বুদ্ধদেব বসুর কবিতা
*
ম্যাল-এ       
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া | “দময়ন্তী” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

‘আপনারা কবে ? আমরা এসেছি সাতাশে |
ওকভিলে আছি | আসবেন একদিন |’---                
শাড়ির বাঁধনে শোভে শরীরের ইশারা,
ঠোঁটের গালের রঙের চমকে কী সাড়া !
কী করুণ, আহা, অতরূণ তনু সাজানো !
সবি বুঝলুম | ইচ্ছে হ’লে যে বাংলাও পারে বলতে
তাও বুঝলুম |        মহৎ যত্নে অ্যাকসেন্টগুলো মাজানো
ব্যর্থ হবে কি তাই ব’লে, বলো!
.         নিখুঁত বাংলা ফোটে ফিরঙ্গ রঙ্গে,
.         ইংরেজি সুরে তির্যক গতিভঙ্গে |
.     আমরা চমকে থমকে দাঁড়াই, হয়তো বা কারো জুতোই মাড়াই,
.     বাংলা শুনেই সার্থক শ্রম চৌরাস্তায় সন্ধেবেলায় হাঁটলে |
ভাবি শুধু এই, অমনি সুরেই বেরোবে কি বুলি হঠাৎ চিমটি কাটলে ?


.                                ২

.           আজকে না-হয় ম্যালেই চলো |
.            ভারি সুন্দর বিকেল ---- না ?
.           মিমির জন্যে কী-খেলনা
.           কিনবে ? দোকানে গেলেই হ’লো |
.            তোমার নতুন কী চাই, বলো ?
.            কিচ্ছু চাইনে ?  এমন মিথ্যে
.           কী ক’রে বললে ?  কপট অঙ্ক
.            রটায় আমার কত কলঙ্ক,        
.            তুমিও কি তাই শুনে ঘাবড়ালে ?
.           গণিকা-গণিত লক্ষপতিকে  
.             খোশামোদ করে, পেয়ে বেগতিকে
.            আমাকে নিত্য করে নাজেহাল ;
.             কখনো একটু পিঠ চাপড়ালে
.            খুশি হয় মন, পানি পায় হাল-----
এছাড়া আমার, বিশ্বাস করো, আর কোনো দোষ নেই চরিত্রে |


                                ৩

আজো কি মানবে গণিতের কড়া জুলুম
জাদুকর রোদে এমন বিরল বিকেলবেলায় ?        
.             হীন অঙ্কের মেনে দাসত্ব
.             হারাবো কি শেষে জীবনস্বত্ব ?                
বেঁচে থাকবার এই কি শর্ত  ? তুমিই বলে !        
সিঁদুরে শাড়িটা প’রে নাও তাড়াতাড়ি |        ম্যালেই চলো |
মলিন হিশেব ঋণের কুঁজও আজকে মিলায়
তুষার-তাঁবুর-দড়ি-ছেঁড়া তিব্বতি এ-হাওায়ায়.
ভোলো প্রতিদিন-পুঞ্জিত ঋণ, ভোলো বেমালুম
জোড়াতালি-দেয়া ছেঁড়াখোঁড়া দিন |      পাল ভালো,
খালি পড়ে আছে আস্ত বেঞ্চি |
.                        ভোলো, ভয় ভোলো |        
যে-ভয় জীবনে ফণিমনসার বন,
যে-ভয়ে নিত্য মেনে চলি মহাজন,
যে-ভয়ে কখনো গান্ধীর কভু অরবিন্দের চরণ-শরণ,
ত্যাগের কম্বা যোগের পন্থা মানস-বরণ,
দিশি সিনেমায় ঋষি-মহিমায় ইচ্ছাপূরণ,
সত্য, শিব ও সুন্ধরে ঢাকি জীর্ণ জীবন, জীবনে-মরণ,
যে-ভয়ে নিত্য ব্যর্থ কর্ম, মিথ্যাচরণ,
কেননা জীবন কেবলি জীবনধারণ,
.                   জীবিকাই, হায় জীবন |         আজ
.                             সে-ভয় ভোলো         |        
দ্যাখো চেয়ে দ্যাখো পায়ের তলায় মেঘের মেলায় আলো মিলায়,
উত্তর-জোড়া তুষার-চূড়ায় খেয়ালি বিকেল আগুন ছড়ায়,
ক্ষণিক রঙের বণিক সূর্য নিবলো এবার | হারালো তুষার-মোড়া উত্তর,
হারালো আকাশ হঠাৎ কুয়াশা লেগে, বারুদগন্ধী মেঘে |
.              ছায়ামুড়ি দিয়ে ছায়ামূর্তির মতো
.               জটিল জনতা প্রগল্ ভ গতিশীল,
.               স্বৈরী মেঘের পূর্ণ স্বরাজ
.               দেখেই কি ওরা এমনম দরাজ,
.               স্বেচ্ছাচারের উচ্চচূড়ার জঙ্গমতা
.               বঙ্গমাতার সন্তানেরাও আজ কি পেলো ?
.           মেঘ-মুড়ি দিয়ে জ্বললো আলো,
.           ল্যামপোস্টগুলো পরেছে আলোর গোল টুপি,
.           ঠিক খৃষ্টান দেবদূত !
.           এসো, কাছে এসো, শোনো কথা চুপি-চুপি,
.           এ কি নয় অদ্ভুত
.          তুমি আর আমি বসে আছি এই কুয়াশা-মোড়া
.           চৌরাস্তায়, মেঘের মধ্যে,
.           সব বেয়াদব চোখ মুছে গেছে এ-ঘন মেঘে,
.           এবার বলো !
.           এখনি হয়তো হঠাৎ হাওয়ার আঘাত লেগে
.           মেঘ কেটে যাবে  কেটে যাবে এই গণিত-অতীত বিরল ক্ষণ |
.          এখনি বলো |                 ঐ তো এলো
.           নিষ্ঠুর হাওয়া মেঘের কাঁটা, কুয়াশা-কাটা !
.           আকাশ ফেটে কি ফুটলো তারা ? লাগলো হাওয়ার তীব্র তাড়া ?
.           এবার তাহলে ফিরেই চলো |  আজ কি হ’লো
.           তোমার আমার অনেকদিনের অঙ্গীকারের উদ্ যাপন ?

.                                       *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
নির্মম যৌবন
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া | “দময়ন্তী” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


যৌবন করে না ক্ষমা |
প্রতি অঙ্গে অঙ্গীকারে করে মনোরমা
বিশ্বের নারীরে | অপরূপ উপহারে কখন সাজায়
বোঝাও না যায় |
তার সে-পসরা
কিছুতেই যায় না গোপন করা |
বারণ শোনে না,
বিচার করে না কিছু, দূর ক’রে দেয় সব ভেদ,
বিশ্বজয়ী এমন দুর্দান্ত সেনা
এমন নির্মম সাম্যবাদী
আর তো দেখিনে |
আসে পথ চিনে
প্রাসাদে কুটিরে মাঠে পল্লীর নিভৃতে
শহরের কুৎসিত বস্তিতে |
নিশ্চিত সে মৃত্যুর মতোই,
রক্ষা নেই তার হাতে, অমৃতে অথই
হবেই যে কোনো নারী-দেহ
কোনো-একদিন | দয়া নেই, ক্ষমা নেই,
জীবনের কিছুকাল --- নারী যে, সে রানীও হবেই |
এমনকি পথে-পথে বেড়ায় যে ভিখারিনী মেয়ে
আঁস্তাকুড়ে খাদ্যকণা খেয়ে,
অতি জীর্ণ জঘন্য মলিন যার বাস
তাকেও ছাড়ে না
যৌবনের ক্ষমাহীন সেনা |
তাকেও সুন্দর করে, তাকেও সাজায়,
লজ্জা দেয়, ভঙ্গি দেয়, দেহ ভ’রে তোলে
লাবণ্য-হিল্লোলে |
বোঝে না যে এতই সে নিরুপায়
দেহ যত শুষ্ক হবে, যত মৃতপ্রায়
তত তার লাভ |
এই আবির্ভাবে
শুধু তার বিপদ বাড়াবে |
উচ্ছিষ্টের কণা
কুড়িয়ে পাওয়ায় যার জীবনসাধনা
তারে কি মানায়
যৌবনের উন্মীলন কানায়-কানায় |
চায়নি সে, চায়নি সে, নিতান্তই ক্ষুন্নিবৃত্তি যার
সবচেয়ে বড়ো কাম্য, এ যে তার অসহ্য জঞ্জাল,
উপরন্তু বিড়ম্বনা |
দেহে যার আবরণ নেই, শয্যা যার পথের ঘৃণিত আবর্জনা
তার ‘পরে এ কী অত্যাচার !
পশুতে পাখিতে গাছে ঘাসে
আনন্দিত পূর্ণতায় যৌবন বিকাশে,
হিরণ্ময় পাত্রে ঝরে সুবর্ণ মদিরা |
ওরাও যে সুন্দর আধার
তাই তো ওদের আছে জন্ম-অধিকার
যৌবনের জাদুকর রূপান্তরে |
বিশ্ব ভ’রে চেয়ে দেখি সুন্দরের লীলা
এর মধ্যে ক্লেদাক্ত মাটির ভাঁড়
বিশ্বের কুৎসিত ক্ষত ঐ ভিখারিনী |
যার কিছু নেই, তার যৌবনেও নেই অধিকার
অতি সত্য এই কথা,
তবু প্রতিদিন এর ঘটায় অন্যথা
নির্মম নিয়তি |
ভিখারিনী, সেও যে যুবতী
এ বেসুর, এ নিষ্ঠুর অসংগতি
কেমনে সহিছে বিশ্বপ্রকৃতির বীণা
আমি তো বুঝি না |

.          *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
পৌষপূর্ণিমা
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া | “দ্রৌপদীর শাড়ি” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


কিশোর-ঈষৎ-শীত কোনো রাত্রে যদি-বা দৈবাৎ
সচ্ছল শরৎ সাজে, আশ্বিনের ইচ্ছারে যদি-বা
পূর্ণ করে অপুষ্পক অঘ্রাণের প্রচ্ছন্ন প্রতিভা

রাশি-রাশি সেই ফুলে, যে-ফুলে কখনো কোনো হাত
আনেনি স্পর্শের জরা ; যার স্পর্শ, যত বাড়ে রাত,
তত নামে নারী হ’য়ে, রক্তমাংসহীন, অপার্থিবা,

অসীমচুম্বনী, তবু চুম্বনের অতীত, অতীবা ;---
যে-গাছের সেই ফুল, তার নীল উল্লাস হঠাৎ
আকাশের শিরা দেয় ভ’রে :  --- তাতে কী ? কেউ কি দ্যাখে ?

--- বালিগঞ্জে বাড়ির গম্ভীর ভিড় যদি কোনো ফাঁকে
মেলে দেয় একটু সবুজ, ইলেকট্রিক আলো জ্বেলে
অচন্দ্রচেতন যুবা ঘন্টা দুই ব্যাডমিন্টন খেলে,

রক্তমাংস তৃপ্তি খোঁজে খাদ্যে, তাপে, ব্যায়ামে, আরামে,
সর্বশেষে ঘুমের ঘনিষ্ঠ কোলে ;  একই নিদ্রা নামে
বস্তির ফুর্তিতে আর প্রাসাদের মর্মর বিষাদে :

আকাশে অসীম চাঁদ কলকাতায় শুধু বাদ সাধে
কুখ্যাত পাখির ঘুমে, কর্কশ চীত্কারে দিয়ে ডাক
ফুটপাতের গাছের বিছানা ছেড়ে উড়ে যায়, নীড়

খোঁজে মেঘের নরম মোমে, ব্যর্থ হ’য়ে তীক্ষ্ণ শাঁখ
বাজায়ে নিখাদ কন্ঠে ---- উতরোল, উদ্ ভ্রান্ত, অস্থির,

চাঁদেরে বন্দনা করে শুধু কাক--- শুধু কাক --- কাক |

.                                *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
অন্য প্রভু
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া | “দ্রৌপদীর শাড়ি” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

রাজত্ব দিয়েছো, প্রভু, সকলেরে : শুধু নয় বাংলার জঙ্গলে
আগুন-রঙের বাঘ, আল্পসের কল্পনা-কৈলাসে
দারুণ ঈগল, বারুণী বরফে তপ্ত তিমি, শুধু
দীপ্ত দৃপ্ত দুর্জয়েরে নয়, দিয়েছো সবারে স্বত্ব
সহজাত রাজত্বের : ঘোলা-জল ধোবার ডোবায়
গলা-ডোবা কালো মোষ ভাদ্রের রোদ্দুরে, গলা-ফোলা, গলা-খোলা ব্যাং
বৃষ্টিশেষ বিকেলের হলুদ রোদ্দুরে, মেঘলা দুপুরে
আকাশে একলা কাক, কার্তিকের রাত্তিরের পোকা, মারীমত্ত মাছি,
রাক্ষস টিকটিকি : ---- সকলেরে রাজত্ব দিয়েছো, প্রভু, সকলেরই
প্রভুত্ব নিয়েছো মেনে | --- এ-স্বারাজ্য-সাম্রাজ্যে শুধু কি
বঞ্চিত শুধু কি আমি ? ---- আমি কবি !  শুধু আমি
রাজ্যচ্যূত ---- নির্বাসিত ?  ---- অন্ন, শুধু প্রত্যহের অন্ন দিয়ে
আমার রাজত্ব নিলে কেড়ে ? শুধু আমি প্রতি মুহূর্তের
অস্তিত্বের অস্বস্তির দাস ? --- সত্যি তা-ই ? --- না কি আমি, কবি-আমি,
কোলের কুকুর কিংবা জুয়োর ঘোড়ার মতো, সব,
সব স্বত্ব হারায়েছি অন্য, হীন প্রভু মেনে নিয়ে !

.                                *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
রবীন্দ্রনাথ
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া | “যে-আঁধার আলোর অধিক”
কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

ছিলো না বনের মৃগ, ঘাস, ফুল মেঘের গহ্বরে
রঙিন আলোর খেলা | এমনকি, বালক ছিলে না |
তীক্ষ্ণ চোখ ঘিরে ছিলো সারাদিন | হাতের খেলেনা
ভারি হ’য়ে প’ড়ে গেছে হাত থেকে | তবু ছিলে অবসরে ভ’রে |

তুমিও পাওনি দেখা নাপোলিতে নীলনয়নার |
চিঠির উত্তর নেই | দেহ ছিলো, আমাদেরই মতো |
হয়তো ঘামাচি, মশা | প্রতিকূল বাতাসে প্রহত
ভূলুন্ঠিত ঘুড়ির আঁধার ঘন্টা | তবু ছিলে প্রতিযোগিতার

পরপারে, বিশ্রামে শুভ্রতাময়, যেন তুমি কখনো করোনি
চেষ্টা, কিংবা যেন কলস গিয়েছে ভেসে, তুমি শুধু জল |
যা পেয়েছি দু-দণ্ড তোমার কাছে, নিঃশব্দে, কেবল

সন্ধ্যার নিবিড়তায় ব’সে থেকে, আজ তাকে নির্ঘুম  যামিনী
জ্বেলে দেয় কূট গ্রন্থে, ভাবনার পাণ্ডুর অনলে,
বাক্, অর্থ, সম্পর্কের হিংসুক দাঙ্গা শেষ হ’লে |

.                                *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
গ্যেটের অষ্টম প্রণয়
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া | “যে-আঁধার আলোর অধিক”
কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

বর্তমানে কাব্যে আমি রাজা,
গদ্য লেখায় আমার নেই জুড়ি |
কুঞ্জবনে মরণ বটে তাজা,
কিন্তু আরেক রক্তরঙা কুঁড়ি

দুলিয়ে দেয় স্বনিত স্বপ্নেরা
হিমের ক্ষীণ বৃন্তে টলোমলো |---
দেশান্তরে, লবণ-জলে ঘেরা,
গোলাপ, তুমি কোন বাগানে জ্বলো ?

কোন দ্রাঘিমায় উদ্ভাসিত নীলে
বাঘের মতো নিদাঘে ডাক দিলে,
তুলতে কি চায় তারই প্রতিধ্বনি

পাতার লালে মাতাল নিঃস্বেরা !
আকাশ ভেঙে আগুন ফোটে ঊষার,
ছদ্মবেশে ব্যর্থ করে তুষার |

-----হাতেম, হায়. কবির শিরোমণি,
পদ্য লেখায় সবার চেয়ে সেরা !

.                   *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
পরি-মা’র পত্র --- রুমিকে
কবি বুদ্ধদেব বসু
কবি শ্যামলকান্তি দাশ সম্পাদিত “ছোটোদের আবৃত্তির ছড়া ও কবিতা”  ২০০৮ থেকে
নেওয়া |


.                ও রুমি, ও রুমি,
আমায়                 চিনবে নাকো তুমি,
.                        আমি তোমার পরি-মা ;
ঐ                 দূরের আকাশ থেকে
রোজ                যাই তোমারে দেখে
.                        তুমি জানতে পারো না |
.                যখন ছিলে ছোটো
পাছে                হঠাৎ জেগে ওঠো
.                        কাঁদো ঘুমের মধ্যে পাছে,.                
              কেবল উড়ে উড়ে
আমি                যেতাম ঘুরে ঘুরে
.                        তোমার কাছে-কাছে |
এখন                 ছোটো তো আর নও,
তোমার         বয়স হল ছয়,
.                        তুমি সাতে দিলে পা ;
মাখো                 মায়ের মুখের ক্রিম,
খাও                 বাবার সঙ্গে ডিম,
.                        আধ আধ পেয়ালা চা ;
.                এখন যারা ছোটো
মুখে                 কথা ফোটো-ফোটো
.                        তাদের মতো কি
.                কন্নাকাটি আর
.                খুনসুটি আবদার
.                        করবে তুমি ----ছি !
.                বড়ো হতে হলে
শুধু                বড়ো হলেই চলে—
.                        এ-কথা ঠিক নয় |
.                বড়ো যারা হবার
এ তো                 জানা আছে সবার
.                        তাদের ভালো হতেই হয় |
.                তাহলে হও রাজি
তুমি                 বলবে না আর পাজি
.                        রেগে, কেঁদে, খেলা ;
আর                 গোল করবে না
যখন                 গল্প লেখেন মা
.                        কিংবা করেন সেলাই
.                খাবে নিজের হাতে
শোবে                 একলা বিছানাতে
.                        ছড়িয়ে হাত-পা,
.                স্নানের সময় মাকে
.                মিথ্যেমিথ্যি ডাকে
.                        ব্যস্ত করবে না |
.                দিদির সঙ্গে আড়ি
.                ঝগড়া মারামারি
.                        কিচ্ছু-না-করে,
.                দিদির আঙুলটাকে
তার                মুখের ভিতর থেকে
.                        টেনে আনবে ধাঁ করে |
.                ভালো-ভালো খাতায়
.                আস্ত বইয়ের পাতায়
.                        কেন আঁকবে হিজিবিজি |
তোমার         শীঘ্রি হবে শেখা
দিদির                 সমান পড়া-লেখা
.                        অঙ্ক আর ইংরিজি |
.                ও রুমি, ও রুমি,
হবে                 কত্ত বড়ো তুমি
.                        আজ ভাবতে পারো না ;
আমি                আছি তো সেই আশায়
আমার                 দূর আকাশের বাসায়
.                        ইতি তোমার পরি-মা |

.                   *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
চম্পাবরন কন্যা
কবি বুদ্ধদেব বসু
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকবি সরল দে  সম্পাদিত “ছোটোদের ৫০০ কবিতা”, ২০০৬
থেকে নেওয়া |


রংমশালের সম্পাদকের চম্পাবরণ কন্যা
ঘর করেছেন আলো,
.        সমস্ত তাঁর ভালো |
দোষের মধ্যে একটি শুধু রাত্তিরে ঘুমোন না |
রাত্তিরে ঘুমোন না ;
.        পূর্ণ চাঁদের তাড়ার মতো
.        প্রথম-ফোটা তারার মতো

সন্ধ্যা হ’লেই তন্দ্রাভাঙা চম্পাবরণ কন্যা |
চম্পাবরণ কন্যা ;
.        চোখ দুটি তাঁর কালো
.        ঘর করেছেন আলো,
দোষের মধ্যে সমস্ত রাত একটুও ঘুমোন না |
একটুও ঘুমোন না ;
.        কাঁদেন এবং কাঁদান তিনি,
.        হাত-পা ধ’রে সাধান তিনি,
রাত-জাগাদের রাজকুমারী হবেন তিনি কোন না |
হবেন তিনি কোন না ;
.        ঘুমপাড়ানি বঙ্গে
.        ঘুমকাড়ানি সঙ্ঘে
বক্তৃতাতে তর্কাঘাতে আপন নামে ধন্যা |
নাম-না-হ’তেই ধন্যা,
.        যত ইচ্ছে শতছিদ্র
.        কোরো তুমি মূঢ়নিদ্র
ভবিষ্যতের বঙ্গভূমে লক্ষ্মী তো, এখন না |
লক্ষ্মী তো, এখন না !
.        সম্পাদকের মুখ খসালে
.        কেমন করে রংমশালে
পদ্য বেঁধে তোমার পায়ে, বলো তো, দিই ধন্যা !

.                   *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
প্রজাপতি
কবি বুদ্ধদেব বসু
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকবি সরল দে  সম্পাদিত “ছোটোদের ৫০০ কবিতা”  ২০০৬
থেকে নেওয়া |


প্রজাপতি, তুই কেন এত চঞ্চল ?
প্রজাপতি, তুই কেন এত সুন্দর ?
রোদে ঝলোমলো তোর দুটি ছোট পাখা
রামধনু-ভাঙা রঙের গুঁড়োয় মাখা,
রামধনু-রাঙা আলোর ঝলকে আঁকা |

আমি ছোট ছেলে, চুপ করে চেয়ে থাকি,
তোকে দেখে-দেখে রঙে ভরে যায় আঁখি |

মোর চোখ, সে কি তার মতো সুন্দর ?
মোর চোখ, সে তো তোরি মতো চঞ্চল |
চোখ যেতে চাই অনেক, অনেক দূরে
হালকা হাওয়ায় নতুন আকাশে উড়ে,
হালকা পাখায় মেঘে-মেঘে ঘুরে-ঘুরে |

কোথায় সে দেশ, জানিনে তাহার নাম,
কত সে দূরের ? কেমন সে নিঃঝাম ?

প্রজাপতি, তুই মোর চেয়ে সুন্দর |
প্রজাপতি, তুই মোর মতো চঞ্চল ?

পাখা কাঁপে তোর উছল আলোর নাচে,
তবু কেন তুই এত কাছে ? এত কাছে ?
দেখে আসবি না, আকাশ-পারে কী আছে ?

আমার কেবল চেয়ে থাকা আর চাওয়া |
আমি ছোটো ছেলে, বারণ বাইরে যাওয়া |

.                   *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
রামধনু
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া। “বারোমাসের ছড়া” কাব্যগ্রন্থের
কবিতা।


‘বীরু, বুলু, রবি সব ছুটে আয়---
.             তিনু, মিলি আর মনু,
চাস যদি তোরা দেখতে একটা
.             সাতরঙা রামধনু !
বাবা-মা এসো গো, বামা-ঝি, রামজী,
.             এসো ছোড়দাদা, নদি---
আকাশ-জোড়া এ-রামধনু চাও
.             দেখতে যদি |’

ছোট্ট কমল, দুষ্টু কমল
.             ভুলে গিয়ে বল খেলা,
চীত্কার ক’রে ডাকলো সবায়
.              সেদিন বিকেলবেলা |
বৃষ্টির পরে ঝিলিমিলি রোদ
.             ঝিকিমিকি রামধনু ;
ছুটে এলো রবি, বীরু আর বুলু,
.             মিলি আর তিনু, মনু |

ছোট্ট পায়ের শব্দে, পাখির
.             কিচিরমিচির চূপ |
হালকা হাতের হাততালি শুনে
.             গাছগুলি খুশি খুব |
মিষ্টি কথার ঢিল খেয়ে-খেয়ে
.             ফুলপাতা টলমল---
ছোট্ট কমল, দুষ্টু কমল,
.             মিষ্টি কমল !

মিষ্টি সবাই, দুষ্টু সবাই
.             ছোট্ট সবাই---
ঠিকরে কোথায় ছুটে ছিটকায়,
.             নেই ঠিক-ঠিকানাই |
বুলু, বীরু, রবি চোখ তুলে চায়,
.              মিলি, তিনু আর মনু---
লাফায়, চ্যাঁচায়, চোখ তুলে চায়,
চোখ তুলে দেখে আকাশের গায়
.               ঝলমল রামধনু |

মা-বাবা তখন চায়ের টেবিলে,
.               বামা-ঝি সাজছে পান,
রামজী হেঁশেলে মশলা পিষছে,
.                ছোড়দা করছে স্নান |
ছোটো আরশিতে চুলের খোঁপাটা
.               দেখছে ন’দি ;----
‘শিগগির ছুটে এসো, রামধনু
.               দেখবে যদি |’
হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো কমল,
.                বীরু, বুলু, মিলি, মনু---
আকাশের গায় এক মিনিটের
.                 সাতরঙা রামধনু |

পেয়ালা ফুরুলে মা-বাবা এলেন ;
.                ন’দি, খোঁপা ঠিক ক’রে ;
ছোড়দাও এলো--- গন্ধ-রুমাল
.                 পকেটে ভ’রে |
বামা-ঝি এলো না----সাজছে সে পান
.                একলা ব’সে,
রামজী এলো না ----রাতে রান্নার
.                 মশলা পিষছে ক’ষে |

বাবা-মা বলেন,  ‘কোথায় ? কোথায় ?’
.                 ন’দি এসে বলে, ‘কই ?
ছোড়দা বলছে,  ‘কিছু তো দেখিনে
.                 আকাশে আকাশ বই |’
ওরা সাতজনে উল্টিয়ে পড়ে,
.                 হেসে না বাঁচে |
‘আমরা দেখেছি, আমরা দেখেছি,
.                  তোমরা জব্দ হ’লে !
দুষ্টু কমল নাচে আর হাসে
.                   এ-কথা ব’লে |
বীরু, বুলু, রবি নাচে আর হাসে,
.                   তিনু, মিলি আর মনু---
‘আমরা দেখেছি --- আমরা দেখেছি
.                   ঝলমল রামধনু !’

.                   *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর