এসে জখম করে |

ভালোবাসা ? তা দেখুন না ভালো আমরা
কত কিছুই বেসে থাকি,
সোনাপিসি, কানা বেড়াল, টেবিলচেয়ার
ইত্যাদি সব টুকুটাকি

যাদের সঙ্গে স্মৃতি জড়ায় | তেমনি বিয়ে ;
ঘরকন্না, সঙ্গে খাওয়া, করুণ রঙিন
পিছন-ফেলা পথের কথা চোখে-চোখে—
যৌবনের আর মেয়াদ ক-দিন |

শরীর কিংবা স্মৃতি নিয়ে আমরা আছি |
আচ্ছা এখন বলুন দেখি,
এই যত সব খুচরো নিয়ে জীবন কাটে,
তাদের সঙ্গে প্রেমের কী ?

মনে করুন আপনি যখন দেখেছিলেন
একটি মেয়ের হাতের নড়া
ঝলক দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে,
তারই নাম তো প্রেমে পড়া ?

তখন যে-সব পাতাল –ঠেলা উথালপাথাল
দিয়োছিলো পাগল ক’রে
সে-উত্সাহ, সে-অশান্তি, সেই আনন্দ,
বলুন তো তা কোথায় ধরে ?

কাকের রূপে অবাক হ’য়ে তাকান যখন ;
কিংবা, চৌরঙ্গি--  মোড়ে
হঠাৎ কেঁপে থমকে দাঁড়ান কোনো কবির
পুরোনো লাইন মনে প’ড়ে,

এ সংসারে সেই প্রেম কি ধরে কোথাও
আপনাদেরই মনে ছাড়া ?
আর সেখানে আয়ু তো তার এক-আধ মিনিট :
না, কাটে না কারোই ফাঁড়া |

তাই তো বলি, এত যে গীত বাঁধলেন
আপনাদেরই গোপন সে-গান ;
আমরা দেখুন বেঁচে থেকেই সুখে আছি,
আমাদের আর কেন শোনান |

.                     *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
এলা-দি
কবি বুদ্ধদেব বসু
ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত “শুধু আবৃত্তির জন্য” থেকে নেওয়া |


পুরোনো পাড়া,  ট্রাম থেকে দূরে ; ব্যস্ততা, ভিড়, খাটুনির বাইরে ;
বড়ো-বড়ো গাছের ছায়ায় গম্ভীর---আমি সেখানে সময় পেলেই যাই,
এলা-দিকে দেখতে |
.  ‘দেখতে’ কথাটাই ঠিক | কেননা আমি, ছেলেমানুষ,
সবেমাত্র উনিশ আমার বয়স, কোন কথা আমি বলতে পারি এলা-দিকে,
যা এর আগে অন্য অনেকে গুনগুন করেনি তাঁর কানে—
সেই সব ভাগ্যবানের দল, কয়েক বছর আগে জন্মাবার সুযোগ পেয়ে
আমার জন্যে কিছই আর বাকি রাখেনি যারা !
.   মস্ত ঘর, ঘর পেরিয়ে বারান্দা | বাইরে চৈত্র মাসের দুপুর,
তেতে উঠছে রোদ্দুর, ধুলোর ঘূর্ণি শিরশির ক’রে ব’য়ে যায় |
কিন্তু এখানে ঠাণ্ডা, ঝাপসা আলোয় চোখের সুখ ছড়ানো,
শব্দ নেই | সবুজে চিকে আব্রু-ঘেরা এই বারান্দা,
ফাঁকে-ফাঁকে রোদের ফিতে কেঁপে ওঠে, আর তাতে
গ’লে-গ’লে মিশে যায় পর্দার রং, দেয়ালের রং,
দেয়ালে ঝোলানো ছবির আভা উজ্জ্বল, কোণে দাঁড়ানো
শৌখিন গাছের হালকা-সবুজ | সবুজ আভা, হলদে আর সবুজ
আর বেগনি আভা ; জলে ডুব দিলে যেমন দেখায়, তেমনি ;
যেন বাতাস জুড়ে গুচ্ছ-গুচ্ছ আঙুর--- তেমনি ঠাণ্ডা,
আর উষ্ণ, আর সম্ভোগের আভাসে ভরপুর |
.    কুশান-আঁটা শিঙাপুরি বেতের চেয়ারে এলিয়ে বসেন
এলা-দি, শান্তিনিকেতনি চামড়া-বাঁধানো মোড়ায় পা রেখে |
পাৎলা তাঁর পা দুটি, তাঁর মুখের চেয়েও ফর্শা,
নীলচে সরু শিরায় আরো সুন্দর ; তাঁকে দেখার আগে
আমি কখনো ভাবিনি মানুষের পায়েরও এত রূপ হ’তে পারে |
আমি তাকিয়ে থাকি সেই পায়ের দিকে, যেখানে লুটিয়ে পড়ে
তাঁর শাড়ির পাড় ময়ূরের বুকের মতো নীল ;
তিনি সামনের দিকে একটু ঝুঁকে সিগারেট ধরান |
যখন তাঁর মুখ থেকে ধোঁয়া বেরোয়, আমি বুক ভ’রে
নিশ্বাস টানি, নিশ্বাসে তাঁর বিলেতি সিগারেটের সুবাস পাই,
আর সেই সঙ্গে, ইঞ্জেকশনের ছুঁচের মতো, আমাকে বেঁধে
জানি না কোন অদ্ভুত নামের সুগন্ধ | আমার মাথার মধ্যে
ঝিমঝিম করে উঠে---- নিজেকে এত হালকা মনে হয়
যেন আমি পাখির মতো উড়ে যেতে পারি |
.     গাছ থেকে শুকনো পাতার মতো, তাঁর ঠোঁট থেকে একটি-দুটি
কথা যখন খসে পড়ে, শুধু তখন আমি তাঁর মুখের দিকে তাকাই |
চোখে   চোখ পড়লে একটু হাসেন এলা-দি ; লিপস্টিকে রাঙানো
ঠোঁটের ফাঁকে তাঁর দাঁতের সারি এত উজ্জ্বল যে আমি তখনই
মাথা নিচু করি--- পাছে ভব্যতার সীমা পেরিয়ে যায় |
তাছাড়া আমার অন্য কথাও মনে পড়ে |
.     মনে পড়ে আমার কাকিমাকে --- এঁদো গলির একতলায়
যাঁর বাসা,  যাঁর দিনের মধ্যে ছয় ঘন্টা কাটে রান্নাঘরে,
যাঁর পাঁচটি ছেলেমেয়ে ছোটো-হয়ে-যাওয়া জামা পরে
ঘুরে বেড়ায়, যিনি দিনে-দিনে ফ্যাকাশে আর রোগা
হয়ে যাচ্ছেন, অথচ এখনো ডাক্তার ডাকা হচ্ছে না
পাছে কোনো শক্ত অসুখ ধরা পড়ে | অথচ তাঁরও
ছিলো রূপ--- সেই ভগবানের দান, মানুষের যত্ন ছাড়া
যা  বেশিদিন বাঁচে না |
.     মনে পড়ে আমাদের ঠিকে-ঝি হরিমতিকে--- সকাল থেকে সন্ধ্যা
যে বাড়ি-বাড়ি ঘুরে বাসন মাজে, যার মুখের মধ্যে
দুটো মাত্র দাঁত আছে এখন, আর সে-দুটো ঝুলে-পড়া প্রকাণ্ড
আর নোংড়া হলুদ | তাকে দেখে এখন আর স্ত্রীলোক
বলে মনে হয় না ; তার শরীর যেন এক ফালি তক্তা ;
আর তার মুখ যেন মেয়েরও নয়, পুরুষেরও নয় |
খুব কম কথা বলে সে, শুধু পিঠ বাঁকিয়ে কাজ করে যায় ;
শুধু কাজ, শুধু বেঁচে থাকা, যে-কোনো রকমে
নিছক বেঁচে থাকা শুধু-এ ছাড়া তার অন্য কিছুরই
সময় নেই | তার দিকে তাকাতে আমার লজ্জা করে |
.    আর এলা-দি যখন বিছানা ছাড়েন, তখন তাঁর স্বামীর
আপিশের গাড়ি তৈরি ; উঠে কফি খান, স্নানে ও প্রসাধনে
বাজে এগারোটা, তারপর হয় গাড়ি নিয়ে সওদায় বেরোন,
নয় গালগল্প করেন টেলিফোনে, আর নয়তো
এই বারান্দায় বসে ছবিওলা বিদেশী পত্রিকার পাতা ওল্টান |
বাড়ি সাজানো, শরীর সাজানো, বিকেলের দিকে ঘন্টাখানেক ঘুম,
সপ্তাহে পাঁচটা-ছটা পার্টি, নানা দেশের ধনী মানী বন্ধু,
মাঝে গ্যাংটকে বা কলম্বোতে বা বার্সেলোনায়
বেড়াতে যাওয়া | সব শ্রম, সব কষ্ট, সব দম-আটকানো
অন্ধকূপের উত্তরে এলা-দির আলস্য একটি সুন্দর
গাছের মতো ছড়িয়ে আছে, পাতায়-পাতায় অজস্র আর সবুজ,
রঙিন ফুল অনবরত ফুটে উঠছে, কিন্তু কখনো ফল ধরে না |

তবু বলি : এলা-দি, তুমি এমনি থেকো চিরকাল ;
কখনো কোনো সমিতির নামে সমাজ-সেবা কোরো না,
চাঁদা দিয়ো না উদ্ধারকারীদের, হঠাৎ কোনো বিবেকপীড়ায়
রুক্ষ হয়ে যেয়ো না | এমনি থেকো---এমনি সুখী ও বিশ্রান্ত.
সুন্দর ও সুগন্ধি, আর এমনি নিষ্প্রয়োজন |

.                     *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
সাগর--দোলা
কবি বুদ্ধদেব বসু
কবি মেঘ বসু সংকলিত ও সম্পাদিত “হে প্রেম” থেকে নেওয়া |


ছোটো ঘরখানি মনে কি পড়ে,
সুরঙ্গমা ?
মনে কি পড়ে ? মনে কি পড়ে ?
জানালায় নীল আকাশ ঝরে,
সারাদিনরাত হাওয়ার ঝড়ে
সাগর-দোলা,
সারাদিনরাত ঢেউয়ের তোড়ে
নাগর-দোলা,
আকাশ-মাতাল জানালা খোলা
দিগন্ত থেকে দিগন্তরে,
দিগন্ত-জোড়া সাগর ভ’রে
ঢেউয়ের দোলা |
সারাদিনরাত হাজার ঢেউয়ের উচ্চস্বরে
অন্ধ অবোধ হাওয়ার ঝড়ে
কী যে লুটোপুটি ছুটোছুটি ওই ছোট্ট ঘরে
মনে কি পড়ে ? মনে কি পড়ে ?
কত কালো রাতে করাতের মতো চিরে
ভাঙাচোরা চাঁদ এসেছে ফিরে
তীক্ষ্ণ তারার নিবিড় ভিরে
ভাঙন এনে,
কত কৃশ রাতে চুপে-চুপে চাঁদ এসেছে ফিরে
সাগরের বুকে জোয়ার হেনে
তোমাকে আমাকে অন্ধ অতল জোয়ারে টেনে
মনে কি পড়ে ?
কত উদ্ধত সূর্যের বাণে তুমি আর আমি গিয়েছি ছিঁড়ে,
কত যে দিনের চুম্বন টেনে দিয়েছি মুছে,
কত যে আলোর শিশুরে মেরেছি হেসে,
সেই ছোটো ঘরে মনে কি পড়ে
সুরঙ্গমা,
মনে কি পড়ে ?
জানালায় নীল আকাশ ঝরে
সারাদিনরাত ঢেউয়ের দোলা,
সমুদ্র-জোড়া দিগন্ত থেকে দিগন্তরে
সারাদিনরাত জানালা খোলা
দস্যু হাওয়ার উচ্চস্বরে
তপ্ত ঢেউয়ের মত্ত জোয়ার-জ্বরে
কী যে তোলপাড় দাপাদাপি ওই ছোট্ট ঘরে, মনে কি পড়ে,
সুরঙ্গমা ?
মনে কি পড়ে
তোমার আমার রক্তে হাজার ঝড়ে
কত সমুদ্র তপ্ত জোয়ার জ্বরে
মনে কি পড়ে ?
কত মৃত চাঁদে এনেছি ফিরায়ে রাত্রিশেষে
কত বর্বর শিশু-সূর্যেরে মেরেছি হেসে
ঘন-চুম্বন-বন্যায় কোন অন্ধ অতলে গিয়েছি ভেসে
মনে কি পড়ে
সুরঙ্গনা
মনে কি পড়ে ?

.                     *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর