বুদ্ধদেব বসুর কবিতা
*
কোনো মেয়ের প্রতি          
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া | “কঙ্কাবতী ও অন্যান্য কবিতা”
কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


একটু সময় হবে ?  পাশে গিয়ে বসিবো তোমার |---
( মোদের বাড়িতে বড়ো লোকজন, বিষম বিভ্রাট,
মায়ের মেজাজ চড়া, শিশুগুলি করিছে চীত্কার | )
টবেতে ফুলের চারা তোমাদের বাড়ির সিঁড়িতে,
নতুন সবুজ পাতা নড়িতেছে ঈষৎ হাওয়ায় :
সিঁড়ির সুমুখে ঘর, ছোটো গর, ঠাণ্ডা, পরিস্কার,
শেলাই-কলের কাছে ছোটো টুলে রয়েছো বসিয়া |
সুতো বুঝি ফুরায়েছে ? বই খোলা কোলের উপরে,
ভিজে কালো চুলগুলি এলায়ে পড়েছে সারা পিঠে,
শাদা শেমিজেরে ঘিরি’ কালো পাড় উঠেছে জড়ায়ে,
শাড়ির চওড়া পাড়,  শাদা শাড়ি, মিশকালো পাড় |
ঠিক তব পাশে নয়--- তবু কাছে, বসিবো, চৌকাঠে---
একটু সময় হবে ?

মোদের বাড়িতে বড়ো লোকজন--- কোথায় যে যাই |
বাইরে দারুণ রোদ—বেরোতেও সরে না যে মন |     
দাঁড়ায়েছি জানালায়---নড়িতেছে নতুন পাতারা,
রাস্তায় এসেছি নেমে---সিঁড়িগুলো টবেতে সাজানো ;
রাস্তাটা হয়েছি পার ---সবচেয়ে নিচের সিঁড়িটি !
মোরা কাছাকাছি থাকি, রাস্তাটির এপার-ওপার,
তুমি মোর নাম জানো, আমিও জেনেছি তব নাম |
তুমি মোর নাম শোনো, শুনেছি তোমার ডাক-নাম |
আমারে দেখিলে তুমি –- পারিবে না ? ---চিনিতে পারিবে,
আমি তো তোমারে চিনি ; মাঝখানে রাস্তাটুকু শুধু –
তারপর শাদা সিঁড়ি, লাল টবে নড়িছে পাতারা |

একটু বসিবো শুধু | থাক, তুমি না-ই বা উঠলে,
ছোটো টুলে ব’সে থাকো  বেশ আছি---এখানে ---চৌকাঠে |
ভিজে চুলগুলি দেখে সারা দেহ করিবো শীতল,
ছোটো পা দু-খানি দেখে ক্ষত মন লইবো সারায়ে |
লোকজন জড়ো হোক আকাশের রোদের মতন ;----
আমার কী এসে যায় ? তুমি ব’সে আছো মোর কাছে ;
ভিজে তব চুলগুলি ; ঘরখানি ঠাণ্ডা, পরিস্কার |

কহিবো হালকা কথা---বাজে কথা, তুমি বা বুঝিবে |
( নেহাৎ কহিতে হবে যদি ! )
সেদিনের থিয়েটার ----আমাদের পাড়ার খবর,
সবচেয়ে রূপসী কে আধুনিক সিনেমা-জগতে,
বব্ ড্ চুল ভালো কিনা ? আফ্রিকার জন্তু আর ব্যাধি |
মাঝে-মাঝে হাসিবে না ? ছলছল-ঢেউয়ের মতন |
ছলছল চলে কেউ---তার মতো বাজে তব হাসি |
জুড়াবে আমার দেহ ছলছল সেই হাসি শুনে,
জুড়াবে আমার মন ভিজে তব এলোচুল দেখে |--
সিঁড়ির সুমুখে ঘর----ছোটো ঘর---ঠাণ্ডা ----পরিস্কার ----
মোদের বাড়িতে বড়ো লোকজন ---বিষম বিভ্রাট ---
একটু সময় হবে ?

.                       *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
গান
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া | “কঙ্কাবতী ও অন্যান্য কবিতা”
কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

চোখে চোখ পড়েই যদি, নিয়ো না চোখ ফিরিয়ে,
নিয়ো না চোখ নামিয়ে -----রাখো এই ---- একটুখানি |
সীমাহীন এক নিমেষে ---খোলা ঐ জানলা দিয়ে
কী আছে তোমার মনে---য আছে, সব দেখে নিই |
বোলো না, ‘একটু সময়---দুটি চোখ ---এমন কী আর !’
গালে লাল রং এনো না, তোমাকে মানায় না তা,
ও দেখুক ভোরের আকাশ, এ দেখুক রাতের আঁধার---
আমার এ  একটু সময়--- কালো চোখ, কোমল পাতা |
কালো চোখ আলোক-ভরা, ছায়াময় কোমল পাতা,
আলো আর ছায়ার ছবি---- ঝিকিমিক আমার চোখে,
নিয়ো না চোখ ফিরিয়ে --- যা বলে বলুক লোকে---
.            চোখে চোখ পড়বে যখন |


মুখে মুখ রাখিই যদি, এমন আর দোষ কী, বলো ?
মনেরে যায় না ছোঁয়া, কেমন চাখবো তারে |
দুটি ঠোঁট----ফুরফুরে ঠোঁট, টুকটুক-রঙিন হ’লো,
ঠোকরাই পাখির মতো, খুটখুট চার কিনারে |
চারিদিক  ঠুকরিয়ে খাই, দুটি ঠোঁট ফলের মতো,
ঐ মুখ ফুলের মতো ফুটেছে আমার পানে ;
খুলে দাও চুলের বোঝা ঝপাঝপ ইতস্তত,
ফুটফুট নরম বুকে টেনে নাও বাহুর টানে |
টেনে নাও আমায় তুমি ফুটফুট নরম বুকে,
শোনো ঐ কইছে কথা হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয় !
গড়িয়ে পায়ের নিচে বয়ে যায় অসীম সময়--
.            মুখে মুখ রাখলে পরে |

.                       *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
মধ্যরাত্রে
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া | “কঙ্কাবতী ও অন্যান্য কবিতা”
কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

‘Pray but one prayer for me  ‘twixt thy closed lips,
Think but one thought of me up in the stars.’
.                                           WILLIAM  MORRIS

ভাবিয়ো আমার কথা একবার তারা-ভরা আকাশের তলে,
কহিয়ো আমার নাম একবার নিশীথের বাতাসের কানে ;
নয়ন তুলিয়া তব চাহিয়ো একটিবার আকাশের পানে,
একবার মুখ তুলে ডাকিয়ো আমার নাম বাতাসের কানে |
আকাশে তারার ভিড়, আকাশে রূপার রেখা বাঁকা চাঁদ জ্বলে ;
রজনী গভীর হয় ; বাতাসে মদির গন্ধ ; চাঁদ পড়ে ঢ’লে ---
চাঁদের রূপালি রেখা লাল হ’য়ে ঢ’লে পড়ে পশ্চিমের কোলে |
রজনী গভীর হয় ; আকাশ আঁধার হ’য়ে আসে পলে-পলে---
ক্লান্ত চাঁদ ঢ’লে পড়ে, ক্লান্ত আঁখি ঢুলে আসে আকাশের তলে |
ভাবিয়ো আমার কথা একবার তারা-ভরা আকাশের তলে,
কহিয়ো আমার নাম একবার নিশীথের বাতাসের কানে |
বাতায়নে তারা জাগে, চাঁদের রূপালি আলো শয়ন-শিথানে,
শিশিরের মতো ঘুম ঝ’রে পড়ে নিশীথের আকাশের তলে ,
নয়ন জড়ায়ে আসে, নয়ন ভরিয়া যায় স্বপ্নের ফসলে ;
রাতের ঘুমের আগে কহিয়ো আমার নাম বাতাসের কানে,
কহিয়ো আমার নাম ভালোবেসে একবার বালিশের কানে ;
রাতের ঘুমের আগে ভাবিয়ো আমার কথা আকাশের তলে,
নয়ন মেলিয়া তব চাহিয়ো একটিবার জানালার পানে,
একবার মুখ খুলে ডাকিয়ো আমার নাম বালিশের কানে ;
তারপর চোখ বুজে দেখিয়ো আমার মুখ আঁধারের তলে,
দেখিয়ো আমার মুখ একবার ঘুমে-ভরা আঁধারের তলে---
রাতের ঘুমের আগে দেখিয়ো আমার মুখ নয়নের তলে,
দেখিয়ো আমার মুখ একবার নয়নের পল্লবের তলে |
---- কহিয়ো আমার নাম একবার নিশীথের বাতাসের কানে,
ভাবিয়ো আমার কথা একবার তারা-ভরা আকাশের তলে,
.      ---- তারা-ভরা আকাশের, তারা-ঝরা জানালার তলে,
.      নিশীথের বাতাসের, ঘুমে ভরা বালিশের কানে |

.                       *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
স্পর্শের প্রজ্বলন        
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া | “স্পর্শের প্রজ্বলন” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

এমন দিনে তারে বলা যায়,
আজকের মতো এই বর্ষার দিনে |

কিন্তু বলবার কিছু নেই যে |      
এখন আর
কিছু বলবার কথা নেই ;                    
এখন শুধু স্পর্শের স্বাক্ষর,
স্পর্শের প্রজ্বলন |   

স্পর্শ, স্পর্শ !
আগুনের শাঁস,
ঈশ্বরের শরীর |    
এখন আর কিছু বলবার নেই |
এখন শুধু স্পর্শের লাল ফুলের উন্মীলন |

কেন আমি একা?         
কেন আমার বুকের মধ্যে  এই বর্ষার হাওয়ার হাহাকার ?
কেন তুমি একা,
তোমার মুখ অমন ম্লান কেন, কেন তোমার চোখের নিচে ক্লান্তির কালো ফুল ?   

কেন আমাদের মাঝখানে এই মানুষের দেয়াল ?

.                       *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
জন্ম         
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া | “নতুন পাতা” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

তোমাকে বুকে ক’রে, তোমাকে বুকে ভ’রে কাটে আমার রাত্রি |    
সমস্ত চিরকাল সেই উত্তাল অন্ধকার-মন্থিত মুহূর্তে
থমকে দাঁড়ায় ---যেন পথ হারায় অন্ধ অবায়ু চিরায়ু মহাশূন্যের যাত্রী---
কোন উদ্যত খড়্ গের মতো আমার উত্তপ্ত মাংসের মধ্যে খুঁড়তে |      

তোমাকে বুকে রেখে, তোমার মুখের মধ্যে ঢেকে আমার মুখের আহত,
.     বিক্ষত ক্লান্তি
প্রতি নিশ্বাসে আমি নিঃশেষে শোষণ করি      তোমার রাত্রির শক্তির উত্স :
হে চোখ-ধাঁধানো চূড়া ! আমার দৃষ্টি যে ফুরায়--- এ কী জলন্ত অশান্তি,
.      এ কী শান্তি !
হে অদৃশ্য, কবোষ্ণ বন্যা, স্পর্শময় প্রাণ-ঝরনা, কোন সংগোপন সুড়ঙ্গ থেকে
.      তুমি উঠছো !

আগ্নেয়, দুঃসহ, তীব্র,        উত্তাল, বিশাল এই রাত্রি |
কাঁপে পাহাড়, ভাঙে কঙ্কাল-হাড়, জাগে সুড়ঙ্গে জোয়ার, অদম্য |
হে দৃষ্টি-অন্ধ-করা যুগ্ম চূড়া, এ কোন যজ্ঞ ? বলো, তুমিই কি ধাত্রী
দিগন্তে ঘুমন্ত সূর্যের ? হে অন্ধকার, তুমি কি মৃত্যুর, তুমি কি জন্মের সিংহদ্বার ?
এ কী অসহ্য মৃত্যু ! এ কী উজ্জ্বল, অলজ্জ নব জন্ম !

.                            *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
এখন যুদ্ধ পৃথিবীর সঙ্গে
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া | “নতুন পাতা” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

এখন যুদ্ধ পৃথিবীর সঙ্গে, এই পৃথিবীর |
একদিকে আমি, অন্যদিকে তোমার চোখ স্তব্ধ, নিবিড় ;
মাঝখানে আঁকাবাঁকা ঘোর-লাগা রাস্তা এই পৃথিবীর |

আর এই পৃথিবীর মানুষ তাদের হাত বাড়িয়ে
লাল রেখা আঁকতে চায়, তোমার থেকে আমাকে ছাড়িয়ে
জীবন্ত, বিষাক্ত সাপের মতো তাদের হাত বাড়িয়ে |

আমার চোখের সামনে স্বর্গের স্বপ্নের মতো দোলে
তোমার দুই বুক ; কল্পনার গ্রন্থির মতো খোলে
তোমার চুল আমার বুকের উপর ; ঝড়ের পাখির মতো দোলে

আমার হৃৎপিণ্ড ; আমরা ভয় করবো কাকে ?
আমরা তো জানি কী আছে এই রাস্তার এর পরের বাঁকে---
সে তো তুমি---- তুমি আর আমি : আর কাকে

আমরা দেখতে পাবো ? আমার চোখে তোমার দুই বুক
স্বর্গের স্বপ্নের মতো ; তোমার বুকের উপর উত্তপ্ত, উত্সুক
আমার হাতের স্পর্শ ; কূল ছাপিয়ে ওঠে তোমার দুই বুক
                                  
আমার হাতের স্পর্শে, যেন কোনো অন্ধ অদৃশ্য নদীর
খরস্রোত ; তার মধ্যে এই সমস্ত দুরন্ত পৃথিবীর
চিহ্ন মুছে যায় ; শুধু এই বিশাল অন্ধকার নদীর

তীব্র আবর্ত, যেখানে আমরা জয়ী, আমরা এক, আমি
আর তুমি--- কী মধুর, কী অপরূপ-মধুর এই কথা---
.                তুমি---তুমি আর আমি |

.                            *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
দয়াময়ী মহিলা
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া | “নতুন পাতা” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

আমার দুঃখ দেখে দয়া হয় কি তোমার
দয়াময়ী মহিলা ?
তাই কি আমার কাছে আসতে চাও---
দয়ময়ী মহিলা !

থাক, দাঁড়াও ওখানেই, মুখ ফেরাও,
করুণাময়ী !
মরতে দাও আমাকে একা, কিন্তু তোমার
ঐ দয়ার দেবীত্বের লীলা

তা থেকে আমাকে বাঁচাও, বাঁচাও |
ফিরে যাও, হে দেবী, ফিরে যাও
যেখানে তোমার স্বরক্তের শাখা-প্রশাখা,
তোমার উত্স, তোমার মূল,

যখান থেকে দয়া ক’রে এসেছিলে
আমাকে একা দেখে, ভালোবেসে,
আমাকে ভালোবেসে--- কী ভূল !

কে চায় তোমার ভালোবাসা, কে চায় !
তোমার ঐ শাদা দয়ার ভালোবাসা কে চায়, বলো !
নিয়ে যাও, ফিরিয়ে নিয়ে যাও, হে দেবী-অতিথি ---
কেঁদো না, ঐ তোমার চোখের ছলোছলো

করুণ দৃষ্টি অনেক মেরেছে আমাকে |
কাঁদতে-কাঁদতে তুমি এসেছিলে ---কেন এলে ?
অত কান্নার দাম আমার মধ্যে নেই,
সত্য ক’রে বলি |

এখন আর কেঁদো না, যাও ; ফিরে-ফিরে
আর তাকিয়ো না ; আমিও
অনেক কেঁদেছি, অনেক  বুক ভেঙে গেছে ;
তোমার করুণার অমিয়

সে-ফাটা জোড়া লাগাবে না ; যাও তুমি,
যেখানে তোমার শান্তির ছায়া,
তোমার জন্ম-তরুর মূল আর শাখা |
---আমার রাস্তায় অনেক কাঁটা, অনেক আঁকাবাঁকা |

আমার মধ্যে শান্তি পাবে না এ তো জানতেই |
আমি ক্ষুধিত, আমি অস্থির, আমি নিষ্ঠুর,
চীৎকার ক’রে আমি চাই, চাই, চাই,
হয়তো কোনদিন ভেঙে ফেলতুম তোমার মধুর

দেবী –প্রতিমা, লোকে ছী-ছি বলতো | যাক, ভালই  হ’লো,
এ-খেলা যে ভাঙলো, ভালোই হ’লো |
এবার তো দেখলে আমার চরম নগ্নতা---
কী হিংস্র আমি, নির্লজ্জ, নিষ্ঠুর !

নির্লজ্জের মতো চেয়েছিলুম তোমাকে
সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র তুমি |
আর-কেউ নয়, আর-কিছু নয়, শুধু তুমি---
তুমি !

আর তুমি কি চাও আমাকে সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে মিলিয়ে,
কোনোখানে একটু খোঁচ থাকবে না, একটু চিড় |
নিজেকে হাজার টুকরো ক’রে দেবো বিলিয়ে

যত-কিছু তুমি ভালোবাসো, সবার মধ্যে,
নানা আয়োজনে, নানা অনুষ্ঠানে,
রীতিপালনে, নিয়মরক্ষায় | সবই সুন্দর,
ছন্দের সুষমায় গাঁথা ! ----নিতে আমাকে কুড়িয়ে,

ভাঙা টুকরোগুলো ভালোবাসার সুতো দিয়ে গেঁথে !
ক্ষমা করো আমাকে --- অন্য সব ভালোবাসা আমার গেছে ফুরিয়ে

তোমাকে ভালোবেসে  নির্বোধের মতো চেয়েছিনু তোমাকে
সমস্ত পৃথিবী থকে বিচ্ছিন্ন করে --- তুমি আমার, আমার !
দ্যাখো, এই তো আমার ভালোবাসা, যা আমি দিতে পারি,

এতে উন্মত্ততা, এতে সর্বনাশ |   এ কি তোমার সইবে ?
আমার চুম্বনের ধারে তুমি কি ছিঁড়ে যাবে না ?
ভয় নেই--- আমিও ছিঁড়ে গেছি আমার বাসনার ধারে |

ভয় নেই তোমার, তুমি যাও,
যাও, ছলোছলো চোখে ফিরে-ফিরে চেয়ো না,
একা মরতে দাও আমাকে |

জানি তোমার ছলোছলো চোখ, জানি কান্না ;
আমারও বুক কান্নায় ভেঙে গেছে |
এখন আমার ভাঙাচোরা টুকরোগুলো কুড়িয়ে

তুমি কি দয়া দিয়ে বাঁচাতে চাও ? যাও, এগিয়ো যাও,
হাওয়ায় তোমার কালো চুল দাও উড়িয়ে,
ঝেঁটিয়ে নিয়ে যাক তোমার বুকের ঠাণ্ডা দয়া |

হও নিষ্ঠুর ; তোমার ভালোবাসা যাক ফুরিয়ে,
ভয় কোরো না | তবু হোক তোমার বুক আগুনের উত্স,
আমাকে পোড়াও আগুনের ঝরনায়, যদি পারো,
তোমার ঘৃণার চাবুকে মারো আমাকে, মারো,

হও স্ত্রী, হও স্ত্রীলোক—দয়ার শ্বেত দেবী নয়,
নয় নিয়মের ছন্দে ঢালা মহিলা !
অনেক দেখেছি তোমার দয়া-শ্বেত ভালোবাসার লীলা---
আর নয় !

.                            *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
পাণ্ডুলিপি
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া | “নতুন পাতা” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

অজীর্ণ রোগে শীর্ণ, মগজে
পক্ষপাতী পাটিগণিত ঠাশা ;
মাথার অল্প চুল তেলে চিকচিকে,
চোখ দুটো ধূর্ত, লোভে হলদে |
সে তার তেল-চিটচিটে, স্যাঁৎসেঁতে আঙুল দিয়ে
নেড়ে-চেড়ে দেখছে আমার পাণ্ডুলিপির
হংস-শুভ্র পাতাগুলো,
যা এর আগে আমি ছাড়া কেউ ছোঁয়নি ;
আর তার ধূর্ত চোখের ছোটো-ছোটো গর্ত
আমার দিকে মিটমিট করে বলছে---
.                        ‘এ-বই আপনার চলবে তো ?’

মনে পড়লো সারা রাত জেগে এই বই যখন শেষ করেছিলুম |
নিজেকে মনে হয়েছিলো দেবতা, কী অপরূপ !
যেন এই শাদা পাতাগুলো দিয়ে ছোটো একটি সূর্য আমি তৈরি করেছি,
একটি সূর্য, আমারই প্রাণে জলন্ত |

.        আর সেই কাক-ভোরে
.        বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ
.        ঘুমাতে পারিনি আনন্দে |
.        যে গাইতে পারে তার গলা বেয়ে যেমন ওঠে গান,
.        তেমনি আনন্দ উঠেছিলো আমার বুক ঠেলে |
.        ক্লান্ত শরীর, চোখে ঘুমের তৃষ্ণা, তবু আনন্দে
.        ঘুমোতে পারিনি |

আর তারপর এই ধূর্ত চোখের ছোটো-ছোটো মিটমিটে গর্ত
আর লোভে-চিটচিটে দুটো থাবা
আমার সূর্য-শুভ্র পাণ্ডুলিপিটা চটকাচ্ছে

.        ভেবেছিলুম একটা মিব়্যাকল ঘটবে, ঘটলো না
.        ফেটে পড়লো না আমার ছোটো সূর্য, দারুণ বিস্ফোরণে |
.        সে তার নোংরা স্যাঁৎসেঁতে আঙুলগুলো রাখলো আমার লেখার গায়ে---
.              তবু বেঁচে রইলো |

.                        অবাক হ’য়ে গেলুম |

.                                      *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
দময়ন্তী
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া | “দময়ন্তী” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


বিময় বৃদ্ধের বিদ্যা | দাম্ভিক যৌবন
মনে করে সূর্য তারই সম্ভোগের পথের প্রদীপ,
তারার সেনানী তারই রতি-হ্রস্ব রাত্রির পাহারা |
উদ্ধত সে,
নগন্য সংকল্প তার নষ্ট হ’লে অদৃষ্টের দোষে
বিশ্বে নিন্দে, আপানারে অক্ষম ধিক্কারে
ক্ষত করে :
‘আমি হৃতস্বার্থ, তাই সূর্য কেন্দ্রচ্যুত |’

সহস্র বসন্ত ছিলো আমার যৌবন |
সহস্র চৈত্রের রাত্রি চৈত্ররথ-বনে
কাটায়েছি | সেই রাত্রি, পুঞ্জ-পুঞ্জ বসন্তের মন্থিত অমৃত
যেদিন শরীরে তোর মুঞ্জরিবে, রে কন্যা আমার,
তোর পাণিপার্থী হ’য়ে দেবত্রয় আসিবে সেদিন,
স্বয়ং মহেন্দ্র, অযোনিজ অগ্নি, কালান্তক যম |

স্বর্গ তোরে চায়, যজ্ঞ তোরে চায়, মৃত্যু তোরে চায় |
কিন্তু যৌবনের জাদু স্বর্গ রচে জন্তুর গুহায়,
নাভিমূলে যজ্ঞবেদী, মৃত্যু আরো নিচে |
একদিন হংসদূত এসে
তারই সংগোপন মন্ত্র  জপে গেছে তোর কানে-কানে,
শুনায়েছে প্রিয়তম নাম |
‘প্রণাম, প্রণাম,
দেবগণ, ক্ষমা করো, ত্রাণ করো বিপন্নারে,
যেন চিনি তারে
সহস্র নলের মধ্যে, এই বর দাও |’

ফিরে যাবে দেবগণ |  ওরে দেববিজয়িনী
যৌবনগর্বিণী কন্যা,
রে কন্যা আমার,
সেদিন মুখশ্রী তোর পূর্ণিমার মতো
আকর্ষিবে উচ্ছল অশ্রুর বেগ দু-জনের চোখে ---
নয়, নয় বিচ্ছেদের শোকে,
আনন্দে, স্মৃতির স্রোতে, অতীতের উত্তরাধিকারে |

শোন তোরে বলি ;
যে-ত্রিবলি
তোর জন্ম-সিংহদ্বারে প্রহরীপ্রতিমআজো তা লাবণ্যময়, করুণ, মধুর |
যে-বন্ধুর
শরীর লজ্জিত, আজো, আপনার আকর্ষণ জেনে,
একদিন তার স্বয়ংবরে
স্বয়ং মহেন্দ্র. যম, বৈশ্বানরে
ক্ষুণ্ণ করে যে-মর যৌবন
হয়েছিলো জয়ী,
তার দম্ভে শ্বেত কেস আজ ব্যঙ্গ করে,
কালাঙ্কিত কপোলে ললাটে
দেবতারই বিপরীত প্রতিপত্তি রটে |

তবু জৈব জাদু ব্যর্থ নয় |
যে-প্রণয়
বিবসন, বিশুদ্ধ, জান্তব
মৃত্যু নেই তার |
আছে শুধু রাপান্তর, আয়ুর সর্পিল সোপানে-সোপানে
আছে নবজীবনের অঙ্গীকার |
যে-মূহূর্তে বাসনাবিহ্বল নীবি
খসে পড়ে, দেখা দেয় কালের প্রলয়-জলে
সর্বঘ্ন তিমির-তলে অলজ্জ বদ্বীপ,
অমনি থমকে কাল ; অদৃষ্টের করাল কুহেলি
দীর্ণ করে আদিম পুরুষ
লভে সপ্তদশদ্বীপা সসাগরা পৃথিবীরে ;         
নির্ভয়ে উতরে
স্বগৃহে, স্বরাজ্যে, শান্তির কঠিন তীরে
পুনর্জিত স্বর্গের দুয়ারে |
শিহরে, শিহরে
আজিও সে-কথা মনে হ’লে
এ-জীর্ণ তনুর অন্তরালে
অকাল কঙ্কাল ---
যে মুহূর্তে তরঙ্গিত সময়-সলিলে
দ্বিখণ্ডিত হলো ক্রুর অদৃষ্টের শিলা,
ম্লান হলো হুতাশন, ব্যর্থ হলো যমদণ্ড, ইন্দ্রের -----
বিশ্বাস না হয় যদি, জননীরে শুধায়ে দেখিস |

কিন্তু শেষ শিক্ষা আছে বাকি |            
ক্লান্ত আজ স্বেচ্ছাচারী অজ্ঞান বৈশাখী
একদিন উন্মাদ নৃত্যের তালে-তালে
পঞ্জরে যে মুঞ্জরেছে, সংকীর্ণ কঙ্কালে
করেছে সকাম |
স্তব্ধ আজ রললোল ; বিলোল আকাশগঙ্গা
ঝরে না ঝরে না আর নীহারিকা-স্বপ্নাকুল উত্সুক নিশীথে ;            
অন্ধকারে, চন্দ্রালোকে, সন্ধ্যায় নিভৃতে
শরীরসীমান্ত বার-বার
বিচূর্ণ  হয় না আর
উপপ্লাবী বাসনার বর্বর জোয়ারে |
জরার জটীল রেখা শরীরেরে
কঠিন পাথরে ঘেরে ;
এ-দুর্গম দুর্গে বন্দী, অনাক্রমণীয়,
নিশিন্ত আমার সত্তা ; অনর্গল, অক্লান্ত ইন্দ্রিয়
এতদিনে রুদ্ধ হ’লো |  অপরাহ্ন ছিন্ন-অঙ্গ মেঘে
সবুজ হলুদ নীলে পশ্চিমে অন্তিম
বাসর সাজালো |
সূর্যাস্তের জাদুকর আলোর আয়না
হাতে নিয়ে সন্ধ্যা নামে : ধকারে জলে শুধু ছায়ার, স্ম়ৃতির
অফুরন্ত ভীড় | এ-শরীর অবলুপ্ত জান্তব যৌবনে
হঠাৎ হারায় |  কল্পনা বাড়ায় প্রেত-হাত
দীর্ঘ ছায়া পার হ’য়ে অতীতেরে আনে সে ছিনায়ে |     
সেখানে এখন
বিনষ্ট সংকল্প পূর্ণ, সার্থক ধিক্কৃত অনটন,
স্বার্থ-কেন্দ্র-চ্যুত বিশ্ব ফিরেছে আদিম মহিমায় |
জীবনের সমাপ্তিসীমায়
শেষ শিক্ষা এ-ই ছিলো বাকি |

শিখেছি বৃদ্ধের বিদ্যা | হাস্যকর, নশ্বর, একাকী,
ব’সে-ব’সে চেয়ে দেখি দাম্ভিক যুবক-দল চলে কলোচ্ছ্বাসে,
আর দেখি তোরে, ওরে
দেব-বিজয়িনী যৌবনগর্বিণী কন্যা, রে কন্যা আমার !
সহস্র নলের ছল ব্যর্থ হবে, ফিরে যাবে
ইন্দ্র, যম, বৈশ্বানর ; দুঃখের কুটিল
অরণ্য পুষ্পিত হবে চৈত্ররথ বনে
তোর যৌবনরে ঘিরে | সেদিন আমার
কাল-কলঙ্কিত, তুচ্ছ শরীরে  তাকায়ে
এ-কথা বিশ্বাস তোর কখনো হবে না---
সহস্র বসন্ত ছিলো আমার যৌবন,
সহস্র চৈত্রের রাত্রি কাটায়েছি মুহূর্তের পরিপূর্ণতায় |
কবে এলো হংসদূত, ক’য়ে গেলো প্রিয়তম নাম,
স্বতঃশ্লথ নীবিবন্ধে আনন্দের ঢেউ তুলে—
সেদিন কখনো ভুলে
ওরে স্বয়ংবরা, তোর এ-কথা হবে না মনে---
যে-নারীর দেহ এই পৃথিবীতে তোর সিংহদ্বার
এ-প্রণয় তারই উত্তরাধিকার,
এ বিশ্ববিজয় তারই কাহিনীর পুনরভিনয় |

তাই তো বিনয়
হৃতশক্তি বৃদ্ধের সম্বল |
অপেক্ষার যে কলাকৌশল
ধৈর্যের যে-চতুরালি ধনী যৌবনের
ব্যঙ্গের বিষয়, দরিদ্র বার্ধক্য তাই দিয়ে
জীবনের ব্যবসার প্রাক্-প্রালয়িক
ভবিষ্যৎহীন দিনগুলি
সযত্নে সাজায় | অবাস্তব, তুচ্ছ, অনর্থক,
পরিত্যক্ত, বিবর্ণ পুতুল----
ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো, আর
কয়েকটি হাড়---
এ-ই আমি, এ-ই আমি | তাই বলি
বলি বার-বার,
‘অপেক্ষা শেখাও,
শেখাও ধৈর্যের নীরবতা,
এ-বিশ্বে ফিরায়ে দাও আদিম মহিমা |
আমার ইচ্ছার
চক্র থেকে মুক্ত করো সূর্য, চন্দ্র, সমুদ্র, পাহাড়,
তারার জ্বলন্ত নৃত্য, পৃথিবীতে সবুজের খেলা,
আকাশের সোনালি-নীলের মেলা ;
মুক্ত করো জন্ম, মৃত্যু ; আমার প্রেমেরে---
প্রেমেরেও মুক্তি দাও ইচ্ছার শৃঙ্খল থেকে----‘

আজ তোরে দেখে,
হে নবযৌবনা কন্যা , রে কন্যা আমার,
আমার প্রেমের মুক্তি | দেখি চেয়ে-চেয়ে---
আজিও করাল কাল ঘুমন্ত যেখানে---
পূর্ণিমা-মুখশ্রী তোর, পার্থিব আমরা |
তার জরা
সূর্যের মৃত্যুর মতো
নিশ্চিত, অথচ
অসম্ভব মনে হয় ; মনে হয়
কাল, তাও তুচ্ছ যেন, এ-বিশ্বের স্থবির ঘটনা,
রূপান্তরহীন |
লক্ষ রাত্রি, লক্ষ দিন
কেটে যায়--- নাকি আসে ফিরে ফিরে
মৃত্তিকার মূর্তি দিতে চিরন্তনী দময়ন্তীরে ?

.                       *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
ছায়াচ্ছন্ন হে আফ্রিকা
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া | “দময়ন্তী” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


ছায়াচ্ছন্ন হে আফ্রিকা,
.          শেষ তব শীর্ণ ছায়া শুষে নিলো আজ
.                    শুভ্র সভ্যতার সূর্য |
.                    করো, জয়ধ্বনি করো,
.                        ছিন্ন হ’লো ঘন অন্ধকার
.                            মেঘবর্ণ মেখলা লুন্ঠিত---
.                               ঐ এলো প্রেমিক বণিক-বীর
.                    তব নগ্ন কৌমার্যের্ ত্বরিতে করিতে
.                                সভ্যতাসন্তানবতী
.                     দীর্ণ তব হৃৎপিণ্ডের রক্তের যৌতুকে |

.                      হে আফ্রিকা, হও গর্ভবতী |
.             আনো, আনো বাণিজ্যের জারজেরে
.                       দ্রুত তব অঙ্কতলে |
.                            পূর্ণ হোক কাল |
.                         স্থূলোদর লোলজিহ্ব লোভ
.                        রক্তস্ফীত বাণিজ্যের বীজ
.                            হোক, পূর্ণ হোক |
.                                         করো,
.                বিকলাঙ্গ, পক্ষাঘাত-পঙ্গু, নপুংসক বিকৃত জাতক,
.                          তার জয়ধ্বনি করো |
.                 উন্মত্ত কামার্ত ক্লীব, আত্মরক্ষা আত্মহত্যা তার |

.           হে আফ্রিকা,
.                  অবসন্ন বণিকবৃত্তির নিহিত মৃত্যুর পরে
.                          বিদ্যুৎ-চমকে
.                  কালের কুটিল গতি গর্ভবতী করিবে কঙ্কালে |
.                  হে আফ্রিকা, হে গণিকা-মহাদেশ,
.                         একদিন তব দীর্ণ বিষুবরেখার
.                         শতাব্দীর পুঞ্জ-পুঞ্জ অন্ধকার
.                         উদ্দীপিত হবে তীব্র প্রসব-ব্যথায় |
.                                     করো,
.                   মৃত্যুরে মন্থন করি’ নবজন্ম কাঁপে থরোথরো,
.                                    জয়ধ্বনি করো |

.                                                  *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর