গান কবি বুদ্ধদেব বসু বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া | “কঙ্কাবতী ও অন্যান্য কবিতা” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।
চোখে চোখ পড়েই যদি, নিয়ো না চোখ ফিরিয়ে, নিয়ো না চোখ নামিয়ে -----রাখো এই ---- একটুখানি | সীমাহীন এক নিমেষে ---খোলা ঐ জানলা দিয়ে কী আছে তোমার মনে---য আছে, সব দেখে নিই | বোলো না, ‘একটু সময়---দুটি চোখ ---এমন কী আর !’ গালে লাল রং এনো না, তোমাকে মানায় না তা, ও দেখুক ভোরের আকাশ, এ দেখুক রাতের আঁধার--- আমার এ একটু সময়--- কালো চোখ, কোমল পাতা | কালো চোখ আলোক-ভরা, ছায়াময় কোমল পাতা, আলো আর ছায়ার ছবি---- ঝিকিমিক আমার চোখে, নিয়ো না চোখ ফিরিয়ে --- যা বলে বলুক লোকে--- . চোখে চোখ পড়বে যখন |
মুখে মুখ রাখিই যদি, এমন আর দোষ কী, বলো ? মনেরে যায় না ছোঁয়া, কেমন চাখবো তারে | দুটি ঠোঁট----ফুরফুরে ঠোঁট, টুকটুক-রঙিন হ’লো, ঠোকরাই পাখির মতো, খুটখুট চার কিনারে | চারিদিক ঠুকরিয়ে খাই, দুটি ঠোঁট ফলের মতো, ঐ মুখ ফুলের মতো ফুটেছে আমার পানে ; খুলে দাও চুলের বোঝা ঝপাঝপ ইতস্তত, ফুটফুট নরম বুকে টেনে নাও বাহুর টানে | টেনে নাও আমায় তুমি ফুটফুট নরম বুকে, শোনো ঐ কইছে কথা হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয় ! গড়িয়ে পায়ের নিচে বয়ে যায় অসীম সময়-- . মুখে মুখ রাখলে পরে |
জন্ম কবি বুদ্ধদেব বসু বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া | “নতুন পাতা” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।
তোমাকে বুকে ক’রে, তোমাকে বুকে ভ’রে কাটে আমার রাত্রি | সমস্ত চিরকাল সেই উত্তাল অন্ধকার-মন্থিত মুহূর্তে থমকে দাঁড়ায় ---যেন পথ হারায় অন্ধ অবায়ু চিরায়ু মহাশূন্যের যাত্রী--- কোন উদ্যত খড়্ গের মতো আমার উত্তপ্ত মাংসের মধ্যে খুঁড়তে |
তোমাকে বুকে রেখে, তোমার মুখের মধ্যে ঢেকে আমার মুখের আহত, . বিক্ষত ক্লান্তি প্রতি নিশ্বাসে আমি নিঃশেষে শোষণ করি তোমার রাত্রির শক্তির উত্স : হে চোখ-ধাঁধানো চূড়া ! আমার দৃষ্টি যে ফুরায়--- এ কী জলন্ত অশান্তি, . এ কী শান্তি ! হে অদৃশ্য, কবোষ্ণ বন্যা, স্পর্শময় প্রাণ-ঝরনা, কোন সংগোপন সুড়ঙ্গ থেকে . তুমি উঠছো !
আগ্নেয়, দুঃসহ, তীব্র, উত্তাল, বিশাল এই রাত্রি | কাঁপে পাহাড়, ভাঙে কঙ্কাল-হাড়, জাগে সুড়ঙ্গে জোয়ার, অদম্য | হে দৃষ্টি-অন্ধ-করা যুগ্ম চূড়া, এ কোন যজ্ঞ ? বলো, তুমিই কি ধাত্রী দিগন্তে ঘুমন্ত সূর্যের ? হে অন্ধকার, তুমি কি মৃত্যুর, তুমি কি জন্মের সিংহদ্বার ? এ কী অসহ্য মৃত্যু ! এ কী উজ্জ্বল, অলজ্জ নব জন্ম !
পাণ্ডুলিপি কবি বুদ্ধদেব বসু বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া | “নতুন পাতা” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।
অজীর্ণ রোগে শীর্ণ, মগজে পক্ষপাতী পাটিগণিত ঠাশা ; মাথার অল্প চুল তেলে চিকচিকে, চোখ দুটো ধূর্ত, লোভে হলদে | সে তার তেল-চিটচিটে, স্যাঁৎসেঁতে আঙুল দিয়ে নেড়ে-চেড়ে দেখছে আমার পাণ্ডুলিপির হংস-শুভ্র পাতাগুলো, যা এর আগে আমি ছাড়া কেউ ছোঁয়নি ; আর তার ধূর্ত চোখের ছোটো-ছোটো গর্ত আমার দিকে মিটমিট করে বলছে--- . ‘এ-বই আপনার চলবে তো ?’
মনে পড়লো সারা রাত জেগে এই বই যখন শেষ করেছিলুম | নিজেকে মনে হয়েছিলো দেবতা, কী অপরূপ ! যেন এই শাদা পাতাগুলো দিয়ে ছোটো একটি সূর্য আমি তৈরি করেছি, একটি সূর্য, আমারই প্রাণে জলন্ত |
. আর সেই কাক-ভোরে . বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ . ঘুমাতে পারিনি আনন্দে | . যে গাইতে পারে তার গলা বেয়ে যেমন ওঠে গান, . তেমনি আনন্দ উঠেছিলো আমার বুক ঠেলে | . ক্লান্ত শরীর, চোখে ঘুমের তৃষ্ণা, তবু আনন্দে . ঘুমোতে পারিনি |
আর তারপর এই ধূর্ত চোখের ছোটো-ছোটো মিটমিটে গর্ত আর লোভে-চিটচিটে দুটো থাবা আমার সূর্য-শুভ্র পাণ্ডুলিপিটা চটকাচ্ছে
. ভেবেছিলুম একটা মিব়্যাকল ঘটবে, ঘটলো না . ফেটে পড়লো না আমার ছোটো সূর্য, দারুণ বিস্ফোরণে | . সে তার নোংরা স্যাঁৎসেঁতে আঙুলগুলো রাখলো আমার লেখার গায়ে--- . তবু বেঁচে রইলো |
শোন তোরে বলি ; যে-ত্রিবলি তোর জন্ম-সিংহদ্বারে প্রহরীপ্রতিমআজো তা লাবণ্যময়, করুণ, মধুর | যে-বন্ধুর শরীর লজ্জিত, আজো, আপনার আকর্ষণ জেনে, একদিন তার স্বয়ংবরে স্বয়ং মহেন্দ্র. যম, বৈশ্বানরে ক্ষুণ্ণ করে যে-মর যৌবন হয়েছিলো জয়ী, তার দম্ভে শ্বেত কেস আজ ব্যঙ্গ করে, কালাঙ্কিত কপোলে ললাটে দেবতারই বিপরীত প্রতিপত্তি রটে |
তবু জৈব জাদু ব্যর্থ নয় | যে-প্রণয় বিবসন, বিশুদ্ধ, জান্তব মৃত্যু নেই তার | আছে শুধু রাপান্তর, আয়ুর সর্পিল সোপানে-সোপানে আছে নবজীবনের অঙ্গীকার | যে-মূহূর্তে বাসনাবিহ্বল নীবি খসে পড়ে, দেখা দেয় কালের প্রলয়-জলে সর্বঘ্ন তিমির-তলে অলজ্জ বদ্বীপ, অমনি থমকে কাল ; অদৃষ্টের করাল কুহেলি দীর্ণ করে আদিম পুরুষ লভে সপ্তদশদ্বীপা সসাগরা পৃথিবীরে ; নির্ভয়ে উতরে স্বগৃহে, স্বরাজ্যে, শান্তির কঠিন তীরে পুনর্জিত স্বর্গের দুয়ারে | শিহরে, শিহরে আজিও সে-কথা মনে হ’লে এ-জীর্ণ তনুর অন্তরালে অকাল কঙ্কাল --- যে মুহূর্তে তরঙ্গিত সময়-সলিলে দ্বিখণ্ডিত হলো ক্রুর অদৃষ্টের শিলা, ম্লান হলো হুতাশন, ব্যর্থ হলো যমদণ্ড, ইন্দ্রের ----- বিশ্বাস না হয় যদি, জননীরে শুধায়ে দেখিস |
কিন্তু শেষ শিক্ষা আছে বাকি | ক্লান্ত আজ স্বেচ্ছাচারী অজ্ঞান বৈশাখী একদিন উন্মাদ নৃত্যের তালে-তালে পঞ্জরে যে মুঞ্জরেছে, সংকীর্ণ কঙ্কালে করেছে সকাম | স্তব্ধ আজ রললোল ; বিলোল আকাশগঙ্গা ঝরে না ঝরে না আর নীহারিকা-স্বপ্নাকুল উত্সুক নিশীথে ; অন্ধকারে, চন্দ্রালোকে, সন্ধ্যায় নিভৃতে শরীরসীমান্ত বার-বার বিচূর্ণ হয় না আর উপপ্লাবী বাসনার বর্বর জোয়ারে | জরার জটীল রেখা শরীরেরে কঠিন পাথরে ঘেরে ; এ-দুর্গম দুর্গে বন্দী, অনাক্রমণীয়, নিশিন্ত আমার সত্তা ; অনর্গল, অক্লান্ত ইন্দ্রিয় এতদিনে রুদ্ধ হ’লো | অপরাহ্ন ছিন্ন-অঙ্গ মেঘে সবুজ হলুদ নীলে পশ্চিমে অন্তিম বাসর সাজালো | সূর্যাস্তের জাদুকর আলোর আয়না হাতে নিয়ে সন্ধ্যা নামে : ধকারে জলে শুধু ছায়ার, স্ম়ৃতির অফুরন্ত ভীড় | এ-শরীর অবলুপ্ত জান্তব যৌবনে হঠাৎ হারায় | কল্পনা বাড়ায় প্রেত-হাত দীর্ঘ ছায়া পার হ’য়ে অতীতেরে আনে সে ছিনায়ে | সেখানে এখন বিনষ্ট সংকল্প পূর্ণ, সার্থক ধিক্কৃত অনটন, স্বার্থ-কেন্দ্র-চ্যুত বিশ্ব ফিরেছে আদিম মহিমায় | জীবনের সমাপ্তিসীমায় শেষ শিক্ষা এ-ই ছিলো বাকি |
শিখেছি বৃদ্ধের বিদ্যা | হাস্যকর, নশ্বর, একাকী, ব’সে-ব’সে চেয়ে দেখি দাম্ভিক যুবক-দল চলে কলোচ্ছ্বাসে, আর দেখি তোরে, ওরে দেব-বিজয়িনী যৌবনগর্বিণী কন্যা, রে কন্যা আমার ! সহস্র নলের ছল ব্যর্থ হবে, ফিরে যাবে ইন্দ্র, যম, বৈশ্বানর ; দুঃখের কুটিল অরণ্য পুষ্পিত হবে চৈত্ররথ বনে তোর যৌবনরে ঘিরে | সেদিন আমার কাল-কলঙ্কিত, তুচ্ছ শরীরে তাকায়ে এ-কথা বিশ্বাস তোর কখনো হবে না--- সহস্র বসন্ত ছিলো আমার যৌবন, সহস্র চৈত্রের রাত্রি কাটায়েছি মুহূর্তের পরিপূর্ণতায় | কবে এলো হংসদূত, ক’য়ে গেলো প্রিয়তম নাম, স্বতঃশ্লথ নীবিবন্ধে আনন্দের ঢেউ তুলে— সেদিন কখনো ভুলে ওরে স্বয়ংবরা, তোর এ-কথা হবে না মনে--- যে-নারীর দেহ এই পৃথিবীতে তোর সিংহদ্বার এ-প্রণয় তারই উত্তরাধিকার, এ বিশ্ববিজয় তারই কাহিনীর পুনরভিনয় |
তাই তো বিনয় হৃতশক্তি বৃদ্ধের সম্বল | অপেক্ষার যে কলাকৌশল ধৈর্যের যে-চতুরালি ধনী যৌবনের ব্যঙ্গের বিষয়, দরিদ্র বার্ধক্য তাই দিয়ে জীবনের ব্যবসার প্রাক্-প্রালয়িক ভবিষ্যৎহীন দিনগুলি সযত্নে সাজায় | অবাস্তব, তুচ্ছ, অনর্থক, পরিত্যক্ত, বিবর্ণ পুতুল---- ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো, আর কয়েকটি হাড়--- এ-ই আমি, এ-ই আমি | তাই বলি বলি বার-বার, ‘অপেক্ষা শেখাও, শেখাও ধৈর্যের নীরবতা, এ-বিশ্বে ফিরায়ে দাও আদিম মহিমা | আমার ইচ্ছার চক্র থেকে মুক্ত করো সূর্য, চন্দ্র, সমুদ্র, পাহাড়, তারার জ্বলন্ত নৃত্য, পৃথিবীতে সবুজের খেলা, আকাশের সোনালি-নীলের মেলা ; মুক্ত করো জন্ম, মৃত্যু ; আমার প্রেমেরে--- প্রেমেরেও মুক্তি দাও ইচ্ছার শৃঙ্খল থেকে----‘
আজ তোরে দেখে, হে নবযৌবনা কন্যা , রে কন্যা আমার, আমার প্রেমের মুক্তি | দেখি চেয়ে-চেয়ে--- আজিও করাল কাল ঘুমন্ত যেখানে--- পূর্ণিমা-মুখশ্রী তোর, পার্থিব আমরা | তার জরা সূর্যের মৃত্যুর মতো নিশ্চিত, অথচ অসম্ভব মনে হয় ; মনে হয় কাল, তাও তুচ্ছ যেন, এ-বিশ্বের স্থবির ঘটনা, রূপান্তরহীন | লক্ষ রাত্রি, লক্ষ দিন কেটে যায়--- নাকি আসে ফিরে ফিরে মৃত্তিকার মূর্তি দিতে চিরন্তনী দময়ন্তীরে ?