নির্মম যৌবন কবি বুদ্ধদেব বসু বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া | “দময়ন্তী” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।
যৌবন করে না ক্ষমা | প্রতি অঙ্গে অঙ্গীকারে করে মনোরমা বিশ্বের নারীরে | অপরূপ উপহারে কখন সাজায় বোঝাও না যায় | তার সে-পসরা কিছুতেই যায় না গোপন করা | বারণ শোনে না, বিচার করে না কিছু, দূর ক’রে দেয় সব ভেদ, বিশ্বজয়ী এমন দুর্দান্ত সেনা এমন নির্মম সাম্যবাদী আর তো দেখিনে | আসে পথ চিনে প্রাসাদে কুটিরে মাঠে পল্লীর নিভৃতে শহরের কুৎসিত বস্তিতে | নিশ্চিত সে মৃত্যুর মতোই, রক্ষা নেই তার হাতে, অমৃতে অথই হবেই যে কোনো নারী-দেহ কোনো-একদিন | দয়া নেই, ক্ষমা নেই, জীবনের কিছুকাল --- নারী যে, সে রানীও হবেই | এমনকি পথে-পথে বেড়ায় যে ভিখারিনী মেয়ে আঁস্তাকুড়ে খাদ্যকণা খেয়ে, অতি জীর্ণ জঘন্য মলিন যার বাস তাকেও ছাড়ে না যৌবনের ক্ষমাহীন সেনা | তাকেও সুন্দর করে, তাকেও সাজায়, লজ্জা দেয়, ভঙ্গি দেয়, দেহ ভ’রে তোলে লাবণ্য-হিল্লোলে | বোঝে না যে এতই সে নিরুপায় দেহ যত শুষ্ক হবে, যত মৃতপ্রায় তত তার লাভ | এই আবির্ভাবে শুধু তার বিপদ বাড়াবে | উচ্ছিষ্টের কণা কুড়িয়ে পাওয়ায় যার জীবনসাধনা তারে কি মানায় যৌবনের উন্মীলন কানায়-কানায় | চায়নি সে, চায়নি সে, নিতান্তই ক্ষুন্নিবৃত্তি যার সবচেয়ে বড়ো কাম্য, এ যে তার অসহ্য জঞ্জাল, উপরন্তু বিড়ম্বনা | দেহে যার আবরণ নেই, শয্যা যার পথের ঘৃণিত আবর্জনা তার ‘পরে এ কী অত্যাচার ! পশুতে পাখিতে গাছে ঘাসে আনন্দিত পূর্ণতায় যৌবন বিকাশে, হিরণ্ময় পাত্রে ঝরে সুবর্ণ মদিরা | ওরাও যে সুন্দর আধার তাই তো ওদের আছে জন্ম-অধিকার যৌবনের জাদুকর রূপান্তরে | বিশ্ব ভ’রে চেয়ে দেখি সুন্দরের লীলা এর মধ্যে ক্লেদাক্ত মাটির ভাঁড় বিশ্বের কুৎসিত ক্ষত ঐ ভিখারিনী | যার কিছু নেই, তার যৌবনেও নেই অধিকার অতি সত্য এই কথা, তবু প্রতিদিন এর ঘটায় অন্যথা নির্মম নিয়তি | ভিখারিনী, সেও যে যুবতী এ বেসুর, এ নিষ্ঠুর অসংগতি কেমনে সহিছে বিশ্বপ্রকৃতির বীণা আমি তো বুঝি না |
পরি-মা’র পত্র --- রুমিকে কবি বুদ্ধদেব বসু কবি শ্যামলকান্তি দাশ সম্পাদিত “ছোটোদের আবৃত্তির ছড়া ও কবিতা” ২০০৮ থেকে নেওয়া |
. ও রুমি, ও রুমি, আমায় চিনবে নাকো তুমি, . আমি তোমার পরি-মা ; ঐ দূরের আকাশ থেকে রোজ যাই তোমারে দেখে . তুমি জানতে পারো না | . যখন ছিলে ছোটো পাছে হঠাৎ জেগে ওঠো . কাঁদো ঘুমের মধ্যে পাছে,. কেবল উড়ে উড়ে আমি যেতাম ঘুরে ঘুরে . তোমার কাছে-কাছে | এখন ছোটো তো আর নও, তোমার বয়স হল ছয়, . তুমি সাতে দিলে পা ; মাখো মায়ের মুখের ক্রিম, খাও বাবার সঙ্গে ডিম, . আধ আধ পেয়ালা চা ; . এখন যারা ছোটো মুখে কথা ফোটো-ফোটো . তাদের মতো কি . কন্নাকাটি আর . খুনসুটি আবদার . করবে তুমি ----ছি ! . বড়ো হতে হলে শুধু বড়ো হলেই চলে— . এ-কথা ঠিক নয় | . বড়ো যারা হবার এ তো জানা আছে সবার . তাদের ভালো হতেই হয় | . তাহলে হও রাজি তুমি বলবে না আর পাজি . রেগে, কেঁদে, খেলা ; আর গোল করবে না যখন গল্প লেখেন মা . কিংবা করেন সেলাই . খাবে নিজের হাতে শোবে একলা বিছানাতে . ছড়িয়ে হাত-পা, . স্নানের সময় মাকে . মিথ্যেমিথ্যি ডাকে . ব্যস্ত করবে না | . দিদির সঙ্গে আড়ি . ঝগড়া মারামারি . কিচ্ছু-না-করে, . দিদির আঙুলটাকে তার মুখের ভিতর থেকে . টেনে আনবে ধাঁ করে | . ভালো-ভালো খাতায় . আস্ত বইয়ের পাতায় . কেন আঁকবে হিজিবিজি | তোমার শীঘ্রি হবে শেখা দিদির সমান পড়া-লেখা . অঙ্ক আর ইংরিজি | . ও রুমি, ও রুমি, হবে কত্ত বড়ো তুমি . আজ ভাবতে পারো না ; আমি আছি তো সেই আশায় আমার দূর আকাশের বাসায় . ইতি তোমার পরি-মা |
রংমশালের সম্পাদকের চম্পাবরণ কন্যা ঘর করেছেন আলো, . সমস্ত তাঁর ভালো | দোষের মধ্যে একটি শুধু রাত্তিরে ঘুমোন না | রাত্তিরে ঘুমোন না ; . পূর্ণ চাঁদের তাড়ার মতো . প্রথম-ফোটা তারার মতো
সন্ধ্যা হ’লেই তন্দ্রাভাঙা চম্পাবরণ কন্যা | চম্পাবরণ কন্যা ; . চোখ দুটি তাঁর কালো . ঘর করেছেন আলো, দোষের মধ্যে সমস্ত রাত একটুও ঘুমোন না | একটুও ঘুমোন না ; . কাঁদেন এবং কাঁদান তিনি, . হাত-পা ধ’রে সাধান তিনি, রাত-জাগাদের রাজকুমারী হবেন তিনি কোন না | হবেন তিনি কোন না ; . ঘুমপাড়ানি বঙ্গে . ঘুমকাড়ানি সঙ্ঘে বক্তৃতাতে তর্কাঘাতে আপন নামে ধন্যা | নাম-না-হ’তেই ধন্যা, . যত ইচ্ছে শতছিদ্র . কোরো তুমি মূঢ়নিদ্র ভবিষ্যতের বঙ্গভূমে লক্ষ্মী তো, এখন না | লক্ষ্মী তো, এখন না ! . সম্পাদকের মুখ খসালে . কেমন করে রংমশালে পদ্য বেঁধে তোমার পায়ে, বলো তো, দিই ধন্যা !
আমি ছোট ছেলে, চুপ করে চেয়ে থাকি, তোকে দেখে-দেখে রঙে ভরে যায় আঁখি |
মোর চোখ, সে কি তার মতো সুন্দর ? মোর চোখ, সে তো তোরি মতো চঞ্চল | চোখ যেতে চাই অনেক, অনেক দূরে হালকা হাওয়ায় নতুন আকাশে উড়ে, হালকা পাখায় মেঘে-মেঘে ঘুরে-ঘুরে |
কোথায় সে দেশ, জানিনে তাহার নাম, কত সে দূরের ? কেমন সে নিঃঝাম ?