বুদ্ধদেব বসুর কবিতা
*
ইলিশ
কবি বুদ্ধদেব বসু
কবি মেঘ বসু সংকলিত ও সম্পাদিত “আবৃত্তির কবিতা কবিতার আবৃত্তি” থেকে নেওয়া |

আকাশে আষাঢ় এলো : বাংলাদেশ বর্ষায় বিহ্বল |
মেঘবর্ণ মেঘনার তীরে-তীরে নারিকেল সারি
বৃষ্টিতে ধূমল : পদ্মাপ্রান্তে শতাব্দীর রাজবাড়ি
বিলুপ্তির প্রত্যাশায় দৃশ্যপট-সম অচঞ্চল |

মধ্যরাত্রি মেঘ-ঘন অন্ধকার ; দুরন্ত উচ্ছল
আবর্তে কুটিল নদী : তীর-তীব্র বেগে দেয় পাড়ি
ছোটো নৌকাগুলি : প্রাণপণে ফ্যালে জাল, টানে দড়ি
অর্ধ নগ্ন যারা, তারা খাদ্যহীন, খাদ্যের সম্বল |

রাত্রিশেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে
জলের উজ্জ্বল শস্য, রাশি রাশি ইলিশের শব,
নদীর নিবিড়তম উল্লাসের মৃত্যুর পাহাড় |

তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে-ঘরে
ইলিশ ভাজার গন্ধ ;  কেরানির গিন্নির ভাঁড়ার
সরস সর্ষের ঝাঁজে | এলো বর্ষা, ইলিশ-উত্সব |

.            *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
জোনাকি
কবি বুদ্ধদেব বসু
কবি মেঘ বসু সংকলিত ও সম্পাদিত “আবৃত্তির কবিতা কবিতার আবৃত্তি” থেকে নেওয়া |


.                      একী
.                   জোনাকি !
তুই                   কখন
এলি                  বলতো !
.                      একলা
এই                  বাদলায়
কেন                কলকা-
তায়                এলি তুই ?
( এই                সারা রাতজ্বলা চিরদীপমালা দেয়ালি-আলেয়া ! )
তোর                 সঙ্গী
সব                পাড়াগাঁর
পথে                সারা রাত
ঘন                অন্ধ-
কারে                জ্বলছে |
দর-                কারে তার
এই                শহরে
তোকে                শফরে
আজ                 পাঠালো !
( এই                চাঁদ-তারা-ঝরা-ছায়া-ছেঁড়া-চির-দেয়ালি আলেয়া )
এ যে                 কলকা
তার                ফুটপাত,
নেই                ফাঁকা মাঠ
নেই                ঝোপঝাড়
নেই                 জঙ্গল
তুই                 ফিরে যা
তোর                পাড়াগাঁর
পচা                 পুকুরের
পাড়ে                 থমথমে
কালো                 রাত্তিরে
করে                ঝলমল---
( জ্বল                 চঞ্চল তারা তারা-ভরা কালো-আকাশ-তলে )
এই                কলকা-
তায়                রাত নেই,
নেই                চুপচাপ ;
তারা                 তাড়ানোয়
ভরা                সারা রাত |
তুই                এ-ঘরে
কোন্                 বিঘোরে
এলি                 দেয়ালে
ছাদে                জানালায়
ঘুরে                 মরতে !
( এই                আসবাব-ঠাশা-হাঁশফাঁশ করা গুমোট ঘরে ! )
আমি                একলা
এই                 বাদলায়
শুয়ে                দেখছি
তোর                ঝিকমিক
জ্বলে                মশারির
কোণে                চিকচিক,
ঘুম                আসে না |
ভাবি,                ঘুটঘুট
ঘোর                রাত্তিরে
তোর                সঙ্গীরা
তোকে                 ডাকছে ;
তুই                 ফিরে যা-
( তোরা                মাঠ-ভরে-ফোটা সবুজ তারার দেয়ালি জ্বালা ! )
যা                ফিরে যা
তোর                পাড়াগাঁয়
না,না                যাসনে
তুই                এখনই ;
আরো                 একটু
থাক,                চক্ষু
ভ’রে                দেখে নিই---
( এই                 দেয়ালি-আলোয় চঞ্চল কলকাতার রাতে | )
তবু                এটুকুই
বলি                ভাগ্য
আজ                এলি তুই
এই                 রাত্রে—
চোখে                ঘুম নেই |
সারা                শহরে
আমি                একলা
শুধু                দেখলুম
তোর                পাখনার
আলো                ঝিলমিল
যেন                ছোট্ট
তারা                 ফুটলো,
যেন                স্বপ্নে
দিলি                ক্ষণিকের
সুখ-                সঙ্গ-
তুই,                 জোনাকি !

.            *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
বৃষ্টি আর ঝড়
কবি বুদ্ধদেব বসু
ডঃ ঝুমা রায়চৌধুরী  সম্পাদিত “প্রিয় কবিতা ২”  ২০১৫ থেকে নেওয়া |


বৃষ্টি আর ঝড়, বৃষ্টি আর ঝড়, রাত্রি আর দিন |
দিন ধূসর বন্ধ্য, অন্ধকার |             আলো নেই,
ছায়াও নেই |         শুধু বৃষ্টির কুয়াশা, শুধু মেঘের আবছায়া, আর
ট্রামের গোঙানি, ট্রাফিকের ঘর্ঘর |

আকাশে চাপা কান্না, হাওয়ায় দীর্ঘশ্বাস |
দীর্ঘ, দীর্ঘ দিন, রাত্রি কত দূর ?
ক্লান্ত প্রহর, মুহূর্ত মন্থর ; কালের শৃঙ্খল-ঝঞ্ঝনা
অন্তহীন, ক্লান্তিহীন |

রাত্রি ; ঘরে শূন্যতা, বাইরে অন্ধকার,
বৃষ্টি আর ঝড়, বৃষ্টি আর ঝড় |
শূন্য, শূন্য হৃদয়, ব্যর্থ, ব্যর্থ রাত্রি,
শুধু ক্রুদ্ধ শহরের ঘুমহীন গুমরানি |

হৃদয়ে শূন্যতা, শহরে আর্তস্বর, আকাশে অন্ধকার |
ছায়া, হাওয়া, স্বর, মর্মর, ক্রুদ্ধ  রুদ্ধস্বর, দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস
শহরে, শূন্য ঘরে, বৃষ্টি-ঝরা অন্ধকারে, কালের শৃঙ্খল-ঝঙ্কারে
সারা রাত্রি, সারা দিন |

দিন শূন্য, পচা ডোবার মতো চুপচাপ |  রাত্রিও বোবা,
কিছু নেই | নেই নেই |
বৃষ্টির ধূসর কাপড়ে, বাতাসের শহরের আর্তস্বরে
সৃষ্টির মুখ ঢাকা |   কিছু নেই |     আমি একা |    একা |

কালের বিশাল চাকায় অন্ধ মাছির মতো বন্দী ;
বিশ্বের জানালা বন্ধ ; অন্ধকার, রুদ্ধশ্বাস,
পচা ডোবার মতো দিন ; পুরোনো বিস্মৃত কুয়োর তলার মতো
রাত্রি ; আর নিঃসঙ্গতা, শেষহীন |

রাস্তায় ভিড় ব্যস্ততা মত্ততা |         আপিশে ময়দানে রেস্তোরাঁয়
কাজ খেলা নেশা, হাড়-ভাঙা সপ্তাহশেষে জুয়ো, জিন, দুপুরের ঘুম—
সব অস্পষ্ট, আরষ্ট, শহর মূর্ছিত |  বৃষ্টি,
বৃষ্টি |         রাস্তায় ছায়ার ঠেলাঠেলি, দুঃস্বপ্নের হাড়হীন মিছিল |

অকায়, অকঙ্কাল কলকাতা, ছায়াময় ; স্বপ্নের মতো
স্বেচ্ছাচারী, দায়িত্বহীন |       আমিও ছায়া, হাওয়ার ছোঁওয়ায়
কাঁপি দেয়ালে, পর্দার আড়ালে ; দোলে আমার বুকের মধ্যে
বৃষ্টি আর ঝড়, বৃষ্টি আর ঝড়, রাত্রি আর দিন |

.                            *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
এই শীতে
কবি বুদ্ধদেব বসু
ডঃ ঝুমা রায়চৌধুরী  সম্পাদিত “প্রিয় কবিতা ২”  ২০১৫ থেকে নেওয়া |


আমি যদি ম’রে যেতে পারতুম
এই শীতে,
গাছ যেমন ম’রে যায়,
সাপ যেমন ম’রে থাকে,
সমস্ত দীর্ঘ শীত ভ’রে |

শীতের শেষে গাছ নতুন হয়ে ওঠে,
শিকড় থেকে ঊর্দ্ধে বেয়ে ওঠে তরুণ প্রাণরস,
ফুটে ওঠে চিক্কণ সবুজ পাতায়-পাতায়
আর অজস্র উদ্ধত ফুলে |

আর সাপ ঝরিয়ে দেয় তার খোলশ,
তার নতুন চামড়া শঙ্খের মতো কাজ-করা ;
তার জিহ্বা ছুটে বেরিয়ে আসে আগুনের শিখার মতো,
যে-আগুন ভয় জানে না |

কেননা তারা ম’রে থাকে
সমস্ত দীর্ঘ শীত ভ’রে,
কেননা তারা মরতে জানে |

যদিও আমি ম’রে থাকতে পারতুম---
যদি পারতুম একেবারে শূন্য হ’য়ে যেতে,
ডুবে যেতে স্মৃতিহীন, স্বপ্নহীন অতল ঘুমের মধ্যে—
তবে আমাকে প্রতি মুহূর্তে ম’রে যেতে হ’তো না
এই বাঁচার চেষ্টায়,
খুশি হবার, খুশি করার,
ভালো লেখার, ভালোবাসার চেষ্টায় |

.            *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
নস্টালজিয়া
কবি বুদ্ধদেব বসু
ডঃ ঝুমা রায়চৌধুরী  সম্পাদিত “প্রিয় কবিতা ২”  ২০১৫ থেকে নেওয়া |


সে কোন দেশ, যার বিরহে এই কষ্ট !   আমি কি ছিলাম
সেখানে কোনোদিন,  না কি এখনো দেখিনি, না কি আমি
সেখানেই আছি ?
.        আমার চোখ থেকে ফলের মতো ঝুলছে ?    সে কি স্মৃতি ?
আমার গা বেয়ে গাছের মতো বর্ধিষ্ণু --- সে কি আশা ?
একদিন আমি আমার হৃৎপিণ্ড উপড়ে নিয়ে পাখিদের
খাইয়েছিলাম, ঝাঁক ঝাঁক সেই দেশের দিকে তারা উড়ে গেলো
.         তারপর থেকে আমি মাঝে-মাঝে তাদের ছায়া দেখতে
পাই |   যখন হিম হ’য়ে নামে জানুয়ারী, টুকরো হ’য়ে
খ‘সে পড়ে আকাশ, তুষার ঝরে নিঃশব্দে |  যখন
সাব্ ওয়ের আঁধার পেরিয়ে হঠাৎ দেখি প্লাবিত রোদে
তোরণের মতো চৌরাস্তা | বা কলকাতার দুপুরবেলার বৃষ্টিতে,
যখন পৃথিবীটাকে খুব ছোটো আর নিবিড় মনে হয়,
আর আমি কোণের টেবিলে ঝাপসা হ’য়ে মিলিয়ে যাই |
.         ছায়া দেখি সেই পাখিদের, আমার হৃদয় নিয়ে যারা
উড়ে গিয়েছিলো |       অভিজ্ঞ তারা, সব সমুদ্র চেনে,
সব সৈকতে নেমেছে , সব নগরে বন্ধু আছে তাদের |
দেখেছি মানহাটানের ঈস্ট নদীতে তাদের ছায়া,
বাভারিয়ার হ্রদের বুকে চঞ্চল, আবার দেখছি
কলকাতার মেঘলা আকাশে |
.         সে কোন দেশ, যেখানে আমি যেতে চাই ?
সে কি যাওয়া, না ফেরা ?        না কি সন্ধান শুধু ?
মনে হয় আমার গাত্রবাস যেন অতীত, আর ভবিষ্যৎ
আমার পাইচারি করার বারান্দা  আর বর্তমান এক
অন্তহীন পিঁপড়ের সারি আমার পায়ে-পায়ে অনবরত ম’রে যাচ্ছে
.        মনে পড়ে ফোঁটা-ফোঁটা বরফ গলার শব্দ,
আর জানালার কাচে দস্তানা-পরা হাজার হাত
মনে পড়ে চৈত্রের রোদে ঝামাপুকুর গলির গন্ধ,
একটা ছেলেকে মনে পড়ে----খেলতে-খেলতে
হঠাৎ ছুটে এসে মায়ের পেয়ালায় তিন চুমুক
চা খেয়ে চ’লে গেলো |  অমন চা আর কেন হয় না ?
.        যাবার ক্ষণে মনে হয় থেকে যাই, আর ফেরার তারিখ
বার-বার পিছনে ঠেলি | যেন আছি এক এয়ারপোর্টের
হোটেলে, দুই মহাদেশের মধ্যবর্তী, আজ পৌঁছলাম,
কালই চলে যাবো, যেন এই ছিন্ন এক মুহূর্তের মধ্যে
সব বেদনার স্বাদ আমাকে নিতে হবে |  শুনেছি
না এখানে না সেখানে, না দূরে না সান্নিধ্যে
যেন আমি মহাশূন্যে ভাসমান, ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে চলছি,
আর সেই চলাও গতিহীন |
.          আমার পাখিরা, কবে ঘরে ফিরবে ?

.                   *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
এক অপরিচিতা মৃতার স্মরণে
কবি বুদ্ধদেব বসু
ডঃ ঝুমা রায়চৌধুরী  সম্পাদিত “প্রিয় কবিতা ২”  ২০১৫ থেকে নেওয়া |


বুঝেও বুঝিনি, তাকে নিয়ে গেলো নিঃশব্দে যখন
রৌদ্রে আর মসৃণ নিয়মে লিপ্ত উজ্জ্বল বিকেলে ;
বাহকেরা লব্ধজ্ঞান, সৌম্য, যেন আলোকলক্ষণ,
চলেছে বিনম্র, মৃদু, প্রায় যেন বাতাসে পা ফেলে |

( রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ব্যস্ততায় নিত্যনাগরিক ;
পথ ছেড়ে ট্রাফিক দাঁড়ায় স’রে, কখনো বা তাকায় পথিক | )

এবং দু-চারজন অনুগামী মন্থর মোটরে ;
কিছুটা বিস্মিত, মুগ্ধ – যেন কোনো অগম্য ডাকাত
সব দৃষ্টি, সব দৃশ্য, লুঠ ক’রে নিয়েছে হঠাৎ,
রেখে গেছে আশ্চর্য আঁধার শুধু চক্ষুর কোটরে |

( আশ্চর্য আঁধার---না কি অন্য এক আকাশের জ্যোতি ?
রঙিন খেলেনা সব ভেঙে দিয়ে, কেউ বুঝি পৌঁছলো সম্প্রতি | )

আর আমি, লেখা ছেড়ে, বারান্দায় শব্দের সন্ধানী,
তাকে দেখেছিলাম মিনিট দুই--- মানিনি, সে মৃতা;
মৃতা নয়--- যৌবনপ্রতিমা, নারী হৃদয়প্লাবিনী,
যেন স্বপ্নে-দেখা কোনো চিরন্তনী সম্ভাব্য বনিতা |

সুন্দর, সংহত, শ্রান্ত --- নারীত্বের আদিম স্বভাবে
সন্নত সূর্যের দিকে ঊর্দ্ধমুখ --- উন্মুক্ত, নিষ্ফল,
যেন ধীর বিশাল গ্রীষ্মের যত্নে এইমাত্র পেকে-ওঠা ফল,

নিংড়ে নিয়ে মাটির সমর্থ মদ, ঋতুর নির্যাস,
পার হ’য়ে অবিশ্বাসী অপেক্ষার ভঙ্গুর উচ্ছ্বাস,
হ’লো সে চরম, পূর্ণ | এইবার খ’সে পড়ে যাবে |

.                   *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
বৃষ্টির দিন
কবি বুদ্ধদেব বসু
ডঃ ঝুমা রায়চৌধুরী  সম্পাদিত “প্রিয় কবিতা ২”  ২০১৫ থেকে নেওয়া |


বৃষ্টি এলো, আবার বৃষ্টি! বৈশাখের রূপসী বৃষ্টি নয়, শ্রাবণের আদরে ভরা স্পর্শ
নেই, হিম বৃষ্টি, কালো বৃষ্টি, হেমন্তের শীত-নামানো বৃষ্টি |
.     আ, এই ভালো,  এই আমার ভালো লাগে |  আশ্বিনের উজ্জ্বল দিনগুলি
তাদের হীরের দাঁত দেখিয়ে ব’লে গেছে আমাকে, ‘ওরে প্রক্ষিপ্ত মানবক, বিশ্বের
অপলাপ, চেয়ে দ্যাখ আমাদের দিকে --- কী সুন্দর আমরা, কী নির্মম, উদাসীন |’
তাদের আলোর ধারে ছিঁড়ে গেছি আমি, তাদের ব্যঙ্গের ভাবে অবসন্ন |
.     সান্ত্বনা নিয়ে এলো এই দিন, এই নুয়ে-পড়া বুজে-আসা, নিরবয়ব দিন |
ঘন্টা মুছে গেছে, সময়ের কামড় আজ আর সইতে হবে না আমাকে -----
কিছুক্ষণ, অন্তত কিছুক্ষণ ছুটি ! সকাল মিশে যাবে দুপুরে, দুপুর মিলিয়ে যাবে
বিকেলে --- চিহ্ন নেই, গয়না নেই, অস্ত্র---একটানা, একাকার, ধূসর |
.      আজ  আকাশ ভ’রে মেঘ ছড়িয়ে পড়েছে আমারই আত্মার কালিমার
মতো, আর এই রূঢ় বৃষ্টির তলায় কলকাতা প’ড়ে আছে যেন কামুক স্বামীর
ভারপিষ্ট  কোনো নির্বোধ নিঃসাড় ক্লান্ত সহিষ্ণু প্রৌঢ় রমণী |
.      আমি ব’সে আছি জানলায় ; অন্ধকার মেঘের দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে
অনন্তকালের মধ্যে ডুবিয়ে দিচ্ছি আমার মনস্তাপ ---,  তিক্ত স্মৃতি, দুরন্ত
অনুশোচনা, আমার নিঃশব্দ, নিঃসঙ্গ চীত্কার |
.       এদিকে মানুষের সংসারে বেলা বাড়ে ; কেউ দোকান খুলে বসে, কেউ
ফেরে বাজার থেকে, আর একে-একে ট্র্যামের স্টপে লোকেরা এসে দাঁড়ায়---
ছাতা নিয়ে, বর্ষাতি নিয়ে, বেঁচে থাকার গম্ভীর প্রতিজ্ঞা নিয়ে, ভুলে থাকার
উদার আশ্বাসে মজ্জমান |
কী ভুলতে চায় ? বেঁচে আছে, তা-ই ভুলতে চায় |
.        শুনছো না বৃষ্টির শব্দে আকাশ ভ’রে ঘোষণা উঠছে ----পালাও ! আপিশে,
ফ্যাক্টরিতে, ফটকাবাজারে, রাজনীতির উত্তেজনায়--- যেখানে হয়, পালাও |
আর যখন সন্ধের পর আর-কিছুই থাকবে না, তখন মদ, তখন জুয়ো, তখন
পরিজীর্ণ পরিশ্রমী আলিঙ্গন | যেখানে হোক, যেমন করে হোক ---পালাও,
দুর্ভাগা জীব, লুকিয়ে রাখো তোমার চেতনার অভিসম্পাত, ডুবিয়ে দাও দিনের
পর দিনের এই আবর্তন --- এই হত্যাকারী আবর্তন ! কেননা মৃত্যু দুঃখের নয়,
তুমি যে মরছো সেটা জানতে পাওয়াই যন্ত্রণা |

.                                *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
প্রেমিক
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া | “বন্দীর বন্দনা ও অন্যান্য কবিতা”
কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


নতুন ননীর মতো তনু তব ? জানি, তার ভিত্তিমূলে রহিয়াছে কুত্সিত কঙ্কাল--
( ওগো কঙ্কাবতী )
মৃত-পীত বর্ণ তার : খড়ির মতন শাদা শুষ্ক অস্থিশ্রেণী---
জানি, সে কিসের মূর্তি | নিঃশব্দ, বীভত্স এক রূক্ষ অট্টহাসি---
নিদারুণ দন্তহীন বিভীষিকা |
নতুন ননীর মতো তনু তব ? জানি, তার ভিত্তিমূলে রহিয়াছে সেই
কঠিন কাঠামো ;
হরিণ-শিশুর মতো করুণ আঁখির অন্তরালে
ব্যধিগ্রস্ত উন্মাদের দুঃস্বপ্ন যেমন |

তবু ভালবাসি |
নতুন ননীর মতো তব তনুখানি
স্পর্শিতে অগাধ সাধ, সাহস না পাই |
সিন্ধুগর্ভে ফোটে যত আশ্চর্য কুসুম
তার মতো তব মুখ, তার পানে তাকাবার ছল
খুঁজে নাহি পাই |
মনে করি কথা কবো : আকুলিবিকুলি করে কত কথা রক্তের ঘূর্ণিতে
( ওগো কঙ্কাবতী ! )
বারেক তাকাই যদি তব মুখপানে,
পৃথিবী টলিয়া ওঠে, কথাগুলি কোথায় হারায়,
খুঁজে নাহি পাই |
দূর থেকে দেখে তাই ফিরে যাই ; ( যদি কাছে আসি,
তব রূপ অটুট র’বে কি ? )
ফিরে চ’লে যাই |
দূর থেকে ভালোবাসি দেহখানি তব---
রাতের ধূসর মাঠে নিরিবিলি বটের পাতারা
টিপটাপ শিশিরের ঝরাটুকু
যেমন নীরবে ভালোবাসে |

মোরে প্রেম দিতে চাও ? প্রেমে মোর ভুলাইবে মন
তুমি নারী,  কঙ্কাবতী,  প্রেম কোথা পাবে ?
আমারে কোরো না দান, তোমার নিজের যাহা নয় |
ধার-করা বিত্তে মোর লোভ নাই ; সে-ঋণের বোঝা
বাড়িয়া চলিবে প্রতিদিন ---
যতক্ষণ সেই ভার সর্বনাশ না করে তোমার |
সে-ঋণ করিতে শোধ দ্রৌপদীর সবগুলি শাড়ি
খুলিয়া ফেলিতে হবে |
সভামধ্যে, মোর দৃষ্টি-’ পরে
নিতান্ত নিরাবরণা, দরিদ্র, সহজ
তোমাকে দাঁড়াতে হবে ; রহিবে না আর
রহস্যের অতীন্দ্রিয় ইন্দ্রজাল |

বরং প্রেমের ভান করিয়ো না—সেই হবে ভালো ;
দূর তেকে দেখে মুগ্ধ হবো
তবু মুগ্ধ হবো |
না-ই বা চিনিলে মোরে | আমি যদি ভালোবেসে থাকি,
আমিই বেসেছি |
সে-কথা তোমার কানে নানা সুরে জপিতে চাহি না ;---
আমার সে-ভালোবাসা—তুমি তারে পারিবে না কখনো বুঝিতে |

তবু ধরা যাক |
ধরা যাক, তুমি মোরে স্থাপিয়াছো  হৃদয়ের মণির আসনে,
তুমি--- আমি ---দুজনেরই সুদৃঢ় বিশ্বাস,
তুমি মোরে ভালবাসো |
সেই অনুসারে মোরা চলি-ফিরি, কথা কই, হাতে হাত রাখি ;
লাল হ’য়ে ওঠো তুমি---অনেক লোকের মাঝে চোখে চোখ পড়ে যদি কভু,
লাল হ’য়ে উঠি আমি---পাশের লোকের মুখে তব নাম শুনি কভু যদি ;
আমার মুখের ‘পরে চুলগুলি আকুলিয়া দাও—
সেই গন্ধ রোমাঞ্চিয়া ওঠে বসুন্ধরা |

আরো কহিবো কি ?
ননীর শরীর তব যেমন রেখেছে ঢেকে কুৎসিত কঙ্কাল,
তেমনি তোমার প্রেম কোন প্রেতে করিছে গোপন---
তাহা কহিবো কি ?
আমার দুর্ভাগ্য এই, সকলি জেনেছি |
মোর কাছে এসে আজ যে-অঞ্চল টানি’ দাও সুন্দর লজ্জায়,
জানি, তাহা শ্লথ হবে কোনো-এক রাতে,---
( তখন কোথায় আমি ? )
যে-শঙ্কার শিহরণ তব দেহ-লাবণ্যেরে মোর কাছে করেছে মধুর,
( ওগো কঙ্কাবতী---
মধুর ! মধুর ! )
জানি, তাহা থেমে যাবে ধূসর প্রভাতে এক, যবে চক্ষু মেলি’
পার্শ্বস্থ জানুর দৃঢ় আকুঞ্চন থেকে
আপনার কটিতট নেবে মুক্ত করি’ |
অনিশ্চিত ভয়ে ভরা ভবিষ্যৎ--তরে
যে-উত্কন্ঠা নিত্য হানা দেয়
তোমারে-আমারে ;---
আমাদের মিলনের পরিপূর্ণতম মুহূর্তটি
যে-ব্যথায় টনটন ক’রে ওঠে ;---
তব কোলে মাথা রেখে চুলগুলি নিয়ে যবে আঙুলে জড়াই,
তখন যে বেদনায় হেরি তোমা দুষ্প্রাপ্য, দুর্লভ,
যে-বেদনা এই প্রেমে করেছে মহান,
( ওগো কঙ্কাবতী---
মহান ! মহান ! )
জানি, তুমি ভুলে যাবে সে-উত্কন্ঠা, সে-বেদনা, সেই ভালোবাসা
প্রথম শিশুর জন্মদিনে |
তোমার যে-স্তনরেখা বঙ্কিম, মসৃণ, ক্ষীণ, সততস্পন্দিত---
দেখেছি অস্পষ্টতম আমি শুধু আভাস যাহার,
যাহার ঈষৎ স্পর্শ আনন্দে করেছে মোরে উন্মাদ—উন্মাদ,
জানি, তাহা স্ফীত হবে সদ্যোজাত অধরের শোষণ-তিয়াষে |
আমারে করিতে মুগ্ধ যে-সুস্নিগ্ধ সুষমায় আপনারে সাজাতে সর্বদা,
তোমার যে-সৌন্দর্যেরে ভালোবাসি ( তোমারে তো নয় ! ),
জানি, তা ফেলিয়া দেবে অঙ্গ হ’তে টেনে---
কারণ, তখন তব জীবনের ছাঁচ
চিরতরে গড়া হয়ে গেছে,
কিছুতেই হবে নাকো তার আর কোনো ব্যতিক্রম |
সুন্দর না-হলে যদি জীবনের পাত্র হতে কোনো ক্ষতি, ক্ষয় নাহি হয়,
সুন্দর হবার গূঢ়,দুরূহ সাধনা---
ক্লেশকর তপশ্চর্যা
কে আর করিতে যায় তবে |

সব আমি জানি, তবু --- তাই ভালোবাসি,
জানি বলে আরো বেশি ভালোবাসি |
জানি, শুধু ততদিন তুমি র’বে তুমি,
যতদিন র’বে মোর প্রিয়া |
সম্মুখে মৃত্যুর গুহা, তোমার মৃত্যুর ;
ফুটছো ফুলের মতো ক্ষণতরে আজিকার উজ্জ্বল আলোতে,
প্রেমের আলোতে মোর---
তারি মাঝে যত তব ঝিকিমিকি, ফুরফুরে প্রজাপতিপনা !
তাই সেই শোভা পান করি---
আঁখি দিয়ে, প্রাণ দিয়ে, আত্মা দিয়ে, মৃত্যুর কল্পনা দিয়ে
সেই শোভা পান করি |
তোমার বাদামি চোখ--- চকচকে, হালকা, চটুল
তাই ভালোবাসি  |     
তোমার কালচে চুল, ----- এলোমেলো , শুকনো, নরম
তাই ভালোবাসি |
সেই চুল, সেই চোখ, তাহারা আমার কাছে অরণ্য গভীর,
সেথা আমি পথ খুঁজে  নাহি পাই,
নিজেরে হারায়ে ফেলি সেই চোখে, সেই চুলে--- লালচে-বাদামি,
নিজেরে ভুলিয়া যাই, আমারে হারাই ---
তাই ভালোবাসি
|                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                      

আর আমি ভালোবাসি নতুন ননীর মতো তনুলতা তব,
( ওগো কঙ্কাবতী ! )
আর আমি ভালোবাসি তোমার বাসনা মোরে ভালোবাসিবার,
( ওগো কঙ্কাবতী ! )
ওগো কঙ্কাবতী !

.                                *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
অসূর্যম্পষ্যা
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া | “পৃথিবীর পথে” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

শ্যাম মেঘপুঞ্জ যথা ঢেকে রাখে আকাশের লজ্জাহীন নীলিম নগ্নতা,
বিদ্রোহী তৃণের দল অনাবৃতা ধরিত্রীর রুক্ষ বক্ষে পরায় বসন,
প্রেমের পবিত্র ব্যথা আচ্ছাদন করি’রাখে কুমারীর কাম-চঞ্চলতা ;---
তেমনি ঢাকিয়া রাখো তোমার রূপের স্বপ্নে আমার সমস্ত প্রাণমন |
দৃশ্যমান জগতের চিহ্ন যথা লুপ্ত হয় অমাবস্যা-আঁধার-জোয়ারে,
হে অসূর্যস্পর্শ্যা, তব রূপের বন্যার স্রোতে মৃত্যু মোর ঘটুক তেমনি,
নিঃশেষে নিমগ্ন হয়ে নিজেরে হারাই যেন আনন্দে  নীরন্ধ্র অন্ধকারে,
ঝরুক তোমার প্রেম, আকাশের ফাঁকে-ফাঁকে কারা যথা ঝরায় রজনী |

তনুর ললিত ছন্দে রচিয়াছো তিলে-তিলে অপরূপ যে-কবিতাখানি,
আমার ধ্যানের মন্ত্রে নিয়ত ধ্বনিত হোক মৌন তার সুরের ঝংকার ;
প্রাণের মৃন্ময় দীপে অগ্নির অক্ষর এঁকে লিখিয়াছো যে-অপূর্ব বাণী,
মর্মের অরণ্যে মোর মর্মরি’ উঠুক দুলি’ সংগীতের তরঙ্গ তাহার |
হৃদয়ের সব সুধা সঞ্চিত করিছো যেথা গোপনের আবরণ টানি’,
মনের কামনা মোর একটি কুসুম হ’য়ে সেখানে করুক নমস্কার |

.                                *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
আর-কিছু নাহি সাধ
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া | “পৃথিবীর পথে” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


আর-কিছু নাহি সাধ |  জানি, মোর তরে নহে জয়মাল্য, যশের মুকুট ;
বিশ্বের কবিরা যত জ্বলিছে নক্ষত্র হয়ে রজনীর শ্যামল অঞ্চলে---
সেথা মোর নাহি স্থান | আমার বন্দনা-গান জাগিবে না নীল নভতলে ;
মোর করস্পর্শ কভু লভিবে না শ্রদ্ধাসিক্ত অভিষেক-পল্লবসম্পুট |
মানবের চিত্ততীর্থে নিত্যস্বর্গ নহে মোর : মরণের তিক্ত কালকূট
আমার চরম ভাগ্য | একবিংশ শতাব্দীর কোনো সপ্তদশী লীলাচ্ছলে—
মনে জানি--- পড়িবে না আমার কবিতাখানি জ্যোত্স্না-স্নাত বাতায়ন-তলে ;
সতীর্থের হৃদ্পদ্মে গন্ধরূপে ক্ষণিকের স্মৃতিস্বপ্ন --- জানি , তাও ঝুট |

তবু যে জাগিছে আজি সংগীত-তরঙ্গ-ভঙ্গ হৃদয়ের হিম সরোবরে---
সে শুধু তোমারি লাগি’ | তোমারে যে পেয়েছিনু সর্বদেহে, মর্মে-মনে-প্রাণে,
পেয়েছিনু বিরহের স্পন্দমান অন্ধকারে, মিলনের নিস্পন্দ বাসরে---
সে-কথা কহিতে চাই আকাশেরে, ধরণীরে, তৃণপত্রে, সমুদ্রের কানে ;---
পারি না বহিতে এই পরিপূর্ণতার ভার একা-একা আপন অন্তরে,
সহস্রের মাঝে তাই আপনারে বিতরণ ক’রে যাই লক্ষ গানে-গানে |

.                                *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর